সিরিয়ার কুর্দ জনগোষ্ঠীর বাসভূমি রোজাভা আক্রান্ত, আক্রান্ত তুরস্কের ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রপ্রধান এরদাগন-এর বাহিনীর দ্বারা। কনগ্রা-স্টার, কুর্দ-নারী বাহিনী আজ আবেদন রেখেছে বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে তাঁদের পাশে দাড়ানোর জন্য।
তুরস্কের এই অগ্রাসন সফল হলে, ইসলামিক মৌলবাদী, যারা তুরস্কের সৈন্যদের হয়ে লড়াই করছে, তাদের দ্বারা গনহত্যা সংগঠিত হবে রোজাভা প্রদেশে। বিফল হবে রোজাভা বিপ্লব, যা মধ্য প্রাচ্যে উগ্র ইসলামীয় শাসনব্যবস্থার বিপরীতে সম্পূর্ণভাবে এক বৈপ্লবিক এবং রাষ্ট্রবিহীন গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। কুর্দদের এই ব্যবস্থার মূলে আছে কমিউন আর কাউন্সিল, যা ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণে সক্ষম হয়েছে। নারী-পুরুষের সমান অধিকার কে সুনিশ্চিত করা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে নারী-পুরুষের সমান উপস্থতি, এই সমস্ত বৈপ্লবিক প্রয়াস সমগ্র বিশ্বের নজর কেড়েছে। কুর্দদের অর্থনীতির পরীক্ষা নিরীক্ষা শুধু মধ্য প্রাচ্যের শোষিত মানুষের কাছেই নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী জনতার কাছে অনুপ্রেরণা জোগায়। আর ঠিক এ কারণেই ওরা ভয় পেয়েছে, ভয় পেয়েছে এরদাগন আর সিরিয়া, ইরান সহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের শাসকশেণী। তাদের এই ভয়ের আসল কারণ – কুর্দদের এবং সিরিয়া- র অন্য জনজাতিদের এই বিকল্প রাষ্ট্রব্যবসস্থা অনুপ্রেরণা জোগাবে এই অংশের প্রান্তিক মানুষদের, অনুপ্রেরণা জোগাবে বঞ্চনা আর বৈষম্যের উৎস প্রচলিত শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর বাহিনীকে প্রত্যাহার করে নিয়ে সুযোগ করে দিয়েছে তুরস্কের আক্রমন এর অনুকূল পরিস্থিতি করে দিতে। বুঝতে অসুবিধা হয় না আমেরিকাও মধ্য প্রাচ্যে কোনও বিপ্লবী সরকারের উপস্থিতি চায় না। চায় আরো একটা চরম প্রতিক্রিয়াশীল সরকার, যা সুযোগ করে দেবে আমেরিকাকে ঐ অংশকে তার লুঠের ক্ষেত্র বানাতে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ২০১৪ সনে ইসলামিক স্টেট (আইএস) বিরোধী যুদ্ধে মার্কিন সৈন্যবাহিনীর সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্স (এসডিএফ) সহায়ক শক্তি ছিল রোজাভা। মার্কিন বিমান আক্রমন সাহায্য নিয়ে সফল হয় আইএস জঙ্গীদের কাছ থেকে কোবানিকে (রোজাভার একটি ক্যান্টন) দখল নিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করে নিয়ে কুর্দদের তুরস্কের আক্রমনের সামনে ঠেলে দিয়েছে। বৃহৎ শক্তির দ্বারা বিশ্বাসভঙ্গ নতুন নয় কুর্দদের ইতিহাসে। একটি প্রচলিত কথা আছে কুর্দদের কোন বন্ধু নেই, পাহাড় ছাড়া। বৃহৎ শক্তির দ্বারা এই বিশ্বাসভঙ্গের সূচনাকে ধরা যেতে পারে ১৯২৩ সন থেকে, অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের সময় থেকে। সেই সময় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে কুর্দদের একটি রাষ্ট্রও গঠন করা হবে। কিন্তু পরে তা বাতিল করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের বৃহৎ শক্তিগুলি, ইংরেজ এবং ফরাসি সরকার সাইকস- পিকো চুক্তি দ্বারা বিশ্বাসভঙ্গ করে। কুর্দ জনগোষ্ঠিকে বরং সিরিয়া, ইরান, ইরাকের এবং তুরস্কর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সে সব দেশেই কুর্দরা অত্যাচারিত হয়েছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় পিপলস প্রটেকশন ইউনিট (ওয়াইপিজি)- এসডিএফ এর কুর্দিশ সৈন্যবাহিনী – সফল হয় কোবানি, আফ্রিন, সহ কয়েকটি শহর দখল নিতে এবং উত্তর ও পূর্ব সিরিয়া একটি ডিফ্যাক্টো স্বশাসিত শাসন কায়েম হয় ২০১২ সনে।[1] আর তাদের মূল শক্তি এক গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, পুঁজিবাদ বিরোধী এবং লিঙ্গ বৈষম্য নির্ভেদকারী ব্যবস্থা যার কারনে স্বতস্ফুর্তভাবে কুর্দ সহ সিরিয়ার অন্যান্য অধিবাসী যেমন আরব, অ্যাসিরিয়ান এবং চেচেন – রাও সামিল হয়েছে রোজাভা গর্তে এবং তুরস্কের আগ্রাসন রুখতে। খবরে প্রকাশ, আর্মেনিয়ান ব্যাটেলিয়ন যোগ দিয়েছে সেরেকানিয়ে শহরকে রক্ষা করার জন্য।[2] অন্য দেশে শাসক শ্রেণী নয়, এই লড়াইয়ে কুর্দদের নির্ভর করতে হবে তাদের শক্তির উপর, মধ্য প্রাচ্য সহ সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নিপীড়িত মানুষের সাপোর্টের উপর। ইরান, ইরাক এবং তুরস্কের কুর্দ গনগোষ্ঠী ও সামিল হোক এই লড়াইয়ে, নিজ নিজ দেশে ব্যাপক গণ আন্দোলন গড়ে তুলুক অবিলম্বে এই যুদ্ধ বন্ধ করার দাবিতে। আগামী ২৩ তারিখ, কলকাতায় অবস্থিত তুরস্কের দূতাবাসে এক বিক্ষোভ প্রদর্শনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। সময় বেলা ৩টে। এই জমায়েতের উদ্যোগ নিয়েছে ‘পথে এবার নামো সাথী’ নামে একটি ফোরাম। এতে অংশ নেবে পিডি এস এফ, আইসা, ইউ এস ডি এফ সহ কিছু দলের কর্মী এবং সাধারন মানুষ।
নীচের অংশে কনগ্রা স্টার-এর আবেদনকে বাংলায় অনুবাদ করে অন্তর্ভুক্ত করা হল।
উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার উপর তুরস্কের হানা প্রতিরোধে কনগ্রা -স্টার এর আবেদন
৯ অক্টোবর, ২০১৯, বিকেল ৪.২০তে সেরেনকি শহরের মিসারফায় বোমা ফেলে তুরস্ক উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার উপর যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এখনো অবধি পাওয়া খবর অনুযায়ী এই আক্রমনে নিহত হয়েছেন বেশ কিছুজন সাধারন নাগরিক এবং এসডিএফ-এর সৈন্য। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যা আমরা যত দেরি করবো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে, মৃত ও জখম মানুষের সংখ্যা তত বাড়বে। মিসারফায় এই আক্রমনের সাথে সাথেই মর্টার হানা ঘটেছে এন ইসা, গিরে স্পি, কোওয়ামিশোলো, তিরেবেসপি এবং দিরবেসিয়েতে। বর্তমানে হানাদার তুর্কী বাহিনী চ এবং হাওয়িযার(কামান) আক্রমন সংগঠিত করেছে ডেরিক ও গ্রেসপি-র মাঝখানে ৪৬০ কিলোমিটারে জায়গা জুড়ে। তুরস্কের সীমান্ত থেকে রোজাভা-উত্তর-পূর্বে প্রবেশ করানো হচ্ছে দলে দলে সন্ত্রাসবাদীদেরকে। সীমান্ত এলাকায় এসডিএফ এর প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে, তুরস্ক জোর দিয়েছে বিমান হানা চালানোয়।
তুরস্কের রিফিউজিদের পূর্ণবিন্যাস এর অজুহাতে, তুরস্ক কুর্দের অংশে এক জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করার কাজ করছে। এইটি বাস্তব যে এই গনহত্যার মূল লক্ষ্য নানা ধর্ম আর সংস্কৃতির জনগোষ্ঠি গুলিকে নির্মূল করা। এই আন্তর্জাতিক চক্রান্তের শুরু কুর্দদের জননেতা আবদুল্লা ওকালানকে সিরিয়া থেকে নির্বাসিত করার মধ্যে দিয়ে। আজ থেকে ২০ বছর আগে ঐ ঘটনা ঘটেছিল ৯ অক্টোবর। ৯ই অক্টোবর, আবদুল্লার নির্বাসনের ২০তম দিবসে সিরিয়া আক্রান্ত হল তুরস্কের দ্বারা। সিরিয়ার মানুষ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যুদ্ধ চালাবে তাদের স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য, প্রতিরোধ গড়ে তুলবে হানাদারদের বিরুদ্ধে। আজ তারা প্রস্তুত অস্ত্র হাতে সীমান্তকে রক্ষা করার জন্য।
উত্তর-পূর্ব সিরিয়া মহিলারা বিগত কয়েক মাস ধরে রাস্তায় নেমেছে, স্লোগান দিয়েছে — রক্ষা করো নিজেদের সম্মান আর দেশের মাটি, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গড়ে তোলো প্রতিরোধ।
