নাটক তার জন্মকাল থেকেই যেমন বিনোদনের মাধ্যম, তেমনই প্রতিবাদের মাধ্যম। এ দুটি রূপ যে একে অন্যের থেকে সবসময় আলাদা – তাও নয়। এই মুহূর্তে এনআরসি-সিএএ-এনপিআর বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে (কিন্তু শুধু তাতেই সীমাবদ্ধ থেকে নয়) চলছে বেশ কয়েকটি বাংলা নাটকের অভিনয়, যাতে বিনোদন আর প্রতিবাদ অদ্ভুতভাবে মিশে যাচ্ছে। এই নাটকগুলির বিষয় অনেকসময়ই শ্রম ও শ্রমজীবী মানুষ; তার একটা কারণ হয়তো এই যে এনআরসি-সিএএ-র ফলে সবচাইতে ছিন্নভিন্ন হচ্ছেন এই মানুষরাই। নাটকগুলির অধিকাংশ অভিনয়ও হচ্ছে পথেঘাটে-হাটেবাজারে। এই লেখায় এরকম ছ’টি নাটকের কথা বলা হবে ছয় কিস্তিতে, যদিও সব মিলিয়ে এসময় যতগুলি নাটক তৈরি হয়েছে, হচ্ছে, তার সংখ্যা নিশ্চয়ই অনেক বেশি। নাটকের রাস্তা আর রাস্তার নাটক এক জায়গায় মিলে যাচ্ছে। ছাত্র-মেহনতী মানুষ-নাট্যকর্মী-রাজনৈতিক কর্মী পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নাটক দেখছেন, করছেনও। হয়তো এইভাবে তাঁরা একে অন্যের দিনযাপনেও খানিকটা মিশে যেতেও চেষ্টা করছেন। আশাহীন সময়ের এই আলোর ঝলকগুলি নিয়ে লিখেছেন মধুশ্রী বসু।
কিস্তি ১ (মধুসূদন দাদা) – এই লিঙ্কে
কঠিন রাস্তা
মোটা শার্টের সাথে ঝলরমলর ঘাগরা আর চুন্নি। খানিকটা, মাথায় কাপড় বেঁধে শহর বানাবার কাজে ইঁট ব’ন যে মহিলারা, তাঁদের মতো পোশাক। কিন্তু দারুণ রঙচঙে – যেন এক্ষুনি শুরু হবে বাঁদর নাচের খেলা। “ঝ-ন-ন-ন-ন-ন-ন-ন ধাম কুড়াকুড় ধাম কুড়াকুড় ধাম কুড়াকুড়… জয় হো! জয় হো! জয় হো!”– বলে শুরু হয় নাটক ‘ভুল রাস্তা’। অভিনয়ে – নাট্যকর্মী সব্যসাচী আর সৌমি। নাটক একটু এগোতেই পরিষ্কার আভাস পাওয়া যায় যায়, কাদের জয় আর কাদের পরাজয়ের কথা বলতে চায় এ নাটক; কাদের ইঁট বইতে চায়; কোন রাস্তায় হাঁটতে চায়।
“এক বাত থোড়া সোচিয়েগা বাবুসাব, একটা কথা একটু ভাববেন লক্সমীমাঈ – ভাই বলার রাস্তা, মা বলার রাস্তা, বন্ধু বলার রাস্তা ঠিক? না লাথ মারার রাস্তা ঠিক? একটা ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি জামাকাপড় দেখিয়ে আমাদের আলাদা করে দিচ্ছে। আর আমরা চুপচাপ সেটা মেনে নেব?”
ভারতবর্ষীয় শহরের বুকে এই দশকের প্রথম সাম্প্রদায়িক গণহত্যার ঘা এখনো শুকোতে শুরু করেনি। আমরা বারবার শিউরে উঠছি এই ভেবে, বুঝি বা ‘আলাদা করে দিচ্ছে’ নয়, ‘আলাদা করেই দিয়েছে’। ফেরার রাস্তা বন্ধ।
আবার এরই উল্টোদিকে উঠে আসছে ‘ভাই বলার, মা বলার, বন্ধু বলার’ গল্পও। যদিও এই ভয়াবহ সময়ে গল্পগুলি প্রায় রূপকথার মতো শুনতে লাগছে, তবু মনে হচ্ছে যে, না, তাহলে ফেরার রাস্তা তো আছে। রাস্তা খুঁজছেন এমন মানুষজনও আছেন। হয়তো খুঁজছিলেন না, তবু এই সময়টা তাঁদের এমন একটা জায়গায় টেনে এনে ফেলেছে, যে সে রাস্তা খুঁজে বের করা ছাড়া তাঁদের আর উপায় থাকছে না।
‘ভুল রাস্তা’ এমনই পাকেচক্রে রাস্তা খুঁজে পাওয়ার গল্প। রূপকথার গল্প – এক রাজপুত্রের ঝড়জঙ্গলে রাস্তা হারিয়ে ভিন রাস্তায় গিয়ে পড়া, রাজ্যপাট ফেলে কাঠুরে ভাই আর কাঠুরানি মা-কে খুঁজে পাওয়া, আর তারপর?
