অসমে এনআরসি বিপর্যয়ের ব্যাখ্যা নেই, বাংলায় নাগরিকত্ব বিলকেই তাই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের হাতিয়ার করতে চাইছেন অমিত সাহ। লিখেছেন দেবাশিস আইচ।
বিজেপি’র প্রতিশ্রুতি ছিল অসমে সব অনুপ্রবেশকারীদের (পড়ুন মুসলমান) তাড়ানো হবে। তাই নাগরিক পঞ্জি নবীকরণ। বাস্তবে দেখা গেল হিন্দু বাঙালি তো বটেই, মায় গোর্খা, জনজাতি, কোচ-রাজবংশীরাও বিপুল সংখ্যায় রয়েছেন বাদের তালিকায়। কেন? উত্তর নেই অমিত ‘মিথ্যাচারী’ শাহদের কাছে।
মুসলমানরাই যদি অনুপ্রবেশকারী হন তবে স্রেফ সন্দেহের বশে, প্রায় শূন্য শুনানিতে, একতরফা রায়ে, বিনা বিচারে কেন অন্তত ৩০ শতাংশ হিন্দু ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি। কেন প্রায় সোয়া লাখেরও বেশি ডি-ভোটার বা ডাউটফুল (সন্দেহজনক) ভোটারের তালিকায় নাম ওঠে ধুবড়ির কোচ-রাজবংশী সম্প্রদায়ের দিনমজুর অবলা রায়ের, উদালগুড়ি জেলার ছোট চাষি হিন্দু বাঙালি ও সম্ভবত মতুয়া গোপাল দাসের। আর কেন তাঁদের, মামলার খরচ চালাতে সর্বস্বান্ত হয়ে কিংবা নথির অভাবে, আরো অন্তত ৭০-৮০ জনের মতোই (বেসরকারি হিসেব) আত্মহত্যা করতে হয়? দগদগে সেই মৃত্যু তালিকায় কিছু কম নেই হিন্দু বাঙালির (পড়ুন দলিত, মতুয়া) নাম। কেন? এর উত্তর নেই অমিত শাহদের কাছে।
২০১৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, শিলচরে দেশের সাধারণ নির্বাচনের মুখে প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবিদার নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন ক্ষমতায় এলে ‘বাংলাদেশি হিন্দু শরণার্থী’ ভরা ‘ডিটেনশন ক্যাম্পগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে’। কোথায় গেল সেই প্রতিশ্রুতি? বিগত পাঁচ বছরে উত্তর মেলেনি এই অমিত মিথ্যাচারের। সত্য হল দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। ২০১৪ সাল পর্যন্ত ডিটেনশন ক্যাম্প ছিল দু’টি, দ্রুত তা বেড়ে দাঁড়ায় ছয়ে। (আসলে যেগুলি নিয়মিত জেলগুলির একাংশ নিয়ে গঠিত।) পাশাপাশি, অসমের গোয়ালপাড়ায় দেশের সর্ববৃহৎ গণ ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে বেঙ্গালুরু ও মুম্বাইতেও।
অতএব, আপাতত এনআরসি বা নাগরিক পঞ্জি’র প্রচার সরিয়ে রেখে নাগরিক (সংশোধনী) বিল -এর গাজর হিন্দু বাঙালির মুখের সামনে তুলে ধরার পরামর্শ দিয়ে গেলেন অমিত শাহ। এও এক খুড়োর কলই বটে। কী বলে গেলেন?
‘এনআরসি‘র আগে আমরা নাগরিকত্ব বিল পাশ করব। তখন শরণার্থীরা নাগরিক হয়ে যাবেন। এক জন হিন্দুকেও সমস্যায় পড়তে হবে না। ভারতে যত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান এসেছেন — তাদের সবাইকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।’
অসমে হিন্দু বাঙালিদের এক বড় অংশের মধ্যে এ টোটকা কাজে লেগেছে। তার কারণ শুধুমাত্র তাঁদের হিন্দুপ্রীতি, এ কথা বলা ঠিক হবে না। উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদের হাত থেকে মুক্তি পেতে তাঁদের অনেকেই বিজেপি’র দিকে অর্থাৎ একটি হিন্দুত্ববাদী ও প্রবল ক্ষমতাশালী দলের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন বলেই মনে হয়। বরাক উপত্যকায় বামপন্থী কিংবা কংগ্রেসের সঙ্গেও তো এঁদের বৃহৎ অংশ একাত্ম হতে দ্বিধা করেননি। আজ কেন? কোন ব্যর্থতায়? কার ব্যর্থতায়? তার কলজে ছেঁড়া খোঁজ জরুরি। এক তরফা আঙুল তোলা কিংবা পালটা আঙুল দ্বন্দ্বের নিরসন ঘটায় না। আবার অসমের উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি সহ উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলি নাগরিকত্ব বিলের ঘোরতর বিরোধী। নাগরিক পঞ্জি দিয়েই বাঙালি তাড়ানো যাবে এবং বাকি সব বিদেশি অর্থাৎ হিন্দিভাষী, গোর্খা সব — এই আশা-ভরসায় ছিল আসু, অগপ। ৩১ অগস্ট চূড়ান্ত নাগরিক পঞ্জি তালিকা প্রকাশের পর পঞ্জি বিরোধিতায় আদাজল খেয়ে লেগেছে খোদ অসম বিজেপি। আসু-অগপ’র অবস্থা কহতব্য নয়। আসু থেকে কংগ্রেস, কংগ্রেস থেকে বিজেপি — অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন এনআরসি আর মানছেন না। তালিকায় নাম থাকলেও বর্ডার পুলিশের মাধ্যমে সন্দেহভাজন বলে চিহ্নিত করে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে। কথা রেখেছেন তিনি। ইতিমধ্যেই বরাক উপত্যকায় পঞ্জি তালিকাভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও বাঙালি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রায় ৫০ জন নোটিশ পেয়েছেন।
কী আছে এই বিলে?
বলা হচ্ছে বা যেটুকু কথা বিজেপি সভা-সমিতি, সাংবাদিক সম্মেলনে বলছে তা এরকম, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে সেখানকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, যথা, হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি ও খ্রিস্টানরা এদেশে এসেছেন তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে এবং বেআইনি অভিবাসী হিসেবে গণ্য করা হবে না। হ্যাঁ, বিলেও হুবহু তাই রয়েছে।
কেন এই বিল? সে বিষয়ে ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এক লিখিত বিবৃতি দেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘ভারতে বর্তমানে যে আইন চালু/কার্যকরী রয়েছে, সেখানে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে যেসব হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি ও খ্রিস্টানরা বৈধ অনুমতি (পাসপোর্ট) ছাড়া ভারতে এসেছেন বা অনুমতির সময়সীমা (যাঁরা পাসপোর্ট নিয়ে এসেছেন কিন্তু মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে) পার হয়ে গেছে, তাঁদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করায়, তাঁরা নাগরিকত্বের আশায় আবেদন করার জন্য অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হন। এই বিল (২০১৯) পাশ হলে তাঁরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।’
আমরা জানি সরকার ১৫ জুলাই ২০১৬ বিলটি লোকসভায় পেশ করে। লোকসভায় সংখ্যাধিক্যের জোরে পাশ হলেও তা রাজ্যসভায় পেশ করা হয়নি। উত্তরপূর্ব জুড়ে প্রবল বিরোধিতা এবং অসমে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই বিলটিকে আইনে পরিণত করার চেষ্টা করা হয়নি বলেই রাজনৈতিক মহল মনে করে। অবশেষে, বিরোধীদের দাবি মেনে বিচার বিশ্লেষণ ও বিস্তারিত আলোচনার জন্য বিলটি জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি/ যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি)-তে পাঠানো হয়। এখন এই বিলের সোচ্চার বিরোধিতায় সরব অনেকেই। তাঁদের মতামতই তুলে ধরব আমরা।
এই বিলের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান আপত্তি এই যে, এই বিলটি ধর্মনিরপেক্ষ এই দেশের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার বিরোধী। তাঁরা আর্টিকেল ১৪ বা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪-র কথা তুলে ধরছেন। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র ভারতের অভ্যন্তরে কোনো ব্যক্তিকে ‘আইনের চোখে সমানতা’ বা ‘আইনের সমান সংরক্ষণ’ থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘আইনের চোখে সমানতা’র নিহিত অর্থ হল কোনো মানুষকে বিশেষ অধিকার দেওয়া যাবে না। সকল মানুষই সমান ভাবে সাধারণ আইনের আওতায় থাকবে। অন্যদিকে, আইনের সমান সংরক্ষণ’ বলতে বোঝায় বা তার অন্তর্নিহিত অর্থ হল, সকলের প্রতি সমান আচরণ করতে হবে। অর্থাৎ, আক্ষরিক ভাবে তো বটেই, মর্মগত ভাবেও এই বিল সংবিধানের অন্তরাত্মার বিরোধী।
অভিযোগ আরো যে, যা খোলসা করে বলা হচ্ছে না তা হল, এই বিল আইন হয়ে গেলেই সেই আইনের বলেই স্বয়ংক্রিয় ভাবে এক জন নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন তা কিন্তু নয়। এই বিল এবং গেজেট নোটিফিকেশন অনুযায়ী তাঁকে অন্তত তিনটে শর্ত পূরণ করেতে হবে। এই কথাগুলি পরিষ্কার করে না-বলাটাও অমিত মিথ্যাচারের অঙ্গ বটে। যেমন,
- বাংলাদেশ থেকে আসা একজন হিন্দু বাঙালিকে প্রমাণ করতে হবে তিনি সেখানকার অধিবাসী ছিলেন। তবে, কী কী প্রমাণপত্র প্রয়োজন সে কথা অবশ্য বলা হয়নি।
- এই আবেদনের সুবিধা পেতে হলে তাঁকে এও প্রমাণ করতে হবে তিনি ধর্মীয় কারণে অর্থাৎ হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ার ফলে অত্যাচারিত হয়ে কিংবা অত্যাচারিত হওয়ার ভয়ে দেশ ছেড়ে এসেছেন। ধর্মীয় কারণে অত্যাচার বা অত্যাচারের ভয়ের কী প্রমাণ দিতে হবে তার কোনো নির্দেশিকা কিন্তু এখনো নেই।
- কেউ যদি ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে এসে থাকেন তবে তাঁকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বলে গণ্য করা হবে না। কিন্তু, তাঁকে ছ’বছর ভারতে বসবাস করার প্রমাণ দিতে হবে। (১৯৫৫ নাগরিকত্ব আইনে যা ছিল ন্যূনতম ১১ বছর)। ভারতে একাদিক্রমে ছ’বছর বসবাসের কী কী নথিপত্র থাকতে হবে তার কোনো তালিকা অবশ্য আইনে কিংবা গেজেট নোটিফিকেশনে নেই।
এবার আমরা দেখে নিতে পারি যৌথ সংসদীয় কমিটির প্রশ্নের উত্তরে সরকারের পক্ষ থেকে যে উত্তর দেওয়া হয়েছে তার একাংশ। কমিটির প্রশ্ন ছিল, ২.১৭: সংখ্যালঘুদের মধ্যে ঠিক কতজন, যাঁরা ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়েছেন, এই প্রস্তাবিত সংশোধনীর ফলে উপকৃত হবেন? এর উত্তরে কেন্দ্রীয় ইনটেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি) জানায় যে:
“আমাদের রেকর্ড অনুযায়ী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৩১,৩১৩ ব্যক্তি (হিন্দু – ২৫,৪৪৭, শিখ – ৫,৮০৭, খ্রিস্টান – ৫৫, বৌদ্ধ – ২ ও পার্শি – ২) ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়েছেন বলে জানান এবং ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন। তাঁদের দীর্ঘকালীন ভিসা মঞ্জুর করা হয়েছে। সুতরাং এঁরাই হবেন আশু উপভোক্তা।
২.১৮: বিলে উল্লিখিত তিনটি দেশ থেকে ধর্মীয় অত্যাচার সম্পর্কিত কারণে যে সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ এসেছেন এবং এসে পৌঁছানোর পর পরই সে কথা জানাননি তাঁদের ভাগ্যে কী আছে — এমন প্রশ্নের জবাবে আইবি জানায়,
” অন্যান্যরা যাঁরা এই বিভাগে ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে চান, তাঁদের প্রমাণ করতে হবে তাঁরা ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে ভারতে এসেছেন। ভারতে এসে পৌঁছানোর অবব্যহিত পরেই তাঁরা যদি এই ঘোষণা না-করেন, তবে এখন এমন দাবি জানানো তাঁদের পক্ষে কঠিন হবে। ভবিষ্যতের যে কোনো দাবি তদন্ত করে দেখা হবে। রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং বা আর অ্যান্ড এ ডবলিউ’র (দেশের আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা, ‘র’) মাধ্যমে তদন্ত করে তবেই কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
২.১৯: কমিটি প্রশ্ন করে, স্পষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ অনুযায়ী তাহলে কি শুধুমাত্র ৩১,৩১৩ জনই উপকৃত হবেন? উত্তরে আইবি’র ডিরেক্টর হলফনামা দিয়ে জানান:
“হ্যাঁ, ওঁরা দাবি জানিয়েছেন; আবেদন করেছেন। আরও অনেকে থাকতে পারেন যাঁরা এসে থাকতেই পারেন এবং তাঁরা হয়তো অন্যান্য নানা উপায়ে ইতিমধ্যেই নাগরিকত্ব নিয়ে ফেলেছেন।তাঁরা হয়তো পাসপোর্ট, রেশন কার্ড বানিয়ে ফেলেছেন। আরও অন্যান্য নথি হয়তো তাঁরা জোগাড় করে ফেলেছেন এবং ভোটার তালিকাতেও নাম নথিভুক্ত করে ফেলেছেন। সুতরাং, বাস্তবিক ভাবে খতিয়ে দেখলে তাঁরা এখন ভারতের নাগরিক। ইতিমধ্যেই ট্রাইব্যুনাল (এফটি) রয়েছে। সেখানেই সনাক্ত করা যাবে এঁদের কেউ জালিয়াতি করে নথি সংগ্রহ করেছেন কিনা। বিলটি তাঁদের জন্যই যাঁরা আবেদন করেছেন এবং দাবি জানিয়েছেন যে স্ব স্ব দেশে তাঁরা অত্যাচারিত হয়েছেন।”
