শাহিনবাগ: ভারত ইতিহাসের এক স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অধ্যায়


  • February 28, 2020
  • (0 Comments)
  • 1719 Views

মুসলমানরা মাথা তুলে কথা বলবে, চোখে চোখ রাখবে তা আদৌ বরদাস্ত করতে রাজি নয় হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকার। মুসলমানের কেন এত স্পর্ধা হবে? উত্তর পূর্ব দিল্লিতে সংগঠিত গণহত্যার মধ্যে দিয়ে তার জবাব দিতে চেয়েছে সঙ্ঘ পরিবার। এই পর্বে দিল্লিতে জামিয়ায় ছাত্রদের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মধ্য দিয়েউত্তরপ্রদেশে কম করে ২০ জনকে হত্যা করে যার শুরু। তবু, শাহিনবাগ এই অন্ধকারেও মনুষ্যত্বের এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বলজ্বল করছে। যা স্বাধীনতা পরবর্তীকালে গণআন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়। লিখছেন ঝিলম

 

 

প্রতিটা জায়গার একটা নিজস্ব গল্প থাকে, থাকে ইতিহাসের সঞ্চয়। আজকের শাহিনবাগ প্রায় একটি তীর্থক্ষেত্র। বিকেল বা সন্ধে নাগাদ গেলে দেখা যাবে, শামিয়ানার নীচে লাল-নীল-হলুদ-সবুজ-বেগুনি-গোলাপী নানা রঙের মাথার জটলা হাতের মুঠি শক্ত করে স্লোগানে গলা মেলাচ্ছে, স্লোগান উঠছে মূল মঞ্চ থেকে। এই গান আর স্লোগান অবশ্য শামিয়ানার গণ্ডি ছাড়িয়ে, ছড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়, চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে, জসোলা বিহার-শাহিনবাগ মেট্রো স্টেশনে, ফুটব্রিজের নীচের আড্ডায়, যেখানে এক সময়ে শাহিনবাগ বাসস্ট্যান্ড ছিল ঠিক তার সামনের মানুষের জটলায়। রাজনীতি, আলোচনা, হাসি, আনন্দ, গান, রিডিং কর্নার সব মিলিয়ে এক উৎসবে মেতে উঠেছে শাহিনবাগ। এই প্রতিবাদের উচ্ছ্বাস আর প্রতিরোধের উদযাপনের মাঝেই তৈরি হচ্ছে শাহিনবাগের গল্প— নতুন গল্প, পুরনো গল্প, অনিশ্চয়তার গল্প।

 

এর পাশাপাশিই একটি জায়গা বহন করে নিয়ে চলে কিছু ইতিহাসের গল্পও। তারই সাক্ষ্য মেলে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি চালনায়, শাহিনবাগ এবং জামিয়াতে প্রকাশ্যে গুলি চলার ঘটনায়। এই ঘটনাগুলি ফিরিয়ে আনে ২০০৮ সালের বাটলা হাউজ সংঘর্ষের স্মৃতিকে, তৈরি করে নতুন এক ভয়াবহ স্মৃতি। ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঢুকে গুলি চালায় পুলিশ, নৃশংস আক্রমণ নামিয়ে আনে ছাত্রছাত্রীদের ওপর, তারপর নিজেদের ক্যাম্পাস থেকে হাত উপরে তুলে ‘সন্দেহভাজন’-এর মতো ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য করা হয় পড়ুয়াদের। আর এই উস্কে দেওয়া স্মৃতিই আরও একবার মনে করিয়ে দেয় সব সময়ই কতটা নিরাপত্তাহীন থেকেছে এখানকার জীবন, জীবন কতটা তুচ্ছ এখানে। বাতাসের বারুদের গন্ধ কখনই ছেড়ে যায়নি তাঁদের; ভয়, আশঙ্কা, নির্যাতন, হয়রানি তাঁদের নিত্যসঙ্গী। একটি গল্পের সঙ্গে তাই জড়িয়ে থাকে আরেকটা গল্প, আরেকটা ইতিহাস—‘সন্দেহভাজন’ হয়ে দিন কাটানোর ইতিহাস, দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে দিন যাপনের ইতিহাস, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার বুননকে অক্ষুণ্ন রাখতে নিজের পরিচয়কে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হওয়ার ইতিহাস।

 

