‘ওরা হিংসাভূমি নির্মাণের প্রথম পদক্ষেপে আমাদের সরল বিশ্বাসগুলো ধংস করে তারপর সেই শূন্যস্থানে ওরা দিলের ভুখ মেটাতে অন্ধবিশ্বাসের রোপণ করে।’ গগনে চাঁদ ওঠার কালে মহালগনের অন্ধকার আঁকলেন লাবনী জঙ্গী।
অনেক বছর আগে, গঞ্জের আর পাঁচটা কিশোরীর মতো একজনের কথা। তার সময়ে এখনকার মতো তথ্য এমন বিপুলভাবে সেকেন্ডের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ত না। খবরের, তথ্যের জন্য অপেক্ষা করতে হত… সেই অপেক্ষাগুলোর মধ্যে কত কল্পনা মিশে যেত; তারপর যে তথ্য তা কেবল তথ্য মাত্র নয়, তার সাথে মিশে থাকত একটা আস্ত কল্পনা বিশ্ব।
সেই কিশোরীর মহাবিশ্ব নিয়ে একটা আজব কল্পনার জগৎ ছিল; হবে নাই বা কেন? তখন তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা জারুল গাছের নীচে, দিঘির পাড়ে বসে আসমান দেখার সময় ছিল তাদের। তার মা একবার খোলা উঠুনের পুব দিকে সন্ধেবেলা একটা টর্চ লাইটের মতো আলো আকাশে উঠত তারপর মিলিয়ে যেত, তা দেখিয়ে বলেছিল, ‘ঐ যে আসমানে ধূমকেতু দেখি যা বুড়ি।’ অথবা তাঁদের বিদ্যুৎহীন ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে যেদিন উল্কাবৃষ্টি হবে, খবর এসেছিল। মেয়েটি কল্পনা করেছিল একটা তারা উল্কা হয়ে মাটিতে পড়লে যে পাথর টুকরো, সেটা যদি মিলে যায়; তাহলে…উফ কী যে হবে!
উল্কাপাতের সে রাতের শেষে ভোর থেকেই ভেঙে পড়া তারা টুকরো, ঠান্ডা পাথর টানা কত দিন আঁতিপাঁতি করে রাস্তাঘাটে খুঁজেছে সেই কিশোরী; যেকোনো পাথর একটু অন্যরকম দেখলেই সে টুক করে তুলে আনত; একটা টিনের বাক্স ভরে গেল সে সব তুচ্ছ শীতল পাথরে। অনেক বছর পড়ে সাধারণ খুব সাধারণ কুচো পাথরগুলো বেশ ভালো একটা কাজে লেগেছিল। ঐ খুব সাধারণ পাথরগুলো সরিয়ে ঐ টিনের বাক্সে পুরে রেখেছিল একটা বিশেষ রাতের স্মৃতি। যে স্মৃতিতে আছে ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে গ্রামের সকলে রাস্তায় নেমে আকাশের পানে চেয়ে সারাটা রাত হেঁটে বেড়ানোর দৃশ্য যেন এক রোজকেয়ামতের রাত। কিশোরীর বাপ আরও আপ্লুত হয়ে তার দুই ছানাকে নিয়ে পড়শিদের ছাদে বাসের মই বেয়ে উঠে পড়েছিল। পড়শিদের সাথে মিলে সারারাত ঘনকালো আকাশের বুক থেকে তারা খসে পড়ার সে রাতের স্মৃতিটুকুই যেন এই রিক্ত সময়ের বুকে তার বড্ড অলৌকিক ও রোমাঞ্চের মনে হয় ।
একটা বই ছিল, প্রগতি না রাদুগার কে জানে; ওটা পড়ে কিশোরীর ঐ মহাবিশ্ব আরও নতুন হয়ে উঠত। সে জানে যা কিছু পড়ে আর যেভাবে অনুভব করে তার মধ্যে একটা বিস্তর ফারাক তো থেকেই যায়, তবুও। সন্ধে থেকে একটা মজার খেলা ছিল সন্ধেতারাটা কী করে শুকতারাতে বদলে যায়; তারপর কোন কোন মাসে তারাগুলো আকাশে নানা আঁকিবুকি করে আকাশটা জমজমাট করে তোলে। একটা চাঁদ আছে কিশোরীর আম্মাজান সেই শৈশব থেকেই চাঁদজান বলে হাঁক দিত; টুকি দিয়ে যাওয়ার জন্য। সেই চাঁদ কী অসম্ভব আপন হয়ে যায় একটু বয়স বাড়ার সাথে সাথে। একটা রহস্যময় বড় আলো, মাঝে মাঝে আধ ফালি হয়ে মিশে যায়; কৃষ্ণপক্ষ শুক্লপক্ষ কত নামে। তারপর কিশোরী জানতে পারে এই চাঁদের নিয়মে আরেকটি বর্ষপঞ্জির কথা। এই চাঁদের ক্যালেন্ডার ধরে আসে তাঁদের ধর্মের উৎসবগুলো। এই চাঁদ ক্রমেই আরও রহস্যময় হয়ে উঠতে থাকে।
