“আমার এই দোকান ২৬ বছরের পুরনো। তার আগে আমি এখানকারই ছাত্র ছিলাম। কখনও এমন নৃশংসতা দেখিনি। যখন দোকানের বাইরে থেকে সাইকেল, হোর্ডিং সব নিয়ে যাচ্ছে গেট–এর বাইরে পোড়াবে বলে শিউরে উঠছিলাম,” কথা বলার সময়েও যেন বিস্ময় কাটেনি তাঁর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গেরুয়া বাহিনীর সন্ত্রাস নিয়ে লিখেছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী ।
কলকাতার রাজপথ ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ বিকেলে সাক্ষী রইল এমন এক মিছিলের যার কোথায় শুরু কোথায় শেষ তা দৃষ্টির নাগাল পেল না। ঠিক একদিন আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় — যিনি সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে আরএসএস-এর ছাত্রশাখা এবিভিপি-র দ্বারা নবীনবরণে আমন্ত্রিত ছিলেন — ক্যাম্পাসে পৌঁছালে অসংখ্য পড়ুয়া তাঁর বিরূদ্ধে প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পড়ুয়াররা তাঁকে ফ্যাসিস্ত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবেই দেখেছিল। এর পর গেরুয়া বাহিনী সন্ত্রাস চালায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ও বাইরে। ক্ষমতার আস্ফালনে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ বিক্ষোভকে দমিয়ে দিতে চায়।
এই সঙ্ঘী সন্ত্রাসের বিরূদ্ধেই ছিল মিছিল, যেখানে অজস্র শ্লোগানে ছিল ফ্যাসিজম-কে রুখে দেওয়ার সাহসী বার্তা।
এই সবের মাঝেই একটি চরিত্র তড়িৎবরণ দাস, যাদবপুরের পড়ুয়াদের পরিচিত ‘তড়িৎদা’। এই চরম অবস্থার মাঝে নেহাতই একজন প্রতিবন্ধী মানুষ, যার ক্ষতি হওয়ার কথা ছিল না। মিছিল বেরিয়ে যাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের চার নম্বর গেট দিয়ে ঢুকেই চোখ গেল ছাত্র সংসদের বিধ্বস্ত ইউনিয়ন রুমের দিকে। চে গ্যুভেরা-র ছবিতে কালি দিয়ে দেওয়ালে বড় বড় করে এবিভিপি লিখে ক্ষমতার আস্ফালন দেখিয়েছে গেরুয়া বাহিনী। পাশেই খোলা তড়িৎবরণের চিপ স্টোর্স, সস্তায় যেখানে খাতা, পেন থেকে লেখাপড়ার যাবতীয় সামগ্রী পাওয়া যায়।
একটু অপেক্ষা করতেই দেখা গেল তড়িৎদা আসছেন। দুই হাতে ক্রাচ, একটি পা নেই তাঁর। মাথায় ও গালে চোট আছে, সেই ক্ষতস্থানে প্রলেপ দেওয়া। তার দোকানের সামনে ডিউটি করা সাদা পোশাকের পুলিশও নমস্কার করে জানতে চাইলেন ভালো আছেন কি না। প্রতিনমস্কার করে শান্ত স্বরে জবাব দিলেন – ‘আছি’।
দোকানের ভেতরে গিয়ে জানতে চাইলাম একটু যদি বলেন ঠিক কী ঘটেছিল আগের দিন তাঁর দোকানে। যা বললেন – “ঘটনাটা সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে ঘটে। ভিড় বাড়ছে দেখেই আমি আমার সহকারী ভাইকে বলি বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে ও যেন চলে যায়। আমি ভেতর থেকে জানলা বন্ধ করে ভেতরে বসে থাকি। ওরা এসে আমার দোকানের দরজা লাঠি, লাথি দিয়ে মেরে ভাঙার চেষ্টা করে। দরজাটা শক্ত বলে ভাঙতে পারেনি। তারপর আমার কাঁচের জানলার বাইরের গ্রিলে মোটা কাঠের লাঠি ঢোকানোর চেষ্টা করে। গ্রিলের ফাঁকটা ছোট বলে পারেনি। তখন ইট, পাথর দিয়ে কাঁচ ভেঙে ফেলে। আমি আলো নিভিয়ে বসেছিলাম। অনেক করে বললাম এটা চিপ স্টোর্স, এখানে কিছু করো না, কোনও কথাই কানে নিল না। ওরা তখন ‘জয় শ্রীরাম’ বলে চিৎকার করছে আর হাত ঢুকিয়ে যা পাচ্ছে নিয়ে বাইরে ছড়িয়ে দিচ্ছে, পকেটে ভরছে। বেশ খানিকক্ষণ এরকম তাণ্ডব চালিয়ে আবার অন্যদিকে চলে যায়।”
