নাটক তার জন্মকাল থেকেই যেমন বিনোদনের মাধ্যম, তেমনই প্রতিবাদের মাধ্যম। এ দুটি রূপ যে একে অন্যের থেকে সবসময় আলাদা – তাও নয়। এই মুহূর্তে এনআরসি-সিএএ-এনপিআর বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে (কিন্তু শুধু তাতেই সীমাবদ্ধ থেকে নয়) চলছে বেশ কয়েকটি বাংলা নাটকের অভিনয়, যাতে বিনোদন আর প্রতিবাদ অদ্ভুতভাবে মিশে যাচ্ছে। এই নাটকগুলির বিষয় অনেকসময়ই শ্রম ও শ্রমজীবী মানুষ; তার একটা কারণ হয়তো এই যে এনআরসি-সিএএ-র ফলে সবচাইতে ছিন্নভিন্ন হচ্ছেন এই মানুষরাই। নাটকগুলির অধিকাংশ অভিনয়ও হচ্ছে পথেঘাটে-হাটেবাজারে। এই লেখায় এরকম ছ’টি নাটকের কথা বলা হবে ছয় কিস্তিতে, যদিও সব মিলিয়ে এসময় যতগুলি নাটক তৈরি হয়েছে, হচ্ছে, তার সংখ্যা নিশ্চয়ই অনেক বেশি। নাটকের রাস্তা আর রাস্তার নাটক এক জায়গায় মিলে যাচ্ছে। ছাত্র-মেহনতী মানুষ-নাট্যকর্মী-রাজনৈতিক কর্মী পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নাটক দেখছেন, করছেনও। হয়তো এইভাবে তাঁরা একে অন্যের দিনযাপনেও খানিকটা মিশে যেতেও চেষ্টা করছেন। আশাহীন সময়ের এই আলোর ঝলকগুলি নিয়ে লিখেছেন মধুশ্রী বসু।
বইমেলায় ঘুরতে-ঘুরতে একটি ছোট পত্রিকার নতুন সংখ্যা চোখে পড়ল। বিষয় – ‘শিল্প সাহিত্যে শ্রমজীবী মানুষের জীবন ও আন্দোলন’।[1] তাতে একদিকে আছে শিল্প সাহিত্যে বিষয় হিসেবে শ্রমজীবী মানুষের উপস্থিতি নিয়ে আলোচনা,অন্যদিকে শিল্পসাহিত্য সত্যিই কতটা শ্রমজীবী মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে, তার হিসেব নিকেশ। আছে সাহিত্য, সিনেমা, কবিতা, গান নিয়ে কথাবার্তা। হাতে আঁকা ছবিও চোখে পড়ল – তা নিয়ে লেখা না থাকলেও। কিন্তু পত্রিকার একটি স্কোয়ার সেন্টিমিটারও ব্যায় হতে দেখা গেল না পারফর্মেন্স শিল্প নিয়ে।
অথচ প্রতিবাদী শিল্পজগতে নাটকের ঠিকানা দুয়োরাণীর কুঁড়ে নয়, বরং উল্টোটাই। তাই অবাক লাগল। তার উপর এই মুহূর্তে এনআরসি-সিএএ-এনপিআর বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে কলকাতা শহরে চলছে বেশ কয়েকটি নাটকের অভিনয়, যার বিষয় শ্রম ও শ্রমজীবী মানুষ। সেসব নাটকের শো হচ্ছে আগে থাকতে ঠিক করে রাখা স্টেজে বা ঘরে নয়; বরং প্রতিবাদী জমায়েতে, জোড়াতালি দেওয়া মঞ্চে, খেটে খাওয়া মানুষের মাঝেও। নাটকের দলগুলিকে বিশেষ ভাবে খাটতে হচ্ছে ভিড়ে, সভায়, মিছিলে গলা তুলে সংলাপ বলার জন্য, শরীরের ভাষা দিয়ে দর্শকের আগ্রহ টেনে রাখার জন্য।
পশ্চিম বাংলার মাঠে-বাজারে-রাস্তায় চলতি এই নাটকগুলি চাইছে মানুষের প্রতিবাদে সামিল হতে, মানুষের বিপন্নতা ও শোককে বুঝতে, সম্ভব হলে তার স্বাদ ভাগ করে নিতে। ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড থিয়েটারের তত্ত্বের গণ্ডি পেরিয়ে এই নাটকগুলি দেখা প্রয়োজন। এগুলি নিয়ে আরও বেশি করে কথা হওয়া প্রয়োজন। নাটকের ভিতর দিয়ে আরও মানুষের কাছে আসা প্রয়োজন। নানাভাবে একে অন্যকে সাহায্য করা প্রয়োজন।
