ট্রাম্প–মোদীর সামরিক চুক্তির শেষ হলে দেশের সর্বশক্তিমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দিল্লি প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের পর জানালেন প্রয়োজনে সেনাবাহিনী পথে নামবে। মনে পড়তে পারে গুজরাত গণহত্যার সময় সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডারের আক্ষেপ। কীভাবে তাদের নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। এই হল রাষ্ট্রীয় কাঠামোগত হিংসা। এই হল সুপরিকল্পিত সুসম্বদ্ধ নির্মম বিনাশ প্রণালী। লিখলেন দেবাশিস আইচ।
গুজরাত সরকারের সঙ্গে একবার নিরোর তুলনা করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। ‘আধুনিককালের নিরো’। সেটা ২০০৪ সাল। ২০০২ সালে গুজরাতে মুসলিম গণহত্যার সময় বেস্ট বেকারিতে আশ্রয় নেওয়া ১৪ জন শিশু ও নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। গুজরাতের নিম্ন আদালত ও হাইকোর্ট এই ঘটনায় যুক্ত ২১ জনকে বেকসুর খালাস করে দেয়। তার বিরুদ্ধে আবেদন শুনছিল শীর্ষ আদালত। ২১ জনের মুক্তির নির্দেশ খারিজ করে মহারাষ্ট্রে মামলা সরিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়ার সময় বিচারপতি দোরাইস্বামী রাজু ও বিচারপতি অরিজিৎ পাসারাত গুজরাত সরকারকে বিদ্ধ করে মন্তব্য করেন, “যখন বেস্ট বেকারি, শিশু ও নারীরা আগুনে জ্বলছে তখন আধুনিককালের নিরোরা মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল, সম্ভবত পরামর্শ করছিল অপরাধ ও অপরাধীদের কীভাবে আড়াল করা যায়।” গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী তখন নরেন্দ্র মোদী।
দিল্লি যখন জ্বলে উঠেছে মোদী তখন তার যোগ্য আন্তর্জাতিক সহযোগী ট্রাম্প সকাশে সবরমতী আশ্রমে মার্কিন দম্পতিকে চরকার মাহাত্ম্য বোঝাচ্ছেন। ‘নমস্তে ট্রাম্প’ জয়ধ্বনিতে মাত করছেন মোতেরা।
মোদী সরকারের সেই বিষ-বেহালার বাদন ফের শোনা গেল। দিল্লি যখন জ্বলে উঠেছে মোদী তখন তার যোগ্য আন্তর্জাতিক সহযোগী ট্রাম্প সকাশে সবরমতী আশ্রমে মার্কিন দম্পতিকে চরকার মাহাত্ম্য বোঝাচ্ছেন। ‘নমস্তে ট্রাম্প’ জয়ধ্বনিতে মাত করছেন মোতেরা। বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রের ডাকে সঙ্ঘী ও দিল্লি পুলিশের যৌথবাহিনী তখন যাবতীয় প্রস্তুতি সমেত ঝাঁপিয়ে পড়েছে উত্তর পূর্ব দিল্লির মুসলিম মহল্লায় মহল্লায়। মোতেরার গগনভেদী উল্লাসকে ম্লান করে দিয়ে অসহায় আর্তনাদ, কালো ধোঁয়া আর লেলিহান আগুনের শিখা দিল্লিকে গ্রাস করতে খুব বেশি সময় নেয়নি। মোতেরার মতো এখানে ধর্মোন্মাদদের গলায় শোনা গিয়েছে মোদী মোদী ধ্বনি। প্রেমের সৌধ বলে খ্যাত তাজমহলে তখন স্বদেশে ঘৃণার ব্যবসায়ী বলে খ্যাত এক মার্কিনি স্ত্রী-কন্যা নিয়ে প্রমোদভ্রমণে ব্যস্ত। সেই রায়ের দেড় দশক পর আজ আর কোনও সুপ্রিম কোর্ট নেই, শীর্ষ বিচারক নেই যে বলবেন, দিল্লি যখন জ্বলছে তখন কেন্দ্রীয় সরকার অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল, সম্ভবত কীভাবে সঙ্ঘীবাহিনীর অপরাধ ঢেকে ফেলা যায় তার কুমন্ত্রণায় ব্যস্ত ছিল তারা। শীর্ষ আদালতের কোনও বিচারপতি এখন মোদী বন্দনায় মুখর, কোনও কোনও বিচারপতি আবার আইনের শাসনে নয়, অন্ধবিশ্বাসকে ভিত্তি করেন রায়দানের সময়। সাত মাস কাশ্মীর অবরুদ্ধ, গৃহবন্দি কিংবা জেল হেফাজতে একাধিক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, প্রথম সারির নেতা থেকে সাধারণ মানুষ মায় শিশু-কিশোরেরা। সুপ্রিম কোর্টে একের পর এক মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার, মৌলিক অধিকারের উপর ভিত্তি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিচারপতিদের সময় হয়নি শুনানি করার।
ট্রাম্পের কাছ থেকে পাঁচিল তোলার শিক্ষা গ্রহণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি মোদীর কাছ থেকে শিখলেন কীভাবে রাষ্ট্রের মদতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা সংগঠিত করতে হয়?