অতএব, এই আইনের গেঁড়ো থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার বর্তমান প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব বিল বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের কোনো জাদুদণ্ড নয়। আইনের প্যাঁচ আর নথির জালে জড়িয়ে তাঁরা আবারও চরম মানসিক, শারীরিক, আর্থিক নিপীড়নের শিকার হবেন। এনআরসি-কাণ্ডে অসমে যা ঘটেছে তারই পুনরাবৃত্তি হবে বাংলায়। সরকারি নথির তালাশ যাঁরা একবার করেছেন সেই সব ভুক্তভোগীরা জানেন একটি শংসাপত্র পেতে, বিশেষ করে দরিদ্র, লেখাপড়া না-জানা কিংবা কম জানা মানুষদের, যাঁরা ধরাকরা করতে পারেন না তাঁদের কী পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয়। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও জোটে না একটি এসসি/এসটি/ওবিসি শংসাপত্র। আর এই নাগরিকত্বের শংসাপত্র পেতে তাঁদের তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে হবে। আবার এই শংসাপত্র দেবার অধিকারী দিল্লি। ১৯৮৬-‘৮৭ সালের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকত্ব দেওয়ার অধিকার বর্তায় দিল্লির নর্থ ব্লকের হাতে। বাংলার উদ্বাস্ত আন্দোলনের নেতা সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাসের মতে, ‘এই কেন্দ্রীভবনের ফলাফল হলো, বিশেষ করে কোনো বাঙালি ১৯৮৬ সালের পর থেকে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে ভারতের নাগরিকত্ব অর্জন করতে পারেননি। এখানেই শেষ নয়, তাঁর ভয়ংকর অভিযোগ, ‘প্রকৃতপক্ষে দেশান্তরিত উদ্বাস্তু মানুষেরা যাতে ভারতের নাগরিকত্ব না পান, তার জন্য এই প্রশাসনিক পদক্ষেপ করা হয়।’
অর্থাৎ, একদিকে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি মানুষ, আইনজীবীরা সম্পূর্ণ ভাবে নাগরিক (সংশোধনী) বিলের বিরোধিতা করে চলেছেন। অন্যদিকে, ‘সারা ভারত মতুয়া সংঘ’, ‘জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি ফর বাঙালি রিফিউজিস’ এর মতো সংগঠনগুলির প্রধান দুই দাবি হলঃ
# দেশবিহীন হিসাবে ভারতে থাকার অধিকার নয়; সমস্ত দেশান্তরিত উদ্বাস্তুদের ভারতে নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দিতে হবে।
# উদ্বাস্তুদের উত্তর প্রজন্মের জন্য (নিঃশর্তে) জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব দিতে হবে।
আরও একবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক, যেহেতু নাগরিক পঞ্জি নবীকরণ করতে গিয়ে অসমে বিজেপি’র মুখ পুড়েছে এবং পঞ্জির যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, তাই এই মুহূর্তে দেশের কোথাও নাগরিক পঞ্জি নিয়ে এগোতে চাইছে না বিজেপি। অন্যদিকে, নাগরিকত্ব বিল নিয়ে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে বিজেপি অসমে হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে রীতিমতো প্রভাব বিস্তার করতে সফল হয়েছে, তাই পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন নির্বাচনে এই বিলকেই সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করা এবং হিন্দু ভোট এককাট্টা করার কাজে লাগাতে চায় সঙ্ঘ পরিবার। দ্বিজাতিতত্ত্বের যে বিষে ছারখার হয়েছে বাঙালি, সেই দ্বিজাতিতত্ত্বকেই ফের বাংলায় হাতিয়ার করতে চাইছে তারা। বিভাজনের সেই নয়া রূপ শ্লোগান — হিন্দুরা শরণার্থী, মুসলমানরা অনুপ্রবেশকারী। দেশভাগের পর হিন্দুরাই তো তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে লাখে লাখে এ বঙ্গে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। আর মুসলমানদের যেতে হয়েছে পাকিস্তানে। বাংলার মুসলমানদের মধ্যে অনুপ্রবেশকারীর খোঁজ করা আসলে এক হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানী চক্রান্ত।
ঋণ:
আচার্য দুর্গাদাস বসু, সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস, পার্থপ্রতিম মৈত্র, দেবাশিস ভট্টাচার্য (অসম)।
এটাও পড়ুন : অমিত মিথ্যাচার — এক