সেই অমিত মিথ্যার ফুলঝুরি, সেই নাদির শাহিনাদ। তৃতীয়ার বাংলায় ধ্বংসলীলার আগমন বার্তা শাহ-র। দেবাশিস আইচ-এর প্রতিবেদন।
সোমবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে একটিও নতুন কথা বলেননি অমিত শাহ। ২০১৪ সাল থেকে এই বাংলায়, অসমে কিংবা দেশের অন্যত্র যে অমিত মিথ্যাচার, যে ভয়ংকর বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়েছেন মোদি-শাহ জুটি তা আরও একবার উসকে দিয়ে গেলেন তিনি। এক-দু’কথায় এভাবেই বর্ণনা করা যায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিজেপি’র সর্বভারতীয় সভাপতির বক্তব্যকে।
অসমে চূড়ান্ত নাগরিক পঞ্জি তালিকা থেকে লক্ষ লক্ষ বাঙালি হিন্দুর বাদ পড়া, পঞ্জির যৌক্তিকতা নিয়ে সারা দেশ জুড়ে প্রশ্ন উঠে যাওয়া, এ রাজ্যে ক্রমে পঞ্জিবিরোধী জনমত দানা বেঁধে ওঠা বাংলার বিজেপি নেতৃত্বকে অনেকটাই বেকায়দায় ফেলেছে। সর্বোপরি অতি অল্পসময়ের মধ্যে এনআরসি’র আতঙ্ক ও নথি-তাড়নায় ১৮ জনের মৃত্যু বিজেপি’র স্থানীয় নেতৃত্বকেও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।ফ্যাসিবাদ তো এটাই চায়। ভয়। দেশ হারানোর ভয়, বন্দিশিবিরের ভয়, মৃত্যু ভয়। বাংলার বিজেপি’র আম সমর্থক, ভোটদাতা, এবং পদাতিক সৈনিকরা এই হিন্দিবাদী দাঙ্গা-সংস্কৃতিতে বড় হয়নি। কিন্তু, হিটলারের উপাসক সঙ্ঘীরাও চায় ভয় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াক মানুষকে। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের মনোবল ফেরানোটা জরুরি ছিল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে। বাঙালির কলজের জোর কম। ঘোষের গোয়ালে এখনও সেই বিজাতীয় হিংস্র বাঙালি পাষণ্ড বাড়ন্ত। অতএব নাগপুরের আরএসএস-এর খোঁয়াড়ই ভরসা। অতএব, মহালয়ায় বিজেপি ও আরএসএস নেতা জগৎপ্রকাশ নাড্ডা, কৈলাশ বিজয়বর্গী, শিবপ্রকাশদের দেখা গেল গঙ্গার ঘাট আলো করতে। এই ভিনদেশি, ভিনভাষী, ভিনসংস্কৃতির নেতারাই বাংলার বিজেপি’র হর্তাকর্তা বিধাতা। বিভাজনের রাজনীতি, হিংসা-দ্বেষপ্রেমের রাজনীতিই বিজেপি’র সবচেয়ে বড় অস্ত্র। সে অস্ত্রের ধার ও ভারের সফল পরীক্ষা একপ্রস্থ হয়ে গিয়েছে ২০১৯-এ। এই নয়া বর্গি আক্রমণের রণকৌশল স্থির করতে অন্যতম সেরা অবাঙালি সেনাপতিদের বাংলা জয়ের দায়িত্ব দিয়েছে সঙ্ঘ পরিবার। সামনে যে একুশ।
২০১৪-তে লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে পশ্চিমবঙ্গে এই উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি নতুন করে শুরু করেন নরেন্দ্র মোদি। শ্রীরামপুরের নির্বাচনী জনসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশিরা ব্যাগ গুছিয়ে রাখুক। নির্বাচনের পরই তাদের তল্পিতল্পা গোটাতে হবে।’ আর একই দিনে বারাসতের কাছারি ময়দান ও পরদিন কৃষ্ণনগরে মতুয়াদের উদ্দেশ্যে তাঁর ঘোষণা, ‘আমরা ক্ষমতায় এলে মতুয়াদের নাগরিকত্বের ব্যবস্থা করব।’ এই ঘৃণার রাজনীতির সংগঠিত প্রোপাগ্যান্ডার প্রচালক হিসেবেই সোমবার কলকাতায় হাজির হয়েছিলেন অমিত শাহ। এই প্রতিবেদনে তাঁর মুখ্য বক্তব্যর জবাব দেওয়ার চেষ্টা করব।
