তরুণ লেখক ছুদেন কাবিমোর উপন্যাস ‘ফাৎসুঙ্’ — দার্জিলিং পাহাড়ের মাটির কথা, তারই এক আখ্যান। এক অসম লড়াইয়ের ইতিকথা। বিশ্বাসঘাতকতার কাছে অসীম বীরত্বের হেরে যাওয়ার কথা। প্রায় তিন দশকের গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন এই উপন্যাসের পটভূমি হলেও — তার সার্বিক চিত্রটিকে ছুদেন পাহাড়জোড়া ভাস্কর্যে রূপ দিতে চাননি তাঁর ক্যানভাস ছোট কিন্তু গুহাচিত্রের মতো মরমী, আন্তরিক। লিখেছেন দেবাশিস আইচ।
শিক্ষাহীন, বিদ্যুৎহীন, ক্ষুধার্ত গ্রাম ছেড়ে চলেছে একদল কিশোর ও তরুণ। প্রায় সকলেই স্কুল পালানোর দল। তাদের নেতা ফেল্টার হ্যাট পরা এক প্রাক্তন ফৌজি তবে সেও কাজ ছেড়ে একরকম পালিয়েই এসেছে। তাদের গন্তব্য দার্জিলিং। পাহাড়ের মাথায় তাদের গ্রাম। নীচে অনেক নীচে পিচঢালা রাস্তা থেকে দূরে ওই গাঁয়ে চক্রযানে যাওয়ার কোনও পথ নেই। পায়ে পায়ে পৌঁছতে হয় চোরাবাটো ধরে, চড়াই-উতরাই বেয়ে বেয়ে। দার্জিলিং শহরে বড় সভার ডাক দিয়েছেন সুবাস ঘিসিং। আলাদা রাজ্যের ডাক দিয়েছেন। সেই ডাক এসে পৌঁছেছে কালিম্পঙের এই প্রত্যন্ত গ্রামেও।
পথ চলতে চলতে পেশকে এসে খানিক জিরিয়ে নিতে নিতে ছেলেপিলেদের গ্রামতুতো দাজু লাছিরিং বলে, “আসলে বলতে গেলে এটা তো আর পেশক নয় — এটা হল পোজক, বুঝলে? পোজক। লেপচা ভাষায় এর মানে হল জঙ্গল। আর ওটাও তিস্তা নয় কিন্তু। আসলটা হল থী সথা (ত্রিস্রোতা), জানো তো?” এভাবেই দার্জিলিং যে ‘দার্জ্যোল্যাঙ্’, যার অর্থ — ‘যে-জায়গায় ভগবানও হাসে।’ কার্শিয়াং প্রকৃত উচ্চারণে ‘খর্সাঙ’, লেপচা ভাষায় যার অর্থ অর্কিডের ফুল। কালিম্পং কালেবুঙ আসলে ‘কালেনপোঙ্’, লেপচা সমাজের জড়ো হওয়ার স্থান।
কোনও মানবসমাজ, কোনও জাতি যখন আত্মনিয়ন্ত্রণের, রাজনৈতিক-আর্থনীতিক স্বাধীনতার ভাবনায় জারিত হয়, তখন অতীতচারণ, অতীতচিহ্ন, গৌরবগাথা, হারিয়ে যাওয়া ভাষা এভাবেই আত্মপ্রকাশ করে। ইংরেজের উপনিবেশ, ইংল্যান্ডের ‘নস্ট্যালজিয়া’ থেকে বাঙালির, বাংলার ‘অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’ হয়ে ওঠা দার্জিলিং আজ ১১২ বছর হল নিজের পথ নিজে বুঝে নিতে চেয়েছে। যে পথ খোঁজার, যে পথ চলার আজও শেষ হয়নি। তরুণ লেখক ছুদেন কাবিমোর উপন্যাস ‘ফাৎসুঙ্’ — দার্জিলিং পাহাড়ের মাটির কথা, তারই এক আখ্যান। এক অসম লড়াইয়ের ইতিকথা। বিশ্বাসঘাতকতার কাছে অসীম বীরত্বের হেরে যাওয়ার কথা। প্রায় তিন দশকের গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন এই উপন্যাসের পটভূমি হলেও — তার সার্বিক চিত্রটিকে ছুদেন পাহাড়জোড়া ভাস্কর্যে রূপ দিতে চাননি তাঁর ক্যানভাস ছোট কিন্তু গুহাচিত্রের মতো মরমী, আন্তরিক। লেখকের ভাষায়, “দার্জিলিং বললেই মানুষের মনে একটা সুন্দর ছবি ভেসে ওঠে। পাহাড়ের রানি ভেবে নেই আমরা। কিন্তু, দার্জিলিংয়ের ভেতরেই আছে অনেক ছোট ছোট দার্জিলিং। যেখানকার মানুষ দার্জিলিং পাহাড়ে জন্মেও দার্জিলিং শহর না-দেখেও মরে যায়। যেখানে বিদ্যুৎ নেই, রাস্তা নেই, স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, স্কুল নেই। আমি সেরকমই একটা ছোট্ট জায়গায় জন্মানো একজন মানুষ। যেখানে আজও অপর্যাপ্ততা আর অভাবের পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। ‘ফাৎসুঙ’ আসলে সেই ছোট-ছোট পাহাড়গুলোর গল্প।” এই দার্জিলিংকে আমরা চিনি না। আমরা ‘ট্যুরিস্ট-ট্যুরিস্ট’, ‘ট্রেকিং-ট্রেকিং’ বাঙালি শুধুই নয়, বাঙালির বহু বহু প্রাতঃস্মরণীয় আইকনরাও নন। সে কথাটি এ বেলা সেরে নেওয়া যাক।
৮ অগস্ট ২০১৭, আনন্দবাজার পত্রিকা-র ‘সম্পাদক সমীপেষু’ বিভাগে ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্রের একটি চিঠি আমাদের সে কথার উৎস, যা ২০ জুলাই ওই পত্রিকায় প্রকাশিত সাহিত্যিক বিমল লামার ‘আবেগ যেন শুধু পাহাড়েই’ শীর্ষক উত্তর সম্পাদকীয় অনুপ্রাণিত।
“বিমল লামার রচনাটি (‘আবেগ যেন শুধু…’, ২০-৭) পড়তে পড়তে প্রায় সত্তর বছর আগে এক সমতলবাসী বাঙালি মেধাজীবী শশিভূষণ দাশগুপ্তের নির্মোহ প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধের কথা মনে পড়ল, ‘শার্দুলগিরির অরুণোদয়’ নামে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ বিশ্লেষণী লেখাটি ফিরে পড়লাম। তাঁর মতে, পাহাড়ে এক দঙ্গল উন্নাসিক দেশি সাহেবি সমাজের আচার ও কৃষ্টির দাপটে গোটা ‘দার্জিলিং শহরটা’ই’ ‘আত্মকেন্দ্রিকতার বিলাসভূমি’ হয়ে গেছে, গিরিশ্রেণির ফাঁকে ছোট বসতিগুলিতে যে লোকগুলোর বাস, তাদের কথা একদম জানা বা শোনাই যায় না। কেবল বঙ্গভূমি নয়, সারা দেশের সঙ্গেই ‘এই দার্জিলিং শহরের যেন কোন অচ্ছেদ্য যোগ নেই।’
পাহাড়ি জনকীর্তির প্রতি সমতলবাসীর অজ্ঞতাই শশিভূষণের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল, জাতি-বিদ্বেষের সম্ভাবনাও তাঁর চোখ এড়ায়নি। খেয়াল হয় যে, রবীন্দ্রনাথ থেকে রঞ্জন-এর লেখায় সমৃদ্ধ বাঙালির বিশ শতকীয় সাহিত্যে মনে রাখার মতো গোর্খা চরিত্র দারোয়ান উজরে সিং থাপা। তার সঙ্গে অমায়িক কথপোকথনটি সেরে বুদ্ধিমান বাঙালি ব্যোমকেশ মন্তব্য করেন, ‘উজরে সিং লোকটা হয় নিরেট বোকা, নয় আমার চেয়ে বুদ্ধিমান।’ বাঙালি-নেপালি আলাপের আদর্শ সাহিত্যিক বয়ান, উচ্চমন্যতার গুমোরে ভরে।”
আমরা যদি হরিমোহন সান্যালের ‘দারজিলিঙ্গের ইতিহাস’ (১৮৮০), তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দার্জ্জিলিঙ্গ-প্রবাসীর পত্র’ (১৮৯৫), উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির ১৮৯১ সাল থেকে ‘দার্জিলিং’, ‘মেঘের মুলুক’ শীর্ষক দাজিলিং ভ্রমণের নানা স্মৃতিকথা — যা মূলত ভ্রমণকাহিনি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা — চলার পথে যেটুকু ভোট-গোর্খা-লেপচাদের সঙ্গে চোখ চাওয়া-চাওয়ি সেটুকুই তাদের লিখে রাখা। ইতিহাসে ততদিনে ইংরেজ রাজপুরুষরা যথা, কর্নেল লয়েড, ড. হুকার, ড. ক্যাম্বেলরা এই অঞ্চলের রাজনৈতিক-প্রাকৃতিক ইতিবৃত্ত, জনসমাজের বৃত্তান্ত নথিভুক্ত করে ফেলেছিলেন। তৎকালীন পূর্ত দফতরের ওভারসিয়ার হরিমোহন সান্যাল সেই তথ্যের উপর ভিত্তি করেই প্রথম বাংলায় দার্জিলিঙের ইতিহাস রচনা করেন। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত নলিনীকান্ত মজুমদারের ‘সচিত্র দার্জ্জিলিংএর পার্ব্বত্যজাতি’ সম্ভবত পাহাড়িয়া জনগোষ্ঠী বিষয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম লিখিত সামাজিক-নৃতাত্ত্বিক কাহিনি। এই রচনাগুলিতে জাতি-বিদ্বেষের ছাপ না পাওয়া গেলেও পাহাড়িয়া জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে ‘হাসিখুশি, পরিশ্রমী জাতি’ ছাড়া খুব একটা প্রশংসাসূচক বিশেষণের খোঁজ মেলে না। এই উচ্চমার্গের বাঙালি লেখকদের সঙ্গে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর খুব একটা অন্তরের যোগও খুঁজে পাওয়া যায় না। দার্জিলিং নিয়ে সম্ভবত প্রথম অন্য এক স্বর, এক সংবেদনশীল বাঙালি লেখকের স্বর পাওয়া গেল ‘দার্জিলি: স্মৃতি সমাজ ভবিষ্যৎ’ গ্রন্থে। লেখক পরিমল ভট্টাচার্য। কিন্তু সে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
বাঙালির সেই ট্রাডিশন কিন্তু বহমান। আর তারই মাঝে এক বিস্ময় নেপালি উপন্যাস ‘ফাৎসুঙ’ বাংলা অনুবাদে হাতে পাওয়া। অনুবাদক শমীক চক্রবর্তী কলকাতার বাসিন্দা হলেও তিনি সর্বসময়ের ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী এবং তাঁর প্রধান সাংগঠনিক কর্মস্থল দার্জিলিং ও ডুয়ার্সের চা-বাগান। ‘লেখকের কলমে’ ছুদেন কাবিমো জানাচ্ছেন, “আসলে শমীক আজ আমাদের জন্য শুধু অনুবাদকই নন, উনি একটা সেতুও বটে, যিনি নেপালি ভাষাকে বাংলা ভাষার সাথে যোগসূত্রে বেঁধে দিয়েছেন।” প্রসঙ্গত দার্জিলিং, গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের পটভূমিকায় লেখা বিমল লামার প্রখ্যাত উপন্যাস ‘নুন চা’ বাংলা ভাষায় লেখা।
১৯৮০ সালে সুবাস ঘিসিংয়ের নেতৃত্বে গঠিত হয় গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট বা জিএনএলএফ। দু’তিনটি ঘটনা এই সময় জিএনএলএফ গঠনে বড় ভূমিকা নেয়। এক, ১৯৭৮ সালে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই সদ্যগঠিত বামফ্রন্ট সরকারের দার্জিলিংকে স্বশাসিত অঞ্চল বা অটোনমাস রিজিয়ন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। দুই, ওই একইসময়ে দার্জিলিংয়ে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নেপালিভাষীদের নেপালে ফিরে যেতে বলেন। এর পাশাপাশি উত্তরপূর্ব ভারত ও উত্তর ভারতের কোনও কোনও রাজ্যে নেপালি বিরোধিতা ও বিতাড়ন শুরু হয়। তার গভীর প্রভাব পড়ে দার্জিলিঙের পাহাড়ে। আশি সালে গঠিত হলেও প্রথম বড়সড় আন্দোলন শুরু হয় ১৯৮৬ সালে। সে বছর ১৩ এপ্রিল পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গঠন ও ১৯৫০ সালের ভারত-নেপাল চুক্তি খারিজের দাবিতে জিএনএলএফের আন্দোলন শুরু হয়। পয়লা মে দার্জিলিং শহরে বিশাল মিছিল সংগঠিত হয়। ১২ মে ৭২ ঘণ্টা পাহাড় বন্ধের শুরু। অশান্তির জেরে পুলিশের গুলিতে একজনের মৃত্যু হয়। আহত সাত। ২৫ মে কার্শিয়াঙে আরও পাঁচজন জিএনএলএফ কর্মী পুলিশের গুলিতে মারা যায়। আহত ২২। ২৬ মে সেনা সতর্ক, বিএসএফ মোতায়েন। ২৭ জুলাইয়ে কালিম্পঙে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় আট জনের। জিএনএলএফ কর্মীদের খুকুরির আঘাতে মৃত্যু হয় এক সিআইএসএফ জওয়ানের। আহত হন ডিআইজি (সিআইডি) কমল মজুমদার-সহ ৩০ জন। ২৮ মে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫। ১০৮ ঘণ্টা পাহাড় বনধ শুরু । উলটোদিকে আক্রান্ত হতে থাকে সিপিএম কর্মী-নেতারা। ৭ সেপ্টেম্বর সোনাদায় সিপিএম সাংসদ আনন্দ পাঠকের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। অক্টোবরে বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয় ওই দলের দার্জিলিঙের দলীয় দপ্তর। চোরাগোপ্তা আক্রান্ত হতে থাকে সিপিএম দলের সদস্যরা কারও কারও মৃত্যুও হয়। একের পর এলাকায় জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ঘরবাড়ি। (আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, প্রসঙ্গ গোর্খাল্যান্ড, ১৯৮৭)। এই সময়টি আলোচ্য উপন্যাসের পটভূমি।
উপন্যাস শুরু হয় সাম্প্রতিক এক সময়ে পাহাড়ে প্রবল ভূমিকম্প এবং দূর পাহাড়ি গাঁয়ে ধস নেমে আখ্যায়কের বাল্যবন্ধু রিপদেনের সম্ভাব্য মৃত্যুর সংবাদের মধ্য দিয়ে। ধস থেকে সেনাবাহিনী তিনটে লাশ উদ্ধার করেছে। রিপদেনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর লাশ না-মিললে ক্ষতিপূরণও মিলবে না। গ্রামবাসীদের তাই আকুল আবেদন, রিপদেনের নামটা খবরের কাগজে তুলে দিতে হবে। আর এই ভয়াবহ সংবাদ, রিপদেনের খোঁজে দুর্গম গাঁয়ে ফিরে ক্রমে পরতে পরতে খুলে যায় কত শত স্মৃতি। গ্রাম, গ্রামের স্কুল, রিপদেন, রিপদেনের ডাকাবুকো বাপ নোর্দেন আর আন্দোলনের এক তুঙ্গ সময়ে নোর্দেনের হারিয়ে যাওয়া। আখ্যান ক্রমে চারিয়ে যেতে থাকে বাল্যবন্ধুর দুষ্টুমি থেকে স্কুল পালানোর গল্পে। স্কুলই বটে। বাঁশের কঞ্চির বেড়া চারদিকে ভাঙা। ফলে যেদিক দিয়ে খুশি যেমন খুশি পালানো যেত। রিপদেন মন্ত্র দিয়েছিল, পড়াশোনায় লাভ নেই, লাঙল চালিয়ে ভাত খাব। একদিন ধরা পড়ে জুটল শাস্তি। এবার আর স্কুলেই গেল না রিপদেন। ছাগল চড়ানো শুরু করল। রিপদেনের মা ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল চার বছর বয়সে। ছিয়াশির আন্দোলনে যোগ দিয়ে বাবা নোর্দেন আর বাড়ি ফেরেনি। নোর্দেনের আপাও তো হারিয়ে গিয়েছিলেন। সে এক করুণ কাহিনি। নোর্দেন তখন তিন ক্লাসে উঠেছে। আপা মাস্টারের কাছে সে কথা শোনার পর প্রথমে খুব খুশি হলেন। কিন্তু ছেলে তো নিজের নামটা লিখতে শেখেনি। ‘কী লাভ এই পড়াশোনায়?’ ভয়ংকর রেগে মাস্টারের টেবিল ঘুষি মেরে জিজ্ঞাসা করলেন, “স্যার কী পড়াও তোমরা, অ্যাঁ? খোকা তিনে পৌঁছে গেল, তবুও তো ও নিজের নামটা লিখতে শেখেনি।” স্যার, তাঁর এই আচরণে রেগে গিয়ে ‘পুলিশ কেস’ দেওয়ার ভয় দেখালেন। সেই রাতেই হারিয়ে গেলেন নোর্দেনের আপা। একদিন বাবার খোঁজে বেরিয়ে পড়ল রিপদেন। এই খোঁজের মধ্য দিয়েই ক্রমে উঠে এল আন্দোলনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ইতিহাস।
গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন এবং তার সামগ্রিকতাকে উপজীব্য করে এই উপন্যাস রচিত হয়নি। এটি তার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ — দার্জিলিং কিংবা কালিম্পং শহর ছাড়িয়ে ঢের দূর পাহাড়ের, জঙ্গল ঘেরা এক দুর্গম গ্রামেও কীভাবে পৌঁছে গিয়েছিল মাটির স্বপ্ন, ‘ফাৎসুঙ’ সেই স্বপ্নের কথা বলে। উপন্যাসের নামকরণেই তা স্পষ্ট। ‘ফাৎসুঙ’ একটি লেপচা শব্দ, অর্থ মাটির কথা। ছোট ছোট আঁচড়ে সেই সরল, পরিশ্রমী, গরিব মানুষদের দিন আনি দিন খাই জীবনটাও লেখক অনায়াসে এঁকে ফেলেন স্রেফ বিনা আয়াসে। কেননা, এই পৃথিবীটির সঙ্গে, এই মানুষদের সঙ্গে তাঁর নাড়ির যোগ রয়ে গিয়েছে। যে টুকরো টুকরো স্লোগানে তিনি আন্দোলনের প্রতি মানুষের সহমর্মিতাকে তুলে ধরেন সেখানেও মাটির গন্ধ মাখা। ‘পার্টির চেয়ে জাতি বড়, জাতির চেয়ে মাটি’ কিংবা “মাটির তিলক হল রাজতিলক/ মাটির তিলক হল রানিতিলক।’ কিংবা ‘আলু কাটি তরকারি তামালাই, নচলাউনু গোর্খালি আমালাই।” বাংলা করলে দাঁড়ায়, তামার বা বাঁশের অঙ্কুরের তরকারির জন্য আলু কেটো, কিন্তু ঘাঁটিও না গোর্খালি মা-কে। সেই মাটির তিলক পরার দিনের ডাক ছড়িয়ে পড়েছিল পাহাড় থেকে পাহাড়ে। এই উপন্যাসের কুশীলবরা সব এই মাটির মানুষ, যারা অনায়াসে প্রাণ দেয়, প্রাণ নেয়ও।
ছিয়াশির গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের যেমন ২৭ জুলাই তারিখে কালিম্পঙে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, গুলি চালনা অন্তত ১৫ জনের মৃত্যুর মতো বড় ঘটনা ছুঁয়ে গেছেন কিন্তু রচনা আবর্তিত হয়েছে, ‘চিফ’-কে ঘিরেই। চিফ আর তার ‘গোর্খাল্যান্ড ভলান্টিয়ার্স কমিটি’ বা জেভিসির সশস্ত্র আন্দোলনের প্রচেষ্টাকে ঘিরে। ফেল্টার হ্যাট, দূর অরণ্যে ঘাঁটি বা ক্যাম্প তৈরি করে গেরিলা কায়দায় আক্রমণ — আমাদের ওই সময়ের আন্দোলনের জঙ্গি নেতা ছত্রে সুব্বার কথা মনে করিয়ে দেয়। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ‘চিফ’-এর সঙ্গে জিএনএলএফ-এর প্রধান সুবাস ঘিসিংয়ের বিরোধ বাঁধলে — একদিকে জিএনএলএফ অন্যদিকে প্রশাসনের যৌথ চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল চিফের জেভিসি। এই অন্তর্দ্বন্দ্বও ফুটে উঠেছে উপন্যাসে। আর এখানেই বিতর্কিত হয়ে উঠেছে এই উপন্যাস।
বিতর্কিত হওয়ার আরও এক কারণও আছে বটে। নতুন রাজ্যের নামকরণ নিয়ে যে পাহাড়ের আদি বাসিন্দা শিক্ষিত লেপচাদের মধ্যে যে একটা কিন্তু কিন্তু ভাব ছিল তা বেরিয়ে আসে চিফ ঘনিষ্ঠ লাছিরিঙের এক আলোচনায়। আলাদা রাজ্যের পক্ষে মত আন্দোলনকারীদের কিন্তু নামটা দার্জিলি থাকলে ক্ষতি কী হত। লাছিরিঙের বয়ানে যুক্তিটা এরকম, পাহাড়ের ইতিহাস ‘লেপচাদের সঙ্গে জোড়া’। “তিব্বতীরা এল, আর লেপচাদের লিখিত ইতিহাস শেষ করে দিল। ভুটানিরা এল লেপচাদের রাজাকে মেরে দিল। এখন এরকম আর কত বার লেপচাদের মরতে হবে?” এই মনোবেদনা লেপচাদের বহুযুগের। এক্ষেত্রে মনে পড়ছে প্রয়াত অন্নদাশঙ্কর রায়ের কথা। তিনি মনে করতেন, “…দার্জিলিং জেলার তিনটি মহকুমার নেপালি, ভুটিয়া, লেপচা, বাঙালি নাগরিকদের গণভোটের উপর ছেড়ে দিতে হবে। তবে, গোর্খাল্যান্ড নামটি তাঁর পছন্দ ছিল না। লেপচা ও মেচরা যে পাহাড়ের আদি বাসিন্দা সে বিষয়ে তিনি অনেক বেশি সচেতন ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “গোর্খারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারে, কিন্তু অন্যেরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হতে রাজি হবে কেন?” তিনি একটি নামও প্রস্তাব করেছিলেন। আর তা হল “হিমাল চুলী” বা হিমালয় কন্যা। (সূত্র: প্রসঙ্গ গোর্খাল্যান্ড।)
এই উপন্যাস নেপালি ও বাংলা সাহিত্যের এক সেতু রচিত হল বটে কিন্তু, পাহাড়ের মাটির আবেগ আর সমতলের ‘অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’র আবেগের মাঝে সেতু রচনা করবে কে? মল, টাইগার হিলে সূর্যোদয়, সান্দাকফু আর বরফপাতের বাইরে বাঙালির সত্যি কী দার্জিলিং নিয়ে কোনও আবেগ রয়েছে? মনে হয় না। বাংলা সংবাদমাধ্যমের তো সেই এক রা। না হলে, বিমল গুরুঙের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সাম্প্রতিক বনধ ৪০ দিন পার হয়ে গেলেও টুরিস্ট বাঙালির আর বাংলা সংবাদমাধ্যমের একটাই আক্ষেপ — আহারে বেড়াতে যাওয়া হল না। ৪০ দিন পাহাড়ের মানুষগুলো কী খাচ্ছে, কী পরছে তা নিয়ে কোনও প্রতিবেদন চোখে পড়ে না। সেই আক্ষেপই ঝরে পড়ে বিমল লামার কলমে। “এই বনধ তো একদিন না একদিন শেষ হয়ে যাবেই।…একশো দশ বছরের ইতিহাসের গতি আবার নেমে যাবে খাদে।…মানুষ ফিরে যাবে যে যার অভ্যস্ত রোজনামচায়। শুধু একটা অংশ রয়ে যাবে যারা কোনওদিন সংবিৎ ফিরে পাবে না। কারণ তারা ফিরে পাবে না তাদের হারানো প্রিয়জনদের। এতখানি হারিয়েও যে বদলে কিছু পাওয়া গেল না, এই ক্ষোভ তাদের বাড়তেই থাকবে। ঠিক কার বিরুদ্ধে সে কথা একমাত্র ইতিহাসই বলতে পারবে, আবার যখন সে উঠে আসবে খাদ থেকে।”
আগ্নেয়াস্ত্রের সন্ধানে বেরিয়ে নোর্দেন হারিয়ে গিয়েছিল। দার্জিলিং আলাদা রাজ্য হয়নি। অগস্ট ১৯৮৭, তৈরি হয়েছিল দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল। আমরা জানি এর পরও স্বাধীন রাজ্যের দাবি থেমে থাকেনি।
ফাৎসুঙ্
ছুদেন কাবিমো
নেপালি থেকে অনুবাদ: শমীক চক্রবর্তী
প্রকাশক: মনফকিরা
মূল্য: ২০০ টাকা।