সেই কিশোরী গঞ্জে আসা এক সাপ্তাহিক পত্রিকাতে মুখ ডুবিয়ে পড়েছে; এক রক্ত-চাঁদের কথা-অকথা। আগামী তিনদিনে পৃথিবীর বুকে যে ব্লাডমুন দেখা যাবে। সেবার সে পত্রিকাতে লেখা ছিল ঐ সময়ে যেন চাঁদের দিকে বেশি তাকিয়ে থাকা ঠিক হবে না; ঐ রক্ত-চাঁদ মানুষের মধ্যে পৈশাচিক খিদে তৈরি করতে পারে।’ অথবা পৃথিবীর বুকে যেদিন রক্ত-চাঁদ উঠবে সেদিন হয়তো এই পৃথিবীতে আরও কোন অলৌকিক ঘটনা বা অঘটন ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিশোরীর গায়ে কাঁটা দেয়; রোমাঞ্চিত সে এগুলো পড়ে। সে আধা বিশ্বাস করে কারণ সে চাঁদের প্রভাবে জোয়ার ভাঁটার কথা জানে, কিন্তু বইয়ের বিজ্ঞানটা ঠিক মতো না বুঝেই সে এই চাঁদের অলৌকিক ক্ষমতাতে বিশ্বাস করতে চায়। চাঁদ ঘিরে নানা অলৌকিক রহস্য যেনও তার কাছে দিলের খিদের মতো। মগজে মুখস্থ রাখে এটি একটি পৃথিবীর উপগ্রহ, পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব, ব্যাস, আয়তন ইত্যাদি। সে মুখস্থ রাখে চন্দ্রকলা, আবর্তন, বেড়িকেন্দ্র। সে সোভিয়েতের চন্দ্রযান লুনার অসংখ্য প্রচেষ্টার কথা পড়ে, সে অ্যাপেলো ১১-র কথা পড়ে; সে নীল আমস্ট্রং, অল্ড্রিনের কঠিন নাম হ্যারিকেনের আলোতে মাথা দুলিয়ে মুখস্থ করে। এর অনেক বছর পর একদিন হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটিতে সে আকস্মিক একটা ভুয়ো গল্প পড়েছিল নীল আর্মস্ট্রং, বাজ অল্ড্রিনের চন্দ্রযান নাকি মিথ্যে বানানো ছিল। তারও পরে নিজের দেশের চন্দ্রযান নিয়ে ঐ হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটিতে যা যা মিলেছে একটু একটু করে কিশোরীর সেই কল্পনার অলৌকিক জগতটা ধসে গেছে। আর বিজ্ঞান বাস্তবতার কথা তো ছেড়ে দিয়েছে… এই মুহূর্তে যে দেশে আমরা বাঁচি সেখানে বাস্তব ও বিজ্ঞানকে ভুলিয়ে দেওয়াটাই মূল ট্রেন্ডের অংশ।
এইসবের মাঝে গত কয়েকদিন যাবৎ আসমানের দিকে চেয়ে চাঁদটার সাথে আবার সে মেয়েটির সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে। মিথ্যেতে মোড়া এই হিংসাভূমিতে এই চাঁদটা দেখতে ভুলে গিয়েছিল কিশোরী একটু একটু করে। আর ধসে গিয়েছিল সেই মেয়েটির আসমানি রোমাঞ্চের কতকথা। চারিপাশে অন্ধবিশ্বাসের ছয়লাপ। মেয়েটি পিছনে ফিরে তাকালে দেখতে পায়; তার মায়ের তার দাদির আসমান আর চাঁদের গল্পগুলো অলৌকিক বিশ্বাসে মোড়া ছিল; কিছু সহজ বিশ্বাস ছিল কিন্তু অপার অন্ধবিশ্বাস ছিল না। সে এখন ফারাক করতে পারে অলৌকিক বিশ্বাস আর অন্ধবিশ্বাসের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম সুতোর তফাত। সে জানে অলৌকিক বিশ্বাসগুলো খুবই দিলের খোরাক খুবই নিজস্ব। কিন্তু অন্ধবিশ্বাস সময় আর সুযোগ মিললেই কি মারণাস্ত্র হয়ে উঠতে পারে?