এই সেই ভারত, হিন্দু শ্রেষ্ঠত্বের প্রবক্তা ভারত, যার সঙ্গে আশ্চর্য ভাবে মিলে যায় এক মার্কিন স্বৈরাচারীর রাজনৈতিক ও আর্থনীতিক দর্শন। এই সেই নাগরিকত্ব আইন, পঞ্জির ভারত যার সঙ্গে হরিহর আত্মা হয়ে ওঠেন এক অভিবাসী ও মুসলিম বিদ্বেষী সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রনায়ক। ট্রাম্পের কাছ থেকে পাঁচিল তোলার শিক্ষা গ্রহণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি মোদীর কাছ থেকে শিখলেন কীভাবে রাষ্ট্রের মদতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা সংগঠিত করতে হয়? নাকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হিন্দুপ্রেমী মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে উপহার দিলেন এক আদর্শ হিন্দুত্ববাদী ভারতের রৌরব নরকের চিত্র। ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনী প্রচারে এই ট্রাম্পই না বলেছিলেন, ‘আই লাভ হিন্দু।’
ফ্যাসিস্ত হিন্দুত্ববাদীরা কতদূর পর্যন্ত নৃশংস নির্লজ্জতা প্রদর্শন করতে পারে তার একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে ২০২০-র ফেব্রুয়ারির দিল্লি।
দুই চরম দক্ষিণপন্থী, দুই চূড়ান্ত ক্ষমতালোভী, কর্পোরেট পুঁজি ও এলিট নাগরিকদের পোস্টার বয়ের মহামিলন যজ্ঞর জন্য কী নিঁখুত নৈপুন্যে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল রাজধানী দিল্লির রঙ্গমঞ্চ। পর্দার অন্তরালে ছিল মোদী-শাহ গুজরাত গণহত্যার নীল নকশা। প্রকাশ্যে নেতৃত্ব দিল দিল্লির বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র ও দিল্লি পুলিশ। ফ্যাসিস্ত হিন্দুত্ববাদীরা কতদূর পর্যন্ত নৃশংস নির্লজ্জতা প্রদর্শন করতে পারে তার একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে ২০২০-র ফেব্রুয়ারির দিল্লি। এক বিদেশি অতিথি, দেব: ভব: অতিথির সফরকালে এমন এক রক্তপাত, হত্যালীলা, ধ্বংসযজ্ঞ যে গৃহকর্তার সম্মানহানি ঘটায় সেই সাধারণ বোধটুকু বিদ্বেষের হিংস্র উল্লাসে কবেই হারিয়ে ফেলেছে মোদী-শাহ ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি। গুজরাতের মতো কপিল মিশ্রদেরও কি তিনদিনের যা কিছু করার লাইসেন্স দিয়েছিল দিল্লি প্রশাসন? কার নির্দেশে? ষাট ঘণ্টা পার হওয়ার পরও রাজধানী দিল্লির, বিশেষ ভাবে উত্তর পূর্ব দিল্লির অসংখ্য নাগরিক লাগাতার আক্রমণের শিকার হয়ে চলে কার অঙুলিহেলনে? সর্বোচ্চস্তর থেকে নির্দিষ্ট নীতি নির্দেশিকা না-মিললে এক বিদেশি অতিথির উপস্থিতি সত্ত্বেও হিন্দুত্ববাদী জঙ্গিবাহিনী জয় শ্রী রাম, হর হর মহাদেও কিংবা মোদী মোদী মোদী নাড়া লাগিয়ে মুসলমানদের উপর টানা চরম আক্রমণ শানাতে পারত না। ট্রাম্প-মোদীর সামরিক চুক্তির শেষ হলে দেশের সর্বশক্তিমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দিল্লি প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের পর জানালেন প্রয়োজনে সেনাবাহিনী পথে নামবে। মনে পড়তে পারে গুজরাত গণহত্যার সময় সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডারের আক্ষেপ। কীভাবে তাদের নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। বাহাত্তর ঘণ্টা এখনও পার হয়নি। দিল্লি এখনও জ্বলছে। এই হল রাষ্ট্রীয় কাঠামোগত হিংসা। এই হল সুপরিকল্পিত, সুসম্বদ্ধ নির্মম বিনাশ প্রণালী।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফরে কতদূর উপকৃত হল ভারত তার মূল্যায়ন করুক যুদ্ধবাজ মিডিয়া আর ক্রোনি ক্যাপিটাল। তামাম বিশ্ব মনে রাখবে ট্রাম্প-মোদী আলিঙ্গন কেবল নয়, প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে প্রকাশিত হয়েছিল মুসলমানের ছবিও। রক্তাক্ত, মৃত্যুমুখী এক মানুষের ছবি। ভারতের আত্মার ছবি। যে ভারতকে ফিরে পেতে চেয়েছে। দিল্লির রাজপথে উদ্ধত হিংস্র লাঠিয়ালদের ঘেরাটোপে তিনি সেরে নিচ্ছেন শেষ এবাদত। অন্ধকার নেমে এসেছে। আর কবে মর্মভেদী হয়ে বিঁধবে অন্তিম এবাদতের, অন্তিম উপাসনার এই শেষ বাণী! আর কত অন্ধকার নেমে এলে আমরা আলোর সন্ধানে বের হব?
লেখক সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী।