নীলামে চড়েছে দেশ। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে রোড শো করে দেশের বিভিন্ন সরকারি শিল্প ও আর্থিক সংস্থাকে বিক্রি করার চেষ্টা করবে। সরকার ইতিমধ্যে বিপিসিএলকে বিক্রি করার কাজ জোর কদমে শুরু করে দিয়েছে। কোম্পানির বাজারদর যদিও ১.০৬ লক্ষ কোটি টাকা, তবে ওয়াকিবহাল সূত্রের খবর, সরকার ৬০,০০০-৭০,০০০ কোটি টাকা পেলেই বিপিসিএলকে বিক্রি করে দিতে রাজি। লিখেছেন সুমন কল্যাণ মৌলিক।
নীলামে চড়েছে দেশ। প্রত্যেক দিন সকালে কাগজ খুললেই জানা যাচ্ছে কোন্ সরকারি প্রতিষ্ঠানকে এবার বিক্রি করা হবে। বাণিজ্যিক সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে রোড শো করে দেশের মানুষের ঘাম, রক্ত, অর্থে তৈরি করা বিভিন্ন সরকারি শিল্প ও আর্থিক সংস্থাকে বিক্রি করার চেষ্টা করবে। আচ্ছে দিনের স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা এই আর্থিক বর্ষে দেশ বেচার লক্ষ্যমাত্রা ইতিমধ্যে স্থির করে নিয়েছে। ২০১৯-২০ আর্থিক বর্ষে তাদের জোগাড় করতে হবে ১.০৫ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৯ সালের ২১ নভেম্বর পর্যন্ত দেশ বেচে পাওয়া গেছে ১৩৬৪.২৬ কোটি টাকা। তাই বলা যেতে পারে দিল্লি এখনও অনেক দূর।
বিলগ্নীকরণ—সরাসরি পরিচালন ব্যবস্থা বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া—সাদা বাংলায় সোজাসুজি বিক্রি করা, যে ভাবেই হোক না কেন, দেশের সম্পদ কর্পোরেট সংস্থাগুলির হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বঘোষিত ‘দেশপ্রেমী’ ও ৫৬ ইঞ্চি ছাতি-বিশিষ্ট মান্যবর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তার দলবল যে তাড়াহুড়ো করছে, তা দেখে ছোটোবেলায় পড়া ইশপের একটা গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে। সেই গল্পে এক বাঘ নৈতিকতার মুখোশে এক মেষশাবককে হত্যা করতে চেয়েছিল। বাঘ মেষশাবককে বলে, গত বছর সেই শাবক তাকে গালি দিয়েছিল। শাবকটি বিনীত ভাবে জানায়, সেটা সম্ভব নয় কারণ তার বয়স মাত্র চার মাস। বাঘ আর কালক্ষেপ না করে শাবকটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে, তাহলে শাবকটির পিতৃদেব নিশ্চিত তাকে গালি দিয়েছিল। গল্পটির উল্লেখ করলাম তার কারণ এতদিন আমাদের বোঝানো হচ্ছিল যে আর্থিক ভাবে লাভজনক নয়, এমন সংস্থাগুলোই বিক্রি করা হচ্ছে, কারণ সরকার আর তাদের দায় নেবে না। কিন্তু এপর্বের বিক্রিবাটায় সেই মুখোশ আর ধরে রাখা গেল না। কারণ যে সংস্থাগুলোকে বিক্রি করা হচ্ছে তাদের বেশির ভাগই লাভজনক।
আলোচনার সুবিধার্থে এবারের বিক্রির ফর্দটা দেখে নেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে আছে ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন লিমিটেড (বিপিসিএল) যা বর্তমান নিবন্ধের আলোচ্য। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক সরকার তার হাতে থাকা ৫৩.২৯% শেয়ার বিক্রি করে দেবে। স্বাভাবিক ভাবেই ম্যানেজমেন্ট চলে যাবে বেসরকারি হাতে। এই সংস্থা গত ৫ বছরে ৩৫,০০০ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে এবং কর ও ডিভিডেন্ট বাবদ সরকারের ঘরে ৩০,০০০ কোটি টাকা জমা করেছে। দ্বিতীয় নামটি হল কন্টেনার কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (কনকর)। এটিও বিপিসিএল-এর মতো একটি নবরত্ন কোম্পানি। সরকার এর ৩০.