লিখতে গিয়ে লেখার নাম ভাবতে খানিকটা সময় দিতে হল। আলোচ্য প্রতিটি নাটকই ভীষণ ভাবে ‘এই সময়ের নাটক’ তো বটেই। কিন্তু নাটক মানে তো খালি অভিনয় আর দর্শক নয়। প্রতিটি নাটকের আড়ালে থাকে অনেকখানি ব্যক্তিগত কষ্টস্বীকারের গল্পও। নাটকগুলি উঠেও আসছে কষ্টের জায়গা থেকে। চারদিকের অবস্থা দেখে কষ্ট, কিছু করতে না পারার কষ্ট। আবার এমন একটা ভাষা খুঁজে বেড়াবার কষ্ট, যে ভাষা নিজের ভিতরকার কষ্টকে দর্শকের সামনে তুলে ধরতে পারবে, দর্শকের ভিতরকার কষ্টকে হাসিয়ে-কাঁদিয়ে বার করে আনতে পারবে। এই যে ‘কষ্ট’, এই যে ‘চারদিকের অবস্থা’ – এর অর্থ খালি এনআরসি-সিএএ-মিছিল-লাঠিচার্জ নয়। এ কষ্টের শিকড় অনেক গভীরে, সাধারণ মানুষের নিত্যযাপনে।
তার উপর রাস্তার মানুষকে নাটক দেখাতে গেলে সাহসও তো লাগে! মারের ভয় নয়, ধরপাকড়ের ভয় নয়, তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ভয় অব্দি নয়। ভয় থেকে যায়, মানুষের জীবনমরণ সমস্যাকে গল্পকথার ছলে, তাত্ত্বিক কাটাছেঁড়ার ছলে যেন ছোট না করে ফেলা হয়। শিল্পী যেন তাঁর সহমর্ম বোধকে দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন – উপর থেকে নয়, ভিতর থেকে। সহজ কাজ না। তাই এভাবে পথেঘাটে নাটক করে যাওয়া একভাবে দেখলে ক্রমাগত পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়ার আর সেই মাটি কামড়ে থাকার গল্প।
জানুয়ারি মাসের বারো তারিখে মেটিয়াব্রুজের আকড়া ফটকে, স্থানীয় মানুষের আয়োজনে সিএএ বিরোধী এক অনুষ্ঠানে (‘আমরা ভারতের নাগরিক’) এই নাটকগুলির মধ্যে তিনটির অভিনয় ছিল।[2] কয়েকজন শিল্পী ও ওখানকারই এক স্কুলের বাচ্চা-বড় মিলে কাগজ দিয়ে তৈরি করেছিলেন একখানা মস্ত গাছ। সে গাছে সবার আমন্ত্রণ। সে এক ঝলমলে আনন্দের গাছ। ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই তার নাম দিল ‘সবার গাছ’, ‘রামধনু গাছ’। অথচ, কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই সবার চাইতে ক্ষুদে এক ছাত্রের কাছে সেই গাছই হয়ে উঠল – ‘কষ্টের বৃক্ষ’। কেন, তা বুঝিয়ে বলবার ভাষা তার নেই।
কেন জানি না মনে হল, এই নাটকগুলি যেন সে কষ্টের বৃক্ষেরই এক-একটি ডালপালা। তাই এই নাম।
মধুসূদন দাদা