বাইরে থেকে গেলে প্রথম ধাক্কাটাই লাগবে জামিয়া নগরের জন্য ট্যাক্সি বা বাইক ‘বুক’ করতে গিয়ে, বোঝা যাবে একটা জায়গা কীভাবে হয়ে ওঠে ‘অস্পৃশ্য’। ফোনের অপর পারে থাকা কণ্ঠ প্রথমেই বলে উঠবে, “ওদিকে দাঙ্গা হয়, ওখানে যাব না।” অথবা কিছু না বলেই বুকিং বাতিল করে দেবেন চালক, কারণ কিছু জায়গা তাঁদের স্বাভাবিক মানচিত্রের মধ্যে স্থান পায় না, কিছু জায়গা সব সময়ই ‘নোংরা’ বলে চিহ্নিত, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারত যে জায়গাগুলির নাম দিয়েছে ‘মিনি পাকিস্তান’।

 

শাহিনবাগের দোকানিরা অবশ্য নির্বিকার। এই ‘অদৃশ্য’ হয়ে থাকা, ‘অস্পৃশ্য’ হয়ে থাকার জীবনে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন এখানকার বাসিন্দারা, যে নির্লিপ্ত মুখে তাঁরা জানিয়ে দেন ট্যাক্সি/বাইক ‘বুক’ করতে হলে ওদিকে যেতে হবে, মেট্রো স্টেশনের অন্য প্রান্ত অবধি হেঁটে যান, “এখানে ওরা আসবে না।”

 

এই জায়গাগুলিতে একমাত্র সরকারি বিল্ডিং হল থানা, কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ি চাইলে এক-দু’দিন না-ই আসতে পারে এই এলাকায়, এত মানুষের বাস যে এলাকায়, সেখানে কোনও পার্ক বা খেলার মাঠ নেই, এখানে সরকারি জমি সহজেই প্লাস্টিক পোড়ানোর কারখানার হাতে তুলে দেওয়া যায়, বাকি শহর ফিরেও তাকায় না। তবে এই ‘অস্পৃশ্যতা’ শুধুমাত্র উগ্র দক্ষিণপন্থারই অবদান নয়। উদারপন্থী ও মূলধারার বাম রাজনীতিও হয় এই মুসলমান জনগোষ্ঠীর থেকে দূরে থাকাকেই শ্রেয় মনে করেছে নয়তো বড়জোর ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার চেষ্টা করেছে। মুসলমান জনগোষ্ঠী তাদের কাছে খানিক ‘দয়ার পাত্র’ যাদের উদ্ধার করা প্রয়োজন, যাদের ‘শিক্ষিত’ করে তোলা প্রয়োজন। শাহিনবাগ, পার্ক সার্কাস, রাজাবাজার তাই আমাদের রাজনৈতিক মানচিত্রে ঠাঁই পায় না। সেখানে মিছিল মিটিং-এর ডাক দেওয়া হয় শুধুমাত্র ‘মুসলিম’ ইস্যু নিয়ে, অথবা যাওয়া হয় ‘ডেটা’-র প্রয়োজনে।

 

প্রচলিত এই অনুশীলনকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায় আজকের শাহিনবাগ। আমাদের টেনে নিয়ে যায় সেই জায়গাগুলিতে, যে জায়গা চিরদিনই ব্রাত্য থেকে গেছে আমাদের রাজনীতির মানচিত্রে। আমরা নতুন করে শিখতে থাকি, আর তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ আমাদের পুরনো শেখাগুলোকে ছুঁড়ে ফেলার শিক্ষা পাই। মুসলিম মহিলাদের রাজনৈতিক চেতনাকে ঘিরে তৈরি হওয়া এই আন্দোলন আমাদের নিজেদের সুবিধাপ্রাপ্ত অবস্থানকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের রাজনৈতিক ব্রাহ্মণ্যবাদ। শাহিনবাগের ‘দাদি’ মেহরুন্নিসা, বিলকিস, রফিকা ও অন্যান্যরা যখন হাত ধরে বলেন “ভাল হয়েছে, এই উপলক্ষে আপনারা এখানে এলেন, আপনাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল,” তখন আমাদের রাজনীতির মানচিত্রের কালো বিন্দুগুলোকে আমরা চিনতে শিখি, আমাদের বোঝাপড়ার ফাঁকগুলোকে দেখতে শিখি। মনে পড়ে যায় পশ্চিমবঙ্গেই কিছু যুক্তিবাদী সংগঠন, এবং এমনকি কিছু অসংসদীয় বাম সংগঠনও মুসলমান সংগঠনগুলোর সঙ্গে এক মিছিলে হাঁটতে অস্বীকার করে। মনে পড়ে যায়, ফ্যাসিবাদ বিরোধী মঞ্চে স্থান পাওয়ার জন্য কীভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয় মুসলমান সংগঠনদের। সাম্প্রতিক অতীতেও ‘প্রগতিশীল’, ‘উদারপন্থী’ মানুষরা, দাড়ি-টুপি, হিজাবের সঙ্গে এক মিছিলে হাঁটতে অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন বার বার, এই জমায়েতগুলোকে দেগে দিয়েছেন ‘ইসলামিক’ ও ‘মৌলবাদী’ বলে। নিজেদের ধর্মীয় চিহ্নকে বহন করেই শাহীনবাগ, পার্ক সার্কাস, নাগপাড়া, সিলামপুরে মুসলিম মহিলারা আজ জড়ো হয়েছেন, দখল নিয়েছেন দৃশ্যের। নিজেদের পরিচয়কে জাহির করে আমাদের অতি প্রিয় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র ধারণাকে ভেঙেচুরে দিচ্ছেন তাঁরা, নির্মাণ করছেন এক নতুন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, যে ধর্মনিরপেক্ষতাতে স্থান পায় প্রতিটি ধর্ম, যে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণায় কোনও নির্দিষ্ট ধর্মকে তার ধর্মীয় চিহ্ন সরিয়ে রেখে আসতে হয় না, যে ধর্মনিরপেক্ষতাতে শুধুমাত্র কোনও কোনও গোষ্ঠীকে বার বার নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমাণ দিয়ে যেতে হয় না।