# কোনও দেশ কোটি কোটি অনুপ্রবেশকারীর বোঝা বইতে পারে না। তাই এনআরসি করতেই হবে। তবে বাংলার দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব হবে।
এই বক্তব্যের অমিত শাহি ভাষায় ‘মুখতোড়’ জবাব দিয়ে ফেলেছে অসমের নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা। ৪০ বছর ধরে ৪০ থেকে এক কোটি অনুপ্রবেশকারীর গল্প শুনিয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা। সর্বশেষ পঞ্জি তালিকায় তা ১৯ লক্ষে দাঁড়িয়েছে। হিন্দুত্ববাদীদের প্রচার যার মধ্যে ১২ লক্ষ বাঙালি হিন্দু। কোটি কোটির মিথ্যা প্রচার মুখ থুবড়ে পড়লেও নির্লজ্জের মতো আবারও চরম মিথ্যাটি বলে গেলেন।
আর বাঙালির অর্থনৈতিক অবনমনের কারণ যদি খুঁজতে হয় তবে তা খুঁজতে হবে ঔপনিবেশিক শোষণে। যে ঔপনিবেশিক শাসকদের পরম মিত্র ছিল হিন্দু মহাসভা, ইংরেজের কাছে মুচলেকা দেওয়া বীর সাভারকাররা। খুঁজতে হবে কৃষির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নীতিতে। যার যাবতীয় ফলভোগ করেছে হিন্দু ও প্রধানত উচ্চবর্ণের অলস, অত্যাচারী, পায়রা ওড়ানো, বাঈজি নাচানো জমি-বিচ্ছিন্ন শহুরে জমিদাররা এবং সেই জমি থেকে আয় ক্রমে হ্রাস পেতেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার মধ্যে; তৃতীয় প্রধান কারণ দেশভাগ। বানরের পিঠেভাগের মতো দেশভাগ হয়েছে, থানা ধরে ধরে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন হয়েছে, না হিন্দু মহাসভা না দেশভাগে ব্রতী কংগ্রেস ভাবেনি মানুষের কথা। তাঁদের প্রকৃত পুনর্বাসন, জমি-জিরেত, বাসস্থান, চাকরি-বাকরির কথা। না, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও ভাবেননি। ভাবার প্রয়োজন মনে করেননি। কেননা কলকাতার অট্টালিকা আর হুগলির জমিদারিতে দেশভাগ ছায়া ফেলতে পারবে না এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন। বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা হিন্দু-মুসলমানদের সম্ভাব্য প্রব্রজনের কথা তিনি ভাবেননি, ভাবতেও চাননি। ভাবলে দেশভাগের কয়েক বছরের মধ্যে হিন্দু মহাসভা, জনসংঘ ও শ্যামাপ্রসাদ মুছে যেতেন না। বাংলার একটিও উদ্বাস্ত কলোনি কি শ্যামাপ্রসাদের নামে নামাঙ্কিত? অজস্র নেতাজি কলোনি রয়েছে, রয়েছে রবীন্দ্রপল্লি। চতুর্থত, কোথাও কোনও আলোচনায়, তর্ক বিতর্কে যথাযথ ভাবে উঠে আসেনি কৃষি, হস্তশিল্প কিংবা পাটচাষ ও চটশিল্পের উপর বিরূপ প্রভাবের কথা। অবশ্যই আর এক অন্যতম কারণ স্বাধীন দেশে কেন্দ্রীয় সরকারের শিল্পনীতি। চট ও চা-শিল্পকে মদত দিতে অস্বীকার, দুর্গাপুরের ইস্পাত শিল্পকে ক্রমে রুগ্ন করা, মাশুল সমীকরণ নীতি, লাইসেন্স রাজ, কয়লাভিত্তিক শিল্প থেকে পেট্রোলিয়াম ভিত্তিক শিল্পে পরিবর্তন, ‘সানরাইজ শিল্প’ অর্থাৎ ইলেকট্রনিক্স শিল্পকে সীমান্তবর্তী বা অরক্ষিত অঞ্চল বলে ‘সল্টলেক ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স’ বাতিল করে দেয় ইন্দিরা গান্ধী সরকার। লাইসেন্স রাজের অবলুপ্তির পর জ্যোতি বসু সেক্টর ফাইভের গোড়াপত্তন করেন। অবশ্যই সীমিত জমি এবং উৎপাদন ক্ষমতার হ্রাস বাংলার অনুন্নয়নে বৃহৎ মাত্রা যোগ করেছে। দেশভাগের বাংলায় কোনও অনুপ্রবেশকারী নেই। বাঙালি মুসলমান ঠিক ততটাই বাঙালি যতটা মধুর বাংলা ভাষা, যতটা পূন্য বাংলার মাটি, বাংলার জল। হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান এ সমন্বয়ী সংস্কৃতির অর্থ বুঝবে না। তারা গায়, গাইতে হয় বিকৃত স্বরে ‘য্যান গ্যান ম্যান… ‘।
এটাও পড়ুন পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি আতঙ্ক: ১০ দিনে মৃত ১৭, আত্মঘাতী আট।
লেখক দেবাশিস আইচ সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী।