৮ জানুয়ারির ধর্মঘটকে সফল করা জরুরি, যাতে সংগ্রাম আরো তীব্রতর হবার দিকে এগিয়ে যায়। শ্রমিক তথা সমস্ত নিপীড়িত জনগণকে রাজনীতির আঙ্গিনায় টেনে এনে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও শেষ পর্যন্ত প্রচলিত ব্যবস্থাকে উৎপাটিত করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠার দিকে এগনো যায়। লিখেছেন অলীক চক্রবর্তী।
“Altogether collisions between the classes of the old society further, in many ways, the course of development of the proletariat. The bourgeoisie finds itself involved in a constant battle. At first with the aristocracy; later on, with those portions of the bourgeoisie itself, whose interests have become antagonistic to the progress of industry; at all time with the bourgeoisie of foreign countries. In all these battles, it sees itself compelled to appeal to the proletariat, to ask for help, and thus, to drag it into the political arena. The bourgeoisie itself, therefore, supplies the proletariat with its own elements of political and general education, in other words, it furnishes the proletariat with weapons for fighting the bourgeoisie.” – Manifesto of the Communist Party
“মোটের ওপর পুরনো সমাজের নানা শ্রেণির মধ্যে সংঘাত শ্রমিকশ্রেণির বিকাশের জন্য নানাভাবে সাহায্য করে। প্রথমে লড়াই হয় অভিজাতদের বিরুদ্ধে, পরে বুর্জোয়া শ্রেণিরই যে যে অংশের স্বার্থ যন্ত্রশিল্পের বিস্তারের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় তাদের বিরুদ্ধে, আর সর্বদাই বিদেশের বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে। এই সব সংগ্রামেই বুর্জোয়াশ্রেণিকে শ্রমিকশ্রেণির কাছে আবেদন করতে হয়, সাহায্য চাইতে হয়, এবং এভাবেই তারা শ্রমিকশ্রণিকে রাজনীতির অঙ্গনে টেনে আনে। তাই বুর্জোয়ারাই শ্রমিকশ্রেণিকে তার নিজস্ব রাজনৈতিক ও সাধারণ শিক্ষা দান করে। অন্যভাবে বললে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অস্ত্র তারাই জোগায়।’’
ওপরের কথাগুলো সর্বহারার মহান দুই শিক্ষক মার্কস-এঙ্গেলস লিখেছিলেন। আজকে আমাদের দেশের অবস্থার দিকে তাকালে সাধারণভাবে এই কথাগুলি যে কত বড়ো অর্থ বহন করে তা বোঝা যায়। দেখতে পাচ্ছি শাসকশ্রেণি পুরনো কায়দায় শাসন করতে পারছে না। যে গণতন্ত্র বুর্জোয়াশ্রেণির শাসনের জন্য প্রয়োজনীয়, সেই গণতন্ত্রকেই আজকে তাদের ধ্বংস করতে উদ্যত হতে হচ্ছে। শাসকশ্রেণির মধ্যে বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্বকারী অংশগুলিকেও স্তব্ধ করে দেওয়া আজকে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে। এর মধ্য দিয়ে আজকে শাসকশ্রেণি টিকে থাকার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এটাই ফ্যাসিবাদ। তৃতীয় আন্তর্জাতিকের নেতা জর্জ দিমিত্রভ যাকে পুঁজিবাদের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অংশের আক্রমণাত্মক শাসন হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এটা উঠেও আসে যখন পুঁজিবাদ সংকটগ্রস্ত। যখন প্রচলিত শাসনব্যবস্থা শাসকশ্রেণিকে টিকিয়ে রাখার প্রতিবন্ধক হয়ে পড়ে। তখন শাসকশ্রেণির অন্তর্দ্বন্দ্বও তীব্র আকার ধারণ করে। এই দ্বন্দ্বের ফলে শ্রমিকশ্রেণি লড়াইয়ের অঙ্গনে আসার সুযোগ পায়।
আজকে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি প্রায় ৪% এ গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যা কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। আমাদের দেশে প্রতিবছর সরকারি হিসেব অনুযায়ী ২.৫% শ্রমশক্তির বৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু সমস্ত সংগঠিত, অসংগঠিত ক্ষেত্র মিলিয়ে ২% শক্তিকেও কাজে লাগানো সম্ভব নয়। উপরন্তু ছাঁটাই, কারখানা বন্ধের, খালি জায়গা পূরণ না করার মধ্য দিয়ে শ্রমশক্তিকে ব্যাপকভাবে উদ্বৃত্ত করা হচ্ছে। এর ফলে যেমন বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি, বাজারে ক্রেতার সংখ্যা আরও ব্যাপকভাবে কমছে, অন্যদিকে উৎপাদন আরো বেশি করে উদ্বৃত্ত হচ্ছে। উৎপাদন ও বণ্টনের মধ্যে ব্যাপক পরিমাণে ভারসাম্যের অভাব দেখা দিচ্ছে। এর ফলে সমাজের নিপীড়িত অংশের সাথে শাসকশ্রেণির সংঘাত মুখোমুখি জায়গায় দাঁড়াচ্ছে। আজকে যখন সরকার নারী শ্রমিকদের রাতের শিফটে কাজ করার জন্যও আইন পাশ করছে তখন পরিসংখ্যান বলছে যে গত দশ বছরে কাজের ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ ১০% কমে গেছে। ২০০৪-৫ এ যেখানে নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ছিল ৩৭% সেখানে ২০১৪-২০১৯ এর মধ্যে তা নেমে এসেছে ২৭% এ (সূত্র : Gender inequality issues in India, Batra, Reuo, Thomas)। এই অবস্থায় সংকটকে মোকাবিলা করতে শাসকশ্রেণির কাছে উগ্রজতীয়তাবাদ, উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী আগ্রাসন, জনগণের ঐক্যকে ধ্বংস করে শাসকশ্রেণির সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অংশের শাসন চাপিয়ে দেওয়াটাই একমাত্র পথ।
আজকে সিএএ, এনআরসি বা এনপিআর এর মধ্য দিয়ে জনগণের ওপর ভয়ংকর আঘাত বিজেপি সরকার নামিয়ে এনেছে। জনগণের মৌলিক সমস্যাকে আড়াল করতে এটা তারা করছে। একদিকে সিএএ অন্যদিকে শ্রম আইনকে আরো বেশি করে মালিকের উপযোগী করে দেওয়া, যাতে শ্রমিক শোষণকে বল্গাহীন করা যায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আগামী ৮ জানুয়ারির ধর্মঘটকে বিচার করতে পারি। এই বনধ ডেকেছে একযোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ট্রেড ইউনিয়ন। সংঘপরিবারের পরিচালিত বিএমএস ও এরাজ্যের সরকারে আসীন তৃণমূল কংগ্রেসের দ্বারা পরিচালিত আইএনটিটিইউসি ছাড়া সকলেই এই বনধে সামিল। সেখানে শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরির দাবি যেমন রয়েছে তেমনি নতুন শ্রম কোড চালু করার বিরুদ্ধে, লাভজনক কারখানা বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে, ব্যাঙ্ক, রেল, বিমান, অস্ত্র কারখানার বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে এই বনধ্। ঠিকভাবে বিচার করলে এই বনধের আহ্বানকে শাসকশ্রেণির অন্তর্দন্দ্বের প্রকাশ বলা যায়, যেখানে এই দ্বন্দ্বে শ্রমিক শ্রেণি সহ সমস্ত নিপীড়িত মানুষকে অংশগ্রহণ করার আহ্বান রয়েছে। এই অবস্থায় শ্রমিকশ্রেণির ও তার অগ্রণী বাহিনীদের ভূমিকা কী হবে?
শাসকশ্রেণির অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রকাশ হলেও, যেহেতু জনগণের মধ্যে শাসকশ্রেণির গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে তার পক্ষে শাসন করাই সম্ভব হয় না তাই এই অন্তর্দ্বন্দ্বে শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থ রয়েছে। যে দাবিগুলো তোলা হয়েছে তা প্রত্যক্ষভাবেই শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থবাহী। শাসকশ্রেণির প্রতিনিধিরা এই আন্দোলনকে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করার জন্য কাজে লাগাতে চাইবে। আন্দোলনকে একদিনের বনধ্-এ সীমিত করতে চাইবে। কিন্তু শ্রমিকশ্রেণির যদি অংশগ্রহণ ঠিকভাবে থাকে তবে ঘটনার অভিঘাত আন্দোলনকে তীব্রতার দিকে নিয়ে যাবে। আজকের সমস্যা হল শ্রমিকশ্রেণি নিজে শ্রেণি হিসেবে সংগঠিত নয়। তার অগ্রণীবাহিনীও তুলনায় ছত্রভঙ্গ অবস্থার মধ্যে রয়েছে। ফলে আজকের সমস্ত কর্মসূচি শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুব, মহিলা সহ সমস্ত নিপীড়িত জনগণকে রাজনীতির আঙ্গিনায় টেনে আনার কর্মসূচি। তাই আমাদের এই বনধকে যেমন সফল করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে তেমনি নিজেদের স্বাতন্ত্র্য যাতে সুরক্ষিত থাকে সেব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। আজকে লড়াই