 

এই প্রেক্ষিতেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে শাহিনবাগের ছড়িয়ে পড়া — বাসস্ট্যান্ডে, চায়ের দোকানে, লাইব্রেরিতে, হাইওয়েতে। শাহিনবাগের দাদি মেহেরুন্নিসাকে আমি জিগেস করি, “অবরোধ কেন?” মেহেরুন্নিসার উত্তর যেন এক সপাট চড়, “নাহলে তো আমাদের কথা কেউ শোনে না… এতে না হলে সারা দিল্লি শহর অবরোধ করব।” শাহিনবাগ বা সিলামপুরে প্রথম দিন গিয়েই বোঝা যায়, এই প্রতিবাদী ক্ষেত্রগুলি আসলে এই জায়গাগুলোকে আমাদের মানচিত্রে স্থাপিত করছে। রাস্তা অবরোধ, আমাদের দৈনন্দিনের পরিসরগুলোর দখল নেওয়ার মধ্যে দিয়ে অলক্ষ্যে থাকা, ‘অননুমোদিত’ এই মানুষেরা আমাদের ‘স্বীকৃতি’ আাদায় করে নিচ্ছেন, আমাদের নজরে আসছেন। এই রাস্তা অবরোধই আজ শাহিনবাগকে আমাদের দৈনন্দিন কথোপকথনের অংশ করে তুলেছে। অটোতে, মেট্রোয়, বাসে, রাতের খাবার টেবিলে, কলেজ ক্যাম্পাসের আড্ডায়, অফিস ক্যান্টিনের আলাপচারিতায় ছড়িয়ে পড়ছে শাহিনবাগ। শাহিনবাগ ছড়িয়ে পড়েছে পাশের বাসস্ট্যান্ডে, যা আজ সাবিত্রী বাই-ফতিমা শেখ লাইব্রেরি, থাকে থাকে সাজানো ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বই আর পোস্টার। পাশের ফুটব্রিজ জুড়ে প্রতিরোধের ভাষ্য, ছবি ও স্লোগান মনে করিয়ে দেয় সেই লড়াইয়ের কথা, যে লড়াইকে এড়িয়ে যাওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। পাশেই একটা দোকানের উঠোন হয়ে উঠেছে শাহিনবাগের শিশুদের ঘর, সেখানে তারা খেলে, বই পড়ে, ছবি আঁকে, পোস্টার বানায়।

 

