রূপান্তরকামী মানুষদের অধিকার, জীবিকা, সংস্কৃতি বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে চলেছে প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট। চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যুর ঠিক পরের বছর ২০১৪ থেকে তারা শুরু করেছে ঋতুপর্ণ ঘোষ স্মারক বক্তৃতা। ভারতবর্ষের সম সময়ের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় আমন্ত্রিত বক্তাদের বাগ্মীতায়, তাঁদের মঞ্চ উপস্থাপনায়। এই বছর ২০১৯-এর স্মারক বক্তৃতায় কলকাতার অন্যতম ঐতিহ্যশালী চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহ বসুশ্রীতে অতিথি বক্তা ছিলেন সাংবাদিক রভিশ কুমার। সুদর্শনা চক্রবর্তীর প্রতিবেদন।
অনুষ্ঠান শুরুর সূচনা মন্তব্যে আয়োজক সংস্থা প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট-এর পক্ষ থেকে অনিন্দ্য হাজরা-র বক্তব্যে উঠে আসে রভিশ কুমার যে কাজের জন্য আজ সারা দেশ জুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে – রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করার মতো সাহসী সাংবাদিকতা। আলাদা করে ধন্যবাদ হয়তো তাঁর প্রাপ্য ছিল না, যদি না সারা ভারতের সাংবাদিকতার চিত্রটি বর্তমানে আমূল বদলে যেত, যেখানে সরকারকে প্রশ্ন করার মতো পরিসর বা ইচ্ছা সাংবাদিকদের মধ্যে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কঠিন সময়ে এই কঠিন কাজটিই রভিশ অবিরাম চালিয়ে যাচ্ছেন। অনিন্দ্য মনে করিয়ে দেন রূপান্তরকামী মানুষদের জীবনের প্রতিটি স্তরে যে লড়াই তা বর্তমান সময়ে দেশের রাজনীতি ও সমাজ বিচ্ছিন্ন নয়। তাছাড়া স্মারক বক্তৃতার ষষ্ঠ বছরটিও তাঁদের জীবনে আলাদা মাত্রা বহন করে আনে, কারণ ইংরেজিতে ‘সিক্স’, বাংলা ও হিন্দি-তে এর প্রতিশব্দটি যে রূপান্তরকামী মানুষদের জীবনে কীভাবে ব্যবহৃত হয় সে বিষয়ে সকলেই অবগত।
সুতরাং, ষষ্ঠতম বছরে রভিশ কুমারের বলিষ্ঠ বক্তব্যে যে ভারতের কথা উঠে আসে তা সকলের বাসযোগ্য, বৈচিত্র্যময় এক ‘ইনক্লুসিভ’ ভারত, যেখানে কোনও নাগরিককে তাঁর কোনও রকম পরিচিতির ভিত্তিতে আলাদা করে দেওয়ার প্রশ্ন উঠবে না।
রভিশ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ সূক্ষ্ম কৌতুক মেশানো তীক্ষ্ণ ও তথ্যপূর্ণ বক্তব্য পরিবেশনের জনপ্রিয় স্বকীয় ধরনে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে প্রায় দু’ঘন্টা বক্তৃতা ও প্রশ্নোত্তর পর্বে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর বক্তৃতায় বারবার ঘুরে-ফিরে আসে ‘বাঙ্গাল মে বিবেক কি আকাল চল রহি হ্যায়’ (বাংলায় বিবেকের দুর্ভিক্ষ চলছে)। একটা সময়ের পর যা দর্শক-শ্রোতার কাছে বিরক্তির কারণ হতে পারে, নিজের পরিচিতি, রাজনৈতিক সচেতনতা, প্রতিরোধের ইতিহাস – যা কিছু নিয়ে বাঙালির অহঙ্কার যখন তাকেই বারবার আঘাত করেন বক্তা তখন সত্যিই মনে হয় আয়নার সমানে দাঁড়িয়ে দেখি ‘সব ঠিক আছে তো’!
