এনআরসি ও নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন ইতিমধ্যেই যা অনিশ্চয়তার মধ্যে সাধারণ মানুষকে ঠেলে দিয়েছে আগামী দিনে তা ভয়ঙ্কর রূপ নেওয়ার দিকে। দেশের বিপুল অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের আরো সস্তায় তাদের শ্রমকে বিক্রি করতে বাধ্য করা হবে। আরএসএস-এর নীতিগত উদ্দেশ্যের সাথেও পুঁজির উদ্দেশ্যের ঠোকাঠুকি এক্ষেত্রে হবে না বরং উভয়পক্ষই লাভবান হবে। ফলে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে পাল্টানোর সংগ্রামকে পুঁজিবাদ এবং হিন্দুত্ববাদের দার্শনিক মতাদর্শের জোটের বিরুদ্ধেই লড়তে হবে আগামী দিনে। লিখেছেন অনিমেষ দত্ত।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহ যন্তরমন্তরে একটি সমাবেশে দাবি করেছিলেন ‘ক্রমহ্রাসমান হিন্দু ও ক্রমবর্ধমান অহিন্দু জনসংখ্যার সমস্যা’ নিরসনে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন চালু করতে হবে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের একটি বিখ্যাত উক্তি আরো একবার স্মরণ করতে হবে, “এক ভি ঘুসপেটিও কো রহেনে নেহি দেঙ্গে, অর হর এক শরণার্থী কো ভারত কা নাগরিক বননে কা গৌরব দেঙ্গে।” অর্থাৎ একজনও অনুপ্রবেশকারীকে ঢুকতে দেওয়া হবে না, আর শরণার্থীদের ভারতের নাগরিক হবার গৌরব প্রদান করবেন তিনি। এই দুই উক্তির সাথে সাথে বিজেপির অসংখ্য নেতা-মন্ত্রীদের গোটা দেশজুড়ে বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যে বারবার উঠে এসেছে ‘অনুপ্রবেশ’, ‘ভারতভূমির সাচ্চা নাগরিক’ ইত্যাদি প্রসঙ্গগুলো। লোকসভা ও রাজ্যসভায় পাশ হয়ে যাওয়ার পর নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল বা সিএবি-তে সই করেছেন রাষ্ট্রপতি। বিল এখন আইনে পরিণত। গোটা দেশেই এনআরসি ও নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন নিয়ে বিতর্ক, প্রতিবাদ, টেলিভিশনীয় তর্জা, আলোচনা চলছে। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে (আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, ত্রিপুরা) নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছেন সেখানকার সাধারণ মানুষ। কিন্তু আদতে বিষয়টি কী? একদিকে বিজপি গোটা দেশে এনআরসি চালু করবে আর অন্যদিকে নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে সরকারের কী উদ্দেশ্য সাধন হবে? দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ? দেশের আসল নাগরিক কারা এই প্রশ্নের সমাধান? দেশের মানুষের নিজেকে এই দেশের নাগরিক প্রমাণ করার দায়? হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান অর্থাৎ ধর্মীয় তর্জা? কোনটা! এই প্রবন্ধে বিজেপি সরকারের এনআরসি ও নাগরিকত্ব আইনের পিছনের ‘ঐতিহাসিক’ উদ্দেশ্য এবং আগামীতে একটা ধর্মীয় ‘দেশ’ গঠনের উদ্দেশ্যকে খোঁজার চেষ্টা করব আমরা।
এনআরসি–র ঐতিহাসিকতা