আমাদের রূপকথা শোনান কারা? না রাজনীতি করা নেতা,আইটি সেল, ধর্মগুরু, টলিউড-বলিউড-হলিউড। আর শোনাতে চান যাঁরা পথেঘাটে নেচে-কুঁদে-গেয়ে-নাটক করে বেড়ান – ট্রেনের বাউল থেকে একাঙ্ক পথনাটক অভিনেতা– যেমন সৌমি আর সব্যসাচী। তাঁদের ঝুলিতে টাকা, ক্ষমতা, লোকবল, ফাইভ-জি, মোক্ষ, ব্লকব্লাস্টার, কিচ্ছু নেই। তাই অতোসব তাবড়-তাবড় কম্পিটিটশনের মুখে দাঁড়িয়ে তাঁদের লড়াইটা খুব কঠিন।
সৌমি আর সব্যসাচী যে রাস্তা ধরেছেন, তা আগে থাকতে প্ল্যান প্রোগ্রাম করে বেছে নেওয়া রাস্তা নয়, খুব গোছানো রাস্তাও নয়। তাতে একদিকে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য ফ্রিল্যান্স কাজ খুঁজতে থাকার ঠেলায় অন্যদিকে নাটকের রিহার্সাল কিছুতেই শুরু না করে উঠতে পারা আছে। একদিকে কাছের মানুষদের সাথে যোগাযোগের ভাষা হারিয়ে ফেলা আর অন্যদিকে নিজের ভাষা খুঁজে না পাওয়ার যন্ত্রণা আছে। আছে একদিকে মাইকের অভাবে সংলাপ শুনতে না পেয়ে রাস্তার দর্শকের টোন কাটা আর অন্যদিকে কিছুতেই মাইক ব্যবহার না করার আদর্শের কামড়। মোদ্দা কথা, শুধু যে মূল লড়াইটাই কঠিন তাই নয়, তার ভিতর যে কাঁড়ি-কাঁড়ি ছোট্ট-ছোট্ট লড়াই আছে, সেগুলোও মিলেজুলে কম কঠিন নয়।
পুরনো রাস্তা
ডিসেম্বর মাস থেকে সব্যসাচী আর সৌমি নানা জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছেন তাঁদের নতুন নাটক ‘ভুল রাস্তা’ নিয়ে। এখন অব্দি হয়েছে চোদ্দটি শো – পথসভায়, মিছিলে, শহরে, গ্রামে। নাটকের মূল নাট্যকার – বাবুসাব, লক্সমীমাঈ, বড়ে মিয়াঁ – হয়তো আপনারা আগেই জানেন –থার্ড থিয়েটার আন্দোলনের প্রবর্তক বাদল সরকার ব্যতিরেকে আর কেহই নন।
তবে এই দুই অভিনেতা তাঁদের গন্তব্য রাস্তাকে থার্ড থিয়েটারের অঙ্গন মঞ্চে অথবা নাট্য উৎসবের বেড়ায় আটকে রাখতে চান না। তাঁরা চান, থার্ড থিয়েটারকে “জয় হো! জয় হো!” জয়জয়কার জানিয়ে পথেঘাটে রূপকথা শোনাতে। ফুল টাইম। চান “সবার কাছে পৌঁছতে, বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে।”
তাহলে ‘ভুল রাস্তা’ কেন? কেন নয় নতুন কোনো নাটক, যা সৌমি-সব্যসাচীর নিজেদের অভিজ্ঞতা-যন্ত্রণার মধ্যে থেকে উঠে এসেছে?