তাঁর বক্তৃতা জুড়ে মুখ্যত ছিল এনআরসি বা নাগরিক পঞ্জি। যেভাবে বাংলায় ক্রমাগত এনআরসি-র হুমকি দেওয়া হচ্ছে বর্তমান কেন্দ্র সরকারের তরফ থেকে এবং খুবই সচেতনভাবে ঘোষণা করা হচ্ছে হিন্দু, শিখ, ক্রিশ্চানদের কোনও ভয় নেই ও বাদ দেওয়া হচ্ছে মুসলমান সম্প্রদায়ের কথা তা আমাদের আরও বেশি রাগিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। বাংলায় নির্বাচনে এনআরসি-কে মুখ্য ইস্যু করা হবে এমন কথা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলার পরেও কেন পশ্চিমবঙ্গে বিরোধীরা বা সাধারণ মানুষ একজোটে এহেন চরম অগণতান্ত্রিক উচ্চারণের বিরূদ্ধে তুমুল প্রতিবাদে পথে নামলেন না তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তিনি। কারণ একটি দেশের সরকার কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্য নয় পরোক্ষভাবেও এমন বলার অধিকার তার মন্ত্রী ও প্রতিনিধিদের নেই। ভারতের সংবিধান সামান্য পড়া থাকলেও এই কথার তীব্র বিরোধিতা করার কথা। রববীন্দ্রনাথের বাংলায় সেই প্রতিবাদ এখন তীব্রতর হওয়ার সময়। কারণ রবীন্দ্রনাথ যে প্রতিবাদের কথা বলেন, যেভাবে সমাজে সকলের অর্ন্তভুক্তি দেখেন তা শুধু তার গান গেয়ে বজায় রাখা সম্ভব নয়। তারজন্য পথে নামতে হবেই।
রভিশ অত্যন্ত সচেতন ভাবেই বাংলার আবেগের সঙ্গে জড়িত তথা হিন্দুত্ববাদের প্রচারে যাঁদের উদাহরণ খুব সচেতনভাবে দেওয়া হয়ে থাকে তাঁদের কথা নিয়ে আসেন আর চমৎকারভাবে সেগুলিই ব্যবহার করেন এই হিন্দু রাষ্ট্রের ধুয়ো তোলা, নাগরিক পঞ্জি চালু করা সরকারের বিরূদ্ধে। উদাহরণ দেন বিবেকানন্দ-র। যাঁকে এই তথাকথিত জাতীয়তাবাদীরা হিন্দুত্বের ধারক-বাহক বলে তুলে ধরছেন। বলেন তিনিও কেমন বলেছেন ভারতবর্ষ আসলে সকলের দেশ, হিন্দু সমাজ সকলকে আপন করে নিতে বলে। এভাবেই তিনি নরম হিন্দুত্বকেই ব্যবহার করেছেন সমালোচনার জন্য। যে পন্থাটি যদিও অবশ্যই প্রশ্নের বাইরে নয়।
এই বক্তৃতায় যা বহুবার তাঁর কথায় ফিরে আসে তা হল রাস্তায় নেমে নিজের পড়শি, পাশের মানুষটির সঙ্গে কথা বলা। এনআরসি আতঙ্ক দূর করার জন্য পথে নেমে মানুষের সঙ্গে কথা বলা-ই এখন সবচেয়ে জরুরি ও সময়োপযোগী পন্থা বলে মনে করেন তিনি। মানুষের মনে যে অহেতুক ভয় ও সামগ্রিকভাবে যে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে বিজেপি শাসিত কেন্দ্র সরকার তার বিরূদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য মানুষের জোট বাঁধা এক ও একমাত্র পথ। আর তা নিজের বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে হতে পারে না, তারজন্য প্রতিবেশী মানুষদের চেনা ও কথা বলা প্রয়োজন। এবং এই প্রশ্নও অবিচ্ছিন্নভাবে ক্রমাগত চালিয়ে যাওয়া দরকার যে একটি দেশের সরকার ধর্মের নামে কীভাবে এমন পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করতে পারে?
স্পষ্টতই কোনও রাখঢাক না রেখে তিনি বলেন যে, এই সরকারের আসল ভয় শিক্ষাকে। কারণ শিক্ষাই মানুষকে অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড়াতে শেখায়, শেখায় ক্রমাগত বিরোধীতা চালিয়ে যেতে। সেইজন্যই দেশের প্রথম সারির শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি তাদের এত ক্রোধ ও তাই তারা হোয়াটস্অ্যাপ ইউনিভার্সিটিতে নিজেদের প্রোপাগ্যান্ডা রাজনীতি চালিয়ে যেতে চান। যেখানে মিথ্যে তথ্যের চালাচালি চলতে থাকে ও তা ক্রমশই উসকানিমূলক হয়ে যায়। সঠিক তথ্য যাচাই না করে মিথ্যের ভিতের উপর চলতে থাকে দেশাত্মবোধের জয়জয়কার। তবে একইসঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জেলায় যে কলেজগুলি রয়েছে সেখানে যে পড়াশোনার সমস্যা, শিক্ষাব্যবস্থার অবক্ষয় তা নিয়ে যতক্ষণ কথা না বলা হচ্ছে ততক্ষণ আমূল পরিবর্তন সম্ভব নয়।