‘৪৭-এ দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৫১ সালে প্রথমবার (এবং শেষবার) ভারতীয় নাগরিক, তার সংখ্যা ও আরো অন্যান্য তথ্য নিয়ে ন্যাশানাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স অর্থাৎ জাতীয় নাগরিক পঞ্জী তৈরি করা হয়। এখনেই আসামের প্রসঙ্গটিকে ছুঁয়ে যাওয়া জরুরি। ব্রিটিশ সরকারের নতুনভাবে আসামের জমি ব্যবহার করার চাহিদা মেটাতে আসামে উনিশ শতকের শেষ থেকেই ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ নিয়ে আসা শুরু হতে থাকে। চা বাগানের ম্যানেজার থেকে ধান-পাটচাষি – সবরকমের পেশায় মূলত তৎকালীন পূর্ববঙ্গ, ছোটনাগপুর মালভূমি, নেপাল থেকে আসা মানুষদের যুক্ত করানো হয়।
আসামে বহুবছর ধরেই খিলঞ্জিয়া (আসামের আদি বাসিন্দা) বনাম বিদেশি, এই মেরুকরণ প্রস্তুত ছিল; যা ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ অবধি চরম জাতিবিদ্বেষী, উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পর ১৯৮৫ সালে ‘আসাম চুক্তি’র মাধ্যমে শেষ হয়। এই চুক্তিতে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার নতুন করে আসামের নাগরিকপঞ্জী তৈরি করার কথা দেয়। চুক্তিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চ মধ্যরাত্রির মধ্যে যারা ভারতে প্রবেশ করেছেন, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, তার পরে যারা এসেছেন তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। তারপর নতুন নাগরিক পঞ্জী তৈরির কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই প্রথম প্রকাশিত খসড়া তালিকায় প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ নাগরিক পঞ্জী থেকে বাদ পড়েন। তারপর সেই তালিকা সংশোধনের মাধ্যমে (২০১৯ সালের ৩১ আগষ্ট) এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৯ লক্ষে। আসামে এনআরসি এক বিশাল মানবিক সংকটের সৃষ্টি করেছে।
আসামের প্রসঙ্গটা এই জায়গা থেকেই ছুঁয়ে গেলাম কারণ আসামের এনআরসি নিজে একটি স্বতন্ত্র্য আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াকে বাকি রাজ্যগুলিতে প্রয়োগ করে নাগরিকত্ব আইনের মান্যতা তৈরি করবার প্ল্যান কেন চালাচ্ছে বিজেপি সরকার, সেই মূল আলোচনায় এবার ঢুকব।
আর্য সমাজ, ‘আর্য রাষ্ট্রের‘ ভাবনা ও উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে ‘হিন্দুত্বের প্রবেশ
দেশের প্রকৃত নাগরিক কারা, জন্মগত, বাইরে থেকে আসা কিন্তু সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে নেওয়া অথবা অন্য যা যা চালু লজিক আছে ‘নাগরিক’ নিয়ে সেই আলোচনায় ঢুকছি না। আমরা দেখার চেষ্টা করব বিজেপির মাতৃ সংগঠন আরএসএস-এর হিন্দু রাষ্ট্রের আইডিয়াটা আসলে কি। একটু ইতিহাসে ফিরে যেতেই হবে এর শিকড় খোঁজার জন্য।
ভারতে হিন্দু-মুসলিমদের একসাথে বসবাসের ইতিহাসটা প্রায় ৮০০ বছরের। মাঝেমধ্যে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক হানাহানি হলেও সংগঠিত ভাবে আলাদা ভারতীয় হিন্দুরাষ্ট্রের ধারণা কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতের আগে সেভাবে কখনোই সামনে আসেনি। এই হিন্দুরাষ্ট্রের ধারণা ভ্রুণাকারে প্রথম আসে ‘আর্যসমাজ’ (১৮৬০-৭০ সাল নাগাদ)-এর হাত ধরে যার নেতৃত্বে ছিলেন দয়ানন্দ সরস্বতী। তাঁর বক্তব্যের মূল বিষয় ছিল যে চারটি বেদই হল হিন্দু ধর্মের একমাত্র সত্য এবং ভারতের ‘আদি বাসিন্দা’ আর্য জাতির মহান ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে হিন্দু সমাজের পুনরুজ্জীবন করতে হবে। সমাজের নিচুতলার লোক যারা হয়তো সামাজিক বাস্তবতার কারণে মুসলিম বা খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিল তাদের এই ‘মূল আর্য হিন্দুত্বে’ ফিরিয়ে আনতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই উত্তর ভারতে ‘আর্য সমাজ’ ব্যাপকভাবে ‘শুদ্ধি আন্দোলন’ শুরু করে। দয়ানন্দ অ্যাংলো বেদিক বা ডিএভি স্কুল ও গুরুকুল স্থাপন করা হয়। এদের হাত ধরেই এতদিনের প্রচলিত উর্দু লিপির বদলে দেবনাগরীতে হিন্দীভাষা লেখার প্রচলন শুরু হয়। এই ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মদনমোহন মালব্য ১৯১৫ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় (বিএইচইউ) স্থাপন ও সম্পূর্ণ ভাবে শুধুমাত্র দেবনাগরী হিন্দী ব্যবহার শুরু হয়। আমার জানি পরবর্তীতে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে বহু আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার নেতারা শিক্ষিত হয়েছেন। আর্যসমাজ বর্ণাশ্রম প্রথাকে পাল্টে দেবার ডাক দিয়ে এও ঘোষণা করেছিল যে জন্ম দ্বারা ঠিক না হয়ে বরং কাজ ও মেধার দ্বারা বর্ণ ঠিক হোক (নিচুতলার মানুষদের ‘শক্তিশালী আর্য রাষ্ট্রে’ অন্তর্ভুক্তিকরণ যার প্রধান উদ্দেশ্য আকারে থেকেছিল)। বাংলায় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠে’ আমরা এই ছাপ পাই, কীভাবে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের হারিয়ে হিন্দুদের এক শক্তিশালী রাষ্ট্রের কথা তুলে ধরা রয়েছে সেখানে। বিবেকানন্দ জোরের সাথে বলেন যে ভারত হিন্দু আধ্যাত্মিকতার দ্বারাই জগৎ জয় করবে,-“বেদান্তের পরম সত্যগুলোকে প্রচার করার জন্য সাহসী কর্মীদের প্রয়োজন।”
এরপর আমরা দেখব ব্রিটিশ উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামে হিন্দুত্বের অনুপ্রবেশ আস্তে আস্তে বিস্তারলাভ করছে। প্রাচীন ভারতের শৌর্যের প্রতীকগুলি দ্বারা হিন্দুসত্ত্বাকে আরো জাগ্রত করতে পশ্চিম ভারতের কংগ্রেসের নেতা বালগঙ্গাধর তিলক ‘গণপতি উৎসব’ ও ‘শিবাজী জয়ন্তী উৎসব’ পালনের প্রথা চালু করেন বিপিনচন্দ্র পাল বলেন, “হিন্দু সংস্কৃতি ইউরোপীয় জাতিসত্তার চেয়েও এক উচ্চতর আদর্শ স্থাপন করতে পারে।” এতকিছু সত্ত্বেও এইসব নেতারা কিন্তু ভারতকে সম্পূর্ণ হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার স্লোগান তোলেননি। হিন্দুরাষ্ট্রের স্লোগান সংগঠিতভাবে প্রথম ভারতীয় রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে নিয়ে আসে হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস।
হিন্দু মহাসভা, আরএসএস ও ‘হিন্দুরাষ্ট্র’