যে মূল্যবোধকে তুর্কীরা নষ্ট করতে চায়, তা নারী-বিপ্লবের আদর্শ। আইসিস বিরুদ্ধে যুদ্ধে শহীদ নারী ও পুরুষ যোদ্ধাদের রক্ত দিয়ে এই মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে সিরিয়ার এই অংশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক স্বাধীন দ্বীপ। সেখানে নারীরা সক্ষম তাদের শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক বিকাশ ঘটাতে। অন্যদিকে তুরস্ক তার হাজার বছরের পুরোনো পিতৃতান্ত্রিক চিন্তা নিয়ে আক্রমন চালাচ্ছে রোজাভার নারীদের উপর, কারণ রোজাভা এই অংশে একটা স্বাধীন দ্বীপের মত। তুরস্ক মহিলাদের যৌন-দাসী ছাড়া আর কিছু মনে করে না। তাদের লক্ষ্য এই স্বাধীন সমাজকে ধ্বংশ করা যেখানে মহিলারা সমাজকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।
এই কারণে আমরা বিশ্বের নারীদের কাছে এই আবেদন রাখছি এই স্বাধীন দ্বীপটিকে রক্ষার্থে এগিয়ে আসুন, এটি কঠিন আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আমাদের জন্য। বিশ্বের সকল প্রান্তের ‘মহিলারা রোজাভাকে রক্ষা করো’— এই মর্মে প্রচার আন্দোলন গড়ে তুলুন। তুরস্কের ফ্যাসিস্ট সরকারের আক্রমন মধ্য প্রাচ্যের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় বাধা দিচ্ছে। একই সাথে, মধ্য প্রাচ্যের মানুষের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার আদর্শের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং মধ্য প্রাচ্যে বৈপ্লবিক আন্দোলনের বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছে তুরস্ক। এই ফ্যাসিস্ট তুর্কি স্টেটের সহায়ক শক্তি এই অংশের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র এবং ন্যাটোর রাষ্ট্ররা। তাই মধ্য প্রাচ্য, ইয়োরোপ, আমেরিকা, ল্যাতিন আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা সহ সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, অ্যানার্কিস্ট এবং পরিবেশ আন্দোলনকারীদের কাছে আমরা আবেদন রাখি তুরস্কের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য। পৃথিবীর সমস্ত মানবাধিকার কর্মীদের কাছে আমরা আবেদন রাখি ফ্যাসিস্ত তুর্কীর এই আগ্রাসন এবং গণহত্যার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে এক সক্রিয় বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে।
স্পেন, আলজেরিয়া, ভিয়েতনাম সহ সারা দুনিয়ার ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে মহিলাদের ভুমিকার স্মৃতি ও আদর্শ অনুপ্রেরনা জুগিয়েছে কোবানিতে ওয়াইপিজি-র ফ্যাসিস্ত আইএসআইএস-দের পরাজিত করার লড়াইয়ে। মহিলারা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আফ্রিন শহর রক্ষা করার লড়াই করেছে। বিশ্বের অন্যপ্রান্তের মহিলা এবং পুরুষদের এই প্রতিরোধই ফ্যাসিস্ত তুর্কীর আগ্রাসনকে প্রতিহত করতে পারে। বিশ্বের সমস্ত নারীদের আমরা আহ্বান জানাই তাদের শক্তি এবং কার্যকলাপ আমাদের প্রয়াসের সাথে মিলিত হোক, এগিয়ে চলুক মানুষের সম্মিলিত সংগ্রাম।
পৃথিবীর সমস্ত ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তিকে আমরা আহ্বান জানাই ইউএন এবং ন্যাটোর রাষ্ট্রদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে যাতে উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার ভূখন্ডের উপর তুরস্কের আগ্রাসন বন্ধ হয় এবং বন্ধ হয় কুর্দ জনগোষ্ঠীর উপর আনা গণহত্যার প্রচেষ্টা। এর সাথে আমরা বিশ্বের সমস্ত সরকার, প্রতিষ্ঠান এবং রাজনীতিবিদদের কাছে আবেদন রাখি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা সক্রিয় হন এবং প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলুন।
আমরা ইউএন সিকিউরিটি কাউন্সিল-এর কাছে আবেদন রাখি তারা যেন এই ঘৃণ্য এবং গণহত্যার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহন করে।
তথ্যসূত্র
[1] wiki/rojava
[2] https://anfenglish.com/rojava-syri
https://womendefendrojava.net/
অনুবাদক: প্রত্যয় বন্দ্যোপাধ্যায়, গবেষক: তুলনামূলক সাহিত্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়