অবশ্য দেশের গণমাধ্যম/মিডিয়ার যে লজ্জাজনক অবস্থান তা এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। কারণ রভিশ স্বীকার করে নিলেন যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বলে এ দেশে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তথ্য যাতে আপামর মানুষের সামনে না আসে সেজন্য টেলিভিশন, সংবাদপত্র থেকে তৃণমূল স্তরে সাংবাদিকতা বা গ্রাউন্ড রিপোর্টিং-এর চলটি তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন পুরোপুরি অ্যাঙ্কর বা সঞ্চালক নির্ভর সংবাদব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে। যা এক মারাত্মক ট্রেন্ড। হয়তো টেলিভিশনের পর্দায় তাঁদের মতো অ্যাঙ্করদের দেখে তাঁদের তারকা তৈরি করে দেওয়ার প্রবণতা হয়, কিন্তু আসলে রভিশ নিজে স্বীকার করলেন যে এ অন্তত তাঁর জন্য এক বড় ‘ক্রাইসিস’। ক্রমাগত রিপোর্টিং-এর সুযোগ কমিয়ে দেওয়ার কারণে আসলে যে সরকারের সমালোচনার সুযোগটাই কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাও মনে করিয়ে দিলেন তিনি। এরকম অবস্থায় নিজেরা তথ্য যাচাই করে তা নানাভাবে সকলের সামনে তুলে ধরার উপরেই জোর দিলেন এই সাংবাদিক। প্রতিদিন ২০০০ শব্দ লেখার চর্চা জারি রাখার পরামর্শও দিলেন। তার বাইরে রয়েছে মিডিয়া-র পিতৃতান্ত্রিক, ব্রাক্ষ্মন্যবাদী চেহারা, যা যে কোনও বিরূদ্ধ স্বরকে চুপ করিয়ে দিচ্ছে আঙুল তুলে। মহিলাদেরও সেই পিতৃতন্ত্রের মোড়কে ঢেকে ফেলা হচ্ছে। মিডিয়ার এই চেহারা কষ্টকর।
রভিশের এই বক্তৃতায় বারবারই বলছিলেন যে প্রশ্ন করার কোনও বিকল্প হতে পারে না। আর উঠে আসছিল বাংলায় কীভাবে বিজেপি তাদের পা শক্ত করছে সেই বিষয়টিও। মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন বাংলার ইতিহাসের কথা। দক্ষিণ আফ্রিকায় মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর সাথী শেখ হাফিজের পরিচিতি পত্রের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মতো করে প্রতিরোধ তৈরির ডাক দিলেন নাগরিক পঞ্জির বিরূদ্ধে। বললেন – জনতা সেই যে বিবেক হারিয়ে ফেলে না, নিশ্চুপ থাকে না, ভীত-সন্ত্রস্ত হয় না, নিজের ও পাশের নাগরিকের ভালমন্দ বিষয়ে সচেতন থাকে। হিন্দুত্বের হাত ধরে বাংলার ঐতিহ্য যেন নাগরিক পঞ্জির চোখরাঙানিতে হাতছাড়া না হয়ে যায় তাও মনে করিয়ে দিলেন তিনি। কারণ এই বাংলাতেই কেউ ‘জয় হিন্দ’ বলেছিলেন, ‘জনগনমন’ লিখেছিলেন, এঁকেছিলেন প্রথম ‘ভারতমাতা’র ছবি, যা চিরকাল অর্ন্তভুক্তির কথা বলেছে, সব নাগরিকের অধিকারের কথা বলেছে।
না, তিনি আলাদা করে কাশ্মীর প্রসঙ্গে কথা বলেননি। কারণ, একজন সাংবাদিক হিসাবে তিনি মনে করছেন বোধহয় নতুন করে এই বক্তৃতা মঞ্চে আলোচনার প্রয়োজন ছিল না। অবশ্য নাগরিক পঞ্জি নিয়ে তাঁর বক্তব্য ও কাশ্মীর প্রসঙ্গে নিশ্চুপ থাকা নিয়েও কথা বলা যায়। যদিও তিনি যখন বলেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকা বা সরকারের কাছ থেকে তথ্য জানতে না পারা আসলে আমাদের ইতিমধ্যেই ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’-এ রাখার শামিল, তখন মনে হয় না কি যে কাশ্মীরের মানুষদের উপরে যে নিষেধাজ্ঞা তাতে আমরাও যেন কোনওভাবে ঢুকে গেছি।
এভাবেই রাষ্ট্রের সন্ত্রাস, ধর্মের নামে পক্ষপাত, সাম্প্রদায়িকতার উস্কানির বিরূদ্ধে ভারতের বৈচিত্র্য বজায় রেখে বহুস্বর তৈরির ডাক দিলেন এক সাংবাদিক, ষষ্ঠ ঋতুপর্ণ ঘোষ স্মারক বক্তৃতার মঞ্চ থেকে। যেখানে অনুষ্ঠান শুরুর আগে দর্শকদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অনেক শ্রোতাকেই বলতে শোনা গেল – ‘এখনই তো এধরনের আলোচনা শোনার, কথা বলার সময়, আমাদের দেশ এখন একটা বিপন্ন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, আমাদের তো আসতেই হবে।’
লেখক সাংবাদিক এবং ডকুমেন্টারি নির্মাতা। ছবির সুত্রঃ দেবাশীষ ঘোষ।