‘হিন্দু মহাসভা’ তৈরি হয় ১৯১৫ সালে মদনমোহন মালব্য, লালা লাজপত রাই এর মতো কংগ্রেসি নেতাদের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণে। কিছুদিনের মধ্যেই হিন্দু-মহাসভার মঞ্চে আসলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর। ১৯০৬-১৯১০, এই চার বছর ব্রিটেনে থাকাকালীন ইতালির মাৎসিনির লেখাপত্রের দ্বারা অনুপ্রেরিত হন সাভারকর। ভারতে আর্য আক্রমণের তত্ত্ব খারিজ করে তিনি বলেন যে, “ভারতে উৎপন্ন সমস্ত রকম ধর্মীয় বিশ্বাসই আসলে ‘হিন্দু’।” সেই হিসেবে বৌদ্ধ-জৈন ইত্যাদিরাও বৃহত্তর অর্থে হিন্দু। কিন্তু খ্রিস্টান বা ইসলাম ধর্ম যেহেতু ভারতে উৎপত্তি হয়নি তাই সেইসব ধর্মে বিশ্বাসী মানুষজন কখনোই ‘হিন্দু’ নয়; কারণ তাদের পবিত্র উপাসনাস্থলগুলি ভারতের বাইরের; তারা যদি তাদের ‘বহিরাগত বিশ্বাসগুলি’ ত্যাগ করে হিন্দুত্ব গ্রহণ করে তাহলে তাদেরকে এই ‘হিন্দুরাষ্ট্রে’ অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।”
এরপর আসছি আরএসএস -এর প্রসঙ্গে। ১৯২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আত্মপ্রকাশ। জন্মলগ্ন থেকেই আরএসএস হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় ইন্ধন জুগিয়ে জঙ্গি হিন্দুত্ববাদী ভাবধারায় নিজেদের সংগঠিত করতে শুরু করে। যেখানে যেখানে দাঙ্গা করতে পারে, সেখানেই আরএসএস সংগঠন গড়তে সচেষ্ট হয়। প্রথম সরসংঘচালক হেডগেওয়ারের নেতৃত্বে ‘৩০-এর দশকের শুরুতে তাদের জন্মভূমি নাগপুর থেকে পশ্চিম মহারাষ্ট্রের দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। দ্বিতীয় সরসংঘচালক গোলওয়ালকর এসে আরএসএস-এর তাত্ত্বিক আদর্শগত ভিত্তি সুনির্দিষ্ট দিশায় চালিত করেন। গোলওয়ালকর তাঁর বইতে লিখছেন, “…হিন্দুস্তানের সমস্ত বিদেশি জাতিদের হিন্দুধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতিকে উচ্চাসনে বসিয়ে সম্মান করতে হবে ও মেনে নিতে হবে…তাদের কোনও কিছু পাওয়ার অধিকার থাকবে না… এমনকী নাগরিকত্ব পাওয়ারও কোনও অধিকার তাদের নেই…..জার্মানি আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে জাতির গৌরব ও পবিত্রতা কীভাবে রক্ষা করতে হয়…. ইহুদিদের নির্মূল করে”। ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদের ধারণা খণ্ডন করে তিনি লেখেন যে, “আমাদের দেশ আদতে হিন্দুরাষ্ট্র ছিল…. কেউ এখানে অতিথি হিসেবে এসেছে যেমন পার্সিরা আর কেউ শত্রু হিসেবে যেমন মুসলিম ও খ্রিস্টানরা… অতএব দেশের মাটির ছেলে আর বিদেশিদের একই অধিকার দেওয়া যায় না।” আজকের আরএসএস-এর তাত্ত্বিক ভিত্তি হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে মোটামুটি এটাই, অপরিবর্তিত।
গোলওয়ালকার কর্মপদ্ধতিতে মনে করতেন যে তাদের কাজ হল মূলধারার রাজনীতি থেকে দূরে থেকে নিঃশব্দে হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের উপযোগী কর্মীবাহিনী গড়ে যাওয়া। তাই নিজস্ব সশস্ত্র শাখা তৈরি, রীতিমত সামরিক কায়দায় অভ্যাস করা এগুলি চলতে শুরু হয় তখন থেকেই। এই রচনায় যেটা বারবার ফোকাস করা হচ্ছে সেটা হল আরএসএস-সহ হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির ‘হিন্দুত্ব’র ধারণা, ‘নাগরিকত্ব’র ধারণা। ফলে সেই ধারণার সূত্রপাত এবং বিকাশলাভ কীভাবে ঘটল স্বাধীনতাপূর্ব ভারতে তা খুঁজবার চেষ্টা করলাম এতক্ষণ। এরপর আবার আমরা চলে আসব আজকের পরিস্থিতির দিকে। মোটামুটি ধরে নিচ্ছি পাঠক জানেন যে স্বাধীনতা পরবর্তীতে আরএসএস-এর জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ, জনসংঘ এবং তারও পরে বিজেপির আত্মপ্রকাশ। এই ইতিহাস নিয়ে আলোচনা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। আজ আমরা যে বিজেপিকে ক্ষমতায় দেখছি তাদের ‘পলিসি মেকিং’ করে পিছন থেকে এই আরএসএস- সহ অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো। এই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি ‘ভারত রাষ্ট্র, হিন্দুরাষ্ট্র’র যে তত্ত্ব খাড়া করে তার ‘সাচ্চা নাগরিক’ কারা হবেন, তা তাদের দার্শনিক অবস্থানেই স্পষ্ট। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের অনেক নেতা-মন্ত্রীই পূর্বতন আরএসএস কর্মী (খোদ প্রধানমন্ত্রী)। অতএব ভারতের নাগরিক কারা হবেন, ‘দেশীয় রক্ত’ বইছে না যাদের ধমনীতে তাদের নাগরিকত্ব থেকে বাদ দিতে হবে। বিজেপি সেটাই করছে। নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন তারই পক্ষে দাঁড়ায়। সেখানে নাগরিকদের প্রথম শ্রেণি, দ্বিতীয় শ্রেণিতে বিভাজন করে ধর্মীয় ভিত্তিতে আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে।
মুসলিম অনুপ্রবেশের প্রচার ও সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ
রচনার শুরুতেই অমিত শাহ ও গিরিরাজ সিংহের বক্তব্য জানিয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবটা কি তার স্বপক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে পারে? গিরিরাজ সিংহের বক্তব্য অনুযায়ী মুসলমান ব্যক্তিগত আইন বহুবিবাহ অনুমোদন করে এবং তার জন্য বর্তমান মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি বজায় থাকলে ভারতে মুসলমান জনসংখ্যা হিন্দু জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে যাবে। কিন্তু জনগণনার তথ্য বলছে এই প্রচার একেবারেই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। আমরা জানি যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিরক্ষরতা, অপ্রাপ্তি ও দারিদ্রের সাথে যুক্ত। মুসলিম নারীদের সাক্ষরতা বৃদ্ধির সাথে সাথে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হিন্দুদের তুলনায় দ্রুতগতিতে কমেছে। ১৯৯১-২০০১ সাল পর্যন্ত হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে ৩.১৬% যেখানে মুসলমানদের অনুরূপ বৃদ্ধির হার কমেছে ৪.৯২%। গত দু’দশকের মধ্যে সাম্প্রতিক কালে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সর্বনিম্ন। বাংলাদেশ থেকে বেআইনি অনুপ্রবেশের যে বহুল প্রচারিত দাবি সরকার আনছে সেই দাবিকেও খারিজ করে দিচ্ছে এই তথ্য। ১৯৯১ থেকে ২০০১ এর মধ্যে আসামের মুসলমান জনসংখ্যা সারা দেশের মুসলমান জনসংখ্যার সমহারে বেড়েছে, পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সারা দেশের বৃদ্ধির হারের তুলনায় কম। তথ্যের অধিকার সংক্রান্ত একটি সাম্প্রতিক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে যে বেআইনি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ সম্পর্কে কোনো বাস্তব তথ্য বা সংখ্যা দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ ‘শোনা কথা’, ‘অবিশ্বস্ত অনুমান’ একটি সরকারি কর্মসূচির ভিত্তি হয়ে উঠল। বিজেপি, আরএসএস-এর মিথ্যাচার কি আসলে গণহত্যার সপক্ষে সমর্থন সৃষ্টির লক্ষ্যে পরিচালিত হল না!
