হৈ হৈ করে চলছে ৪৪তম আর্ন্তজাতিক পুস্তকমেলা। কিন্তু সবাই কি সেই মেলায় একইরকমভাবে অংশগ্রহণ করতে পারছেন? বইপ্রেমী প্রতিবন্ধী মানুষেরা, যারা নানা জায়গা থেকে এই মেলায় আসছেন বা আসতে চাইছেন তাদের জন্য এই মেলা বিগত সব বছরের মতোই অত্যন্ত অসুবিধাজনক। প্রতিবন্ধকতা অধিকার আন্দোলনকর্মী অধ্যাপক ডঃ বুবাই বাগ লিখছেন তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে।
উন্নত দেশগুলির থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলি অর্থনৈতিক পরিসরের থেকেও মানসিক পরিসরে বহুযোজন দূরে অবস্থান করে তার প্রমাণ পাওয়া গেল ৪৪তম আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলায় যা এশিয়ার সর্ববৃহত্তমও বটে। আট লক্ষ বর্গফুট এলাকা জুড়ে সল্টলেক-এর সেন্ট্রাল পার্কে অনুষ্ঠিত এই মেলায় দেশ বিদেশের একাধিক স্টলের মধ্যে ব্যতিক্রম দেখা গেল ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সসহ একাধিক প্রথম সারির দেশগুলির স্টলে। অন্যদিকে বাংলাদেশসহ ভারতের অধিকাংশ স্টলে চোখে পড়ল সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য যা আমাদের মত প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের প্রাত্যহিক মুখোমুখি হতে হয়। স্টলে প্রবেশের মুখে উঁচু দন্ডায়মান সিঁড়ি বুঝিয়ে দিল ভারতের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের প্রবেশের সীমা/পরিসীমা। অথচ একই স্থানে অবস্থিত উন্নত দেশগুলির ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা গেল না। সেখানে সিঁড়ির পরিবর্তে র্যাম্পের ব্যবস্থা ও প্রশস্ত দরজা বুঝিয়ে দেয় সকল মানুষদের প্রবেশে বাধা বা প্রতিবন্ধকতা নেই।
এখানেই প্রশ্ন আসে গিল্ড-এর উদ্যোগে স্থানীয় কারিগরদের দ্বারা নির্মিত বিভিন্ন দেশের স্টলের মধ্যে পরিবেশগত এই বিভাজনের কারণ কী? তবে কি মেলার আয়োজক গিল্ড প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের পাঠক বা ক্রেতা হিসেবে বিবেচনার মধ্যে নিয়ে আসেন না? নাকি এই চিত্র আসলে ভারতের বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে প্রতিবন্ধকতার সার্বিক অবস্থানকেই চিহ্নিত করে?
সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্ক (যেখানে বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে) মোটের ওপর সুগম্য। মেলা প্রাঙ্গনের নয়টি মূল গেট দিয়ে খুব সহজে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষেরা প্রবেশ করতে পারে। প্রবেশ করা মাত্রই বুঝতে পারা যায় ৪৪ বছরেও গিল্ডের কর্মকর্তাগণ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের বা বয়স্ক মানুষদের (প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের সঙ্গে বয়স্ক মানুষেরাও একই অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে থাকে বলে মনে হয়) এখনও পাঠক হিসেবে বিবেচনার মধ্যে নিয়ে আসেননি। যে কোনও গেট দিয়ে অনেকটা হেঁটে গিল্ড অফিস সহজে খুঁজে পাওয়া গেলেও হুইলচেয়ার কিন্তু খুব সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না। গিল্ড অফিস বলবে পুলিশের কাছে খোঁজ নাও, আবার পুলিশ বলবে গিল্ড অফিসে যাও। অনেক ঘোরাঘুরির পর জানা গেল সমগ্র বইমেলায় একটি মাত্র হুইলচেয়ার রয়েছে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রে যা শুধুমাত্র জরুরী প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে। ফলে একজন চলনজনিত প্রতিবন্ধকতাযুক্ত পাঠক কীভাবে আট লক্ষ বর্গফুট অতিক্রম করবে সেই প্রশ্নের উত্তর অজানা রয়ে যায়।
ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোনও পাঠক হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা করলেও তার পক্ষে সুগম্যভাবে যাতায়াত করা কষ্টকর হয়ে ওঠে। অধিকাংশ স্টলের সামনে দু’তিনটি অসমান উচুঁ সিঁড়ি। সংকীর্ণ দরজা দিয়ে হুইলচেয়ার বাহক বা ক্রাচবাহক পাঠকের প্রবেশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা দেখা যায়। প্রতি বছরের মত এবারেও মেলায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী তাদের স্টল দিয়েছে, যা মেলার প্রবেশের ১নং গেটের সামনে অবস্থিত। রাজ্যে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের অধিকার প্রদানে লড়াই করে যাওয়া এই সংগঠনের স্টল সমতল থেকে দুই ফুট উঁচুতে। সেখানেও বাধাহীনভাবে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ প্রবেশ করতে পারবে না । সর্বোপরি মেলাপ্রাঙ্গণে প্রতিবন্ধী বান্ধব শৌচালয়ের অনুপস্থিতি প্রতিবন্ধকতাযুক্ত পাঠকদের মনে বৈষম্য বা বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি করে। ফলে বাস্তবিক প্রেক্ষাপটের মত মেলাপ্রাঙ্গণেও পরিকাঠামোগত অভাব প্রতিবন্ধকতার অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কিত ভ্রান্তধারণার প্রেক্ষাপটে অনেকে প্রতিবন্ধকতার দৃশ্যমানতার অভাব বা জনপরিসরে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের অনুপস্থিতিকেই দায়ী করে থাকেন। বইমেলার মত বৃহৎ জনপরিসরে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের উপস্থিতি নিঃসন্দেহে প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কিত সচেতনতা বা সদর্থক চেতনার বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারত। কিন্তু প্রগতিশীল প্রকাশক বা গিল্ড-এর কর্মকর্তারা প্রতিবন্ধকতার প্রতি চিরাচরিত সংকীর্ণ মানসিকতার দ্বারা এমনভাবে আচ্ছন্ন থেকে গেছেন যে প্রতিবন্ধকতযুক্ত বা বয়স্ক মানুষেরা পাঠক বা ক্রেতা হতে পারে, তা তাঁদের কল্পনাতীত। গত কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবন্ধকতার অবস্থার পরিবর্তনে ‘মানবিক’ প্রকল্প গৃহীত হয়েছে, আগামীতে আমরা রাজ্যের অন্যতম প্রগতিশীল প্রকাশকদের সেই ধরণের মানবিক মুখ দেখতে পাব আশা করা যায়। বর্তমান পুঁজিবাদী সর্বব্যাপিতার যুগে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষেরা যে ক্রমে উপভোক্তায় পরিণত হচ্ছে তা কি অস্বীকার করা যায়!
লেখক সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বাগনান কলেজ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) এবং একজন প্রতিবন্ধকতা অধিকার আন্দোলন কর্মী