জনতার সাহিত্য উৎসব এক বাহিরিয়ানার উদযাপন


  • February 24, 2020
  • (0 Comments)
  • 1601 Views

বস্তার সলিডারিটি নেটওয়ার্ক কলকাতা-র উদ্যোগে তৃতীয় জনতার সাহিত্য উৎসব শুরু হবে ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০। চলবে দু’দিন। ২৮ও ২৯ ফেব্রুয়ারি। বড়ো পুঁজি লালিত সাহিত্য ও শিল্প চর্চা, সেই বৃত্তের বাইরে যাঁরা বসবাস করেন অথবা কাজ করেন, তাঁরাই এই উৎসবে আমন্ত্রণ পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ, জনতার সাহিত্য উৎসব মূলত বাহিরিয়ানার উদযাপন। যে বাহির গঠিত হয় কর্পোরেট পুঁজির নির্ধারণ করে দেওয়া সাহিত্যচর্চাকে একধরনের উপেক্ষা করে, যে বাহির গঠিত হয় বড়ো পুঁজি নির্ভর প্রকাশনা সংস্কৃতিকে কলা দেখিয়ে। একটি গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন

 

 

কয়েকদিন আগেই হয়ে গেল জেএলএফ অর্থাৎ, জয়পুর লিটারেচার ফেস্টিভ্যাল বা জয়পুর সাহিত্য উৎসব।যেমন হয় প্রত্যেকবার। তবে, এইবার ঠিক আগেরবারেরমতো করে হল না। উৎসবের অব্যবহিত পূর্বে, শিল্পী-সাহিত্যিক মহলের একাংশের মধ্য থেকে প্রশ্ন উঠল, জয়পুরের প্রধান স্পনসর জি-নেটওয়ার্ককে ঘিরে। যাদের সঙ্গে এই দেশের বর্তমান হিন্দুত্ব-ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠীর সম্পর্ক বুদ্ধিজীবী মহলে কারুরই প্রায় অজানা নয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে কি নির্দ্বিধায়  যাওয়া যায় জয়পুরে? নিস্পৃহ চিত্তে কি অংশ নেওয়া যায় সাহিত্য আলোচনায়? বিশেষত, এনআরসি-এনপিআর-সিএএকে ঘিরে যখন চারদিকে এত ডামাডোল, চলছে বহুধা ধারায় আন্দোলন? বিশেষ করে, যে লেখক-শিল্পীরা আন্দোলনের স্বপক্ষে দাঁড়িয়েছেন, রেখেছেন ফ্যাসিবাদ বিরোধী বক্তব্য, তাঁরা ঠিক কীভাবে, কোন রাজনৈতিক অবস্থানের বশবর্তী হয়ে জি-অনুমোদিত ও পরিচালিত সাহিত্য উৎসবে অংশগ্রহণ করতে পারেন?

 

তদুপরি, জয়পুরে উৎসব চালু হওয়ার পরে এনআরসি-সিএএ নিয়ে প্রতিবাদরত একদল ছাত্রের ওপর লাঠি চার্জ করা হল। উৎসব প্রাঙ্গন থেকে বহিষ্কার করা হল তাদের। তবে, যে ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক-কবিরা হাজির হলেন, মঞ্চে উপবিষ্ট হয়ে বড়ো বড়ো বাকতাল্লা ঝাড়লেন, তাঁদের কারুর মুখ থেকে শোনা গেল না একটিও নিন্দাবাক্য। যদিও, তাঁদের অনেকেই এই ঘটনার অব্যবহিত আগে এবং পরে, অনেক কথার মধ্যে এমন কথাও বলেছিলেন যে, ওদের দেওয়া মঞ্চে দাঁড়িয়ে ওদের বিরোধিতা করতে হবে। বাস্তবে কিন্তু ঠিক তেমনটি হল না। যেটা বরং দেখা গেল যে, প্রয়োজন যখন পড়ল, তখন প্রায় সবার মুখেই কুলুপ। আরও একবার প্রমাণিত হল, ওদের দেওয়া মঞ্চে দাঁড়িয়ে আসলে ওদের বিরোধিতা করা যায় না।

 

এবং, তার সাথে সাথে এও প্রমাণিত হল, আজকের কর্পোরেটদের কাছে সাহিত্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষেত্র। তা যেমন জি নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে সত্যি, তেমনি তা সত্যি টাটা বা বেদান্ত বা আরও অন্যান্য কর্পোরেটদের কাছে। যাদের হাতে সংগঠিত হয়েছে গণহত্যা, জমিহরণ, বৃহৎ আকারের পরিবেশ ধ্বংস ও সার্বিক মুনাফাজনিত সামাজিক ধ্বংসলীলা।

 

এই সাহিত্য ক্ষেত্রে সাহিত্য -উৎসব মারফত কর্পোরেটদের প্রবেশকেই অনেকে নাম দিয়েছেন “লিটওয়াশিং” — বা “সাহিত্যধৌততা। এই “সাহিত্যধৌততা” হল সেই প্রক্রিয়া যার মধ্য দিয়ে কর্পোরেটসমূহ নিজেদের একটি নিষ্পাপ শিল্পসংস্কৃতিপ্রেমী মুখ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। মুছে দিতে চায় নিজেদের ইতিহাসের মধ্য থেকে গণহত্যার ইতিহাস, হিংসার ইতিহাস। যেমন ঘটে থাকে কর্পোরেট সমাজসেবার মধ্য দিয়ে। অবশ্যম্ভাবীভাবে তাই এই জাতীয় সাহিত্য-উৎসবের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় এক ধরনের বিশেষ বাতাবরণ। মনে হতে শুরু করে যে বড়ো পুঁজির দাক্ষিণ্য ছাড়া সাহিত্য-চর্চা একেবারেই অসম্ভব। অসম্ভব লেখক বা শিল্পী হয়ে ওঠা।

 

তো, সেই অর্থে জনতার সাহিত্য উৎসব বা পিপলস লিটারেরি ফেস্টিভ্যাল জি বা টাটা বা বেদান্ত দ্বারা পরিচালিত যে কর্পোরেট সাহিত্য উৎসবের ধাঁচা, তার থেকে একটি সম্পূর্ণ বিপরীত আখ্যান তৈরি করে। সেখানে “ওদের মঞ্চ ব্যবহার করে আমি ওদেরই বাঁশ দেব” জাতীয় দোলাচলের কোনো গল্প নেই। একদিক থেকে এখানে “ওদের” ও “আমাদের” বিভাজন খুব স্পষ্ট। যে বড়ো পুঁজি লালিত সাহিত্য ও শিল্প চর্চা, সেই বৃত্তের বাইরে যাঁরা বসবাস করেন অথবা কাজ করেন, তাঁরাই এই উৎসবে আমন্ত্রণ পেয়ে থাকেন। সেই বসবাস হতে পারে পরিকাঠামোগত প্রান্তিকতার কারণে, কিংবা  মতাদর্শগত কারণে। অর্থাৎ, জনতার সাহিত্য উৎসব মূলত বাহিরিয়ানার উদযাপন। যে বাহির গঠিত হয় কর্পোরেট পুঁজির নির্ধারণ করে দেওয়া সাহিত্যচর্চাকে একধরনের উপেক্ষা করে, যে বাহির গঠিত হয় বড়ো পুঁজি নির্ভর প্রকাশনা সংস্কৃতিকে কলা দেখিয়ে।

 

অর্থাৎ, জনতার সাহিত্য উৎসবের একটি অন্যতম লক্ষ্য হল, সাহিত্য ও প্রতিরোধের মধ্যে একধরনের যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে, সেই বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে একধরনের বিকল্প সংস্কৃতি গড়ে তোলা। সেই মর্মে দাঁড়িয়ে অংশগ্রহণকারীরা কথা বলেন শুধুমাত্র সাহিত্যের বিষয় নিয়ে নয়, বরং বিতরণ ও প্রকাশনার পেছনকার পুঁজি ও অন্যান্য রাজনীতি নিয়ে, ভাষা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতির সম্পর্ক নিয়ে, এবং সর্বোপরি গণ-আন্দোলনের সাথে সাহিত্যের সম্পর্ক নিয়ে।এই দিশা মাথায় রেখেই পরিচালিত হয়েছিল গত দু’ বছরের জনতার সাহিত্য উৎসব।সেখানে বক্তব্য রেখেছিলেন এবং নিজেদের সাহিত্য সৃষ্টি থেকে পাঠ করেছিলেন জাসিন্থা কারকেটটা, মীরা সংঘমিত্রা, বামা, হরিপ্রিয়া সইবাম প্রমুখ।

 

এইবার, ২০২০ সালে, তৃতীয় জনতার সাহিত্য উৎসব শুরু হবে ২৮ ফেব্রুয়ারি। চলবে দু’দিন। ২৮ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি। এবং এইবার উৎসবের সূচনা হবে ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে, যখন একদিকে দেশ জুড়ে নেমে এসেছে প্রায় অকল্পনীয় রাষ্ট্রীয় হিংসার ছায়া, প্রায় ছ’মাসের বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ কাশ্মীর, তেমনি দেশের দূরবর্তী প্রান্তেও সংগঠিত হচ্ছে গণ-প্রতিরোধ। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এইবার আসবেন কাশ্মীরি রাপার মুয়াজ্জাম ভাট, দলিত রাপার সুমিত সান্তোস, গল্প সংকলন “সারোগেট কান্ট্রি”-র লেখিকা সীমা আজাদ, যিনি গত কয়েকবছর ধরে ক্লান্তিহীন ভাবে লিখেছেন কোনো শ্রমিকদের বিষয়ে। আসবেন জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী-কর্মী আয়েশা রেনা ও লাদিদা ফারজানা। আসবেন দার্জিলিঙের ঔপন্যাসিক ছুদেন কাবিমো, যার গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন বিষয়ক উপন্যাস সম্প্রতি বাংলায় অনুবাদ করেছেন গণ-আন্দোলনের কর্মী শমীক চক্রবর্তী। এছাড়াও আসবেন ওড়িশার নারীবাদী কবি সুজাতা সাহানি।

 

২০১৮ ও ২০১৯ সালে এসেছিলেন ভারনন গঞ্জালভেস, অরুণ ফেরেইরা, ভারভারা রাও, বি. অনুরাধা। আজ তাঁরা সবাই রাজনৈতিক বন্দি। কাজেই, জনতার সাহিত্য উৎসব আরও একবার এই কথা জানান দিতে চায় যে, সাহিত্যচর্চা, যখন নেমে আসে মানুষের মধ্যে, প্রতিরোধের মধ্যে, তা আর যাই হোক, নিরাপদ নয়।

 

Share this
Leave a Comment