এই মুহূর্তে রাত ঘন হচ্ছে; উল্কাপাতের কোনও সম্ভাবনা নেই; হয়তো সেবারে রক্ত-চাঁদের দিকে তাকানোর ফলে পড়শিদের মধ্যে, সেই মেয়ের মধ্যে একটু একটু করে পৈশাচিক খিদে বেড়েছে। এই এত মানুষের রক্ত, পোড়া শরীরের গন্ধ নইলে কেউ কি করে সহ্য করতে পারে, বা পড়শির মৃত্যুতে পড়শি কীভাবে আনন্দ পেতে পারত! এসব কিছু দেখেশুনে চাঁদ খুব লজ্জিত। এমনিতে চাঁদের একটা নিজস্ব আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আছে; তাকে কত লোকে মামা বলে ডাকে; আবার মেয়েদের মুখ দেখে অনেকে বলে চান্দের মতো মুখ যেন। কিন্তু এই জেন্ডার ক্রাইসিসটা বিশেষ বড় ছিল না এতদিন। এই মুহূর্তে যেটা বেশ জঘন্য রূপ নিয়েছে মানে আমাদের চান্দ এ সময়ে কি বীভৎস আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছে যে দিঘির কাজলা পানিতে নিজের ছায়াছবি দেখেই মেঘের ঘুমটা টেনে নিতে ইচ্ছে করছে তার? এমনিতে ছোট বড় মাঝারি কবি তাকে নিয়ে কাব্য করে বটে; সেটাই তো স্বাভাবিক, সে সব কাব্য নিয়ে চাঁদের নিজস্ব একটা অহংকার যে ছিল তা মিথ্যে নয়। কিন্তু এখন এই হিংসাভূমে দুই পক্ষে ভাগ হয়েছে; একপক্ষ বড় নাম করা কবির কবতে অনুযায়ী ‘পূর্ণিমা চাঁদ উঠেছিল’ বলে গান গাইতে চায় কালচার বাঁচাতে চায়; অন্যরা নতুন কালচার তৈরী করে ‘বাঁড়া চাঁদ উঠেছিল’ গাইতে নাচতে হুল্লোড় করতে চায়। দুই পক্ষই যদিও এই সময়ে মানুষের বাঁচা মরার কথা নিয়ে তেমন কিছু ভাবতে বা বলতে রাজি নয়।
এই মুহূর্তে চান্দ সেই মেয়েটিকে অলৌকিক কথোপকথনে জানিয়েছে এই হিংসাভূমিতে দিল্লির চান্দ-বাগের ভয়াবহতা নিষ্ঠুরতা দেখে নিজেকে পোড়া রুটির টুকরো ভাবতে বেশি স্বাছন্দ্যবোধ করছে এসময়ে। আর সে মেয়েটি আমাকে বলেছে, অলৌকিক বিশ্বাস আর অন্ধবিশ্বাসের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম অন্তর আছে; খুব সূক্ষ্ম। ওরা হিংসাভূমি নির্মাণের প্রথম পদক্ষেপে আমাদের সরল বিশ্বাসগুলো ধংস করে তারপর সেই শূন্যস্থানে ওরা দিলের ভুখ মেটাতে অন্ধবিশ্বাসের রোপণ করে। আর অন্ধবিশ্বাসগুলো মহীরুহ হয়ে ওঠে যখন, তখন একে অপরকে বিশ্বাসের আসমানটা ঢাকা পড়ে যায়। চারিদিকে তখন গহীন অন্ধকার।
লাবনী জঙ্গী সেন্টার ফর সোশ্যাল সাইন্স কলিকাতা–র শিক্ষার্থী ও গবেষক।