যে জায়গায় রয়েছে তাতে তা প্রচলিত ব্যবস্থাটিকে রক্ষা করার অবস্থানে রয়েছে। যেহেতু শাসকেরা প্রচলিত ব্যবস্থাকেই ভেঙে দিতে উদ্যত তাই লড়াই তীব্র হচ্ছে। এর মধ্যে অবশ্য প্রচলিত ব্যবস্থাকে ভাঙার উপাদান রয়েছে, কিন্তু বিপ্লবী শক্তি যদি তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিকভাবে বলীয়ান হয়ে লড়াইতে সামিল না হতে পারে তবে সমস্ত উদ্যোগই শাসকশ্রেণির অন্তর্দ্ব্ন্দের কোনো একটি পক্ষ নেবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে। আমরা জানি ছাত্র ছাত্রীরা বিপ্লবের বার্তাবাহক। আজকে ফ্যাসিবাদী হামলার বিরুদ্ধে সারা দেশের বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা রাস্তায় নেমেছে। লড়াই করছে। সেটা “বরফ গলিয়ে দিতে শুরু করেছে। “কিন্তু তার সাথে আমরা এটাও দেখছি এমনকী উচ্চমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও, বামপন্থী আন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলিতেও আজকে জয় শ্রীরামের পাল্টা বন্দে মাতরম ধ্বনিত হচ্ছে, লাল পতাকার সাথে জাতীয় পতাকা শোভিত হচ্ছে। “ওদের রডের জবাব সংবিধান’ বলে বর্তমান ব্যাবস্থাকেই মহৎ বলে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। এর সাথে থাকার পাশাপাশি যদি এর বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম না চালানো যায় ও বিপ্লবী মতাদর্শকে একটি শক্তিশালী জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করা না যায় তবে শেষ বিচারে ফ্যাসিবাদকেও আটকানো যাবে না। কারণ ফ্যাসিবাদ তার শক্তিকে আহরণ করে প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা থেকে। প্রচলিত ব্যবস্থার সংকট থেকে। তাই সমাজের বৈপ্লবিক পুনর্গঠনের প্রতি জনগণের এক বড়ো অংশকে মানসিকভাবে প্রস্তুত না করলে বর্তমান ব্যবস্থার অচলাবস্থাকে কাটাতে জনগণও ফ্যাসিস্টদের দিকে ধাবিত হবে, যা ইতিমধ্যেই বেশকিছুটা হয়েছে। প্রচলিত ব্যবস্থা তার অন্তর্বস্তুগত নিয়মেই স্থবির হয়ে যেতে বাধ্য। তাই সেইসময়ে দুটো রাস্তাই খোলা থাকে। আরও বেশি প্রতিক্রিয়াশীল শাসনকে চাপিয়ে দিয়ে সমাজকে বর্বরতার জায়গায় নিয়ে যাওয়া, অথবা সমাজের বৈপ্লবিক পুনর্নির্মাণ। আমরা যদি দ্বিতীয় বিষয়টিকে সজোরে সমাজে হাজির করার উদ্যোগ না নিতে পারি তবে প্রথম অবস্থাকে রাখা যাবে না। আমাদের স্পষ্টভাবে বলতে হবে উগ্রজাতীয়তাবাদের জবাব বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ নয়, সামাজিক উগ্রজাতীয়তাবাদ নয় (সোশ্যাল শভিনিজম), তার উত্তর হল সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদ। তথাকথিত জাতীয়তাবাদ কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার অলিখিত অবলুপ্তি ঘটিয়েছে, আর বর্তমান উগ্রজাতীয়তাবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে অবলুপ্ত করে কাশ্মিরকে কারাগারে পরিণত করাকে আইনসিদ্ধ করেছে। কংগ্রেস আমলে সার্জিক্যাল ষ্ট্রাইক হত চুপিসারে। এখন হচ্ছে ঢাক পিটিয়ে। আমাদের মনে রাখতে হবে শাসকশ্রেণি পুরনো কায়দায় শাসন করতে না পারলেই বিপ্লব হয় না। জনগণকেও পুরনো কায়দায় আর শাসিত হব না এটা চাইতে হবে।
৮ জানুয়ারির ধর্মঘটকে আমাদের এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে সফল করা জরুরি, যাতে সংগ্রাম আরো তীব্রতর হবার দিকে এগিয়ে যায়। শ্রমিক তথা সমস্ত নিপীড়িত জনগণকে রাজনীতির আঙ্গিনায় টেনে এনে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও শেষ পর্যন্ত প্রচলিত ব্যবস্থাকে উৎপাটিত করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠার দিকে এগনো যায়্। আজকে শ্রমিকশ্রণির আশু স্বার্থকে রক্ষার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ লক্ষ্যকে অর্জন করার দিকে একধাপ এগনো যায়।
লেখক Trade Union Centre of India (TUCI) -র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রেসিডেন্ট।