৮ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করবে এবং পরিচালন পর্ষদকে বেসরকারি হাতে তুলে দেবে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ১৯৮৯-৯০ আর্থিক বর্ষে সরকার মাত্র ৬৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে কনকর তৈরি করে। এতদিন পর্যন্ত এই কর্পোরেশন কেন্দ্রীয় সরকার সহ তার সমস্ত শেয়ার হোল্ডারদের ডিভিডেন্ট দিয়েছে ৪,৬৬৯ কোটি টাকা। গত আর্থিক বর্ষে সংস্থাটির মুনাফা ছিল ১৬৮৯ কোটি টাকা। কোম্পানির পরিচালন পর্ষদের মতে, যেহেতু কনকরের টার্মিনালগুলো প্রস্তাবিত ফ্রেট করিডরের পাশেই অবস্থিত তাই খুব দ্রুত কোম্পানির বাজারমূল্য বর্তমানের ৩৮,৭৩৩ কোটি টাকা থেকে বেরে হবে ২,০০,০০০ কোটি টাকা। এই তালিকার আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম শিপিং কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া। তালিকায় আরও রয়েছে নর্থ ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার কর্পোরেশন, তেহরি জলবিদ্যুৎ নিগম, ভারত আর্থ মুভার্স লিমিটেড (BEML)। এক্ষেত্রে পরিচালন ক্ষমতা-সহ ৬৩.৭৫ শতাংশ শেয়ার বেসরকারি হাতে চলে যাবে। শিপিং কর্পোরেশনও কিন্তু একটি লাভজনক সংস্থা। প্রশ্নটি শুধু লাভ-লোকসান সংক্রান্ত নয়। ভারতবর্ষের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নটিও এখানে জড়িত। পেট্রোলিয়াম, যোগাযোগ ব্যবস্থাতে একটা মাত্রা পর্যন্ত সরকারি নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি, একথা কিছুদিন আগে পর্যন্ত বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের মার্গদর্শক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের মদতপুষ্ট সংগঠন স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের কর্তাব্যক্তিদের অহরহ বলতে শুনেছি। তথ্যের খাতিরে একটা কথা জানিয়ে রাখা প্রয়োজন যে আসামের বর্তমান অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে সরকার বিপিসিএল-এর অন্তর্গত নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেডের ৬১.৬৫ শতাংশ শেয়ার অন্য কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই তৈলশোধনাগারটি ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তি মোতাবেক উচ্চ আসামের গোলাঘাটে স্থাপন করা হয়েছিল। অসমীয়া জাতীয়তাবাদের আবেগকে আহত করতে পারে এই বেসরকারিকরণ, তাই নুমালিগড়ের ক্ষেত্রে সাময়িক পশ্চাদপসরণের পথ নিল কেন্দ্রীয় সরকার।
একথা অনস্বীকার্য যে ভারতে পেট্রোলিয়াম শিল্পের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিপিসিএল। এদের হাতে রয়েছে চারটি তৈলশোধনাগার—মুম্বাই, কোচি, বিনা (মধ্যপ্রদেশ) এবং নামুলিগড়। এই চারটি তৈলশোধনাগার ৩৮.৩ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত তেলকে জ্বালানিতে রূপান্তরিত করতে পারে। এর মধ্যে বিনা শোধনাগারটি যৌথ মালিকানায় রয়েছে ওমান অয়েল কোম্পানির সাথে। বিপিসিএলের হাতে রয়েছে ১৫০৭৮ টি পেট্রোল পাম্প ও ৬০০৪ টি এলপিজি বিতরণকেন্দ্র।
সরকার ইতিমধ্যে বিপিসিএলকে বিক্রি করার কাজ জোর কদমে শুরু করে দিয়েছে। ডিপার্টমেন্ট অফ ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট এই বিক্রির জন্য ক্রেতা খোঁজার দায়িত্ব দিচ্ছে ডেলইট সংস্থাকে। কর্পোরেট হাঙরদের কাছে দেশের সম্পদ বিক্রি করতে বহুজাতিক দালালি সংস্থাটি এতটাই আগ্রহী যে তারা খাতায়-কলমে তাদের পারিশ্রমিক রেখেছে মাত্র এক টাকা। যদিও এখনও নির্দিষ্ট করে আগ্রহী কোনো সংস্থার কাছ থেকে আবেদন পাওয়া যায়নি, তবে অনেকগুলি বিদেশি সংস্থার নাম শোনা যাচ্ছে। এদের মধ্যে রয়েছে এক্সন, সৌদি অ্যারামকো (এরা ইতিমধ্যে রিলায়েন্সের তেলের ব্যবসার একটা বড়ো অংশ কিনে নিয়েছে), আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি, শেল, টোটাল, বেদান্ত প্রভৃতি। তবে যেহেতু সরকারের আর্থিক সংকট তীব্র, তাই এই ধরনের বিক্রিকে এই সময় অভাবী বিক্রি (distress selling) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কোম্পানির বাজারদর যদিও ১.০৬ লক্ষ কোটি টাকা, তবে ওয়াকিবহাল সূত্রের খবর, সরকার ৬০,০০০-৭০,০০০ কোটি টাকা পেলেই বিপিসিএলকে বিক্রি করে দিতে রাজি। এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়, বিগত বিলগ্নীকরণের ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে জলের দামে কর্পোরেট সংস্থাগুলির কাছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। কর্পোরেট পুঁজিকে নির্বাচনের সময় ব্যবহার করার ক্ষেত্রে এদেশে যে রাজনৈতিক দলটি সবার আগে, আজ তারাই যে দিল্লির মসনদে আসীন, একথা আমরা যেন ভুলে না যাই।