অঙ্কুরের লেখা, পরিচালিত ও একক অভিনয় করা ‘মধুসূদন দাদা’ নাটকের গত বছর ডিসেম্বর থেকে সাঁইত্রিশ-আটত্রিশটি শো হয়ে গেছে। “বনের পথে একলা বালক” গঙ্গা এ নাটকের ‘হিরো’। তবে গঙ্গা এখন আর কচি ছেলেটি নেই, যাকে কথামৃতের মধুসূদন দাদা নিত্য হাত ধরে ভয়ের বনটুকু পার করে দিত। পিছনে বাজত বাঁশির সুরের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, চন্দন-গন্ধপুষ্পে ম-ম করত পথ। তা’বলে গঙ্গার জীবন থেকে ভয় বিদায় নেয়নি, উল্টে আরও জাঁকিয়ে বসেছে, কারণ এখন তার “দিমাগে ক্যাম্প বসত করে” – ডিটেনশন ক্যাম্প। ঘরামি গঙ্গার নিজের হাতে বানানো মস্ত পাঁচিল ঘেরা ক্যাম্প যেন আসলে ক্যাম্প নয়, যেন গঙ্গার মাথার ভিতরকার এক গভীর বন, যার গোলকধাঁধায় সে নিজেই ঘুরে মরছে। ক্যাম্প নয়, যেন বিনা দোষে গুরুমশায়ের ধেবড়া হাতের কানচাপাটি – একবার খেলে ঘুরে পড়তে হয়, মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা ওঠে। তা গ্যাঁজলার দোষ কি? গঙ্গার নিজের কাছেই নেই নাগরিকত্ব প্রমাণ করার ডকুমেন্ট! তাই নিজেরই গোরে মাটি দিতে-দিতে গঙ্গার মুখে তারস্বরে ত্রাহি মধুসূদন দাদা ডাক। দইয়ের ভাঁড় চাই না, চাই ডকুমেন্ট।
ঘরে ডকুমেন্ট নেই, উল্টে অভাব আছে। বন্যায় সর্বস্ব ভেসে যাওয়া আছে। বাইক অ্যাকসিডেন্ট হয়ে পাকাপাকি ভাবে বসে যাওয়া বুড়ো বাপ আছে। পরের ঘরে গতরে খাটা বউ আছে, যার নিজের সংসারে দম ফেলে রান্না করার সময়টুকুও নেই। যে কিনা গোড়ায় স্বামীর রান্না খেতে লজ্জা পেলেও কালে-কালে দিব্যি গঙ্গার “হাত চেটে খায়!” এসবই সাধারণ মানুষের কথা, ঘর গেরস্থির রসকাব্য। কথকতার ঢঙে লেখা সংলাপ।
সংলাপ রচনার সাবেকী ধরনটি এই নাটকে এসেছে কীর্তনিয়াদের সুর ধরে, যাঁদের শিল্পের রূপ ও বিষয়, অর্থাৎ ফর্ম ও কনটেন্ট, ভক্তিরসে ডুবে আছে। শহরের প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ বা শিল্পীরা সচরাচর সে রসের রসিক নন। ‘মধুসূদন দাদা’ নাটকের এই ঢঙটি কি তাহলে আকস্মিক? উত্তর মিলবে নাট্যকারের নিজের লেখাতেই। যেসব লৌকিক উদাহরণ প্রগতিশীল বক্তৃতায় ঠাঁই পায় না, অথচ যা মানুষকে ভালবাসার কথা বলে, আবার যাকে বিকৃত ও ব্যবহার করে বিরিঞ্চিবাবা থেকে মোহন ভাগবতরা দেশবাসীর মুণ্ডু চিবিয়ে খায়, সেইসব উদাহরণকে অঙ্কুর বারবার উঠে আসতে দেখেছেন কীর্তনের আসরে। আধুনিক কীর্তনিয়া বিউটি মন্ডলের কথা টেনে তিনি লিখেছেন,
“আমি দেখছি বিউটি মন্ডলের দর্শকই আমার দর্শক। শুধু আজাদির ছড়া কেটে এদেরকে ধরা যাবে কি? বিউটি দিদির কাছে শিখতে হবে কিভাবে ধরে রাখা যাচ্ছে দর্শক-কে, টানা দু থেকে আড়াই ঘণ্টা। ফর্ম-কনটেন্ট নারকেলের খোল আর ছোবড়ার মত… একে অন্য থেকে ছাড়ানো যায় না। বিউটি দিদির কথকতার শরীরে সেঁধতে পারলেই হয়ত ওই বিউটিফুল কথকতার কিছুটা সেঁধবে আমার বডিতে, আমার মগজে। বডি মেমরি-তে, মাসল মেমরি-তে। হয়ত অজান্তে।”[3]
বিউটি দিদির আসর দর্শককে টেনে রাখে চুম্বকের মতো। তাঁর ইউটিউব ভিডিওতে সত্তর-আশি লাখ ‘ভিউ’ পড়ে – রাস্তার মানুষের ‘ভিউ’। পথনাটকই হোক বা পথেঘাটে বক্তৃতা – এসব যাঁরা করেন, তাঁরা কি পারবেন এই চুম্বকত্বকে পুরোপুরি অস্বীকার করে দর্শক-হৃদয়কে গভীর ভাবে ছুঁতে?