শাসককে সবথেকে বেশি বিচলিত করে আজকের শাহিনবাগের এই ছড়িয়ে পড়া, তার ঠিক করে দেওয়া গণ্ডিকে অস্বীকার করে, তার ‘অনুমোদন’ ও ‘অনুমতি’-র ধারণার তোয়াক্কা না করে, আমাদের ‘রাজনীতি’র   ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়ে রাজপথের দখল নেওয়া শাহিনবাগ। এ যেন রোহিত ভেমুলার সেই ভেলিভাদা— যা আজও তাড়িয়ে বেড়ায় শাসককে, গোড়া থেকে নাড়িয়ে দেয় এই ব্রাহ্মণ্যবাদী রাষ্ট্রের ইমারতকে। তাই বার বার প্রশাসন গুঁড়িয়ে দিতে চায় সেই ভেলিভাদা, পর দিনই আবার গড়ে ওঠে দলিত বস্তি। শাহিনবাগ, সিলামপুর, পার্ক সার্কাস ময়দান, ঘণ্টাঘর, শান্তি বাগ, মুম্বই বাগ, মুম্বরা—‘অস্পৃশ্য’ এই বসতিগুলোতে আজ আমরা যেতে বাধ্য, প্রতিদিন, রাজনীতির পাঠ নিতে। শাহিনবাগের একটি বাচ্চার তৈরি করা পোস্টারে লেখা, ‘কুছ দিন তো গুজারিয়ে শাহিনবাগ মে (আসুন, শাহিনবাগে কয়েকটা দিন তো কাটিয়ে যান)’। ভারত যখন পুলিস রাষ্ট্র হওয়ার পথে এগোচ্ছে, যেখানে একজনের অস্তিত্বর বৈধতা নির্ভর করছে ‘কাগজ’ দেখাতে পারার ওপর, সেখানে দাঁড়িয়ে এই আন্দোলনগুলো নাগরিকত্বের ধারণাকে তৈরি করছে নতুন করে, নতুন করে নির্মিত হচ্ছে আমাদের ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’র ধারণা।

 

এখানে গেলে দেখতে পাবেন লাইব্রেরি ও রিডিং কর্নার, কিন্তু সেই লাইব্রেরিতে পড়ার জন্য কোনও সদস্যপদ নেই, আপনার পড়ার ইচ্ছাই এই লাইব্রেরিতে প্রবেশের অনুমতি পত্র। দেখবেন অস্থায়ী স্কুলে চলছে শিশুদের পাঠদান, কিন্তু সেই স্কুলে ভর্তির জন্য কোনও ফর্ম পূরণ করতে হয়নি কাউকে। ছোটদের লাইব্রেরিতে ঢুকলে শিশুরাই ‘কাগজ’ চাইবে, পোস্টার লেখার কাগজ। এক পাশে টাঙানো ‘ভারতের বেকারত্বের আয়না’, একটি বড় বোর্ডে মানুষ এসে ঝুলিয়ে যাচ্ছেন ‘কাগজ’—তাঁদের বেকারত্বের খতিয়ান। অন্যদিকে রয়েছে ফটো গ্যালারি ‘সব ইয়াদ রাখা যায়গা’ (সব মনে রাখা হবে)—ছবিতে পুলিশি অত্যাচারের সাক্ষ্য। এই প্রতিটি দৃশ্যই আমাদের নাগরিকত্বের ধারণাকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করায়, প্রশ্ন করে আমাদের ‘ডক্যুমেন্টশন’-এর রাজনীতিকে।
শিশুরা এখানে প্রতিরোধের ছবি আঁকে। সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর পোস্টারে লেখা থাকে ‘আজাদি কে গীত গা লিয়ে পার কাশ্মীর কো ভুল মাৎ যা না (আজাদির গান গাইলেন, কাশ্মীরকে ভুলে যাবেন না)’। আলিকা ও তার মতোই আরও অনেকে প্রতিদিন স্কুল থেকে সোজা চলে আসে প্রতিবাদে যোগ দিতে। এই প্রত্যেক শিশু-কিশোর ভেঙে চুরমার করে দেয় আমাদের ‘সুরক্ষিত শৈশব’-এর ধারণাকে। যে সুরক্ষিত শৈশবের ধারণার শিকড় রয়েছে আমাদের সুবিধাপ্রাপ্ত যাপনে। আমাদের ‘সারল্য’-এর ধারণাকে নগ্ন করে দেয় সেই শিশু যে বার বার তার মায়ের কাছে জানতে চায় মন্ত্রীরা তাদের ‘ঘৃণা’ কেন করে, উত্তর হাতড়ান মা।

 