সাধারণ ভাবে পুরনো পারফর্মেন্স নতুন করে করার পিছনে তিনটি ধরন থাকতে পারে–
এক, এই সময়ের প্রেক্ষিতে, নাটকটিকে যেমন ছিল হুবহু তেমনটি রেখেই করা। এই সময়ে নতুন নাটক তৈরি করা মানেই যেমন সেটা এই সময়ের নাটক নয়, তেমনি পুরনো নাটকও হয়ে উঠতেই পারে সমসাময়িক। দুই, মূল নাট্যকারের স্মৃতি উদযাপন বা তাঁকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন; অথবা এই বিশেষ নাটকটির বিষয়ে কোনো ব্যক্তিগত উৎসাহ বোধ থেকে আবার করে করা। এতেও নাটকটি হুবহু উপস্থিত করারই প্রচলন। তিন, পুরনো নাটকটিকে প্রশ্ন করা। স্যাটায়ার নয়, পুনর্পাঠ বলা যেতে পারে। পুরনো নাটকটি একটি বিশেষ সময়ে দাঁড়িয়ে কেন করব, কীভাবে করব, দরকার মতো তার কি কি বদল ঘটাব – এইসবের ভিতর দিয়ে নাট্যকারের সাথে নতুন নির্দেশক ও অভিনেতাদের একটি সমালোচনামূলক কথোপকথন গড়ে ওঠা।
যেসব নাট্যকারের কাজকে নাটক না বলে ‘আন্দোলন’ নাম দেওয়া যায়, যাঁদের তৈরি করা নাটক মানুষকে প্রশ্ন করতে, কথা বলে উঠতে শেখায়, তাঁদের স্মৃতি উদযাপনের জন্য পুনর্পাঠের রাস্তাটি গুরুত্বপূর্ণ।
নতুন রাস্তা
সৌমি-সব্যসাচীর ‘ভুল রাস্তা’ নাটক নতুন করে করার ভিতর তিনটি ধরনেরই সংমিশ্রণ রয়েছে। ওঁরা দুজনেই এমন বিভিন্ন নাট্যদলের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করেছেন, করছেন, যাঁরা নাটককে সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে দেখেছেন; এর মধ্যে থার্ড থিয়েটার পন্থী দল বা নির্দেশকরাও রয়েছেন। গত আট-ন বছর ধরে এই দুই অভিনেতা কাজ করছেন অঙ্গনমঞ্চে ও পথে। দেখেছেন বাদল সরকারের একাধিক নাটকের অভিনয়; বিশেষ করে মনে দাগ কেটে গেছে ২০১০-এ দেখা দুই অভিনেতার করা ‘ভুল রাস্তা’র উপস্থাপনা।[1]
আসলে যতদিন মানুষে-মানুষে শ্রেণী বিভাজন থাকবে, ‘ভুল রাস্তা’ তার বিষয়ের দিক থেকে তো এই সময়ের এক প্রতিবাদী নাটক হয়েই থাকবে। তারই প্রতিধ্বনি শোনা যায় সব্যসাচীর গলায় – “আমার মনে হয়, ‘ভাই বলার রাস্তা’টা চিরকাল একই থাকবে।” তাই বাদল সরকারের এই নাটকটিকে ভালোবেসে, বা একভাবে দেখলে বাদল সরকারকে ভালোবেসেও এঁরা যে এই নাটকটি বেছে নিয়েছেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
বাকি রইল এই নতুন রাস্তায় নেমে, নাটকটির সাথে, নাট্যকারের সাথে এই দুই অভিনেতার সমালোচনামূলক কথোপকথনের বিষয়টি। এই কথোপকথনের খানিকটা চোখে পড়ে নাটকের সংলাপে ছোট খাটো পরিবর্তনে। যেমন, মূল নাটকে ছিল বফর্স কেলেঙ্কারির কথা। বাদল সরকার ছাপ্পান্ন ইঞ্চির বারফাট্টাই, রাফায়েল-টুজির খেলা দেখে যাননি। কিন্তু সৌমি-সব্যসাচীর ‘ভুল রাস্তা’য় সেসব ঢুকে পড়েছে এই সময়টাকে ধরার তাগিদ থেকে; ‘ভুল রাস্তা’কে তাঁরা এইসময় দাঁড়িয়ে যেভাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন, তার থেকে। কথা বলতে-বলতে সৌমি একবার বলে ওঠেন, “নাটক আমায় বুঝিয়েছে, আমি কোথায় আছি…”।[2] তাই শুনে আরেক বার মনে পড়ে যায়, রাস্তার মানুষকে নাটক দেখাতে চাইলে, বর্তমান সময়টার তথ্য হয়ে, গল্প হয়ে নাটকে ঢুকে পড়াটা কতটা জরুরি – বিশেষ করে আজ যখন ‘নিউজ’ আর ‘ফেক নিউজ’-এর মধ্যেকার সুতোটুকু ছিঁড়ে গেছে। ‘ভুল রাস্তা’র মতো সর্বকালের নাটকের মধ্যে ‘এই সময়’-এর এসেন্সটুকু থাকে নিশ্চয়, কিন্তু হালের তথ্য তো থাকে না। সৌমিরা তাঁদের চলার রাস্তায় এই তথ্যগুলিকে ধরতে চাইছেন।