ভক্তিরসের প্রভাবই হোক বা নাটকীয় মুহূর্ত তৈরির পারদর্শিতা, জেনে হোক বা অজান্তে, এ নাটকের সংলাপে ও শরীরের ভাষায় বারবার একটা মগ্নতার ভাব উঠে আসে, যা হয়তো সত্যিই যেকোনো মানুষকে গভীর ভাবে ছুঁয়ে ফেলবার ক্ষমতা রাখে। নাটকের শেষের দিকে যখন উবু হয়ে বসে, কাতারে-কাতারে খেটে খাওয়া মানুষের যৌথ রান্নাঘরে তরকারি কুটতে-কুটতে গঙ্গা (নাকি কথক?) হাত দুলিয়ে বলে ওঠে – “যা যা যা ভেসে যা, খা খা খুঁটে খা”, সেই প্রায় অর্থহীন সংলাপ মন্ত্রের মতো দর্শককে এক শব্দহীনতার পথে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে – তা এ নাটকের একাধিক পারফর্মেন্সে দেখেছি। অফুরান দইয়ের মতো অফুরান মানুষের যৌথতার কথন শুনতে-শুনতে হঠাৎ মনে হয়েছে নাটক নয়, যেন একটা ব্যক্তিগত আদানপ্রদান। যেন, একটা বিরাট মিছিলে কাতারে-কাতারে মানুষের গলা হঠাৎ একটি কম্পাঙ্কে ধ্বনিত হয়ে উঠল।
তাই ‘মধুসূদন দাদা’ যত না প্রতিবাদী নাটক, তার চাইতেও বেশি সন্ধানী নাটক। পথসন্ধানী, ভাষাসন্ধানী, যৌথতাসন্ধানী… অভিনয় করতে-করতে কাছে বসা দর্শকের চোখে চোখ রেখে, কাঁধে হাত রেখে তাঁকে নাটকের ভিতর টেনে নেওয়ার চেষ্টা থাকছে এই নাটকে। এদিকে যখন পড়শির ঘরে আগুন লাগলে পাশ ফিরে ঘুমোতে শিখতে বাধ্য করা হচ্ছে মানুষকে, ওদিকে তখন থাকছে চোখ বুজে গেয়ে ওঠা – “যৌথযাপন নবী-নারায়ণ / বাতাসে পড়শির খবর / পা চালাও রে ভাই সত্বর।”
তা’বলে ভুললে চলবে না, ‘মধুসূদন দাদা’ নাটকে গল্পের গরু যে গাছে চড়ে ঘাস খায়, তা কিন্তু সেই কষ্টের বৃক্ষ, সত্যকালের বৃক্ষ। তাই গঙ্গা ঠিক খেয়াল রাখে, যে “লোহা পিটিয়ে খালি শাবল হয় না, শেকলও হয়।” ভক্তি নিংড়ে খালি ভালোবাসা হয় না, হিংসাবৃত্তিও হয়। ডকুমেন্ট দিয়ে যেমন নাগরিকত্ব জিতে নেবার সুখ পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় পড়শি হারাবার যন্ত্রণাও। লাভের স্বপ্ন আসলে সর্বনাশের সোপান। এ যেমন ভক্তির কথা, তেমনি সমঝদারিরও কথা। তাই গঙ্গা, মধুসূদন দাদার সন্ধান দেওয়া স্বপ্নের দেশকে কাঁচকলা দেখিয়ে সবাই মিলে ডকুমেন্ট না দেখানোর ডাক দিয়ে ওঠে।
কলকাতার যে নাটক দলের সাথে অঙ্কুর সবচাইতে বেশি জড়িয়ে আছেন, সেই ‘স্বভাব নাটক দল’-এর একটি পুরনো নাটক ‘বিশ্বকর্মা’য়, ন্যায্য কাজে ন্যায্য মজুরির স্বপ্ন দেখে বিভুঁইয়ে নোকরি করতে গিয়ে মেশিনের পেটে যায় এক শ্রমিক। ‘মধুসূদন দাদা’ নাটকে সেই শ্রমিকই কিন্তু ধরে ফেলে, কীভাবে মেহনতী মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে নিজের পকেট ভরায় ব্যবসায়ী কোম্পানিরা। তাই এ নাটকে বিশ্বকর্মারা প্রতিবাদে এককাট্টা হয়। যৌথ শ্রম দিয়ে এক সাম্যবাদী, সহমর্মী সমাজ গড়ে তোলার ডাক দেয়।