বিজেপি তাদের লিফলেটে পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি করার সপক্ষে জানাচ্ছে অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের চিহ্নিত করা। এবং স্পষ্ট ভাবেই বিজেপি লিখছে পূর্ব ও উত্তর পূর্ব ভারতে এই অবৈধ নাগরিকরা আসলে অধিকাংশই বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলমান। পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি দরকার কারণ বাংলাদেশ গঠনের পর ‘দলে দলে মুসলমান অনুপ্রবেশকারী’ বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়তে শুরু করে। অর্থাৎ কিনা পশ্চিমবঙ্গ খুব শীঘ্রই ইসলামী পরিকল্পনায় বাংলাদেশ হয়ে যাবে! বিজেপি বলছে এর কারণে কোনো হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন উদ্বাস্তুদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই কারণ তাদের জন্য নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করছে সরকার। এখানে সম্পূর্ণভাবে ধর্মের তাস খেলে উদ্বাস্তু ও অনুপ্রবেশকারীর মধ্যে পার্থক্য করা হচ্ছে না কি? বিজেপির উদ্বাস্তু সেলের অন্যতম উদ্যোক্তা মোহিত রায়ের বক্তব্যে তা স্পষ্ট।
নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ধর্মীয় মেরুকরণ এবং নাগরিক দুর্দশা
বর্তমান সংশোধিত আইনে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের নাগরিকত্ব প্রদানের নিয়মে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর আগে শরণার্থীরা ১১ বছর ভারতে থাকলে নাগরিকত্ব পেতেন। এই আইনে বলা হয়েছে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান- এই তিনটি দেশ থেকে আসা ৬টি ধর্মের, যথা হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পার্সি ও খ্রিস্টান শরণার্থীদের জন্য এই সময়কাল ৬ বছর। অমিত শাহ বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছেন, “দেশের মুসলিমদের কোনও চিন্তা করার দরকার নেই।” এর সাথে সাথে এও বলেছেন যে, “যারা দাঙ্গার কারণে দেশছাড়া হচ্ছেন, তাদের ভারত আশ্রয় দেবে, কারণ আমরা উদার।”
প্রশ্ন ওঠে যে অন্যান্য সমস্তরকম নিপীড়ন বাদ দিয়ে কেবল ধর্মীয় নিপীড়নকেই শ্রেণিকরণের ভিত্তি ভাবা হচ্ছে কেন? এবং পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ এই তিনটি দেশকেই কেবলমাত্র হিসেবে আনা হচ্ছে কেন? চীন, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা বাদ যাচ্ছে কেন? কেবলমাত্র ধর্মীয় নিপীড়ণের হিসেবের মধ্যে আনলেও মুসলিম ধর্মের মধ্যেকার বিভিন্ন সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর যেমন বোহরা, আহমেদিয়া, ইসমাইলি, হাসারা ইত্যাদিদের এবং স্বঘোষিত নাস্তিক বা মানবতাবাদীদের এই শ্রেণির মধ্যে আনতে হয়! কারণ এইসব মানুষরাও তো ‘নাগরিকত্ব আইনে উল্লিখিত মুসলিম সংখ্যাধিক্য দেশে নিজেদের কোনো দোষ ছাড়াই অন্যায় আচরণের শিকার হন। এই আইন ভারতকে ইজরায়েলের পথে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয় কি? ইজরায়েল প্যালেস্তিনীয়দের প্রতি যেরকম আচরণ করে থাকে, ভারতের সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে আরএসএস-বিজেপি ঠিক সেই মডেলকেই চাপানোর যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে নয় কি!
