প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকার রক্ষায় প্রশিক্ষণই যথেষ্ঠ নয়


  • October 28, 2019
  • (0 Comments)
  • 1624 Views

বিমানবন্দরে প্রতিবন্ধী মানুষদের হেনস্থার খবর, আমরা যারা এই বিষয়ে কাজ করি, তারা নিয়মিত পাই। সংবাদমাধ্যম এই বিষয়ে খবর করে, আমরা ফেসবুক সোস্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ করি এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে চিঠি পাঠাই। এই ঘটনাগুলি নিয়ে হইচই হয় কয়েকদিন, তারপর আবারও একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। আমরা কি ভেবে দেখতে পারি না এই ঘটনাগুলির মূল কারণগুলি কী কীলিখেছেন শম্পা সেনগুপ্ত     

 

অক্টোবর মাসের কুড়ি তারিখ যখন দিল্লি যাব বলে রওনা দিয়েছি বাড়ি থেকে, তখন মাথার মধ্যে চিন্তা ঘুরছিল, যে সভায় যাচ্ছি সেখানে কী কী বিষয়ে আলোচনায় জোর দেওয়া উচিত। গত মাসে রাষ্ট্রসংঘ আমাদের দেশকে জানিয়েছে প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকার রক্ষায় ভারত সরকার কোন কোন জায়গায় পিছিয়ে রয়েছে। তাই, জাতীয় স্তরের সভায় কথা হবে এই বিষয়ে এবং বিশেষ ভাবে প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য রাষ্ট্রসংঘ কী কী বলল আর আমাদের আগামী কর্মসূচি নিয়ে। সভায় পৌঁছানোর অনেক আগেই যে প্রতিবন্ধী নারীদের নিয়ে লড়াই শুরু হয়ে যাবে আর যাত্রাপথ হয়ে উঠবে আন্দোলনের আঙিনা তা ছিল না কল্পনার মধ্যে ।

 

কলকাতা থেকে চার জন একসাথে এক উড়োজাহাজে যাওয়ার কথা সেইদিন। আমরা চারজন — রত্নাবলী রায়, জিজা ঘোষ, কুহু দাস এবং আমি। সবাই প্রতিবন্ধকতা ও জেন্ডার আন্দোলনের  সক্রিয় কর্মী । বিমানবন্দরে ঢোকার কিছুক্ষন পরেই শুনি জিজা ফোন করে বলছেন, “আমাকে গো এয়ার -এর গ্রাউন্ড স্টাফ ভিতরে যেতে দিচ্ছে না, বলছে, ‘আমি একা ট্রাভেল করতে সক্ষম নই’।” আমরা তিনজন তখন ভীষণ উত্তেজিত। ঘটনা হল এই যে জিজার সঙ্গে এই প্রথম এমনটা হল না। স্পাইস জেট এয়ারওয়েজের বিমান থেকে ২০১২ সালে তাঁকে একবার নামিয়ে দেওয়া হয়। এরপর কলকাতার আকাশ দিয়ে বয়ে গেছে অনেক ঝড়। সেই ২০১২-এর ঘটনার বিরুদ্ধে পথসভা, চিঠিপত্র করা এবং শেষে সুপ্রিম কোর্ট থেকে ছিনিয়ে আনা গিয়েছিল জয়। স্পাইস জেট কোম্পানি বাধ্য হয়েছিল জিজাকে দশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে। জিজা ছাড়াও আরও বহু প্রতিবন্ধী মানুষদের বিমানবন্দরের অভিজ্ঞতা একইরকম। কুড়ি তারিখ দুপুরে গো এয়ার বিমান সংস্থার মুখপাত্রদের আমরা বাধ্য করেছিলাম ক্ষমা প্রার্থনা করতে। জিজাকে শুধু তারা বিমানে যাত্রা করতে দেন, তাই নয়, তাদের কর্মী দলকে প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে রাজি হন। বলাই বাহুল্য আমরা চারজন একসাথে ছিলাম বলে লড়াই জোরদার হয়েছিল, একা কোনও  প্রতিবন্ধী মানুষের পক্ষে এই লড়াই করা সম্ভব হতো না।

 

কিন্তু হেনস্থা সেদিন শুধু মাত্র জিজার হয়নি। সেই দিন তার খানিকটা আগে কুহু যখন সিকিউরিটি চেক করাচ্ছিলেন সিআইএসএফ-এর মহিলাকর্মী তাঁকে বলেন ক্যালিপার খুলতে এবং দরকার হলে জিন্স খুলেও তিনি পরীক্ষা করবেন। কুহু প্রতিবাদ করেন এবং বলেন ক্যালিপার পরীক্ষা করার যে বিশেষ পদ্ধতি আছে সেই পদ্ধতি গ্রহণ করতে। মহিলা নিরপত্তাকর্মী কুহুকে বলেন, তিনি জীবনে প্রথমবার ক্যালিপার পরা কাউকে দেখছেন, তাই এই পদ্ধতি তিনি জানেন না। কুহু প্রতিবাদ করেন এবং ক্যালিপার বা জিন্স না খুলে  সিকিউরিটি গেট পেরোতে সক্ষম হন। আবারও মনে রাখা দরকার,  কুহুর মতো কোনো অ্যাক্টিভিস্ট না হয়ে যদি সাধারণ কোনো প্রতিবন্ধী মানুষ থাকতেন, ঐ পরিস্থিতিতে জোরালো প্রতিবাদ করতে হয়তো পারতেন না।

 

বিমানবন্দরে প্রতিবন্ধী মানুষদের হেনস্থার খবর, আমরা যারা এই বিষয়ে কাজ করি, তারা নিয়মিত পাই। সংবাদমাধ্যম এই বিষয়ে খবর করে, আমরা অ্যাক্টিভিস্টরা আমাদের ফেসবুক ও সোস্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ করি এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে চিঠি পাঠাই। এই ঘটনাগুলি নিয়ে হইচই হয় কয়েকদিন, তারপর থেমেও যায়। যদিও কোর্ট কেস, বিভিন্ন ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা বেশ কিছু এনজিও-রা করে থাকে। তা সত্ত্বেও আবারও একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। আমরা কি ভেবে দেখতে পারি না এই ঘটনাগুলির মূল কারণগুলি কী কী?

 

সেইদিন দু’জন প্রতিবন্ধী নারীর অপমান নিজের সামনে ঘটতে দেখে বেশ কিছু কথা মনে হয়েছিল। যাঁরা অপমান করছেন দু’জনেই কম বয়সি অ-প্রতিবন্ধী মহিলা। একজন সরকারি কর্মচারী আরেকজন বেসরকারি কাজ করেন। দু’জনেই পড়াশুনো করেছেন, না হলে এই চাকরি পেতেন না। হয়তো তাঁরা এই শহরে বড় হননি। তাঁদের জীবন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা নেই কিন্তু তাঁদের ব্যবহারে পরিষ্কার বোঝা গেল তাঁরা প্রতিবন্ধী মানুষ খুব বেশি দেখেননি। এতে অবাক হওয়ার অবশ্য কিছু নেই। যেখানেই ট্রেনিং করাতে যাই আমি কি বলি না, ‘Disabled population is the invisible minority?’ প্রতি ওয়ার্কশপেই তো জিজ্ঞাসা করি কাদের স্কুলে প্রতিবন্ধী সহপাঠী ছিল। কখনো একটা হাত ওঠে, কখনো দুই তিনটি। আমরা কেনই বা অবাক হব যখন গো এয়ার সংস্থার কর্মী বলেন, তিনি জিজাকে দেখে ভয় পেয়ে গেছিলেন? বা কেন অবাক হব যখন সিএসএফআই-এর মহিলা কুহুকে বলেন, “পহেলি বার অ্যায়সি  দেখা হ্যায়।” শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, চাকরির ক্ষেত্রে, বৃহত্তর সমাজে প্রতিবন্ধী মানুষদের কতটা দেখতে পাওয়া যায়? ইনক্লুসিভ এডুকেশন বা সকলের অর্ন্তভুক্তির সহায়ক শিক্ষাব্যবস্থার নামে আমরা প্রহসন চালাই আর স্পেশাল চাইল্ড, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ইত্যাদি নাম দিয়ে এই মানুষদের সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখি। একজন মানুষ পড়াশুনা শেষ করে, চাকরিতে ঢোকার পর, প্রতিবন্ধকতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ নেবে আর সে এই বিষয়ে সংবেদনশীল হয়ে উঠবে এমনটা আশা করা মুশকিল। আমরা অ্যাক্টিভিস্ট হিসাবে বিমানবন্দরের সব কর্মী যাতে প্রশিক্ষণ পান সে দাবি নিশ্চয়ই করব কিন্তু যে গলদ গোড়াতেই আছে, তা কি ওপর থেকে চাপিয়ে দিলে সমাধানের রাস্তা বেরোবে? ডাইভার্সিটি বা বৈচিত্র বা বিভিন্ন ধরনের মানুষ দেখতে যারা ছোট বয়স থেকে অভ্যস্ত, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া অনেক সহজ, তা সাধারণ বুদ্ধি বলে।