‘স্বভাব’ ও অন্যান্য নানা দলের সাথে কাজ করার মধ্যে দিয়ে নাটকের একটা পাকাপোক্ত দল গড়ে তোলার যে বহুদিনের যৌথতামুখী দর্শন অঙ্কুর ও তাঁর সহকর্মীদের, এই নাটকে তারও ছায়া ভেসে ওঠে। অঙ্কুরের মতে, এই যৌথতা আসলে শ্রমজীবী মানুষের পারস্পরিক বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এই বিশ্বাসের ম্যাজিকে ভর করেই সকালবেলার মাছের বাজারের চাতাল দুপুরবেলা রিকশাওয়ালার ভাতঘুমের বিছানা বা সন্ধেবেলা পথনাটকের মঞ্চ বা যা-ইচ্ছে-তাই হয়ে উঠতে পারে। এই বিশ্বাস খাটা পায়খানার প্রেক্ষাপটে বা বামপন্থী সভার স্লোগানের মাঝখানে বা মাজারের গেটে আপেলগন্ধী শিখিপাখা গোঁজা মধুসূদন দাদার আবির্ভাবের মধ্যে কোমর বেঁধে বৈপরীত্য খুঁজতে যায় না, আদৌ নিলে ক্ষীরটুকুই চেঁছে নেয়। নাটকের শেষে দর্শকের সামনে গামছা বিছিয়ে টাকা-পয়সা-চাল-সবজি যে যেমন পারেন ছাঁদা বেঁধে তোলাটিও সেই যৌথযাপনের অঙ্গ।
গঙ্গা যদি এ নাটকের হিরো, মধুসূদন দাদা তবে এ নাটকের কে? সে কি ফেকু? দুমুখো দালাল? ভিলেন? ভগবান? যেই হোক না কেন, ‘শোক যখন সবাইকে এক করে’, তখন ছোট-ছোট দইয়ের ভাঁড় শিকেয় তুলে মধুসূদন দাদাকে দিয়ে ঘড়া-ঘড়া জল টানিয়ে ছাড়ে গঙ্গা। এমনি ভাবেই, কথামৃতের গল্প উল্টে দিয়ে, তিলকে তাল করে, মোহন বাঁশি আর ডুবকির সাথে কাশ্মীর-কি কলির অ্যাকর্ডিয়নের সঙ্গত করে লীলা চলে এ নাটকের।
প্রতিবাদী মঞ্চগুলি ছাড়াও নানান জায়গায় অভিনীত হয়েছে এই নাটক। বজবজ দশ নম্বর গেটের কাছে শো হয় স্থানীয় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায়, মাজারের একদম সামনে, যেখানে নাকি নাটক করার পারমিশন পাবার কথা ভাবাই যায় না। আলটপকা শো হয় বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে – শাসক দলের বিরোধিতা ছাপিয়ে উঠে আসে সাধারণ দর্শকের আগ্রহ-সমঝদারি। এমনই আরেকটি শো-তে উপস্থিত থাকার পর ধুবুলিয়াবাসী এক ছাত্র লেখেন, ‘মধুসূদন দাদা’ নাটক এক শীতের বিকেলে মাদারিদের মতো দর্শকদের চোখ বন্ধক রেখেছিল। মফস্বলের নাম-না-জানা মহিলা-পুরুষ-বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সাথে নাটকের খুঁটিনাটি নিয়ে কথোপকথন, শহরতলির রাজনীতিবিমুখ যুবকের নিজের উৎসাহে বাইকে চড়িয়ে স্টেশনে পৌঁছে দেওয়া, শহুরে রাজনৈতিক কর্মীর মুগ্ধতায় ভাষা হারিয়ে ফেলা – মধুসূদন দাদার জগতে এসমস্তটার যতটা হৃদয়বৃত্তি, ততটাই রাজনীতি।
সেই একই সুর শোনা যায় অঙ্কুরের এক সহনাট্যকর্মীর গলায় – “খালি ঝান্ডা তোলা নয়, একসাথে বসে খাওয়াটাও রাজনৈতিক, একসাথে গোরে মাটি দেওয়াটাও সাংগঠনিক কর্মসূচি হয়ে উঠতে পারে।” কীভাবে? সত্যিই কি নাটক কোনো রাজনৈতিক পথের সন্ধান দিতে পারে? তা নিয়ে বিতর্ক করার আগে দেখতে হবে নাটক – ‘মধুসূদন দাদা’।
লেখক নাচ, আঁকাআঁকি এবং লেখালেখি করেন।
…
[1] ‘শিল্প-সাহিত্যে শ্রমজীবী মানুষের জীবন ও আন্দোলন / তারুণ্যের বিদ্রোহ ও শ্রমজীবীদের সংগঠিত প্রতিবাদ’, শ্রমজীবী ভাষা, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ভল্যুম ১০, ইশ্যু ৫।
[2] ‘মধুসূদন দাদা’, ‘ভুল রাস্তা’ ও ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ’।
[3] ‘মুক্ত থিয়েটারের রাজনীতি’, কালি কলম ও ইজেল, একাদশ সংখ্যা।