সব্যসাচীদের বেছে নেওয়া নতুন রাস্তা নিয়ে কথা বলতে গেলে তাঁদের বেছে নেওয়া পোশাকের কথাও বলতে হবে। বাঁদরওয়ালার চকরাবকরা লুঙ্গি দেখে রাস্তার দর্শক ব্যঙ্গ করে হাসে না, মেয়েমানুষে ঘাগরা পরে নাচলেও না, বরং পয়সা ছুঁড়ে দেয়। কিন্তু ‘ভদ্রলোকের ছেলে’কে স্কার্ট পরে রাস্তায় নৌটঙ্কি করতে দেখলে দর্শক ব্যঙ্গের হাসি হেসে কুটিপাটি হয়। সেই হাসি (বা সত্যি বলতে সেই পয়সা ছুঁড়ে দেওয়াও) হজম করার ট্রেনিং আমাদের শহুরে ভদ্রলোক-সুলভ নাট্যচর্চায় তেমন থাকে না। তাই সৌমি-সব্যসাচীর মনে সন্দেহ, ভয়, দ্বন্দ্ব ছিল। অথচ যত দিন গেছে, ওঁরা দু’জনে বারবার দেখেছেন, সেই দর্শকই ফের কেমন ঢুকে পড়ে ওঁদের নাটকের গভীরে, গ্রাম-শহর নির্বিশেষে, পোশাকের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে। তাই ওঁদের মনে আর এখন নাটকের বেশভূষা নিয়ে দ্বন্দ্ব নেই।
সমালোচনামূলক কথোপকথনের আরেকটা দিক চোখে পড়ে ‘ভুল রাস্তা’ নাটকের বাইরে এই দুই অভিনেতার ভাষা, ‘ফর্ম’, ‘স্পেস’ খোঁজার তাড়নার মধ্যে। সব্যসাচীর ভাষায় – “দেখতে চাই, ‘কিছু নেই’ থেকে নাটক কিকরে তৈরি হয়। ‘ভুল রাস্তা’ একটা ইন্টারমিডিয়েট স্টেজ।” এই দুই অভিনেতা কাজ করতে চান পাড়ার ক্লাবে গিয়ে, স্কুলে গিয়ে, হেঁটে বা সাইকেল নিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের ভিতর অব্দি পৌঁছে গিয়ে – যেমন থার্ড থিয়েটার আন্দোলনের কর্মীরাও একসময় করেছিলেন, এখনো করেন। তবে তাঁরা চান নিজেদের মতো করে, খালি নাটকের স্ক্রিপ্টের ভাষায় আটকে না থেকে, নেচেকুঁদে ক্লাউন সেজে, নানাভাবে কাজ করে দেখতে। বুঝতে চান, মানুষের প্রতিক্রিয়া কি, যাতে অনেকগুলো ‘কিছু নয়’ থেকে আস্তে-আস্তে ‘কিছু-কিছু’ গড়ে তোলা যায়। শেখা যায়, রাস্তার নাটক কীভাবে আরও সহজ হয়ে উঠতে পারে। গত কয়েক বছরের অভিনেতা জীবনে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখতে-দেখতে তাঁদের মনে যে প্রশ্নগুলি উঠেছে তার উত্তর এইভাবে খুঁজছেন তাঁরা। তাই ‘ভুল রাস্তা’ নিয়ে শহীদ মিনারের সামনে চলে যাওয়া। তাই গ্রামের অনেক মানুষ এনআরসি চান জেনেবুঝেও সে গ্রামে নাটক করতে যাওয়া।
নাটকের সাথে, নাট্যকারের সাথে কথোপকথনের নিশ্চয় আরও বহু দিক আছে, যা আমরা দর্শকরা বাইরে থেকে দেখতে পাই না। তবে যার আমরা স্পষ্ট আভাস পাই, তা হল, এই দুই অভিনেতা সর্বাগ্রে একটি দর্শনকে ছুঁতে চাইছেন। হয়তো এইরকম এক দর্শনের কথা বলতে গিয়েই বাদল সরকার বলেন, থার্ড থিয়েটারে “দর্শন থেকে কনটেন্ট আসছে, কনটেন্ট থেকে ফর্ম আসছে।” এই দর্শন সমাজ পরিবর্তনের দর্শন। এই দর্শন না থাকলে, শুধু ফর্মটুকু থাকলে তা থার্ড থিয়েটার নয়।[3]