আসামে যে ১৯ লক্ষ মানুষ এনআরসি থেকে বাদ পড়েছেন, তাদের অধিকাংশই হিন্দু। কিন্তু বিজেপি সেখানে তাদের বলছে নাগরিকত্ব আইন সমর্থন করতে, কারণ এতে তারা দ্রুত নাগরিকত্ব পাবেন! কিন্তু বাস্তবটা উল্টো ছবিই দেখাচ্ছে। আসাম এখন অগ্নিগর্ভ। এর সাথে সাথেই সংবিধান স্বীকৃত নাগরিক অধিকার তত্ত্বও খারিজ করছে এই আইন। ফলে সরকারের সংবিধান বিরোধী এই উদ্যোগ কি আদৌ একটা দেশের জনগন মেনে নেবেন?
পরিশেষে
গোটা প্রবন্ধে বার বার এটাই খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে নাগরিক পঞ্জি, নাগরিকত্ব আইন নিয়ে গোটা দেশ যখন উত্তাল, বিজেপি সরকারের ঐতিহাসিক উদ্দেশ্যটা এর পেছনে আদপে কী? সঙ্ঘ পরিবারের নীতিগত আদর্শের জায়গা থেকে নয়া আইন একদম খাপেখাপ এবং আরএসএস-এর গ্র্যান্ড প্ল্যানের অংশবিশেষ। ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার যে উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য সঙ্ঘ পরিবারের তাতে সরকারি শিলমোহর পড়েল। পৃথিবীতে কোথাও নাগরিক পঞ্জি তৈরি করার সময় নাগরিকদের উপর দায় চাপানো হয়নি নাগরিকত্ব প্রমাণের। এ যেন ডাইনি খোঁজার মতো করে অভিবাসী খুঁজে বেরানো!
বিভেদের রাজনীতি, ঘৃণার রাজনীতি চলছে গোটা দেশজুড়ে। আমেরিকাতে ট্রাম্প বলছে মেক্সিকান তাড়ালেই আমেরিকা আবার মহান হবে, আরএসএস বলছে মুসলিমরাই আসল দোষী। বিশ্বব্যাপী যেন একটা ফ্যাসিস্ত বাতাবরণ ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু অনুপ্রবেশকারী/উদ্বাস্তু/রিফিউজি যে নামেই ডাকুন না কেন খিদের খোঁজে, কাজের খোঁজে বাধ্য হয়ে সীমান্ত পেরোনো মানুষদের যথাযথ ব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্র দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করছে। আর ডিটেনশন ক্যাম্প-এর ভয়ে সাধারণ মানুষ তিনশো টাকা রোজের কাজটা একশো টাকা রোজে করতে বাধ্য হবেন। কারণ খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। সস্তায় শ্রমিক তৈরি করার পুঁজিবাদের উদ্দেশ্যও এখানে যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। সেই উদ্দেশ্যটিকে ভুলে গেলে চলবে না। পঞ্জি ও নয়া আইন ইতিমধ্যেই যা অনিশ্চয়তার মধ্যে সাধারণ মানুষকে ঠেলে দিয়েছে আগামী দিনে তা ভয়ঙ্কর রূপ নেওয়ার দিকে। দেশের বিপুল অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের আরো সস্তায় তাদের শ্রমকে বিক্রি করতে বাধ্য করা হবে। আর আরএসএস-এর নীতিগত উদ্দেশ্যের সাথেও পুঁজির উদ্দেশ্যের ঠোকাঠুকি এক্ষেত্রে হবে না বরং উভয়পক্ষই লাভবান হবে। ফলে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে পাল্টানোর সংগ্রাম পুঁজিবাদ এবং হিন্দুত্ববাদের দার্শনিক মতাদর্শের জোটের বিরুদ্ধেই লড়তে হবে আগামী দিনে।
লেখক ছাত্রছাত্রী আন্দোলনের কর্মী।