একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান ও রিপোর্টাজের নিরিখে জানা যাচ্ছে যে, পুলিশের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও সমর্থনে দিল্লীতে যে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে উত্তর-পূর্ব দিল্লীর একাংশ। চোখে পড়ার মতো বিষয় হল, দিল্লীর সাম্প্রতিক নির্বাচনে যে যে এলাকায় বিজেপি জিতেছে, সেখানেই মুসলমানদের উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। ২ মার্চ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৪৭, এর সঙ্গে রয়েছে অসংখ্য বাড়ি, স্কুল, মসজিদ, দোকানঘর ধ্বংস করে দেওয়া ও মুসলমানদের উপর অকথ্য অত্যাচারের ঘটনা। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই সাম্প্রদায়িক হিংসা দেশের শাসকগোষ্ঠীকে চূড়ান্ত অস্বস্তিতে ফেলে দেওয়া সিএএ-এনপিআর-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ঘটানো হয়েছে। দিল্লী পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে এই হিংসা শুধু যে থামাবার চেষ্টা করেনি তাই নয়, বরং এতে ইন্ধন দিয়েছে। এটাও পরিষ্কার, যে এই হিংসামূলক ঘটনাগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণেই ঘটেছে। ভারত ও সারা বিশ্বের প্রায় ৩৫০ জন শিক্ষাবিদ নিম্নলিখিত বয়ানে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করছেন।

গত কয়েক মাসে, সারা দেশ জুড়ে মুসলিম মহিলাদের নেতৃত্বে, আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনার যেন এক পুনর্জাগরণ দেখছি। বৈষম্য সৃষ্টিকারী নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও তার আরও দুই সঙ্গী এনপিআর ও এনআরসি-র বিরুদ্ধে এই প্রায় বিরতিহীন প্রতিবাদগুলি বিজেপি সরকার স্পষ্টতই ভালোভাবে নেয়নি, এবং প্রতিবাদীদের ভাবমূর্তি নষ্ট করার ও তাঁদের কৃতিত্বকে খর্ব করার বহু চেষ্টা করা হয়েছে।

এই চরম নীচ ও বিদ্বেষপূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারের চূড়ান্ত প্রকাশ দেখা যায় যখন, বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে দিল্লীর আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে সাবধানবাণী ঘোষণা করেন। মিশ্র বলেন, আন্দোলনকারীরা যদি প্রতিবাদের জায়গাগুলি খালি করে না দেন তাহলে তার ফলাফল ভয়াবহ হতে চলেছে। এই ঘোষণাটি তিনি একজন পুলিশ আধিকারিকের সামনেই করেন। ঐ একই দিন দুপুরে জাফরাবাদ ও মৌজপুরে উন্মত্ত দক্ষিণপন্থী জনতার প্ররোচনায় বীভৎস হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। এই হিংসা দ্রুত উত্তর-পূর্ব দিল্লীর অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়ে।^[1] মৃতের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ৪০ ছাড়িয়ে গেছে।^[2]

সাহসী রিপোর্টাজ ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলি থেকে ঘটনার সাক্ষীদের অসম্ভব যন্ত্রণাময় বিবরণ থেকে এই হিংসার একটি স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাচ্ছে – এটি চারিত্রিকভাবে স্পষ্টতই মুসলিম-বিরোধী এবং মূলধারার গণমাধ্যম যেমন ক্রমাগত এটিকে ‘সিএএ-সমর্থক’ ও ‘সিএএ-বিরোধী’-দের মধ্যে বিবাদ বলে দেখাতে চাইছে, আদপেই তা নয়। উচ্চবর্ণের নেতাদের নেতৃত্বে চরমপন্থী হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজরা দেশের রাজধানীতে লাগামহীন, বেপরোয়াভাবে দাপিয়ে বেড়িয়েছে, মুসলমান পরিবারের গাড়ি, দোকান, ঘরবাড়ি, স্কুল, মসজিদ পুড়িয়ে দিয়েছে, তছনছ করেছে,^[3] একইসঙ্গে এই এলাকাগুলির মুসলিম মানুষদের উপর বর্বর, নৃশংস আক্রমণ চালিয়েছে।^[4]

এটা আমাদের কাছে পরিষ্কার যে, আইন ও বিচারব্যবস্থার এই ব্যাপক স্খলন – যা জামিয়া, এএমইউ ও জেএনইউ-এর উপর জঘন্য আক্রমণের পর অল্প সময়ের ব্যবধানেই ঘটল – তা দিল্লী পুলিশের সাহায্যেই ঘটেছে। এই পুলিশ দক্ষিণপন্থী জনতার সঙ্গে প্রায় নিখুঁত ভাবে তাল মিলিয়ে কাজ করছে – কখনও সরাসরি তাদের সহযোগিতা করে, কখনও চোখের সামনে তাদের হিংসাত্মক কাজকর্ম দেখেও না দেখে।^[5] আমরা এই ঘটনাকেও কাকতালীয় মানতে নারাজ যে, দিল্লী হাইকোর্টের এক বিচারপতি দিল্লী পুলিশকে তাদের ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তার জন্য দায়ী করার পরে, যেদিন তিনি জরুরি শুনানি ডেকেছিলেন, সেদিনই তাঁকে বদলি করে দেওয়া হল।^[6] দিল্লীতে মুসলিম-বিরোধী যে সাম্প্রদায়িক হিংসা আমরা ছড়িয়ে পড়তে দেখছি, তার সঙ্গে আরএসএস ও তার সহযোগীরা ১৮ বছর আগে গুজরাটে ও সাম্প্রতিক সময়ে উত্তরপ্রদেশে যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, সেই কার্যপ্রণালীর অদ্ভুত ও ভয়াবহ মিল রয়েছে।^[7]