দেশের শীর্ষ আদালত উদ্বেগ প্রকাশ করে চার মাসের শিশু প্রতিবাদে কেন; মহিলারা অস্থায়ী ক্রেশ গড়ে তোলেন প্রতিবাদের স্থানগুলোর আশেপাশে। রাষ্ট্রের টাকা খাওয়া সংবাদ মাধ্যম প্রচার চালায় শিশুদের ‘চরমপন্থা’-র দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, শিশুদের শৈশব কলুষিত হচ্ছে; ভেলিভাদায় বেড়ে ওঠা শিশু প্রশ্ন করে আমাদের ইসলামোফোবিয়াকে, পোস্টারে ফুটিয়ে তোলে তাঁদের স্বপ্নের ‘দেশ’-এর ধারণা, এঁকে চলে প্রতিরোধের ছবি। হিন্দুত্ববাদী বন্দুকবাজ প্রকাশ্যে গুলি চালায় জামিয়াতে; রাত তিনটের সময় শাহিনবাগের পথে নেমে আসে কিশোরী-তরুণীর দল, স্লোগান ওঠে ‘জামিয়া তেরে খুন সে ইনকিলাব আয়েগা (জামিয়া তোমার রক্তে ইনকিলাব আসবে)’। সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায় পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ঢুকে সেখানে পড়াশোনা করা ছাত্রদের উপর নির্মম অত্যাচার নামিয়ে আনে; শাহিনবাগ আর পার্ক সার্কাসে তৈরি হয় অস্থায়ী লাইব্রেরি, মানুষ সেখানে পড়ে কাশ্মীরের গল্প, পাকিস্তানের গল্প, ভারতের গল্প, সাধারণ মানুষের ওপর হওয়া নিপীড়নের গল্প, প্রতিরোধের গল্প। সেখানে ‘বিপ্লবের পাঠ’ দিতে যাওয়া আমরা বাধ্য হই খানিক থমকে দাঁড়াতে। ‘ত্রাতা’-র ভূমিকা ছেড়ে বাধ্য হই সংহতির অর্থকে নতুনভাবে বুঝতে, শিখি সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের সংজ্ঞা।

 

শাহিনবাগ, সিলামপুর, পার্ক সার্কাস গল্প বলে বন্ধুত্বের, ভালবাসার। সিলামপুরে এক মহিলা হাসির ছলেই বলেন, “মোদিজি এইটা একটা ভাল কাজ করেছে, এই এত এত নতুন বন্ধু পাচ্ছি।”

 

ক্ষমতা আজ ভয় পাচ্ছে এই বন্ধুত্বকে। যে বন্ধুত্ব তৈরি হয় যন্তর মন্তর ও আজাদ ময়দানের ‘অনুমোদিত’ প্রতিবাদের সীমা ছাড়িয়ে শাহিনবাগ, সিলামপুর, নাগপাড়া, মুম্বরাতে ছড়িয়ে পড়া প্রতিবাদের ময়দানে, নিজেদের ‘ঘেটো’ ছেড়ে রাজপথে বেরিয়ে আসা মানুষের স্লোগানে, নির্ধারিত গৃহস্থালীর অন্দর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসা মহিলাদের প্রতিরোধে, বড়দের ঠিক করে দেওয়া জায়গা থেকে বেরিয়ে প্রতিবাদ মঞ্চে এসে পড়া শিশুর চিৎকারে। রাষ্ট্র যখন একদিকে সীমানা, বংশপরিচয়, পরিবার কাঠামো দিয়ে বেঁধে ফেলতে চাইছে মানুষকে, তখনই শাহিনবাগ, পার্ক সার্কাস, সিলামপুর, মুম্বইবাগ, ঘণ্টাঘর বলছে বন্ধুত্বের গল্প, তৈরি করছে ক্যুয়ার আত্মীয়তার আখ্যান। যে আখ্যান নস্যাৎ করে দেয় বিষম-পিতৃতন্ত্রের নিদানকে, গুলিয়ে দেয় ‘পরিবার’-এর ধারণাকে। আমাদের এ যাবৎকালের গণতন্ত্রের কাঠামোর ধারণা যখন ব্যর্থ প্রতিপন্ন হচ্ছে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এই বন্ধুত্বের রাজনীতিই হয়তো আমাদের নতুন পথ দেখাবে। যে বন্ধুত্ব তৈরি হয় শেখা ও শিক্ষা বর্জনের মধ্যে দিয়ে, যে বন্ধুত্বের মূলে রয়েছে সহমর্মিতার নতুন শর্ত, যেখানে সংহতির শর্তগুলি সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত অংশ স্থির করে না, যেখানে তৈরি হয় প্রতিবাদের নতুন ভাষা, প্রতিরোধের নতুন ভাষ্য। ইতিহাস, স্মৃতি ও সহমর্মিতার ওপর দাঁড়িয়ে তৈরি হওয়া এই বন্ধুত্বের হাত ধরেই হয়তো এগিয়ে যাওয়া যাবে বেশ খানিকটা।

 

প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ইংরেজিতে মূল লেখা, Notes From Shaheen Bagh গ্রাউন্ডজিরোতে , February 18, 2020 তারিখে প্রকাশিত।

ভাষান্তর : সানন্দা দাসগুপ্ত 

 

Share this
Leave a Comment