সৌমি-সব্যসাচীর কাছে এই দর্শন তত্ত্ব নয়, এক জীবিত প্র্যাকটিস। তাই ‘ভুল রাস্তা’ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তাঁদের মনে পড়ে যায় ঊষা ফ্যান কোম্পানির শ্রমিক, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীর কথা, যাঁকে বাইপাসে ট্রাক দিয়ে পিষে ফেলা হয়েছিল – রাজপুত্ররা ‘ভুল রাস্তা’ বেছে না নিলে কাঠুরে ভাইদের যা দশা হয়।
জোট বাঁধার রাস্তা
আমাদের জীবন থেকে ভাই বলার, বন্ধু বলার, ভাই বলার, মা বলার গল্প হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত, ঠিক যেমন ছাপ্পান্ন ইঞ্চিরা চায়। মারমুখী এক দলের সামনাসামনি একলা পড়ে গিয়ে মানুষ দেখতে পাচ্ছে, খেলার মাঠের বন্ধু, কাজের জায়গার ভাই-বেরাদর লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে। মায়ের বয়েসী মহিলা ঠেলা খেয়ে রাস্তায় পড়ে গিয়ে দেখছেন, ছেলের বয়েসী এক ছেলের উদ্যত হাত নেমে আসছে তাঁর শরীরে।
‘ভুল রাস্তা’ নাটকে রাজপুত্রের শোভাযাত্রাকে উড়িয়ে নিয়ে উঠেছিল ঝড়। তবে না তার সাথে কাঠুরে ভাইয়ের, কাঠুরে মায়ের দেখা হল! আজকের দিনে, আমাদের এই সমাজে ঝড় উঠবে কি? তুললেও, তুলবেন কারা? ভাইয়ে-ভাইয়ে জোট বাঁধবেন কারা? খুনীর জোট নয়, গড়ে তোলার জোট। গ্রাম-কে-গ্রাম লুটে নেওয়া রাজপুত্রের শোভাযাত্রার জোট না, স্বপ্নের মতো, রূপকথার মতো, বনজঙ্গলের মাঝে, পশুপাখি-গাছপালার মাঝে কাঠুরে জীবনের জোট।
‘ভুল রাস্তা’র দুটি শো দেখেছি। দু’বারই দেখতে-দেখতে নাটক গড়ে তুলবার লক্ষ্যে জোট বাঁধার কথা মনে হল। জোট জিনিসটা যেমন নাটকের বিষয়বস্তুতে উঠে আসা দরকার, তেমন নাটকের ভিতরকার কলকব্জা চালাতেও দরকার। ‘ভুল রাস্তা’র সাবেক অভিনয়ে অভিনেতা বা অভিনেতাদের পিছনে থাকে বাজনদারের দল – মাইক না থাকলেও জোটের জোরেই হৈ-হৈ করে জমে যায় আসর। সব্যসাচী আর সৌমির পিছনে মঞ্চে না হোক, নানান রূপে সহায় হয়ে নানান বন্ধুরা আছেন। তাও তাঁদের বলতে হয়, “আসলে দু’জন মানুষ, অভিজ্ঞতা কম, টাকাপয়সা কম…”
একে অন্যকে কিকরে বন্ধু বলে ডাকতে হয়, সেই রাস্তার কথা বলে নাটক ‘ভুল রাস্তা’, যেমন বলে এই সময়ের অন্যান্য আরও কিছু নাটক। দর্শক হিসেবে জানতে কৌতূহল হয় – এমনটা কি হয়, যে এক দলের নাটকে আরেক দল নিজের থেকে গিয়ে ম্যারাপ বেঁধে দিল, আরেক দল বাজনদার হয়ে পিছনে বসে পড়ল, আরেক দল গুছিয়ে দিল সরঞ্জাম? হয় না কি? না হলে যারা এই আকালেও স্বপ্ন দেখে, তারা যায় কোন রাস্তায়!
লেখক নাচ এবং লেখালেখি করেন।
…
[1] অভিনয়ে লোপামুদ্রা গুহনিয়োগী ও রজত দাস, অপারেশন গ্রীন হান্ট বিরোধী অনুষ্ঠানে।
[2] ছাত্রাবস্থায় দেখা, শ্রমিক মৃত্যু নিয়ে স্বভাব নাটক দলের ‘বিশ্বকর্মা’ নাটক প্রসঙ্গে।
[3] কথোপকথনে বাদল সরকার, কালি কলম ও ইজেল, তৃতীয় বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৫।
Good, keep it up.