এই হিংসা ইতিমধ্যেই বহু নিরপরাধ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, যার মধ্যে অধিকাংশই সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ। এঁদের মধ্যে রয়েছেন রোজ-খাটা জনমজুর, অটো রিক্সা চালক, পুলিসের একজন হেড কনস্টেবল ও একজন ইনটেলিজেন্স অফিসার। ধর্মের নামেই এই মৃত্যুগুলি ঘটেছে। আমরা সর্বতোভাবে এই সবকটি মৃত্যুর দায় ফ্যাসিস্ট উচ্চবর্ণ হিন্দুত্ববাদী শক্তির উপরেই দিচ্ছি, যারা এই সাম্প্রদায়িক হিংসা পরিচালনা করছে। আমরা একইসঙ্গে প্রগতিশীল ব্যক্তিদের কাছে জোরের সঙ্গে এই আবেদন করছি যে, এই উন্মত্ত জনতা যে হিংসা ছড়াচ্ছে, এবং একজন মানুষ এই হিংসা থেকে নিজের জীবন, পরিবার, বাড়ি ও জীবিকা বাঁচাতে যে চেষ্টা চালাচ্ছেন, তার মধ্যেকার আকাশ-পাতাল তফাতকে চিনুন। আমরা এই মর্মে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াচ্ছি যে,  এই আখ্যানের কোনও দু’টি দিক নেই; রয়েছে শুধুই উচ্চবর্ণের হিন্দুত্ববাদী দক্ষিণপন্থীদের সাম্প্রদায়িক মনোভাব দ্বারা পরিচালিত চেতনাহীন হিংসা।

যারা দিল্লীতে মুসলিম পুরুষ ও নারীদের উপর আরএসএস সমর্থিত এই দক্ষিণপন্থী আতঙ্কবাদীদের নানা ধরনের অপমানজনক বর্বর আক্রমণকে কোনও-না-কোনওভাবে সাহায্য বা সমর্থন করেছে, আমরা, নিম্নে স্বাক্ষরকারী শিক্ষাবিদেরা তাদের অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে নিন্দা করছি।

এই সরকার এতদিন পর্যন্ত গণতান্ত্রিকভাবে কাজ করার যে ভণ্ডামি করছিল, তা ঝেড়ে ফেলে আরএসএস দ্বারা পরিচালিত একটি সরকার হিসাবে খোলাখুলি ভাবে যেসব নিন্দনীয় কাজ করেছে, আমরা তারও তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

আমরা দাবি জানাচ্ছি, দিল্লী পুলিশের ভূমিকা খতিয়ে দেখতে বিচারবিভাগীয় তদন্ত হোক। কারণ রিপোর্টাজ, ভিডিও ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান এদিকেই স্পষ্ট ইঙ্গিত করে, যে হিংসা চালিয়ে যেতে দিল্লী পুলিশ সাহায্য করেছে।

আমরা বিচারব্যবস্থার কাছে আবেদন করছি, বজরঙ্গ দলের মতো একটি উগ্রপন্থী সংগঠনকে, যারা এই সাম্প্রদায়িক হিংসার মূল হোতা ছিল ও যারা মোদী জমানায় আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক।

অবশেষে আমরা দাবি জানাচ্ছি, রাষ্ট্র যেন দ্রুত ও যথার্থ ভাবে যাঁদের বাড়ি, দোকান ও জীবিকার উপায় ধ্বংস হয়ে গেছে, তাঁদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে।

[1]: Hindu supremacist mobs orchestrate violence against Muslims where BJP won in Delhi elections | The Caravan

[2]: Delhi riots: Death toll rises to 42, 148 FIRs registered | The Economic Times

[3]: Delhi violence: Three mosques targeted, school burnt, shops & homes looted | The Indian Express

[4]: Hindu mobs terrorise Vijay Park’s residents | The Caravan

[5]: Delhi violence: Cops shouted “Jai Shri Ram” with armed Hindu mob, charged at Muslims | The Caravan

[6]: HC Judge Who Pulled Up Delhi Police Over Riots Shunted Out by Modi Govt | The Wire

[7]: Why Delhi violence has echoes of the Gujarat riots | BBC News

(স্বাক্ষরকারীরা যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত সেগুলি দেওয়া হল শুধুমাত্র চেনার সুবিধার জন্য ও এই প্রতিষ্ঠানগুলির অবস্থান বোঝানোর জন্য নয়। এই ফর্মটি এখনও খোলা। আমরা আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এই ফর্মটিতে আরও স্বাক্ষরকারীদের নাম যুক্ত করব।)

স্বাক্ষরকারী :