বিপিসিএলের ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়াটার সঙ্গে আইন-আদালতের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। আর সেটা বুঝতে হলে আমাদের একটু ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাতে হবে। ২০০২ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন সরকার হিন্দুস্থান পেট্রোলিয়ামের সঙ্গে বিপিসিএলকে বিলগ্নীকরণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে সে প্রক্রিয়াটি স্থগিত হয়। বিপিসিএলের জন্ম হয়েছিল বার্মা শেল কোম্পানি থেকে, যা ১৯২০ সালে রয়্যাল ডাচ শেল ও বার্মা অয়েল কোম্পানির সংযুক্তির মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে কোম্পানির জাতীয়করণ হয় এবং নতুন নাম হয় ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন। তাই অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকারের পরিকল্পনা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়। এক্ষেত্রে যে আইনগুলি বিপিসিএলকে রক্ষা করে তার মধ্যে ছিল ESSO (Acquisition of Undertakings in India), Burma Shell (Acquisition of Undertakings in India) Act, 1976, Caltex (Acquisition of Shares of Caltex Oil Refinery India Ltd.) Act, 1977। সর্বোচ্চ আদালতের বক্তব্য ছিল, পার্লামেন্টে আইন সংশোধন না করে বিপিসিএলকে বিক্রি করা যাবে না। এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নরেন্দ্র মোদীর সরকার ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেই বিপিসিএল অধিগ্রহণ আইন (সংশোধনী)-সহ ১৮৭ টি পুরোনো আইন বাতিলের উদ্যোগ নেয়। এক্ষেত্রে তাদের হাতিয়ার ছিল ল কমিশনের সুপারিশ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে লোকসভায় ৫০ মিনিট ও রাজ্যসভায় ২০ মিনিট আলোচনার পর ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে অধিগ্রহণ সংক্রান্ত আইনগুলি বাতিল হয়ে যায় এবং বিপিসিএল অধিগ্রহনের পথ প্রশস্থ হয়।
ভারতের অর্থনীতিতে বিপিসিএলের বেসরকারিকরণ এক ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলবে। একথা সকলের জানা যে আধুনিক সভ্যতার চালিকাশক্তি হল পেট্রোলিয়াম পণ্য। সেক্ষেত্রে উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা অত্যন্ত জরুরি। যেমন এতদিন পর্যন্ত বিপিসিএলের পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যগুলি কোম্পানি বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য থাকত। কিন্তু বিদেশি কর্পোরেট সংস্থাগুলির কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর কোম্পানির সেই বাধ্যতা আর থাকবে না। এ ছাড়া অপরিশোধিত তেলের জোগানের যে নিশ্চয়তা ছিল, তা বেসরকারিকরণের পরেও বজায় থাকবে কি না তা এই বিক্রির পরিকল্পনা থেকে জানা যাচ্ছে না। আর যারা কিনবে তারা আসলে ভারতীয় করদাতাদের টাকায় তৈরি পরিকাঠামো জলের দরে পেয়ে যাচ্ছে। যেমন, কোচি রিফাইনারি ওয়ার্কসের আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণের জন্য ৪০,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে, যার সুবিধা পাবে কর্পোরেট ক্রেতা। আর এইভাবে প্রথমে হিন্দুস্থান পেট্রোলিয়াম ও এখন ভারত পেট্রোলিয়ামে দেশের মালিকানা বিক্রি করে দিয়ে স্বনির্ভরতার অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে চাইছে মোদী সরকার। আর পেট্রোলিয়ামের ক্ষেত্রে গল্পটা এখানেই শেষ হচ্ছে না। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ইন্ডিয়ান অয়েলের ক্ষেত্রে সরকারি শেয়ারের পরিমাণ ৫১ শতাংশের নীচে নামিয়ে আনার কথা চিন্তাভাবনা করছে কেন্দ্রীয় সরকার।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন দাবি করেছেন সামাজিক ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা পালন করার জন্য সরকারের টাকা দরকার। তাই দেশের সম্পদ বেচে দেওয়ার এই আয়োজন। এই বক্তব্যের ক্ষেত্রে আবার আমাদের সেই ইশপের গল্পে ফিরতে হচ্ছে। এক কৃষকের ছিল এক রাজহাঁস। সে রোজ সকালে সোনার ডিম পাড়ত। কিন্তু লোভী কৃষক একবারে অনেক সোনার ডিম পাওয়ার লক্ষ্যে হাঁসটির পেট চিরে ফেলল। তার ফল আমাদের সবার জানা। আমাদের মনে রাখতে হবে যে সামাজিক দায়বদ্ধতা জন্য টাকা প্রতি বছর দরকার। কিন্তু এই লাভজনক সংস্থাগুলি বিক্রি করে দিলে এদের থেকে ভবিষ্যতে টাকা পাওয়ার আশা চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ এই শেয়ারগুলি হস্তান্তর করার ফলে সরকারের ধারাবাহিক ডিভিডেন্ট পাওয়ার পথ আর অবশিষ্ট থাকে না। ফলে সরকার সামাজিক প্রকল্পের জন্য টাকা কোথা থেকে পাবে? ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে সংসার চালানোর আত্মঘাতী পথ নিয়েছে এই সরকার। এব্যাপারে আমাদের বিগত অভিজ্ঞতা হল অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন পূর্বতন এনডিএ সরকার অরুণ জেটলির নেতৃত্বে রীতিমতো বিলগ্মীকরণ দপ্তর খুলে বসেছিল। এক্ষেত্রে বিষয়টি হল ৯০-এর দশকের ও বিশ্বব্যাংকের বিশ্বস্ত আমলা মনমোহন সিং যে উদারীকরণ-বেসরকারিকরণ-ভুবনায়নের নীতি চালু করেছিল, পরের পর সরকারগুলি তার বিশ্বস্ত অনুগামী থেকেছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদী সরকার সেই একই পথের অনুগামী। এইভাবে পাইকারী হারে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক সংস্থাগুলিকে জলের দরে বেচে দিয়ে ভারতীয় অর্থনীতির কোনো স্বার্থ আগেও সংরক্ষিত হয়নি, বর্তমানেও হবে না।
আসলে এই অর্থনীতি এক ভয়ংকর ধ্বংসের প্রতীক। প্রকৃত অর্থে নরেন্দ্র মোদীর বর্তমান জমানায় অর্থনীতির পতনের চিহ্নগুলি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ব্রিকস সম্মেলনে বাক্যবাগীশ প্রধানমন্ত্রী বলে এসেছিলেন, ২০২৪ সালের মধ্যে ভারতে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি তৈরি হবে। একটা মূর্খও বুঝবে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বার্ষিক বৃদ্ধির হার হওয়া উচিত সরল পাটিগণিতের হিসেবে ১২ শতাংশ। আর সরকারের হিসাবে জানা যাচ্ছে, ২০১৯-২০ আর্থিক বর্ষে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর, এই তিন মাসে ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় বৃদ্ধির হার ৪.৫ শতাংশ, এবং সেটাও নাকি গণনা পদ্ধতিতে খানিকটা জল মেশানোর কল্যাণে। নয়তো বৃদ্ধির হার মেরেকেটে আড়াই শতাংশের কাছাকাছি। বিস্কুট থেকে গাড়ি, চাহিদা তলানিতে, কর্মসংস্থানের হার গত ৫৫ বছরে সবচেয়ে কম, গত ছ-বছরে চাকরি গেছে ৯০ শতাংশ মানুষের। এই অবস্থায় সরকার উপায় ঠাউরেছে কর্পোরেট পুঁজির কাছে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণের। সেজন্য কর্পোরেট কর হ্রাস, নিত্যনতুন প্যাকেজ সঙ্গে রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের বিক্রিবাটা। এই দেউলিয়া অর্থনীতি ও তার ব্যবস্থাপকদের উচ্ছেদ না করতে পারলে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের বিলুপ্তি আজ শুধু সময়ের অপেক্ষা।
লেখক স্কুল শিক্ষক ও গনতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের কর্মী।