 

বিশে অক্টোবরের এই ঘটনা কলকাতার অনেকগুলি বহুলপ্রচারিত সংবাদপত্র খবর করে। খানিকটা হয়ত চাপে পড়েই কলকাতা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ক্ষমা প্রার্থনা করে ট্যুইট করে। এরপরে এই খবর আমাদের চারজনের ছবি সহ বিবিসি সংবাদসংস্থাও প্রকাশ করে। সংবাদপত্রের এই প্রচার আমাদের আন্দোলনকে কিছুটা এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। কিন্তু আমার মনে আরও বড় প্রশ্ন এনে দেয়। যে বছর তেশরা ডিসেম্বর বাসে উঠতে দেয়নি বলে পনেরো জন প্রতিবন্ধী মানুষদের এক দল বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসের অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পারেনি, সাংবাদিকরা সে কথা জেনেও তো কেউ এক কলমও লেখেননি। কলকাতার বাস ট্রাম মেট্রো সবেতেই প্রতিবন্ধী মানুষরা বাধা পান, সেগুলো প্রথম পাতায় আসে না কেন? প্রতিবন্ধকতা আর দারিদ্র্য অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আমাদের দেশে খুব কম সংখ্যক প্রতিবন্ধী মানুষ বিমানে চড়ার ক্ষমতা রাখেন। তবে কি বিমানে চড়ার উপযুক্ত না হলে তাঁরা সংবাদপত্রে স্থান পাবেন না? প্রায় সব কটি খবরের কাগজে লেখা হল জিজা এর আগে বিদেশে গিয়ে যে ডিগ্রি পেয়েছেন, তার কথা। জিজার সাফল্যে আমরা সবাই আনন্দিত কিন্তু যে সব প্রতিবন্ধী মানুষরা উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে কলেজ অবধি পৌঁছাতে পারেন না, তাদের খবর কে লিখবে? প্রতিবন্ধী আন্দোলনেও অনেক সময় দেখেছি যেসব প্রতিবন্ধী মানুষ ইংরেজিতে সড়গড়, অফুরান ইন্টারনেটের গ্রাহক, তাঁরাই যেন সামনের সারিতে। পরিসংখ্যান বলে ভারতের প্রতিবন্ধী মানুষদের মধ্যে সত্তর ভাগ গ্রামে থাকে। কিন্তু জাতীয় স্তরের কোনো মিটিংয়ে আমি গ্রাম থেকে আসা প্রতিবন্ধী মানুষের দেখা পাই না। শহরের যেসব মানুষ ইংরেজি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, তারাও খুব কম উপস্থিত। সেক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী আন্দোলনের দায়িত্ব কি হয়ে দাঁড়ায় না এই মানুষগুলিকে সামনে টেনে আনা? সংবাদ মাধ্যমের দায়িত্ব কি শুধুই বিমানবন্দরে বৈষম্যমূলক আচরণগুলি প্রকাশ করা? তাহলে রোজ যে মানুষগুলিকে দেখে বাস না দাঁড়িয়ে হুশ করে চলে যায়, তাদের কথা কে প্রকাশ করবে?

 

 

লেখক প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলন লিঙ্গসাম্য আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী

 

Share this
Leave a Comment