— কারা ছিল এই তান্ডবকারীরা? এবিভিপি-তে যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা? কাউকে চিনতে পেরেছেন কি? তড়িৎ জানালেন, যতটুকু দেখতে পেরেছেন সকলেই বহিরাগত ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের এবিভিপি-র সঙ্গে যুক্তদেরও দেখতে পাননি।
“আমি তো ছাত্রছাত্রীদের মুখ চিনি। এখানে যখনই কোনও এইরকম বড় ধরনের ঝামেলা হয়েছে সবটাই বহিরাগতরা করেছে। এখানে তো এতদিন পর্যন্ত সব সংগঠনের সদস্যরাই একসাথে চা–ও খায়। এটাই যাদবপুর। তবে কালকের ওরা সবাই বিজেপি ছিল, জয় শ্রীরাম বলে চিৎকার করছিল।”
যখন তাঁর দোকানে এরকম চলছে ছাত্রছাত্রীরাও রোখার চেষ্টা করেছিলেন। – “ওরা চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারবে কী করে? ওরা কী আর অস্ত্র নিয়ে ঘোরে? বাইরের সবার হাতে লাঠি, বাঁশ আরও নানা কিছু ছিল। আগেও তো দেখেছেন এখানকার ছাত্রছাত্রীরা খালি হাতেই প্রতিরোধ করে।তাদের হাতে বাধা দেওয়ার মতো কোনও অস্ত্র ছিল না। সবাই তো পড়ুয়া।”
দুপুর থেকে যখন উত্তেজনা দানা বাঁধছে, সুভাষগ্রামের কোদালিয়ার বাড়ি থেকে স্ত্রী, ছেলে, দাদা, বৌদি অনেক বার ফোন করে বাড়ি ফিরে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু দোকান ফেলে যেতে পারেননি। তাহলে হয়তো দোকানটি আর বাঁচাতে পারতেন না। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তাই উপার্জনের একমাত্র পথ দোকানটি আগলে ছিলেন এই মাঝবয়সী প্রতিবন্ধী মানুষটি।
“আমার এই দোকান ২৬ বছরের পুরনো। তার আগে আমি এখানকারই ছাত্র ছিলাম। কখনও এমন নৃশংসতা দেখিনি। যখন দোকানের বাইরে থেকে সাইকেল, হোর্ডিং সব নিয়ে যাচ্ছে গেট-এর বাইরে পোড়াবে বলে শিউরে উঠছিলাম,” কথা বলার সময়েও যেন বিস্ময় কাটেনি তাঁর। দোকানের সহকারী দোলন দরজায় তালা দিয়ে বাইরে ছিলেন, আতঙ্ক না-কাটা গলায় জানালেন, “এরকম উগ্র, হিংস্র প্রাণী আগে দেখিনি। জয় শ্রীরাম বলতে বলতে তাণ্ডব চালাচ্ছিল।” তড়িৎ, দোলন দু’জনেই স্বীকার করলেন যে কিছুটা হলেও আতঙ্কে আছেন যে যদি আবার এভিবিপি, বিজেপি হামলা চালায় কী হবে!
অন্ধকারে বসে দোকান বাঁচানোর চেষ্টা করেন যখন, তখন কিছু সময় পরে টের পান গাল বেয়ে তরল কিছু গড়িয়ে পড়ছে। হাত দিয়ে মুছে নাকের কাছে এনে আয়রন-এর গন্ধ পেয়ে বোঝেন রক্ত। ভাঙা কাঁচে মাথা, গাল কেটেছে। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মী ও নিরাপত্তারক্ষী তাঁকে উদ্ধার করেন, সেই টালমাটালে আর ফার্স্ট এইড করারও সুযোগ হয়নি। একেবারে বাড়ি পৌঁছেই চিকিৎসা করতে পারেন।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার-এর কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট থানায় জেনারেল ডায়েরি করেছেন। সেখানে অভিযোগে উল্লেখ করেছেন যে বিজেপি সমর্থকেরাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। শারীরিক প্রতিবন্ধী হিসাবে আর অন্য কোথাও অভিযোগ জানিয়েছেন? উত্তরে বললেন – “না, সেরকম তো কিছু করিনি। আমি তো জানি না কিছু এ বিষয়ে।”
এই প্রেক্ষিতেই দীর্ঘদিনের প্রতিবন্ধী আন্দোলনের কর্মী শম্পা সেনগুপ্ত-র কাছে জানতে চেয়েছিলাম তড়িৎবাবু কী করতে পারেন আর? উত্তরে শম্পা জানালেন – “নিশ্চয়ই করতে পারেন। সমস্যা হচ্ছে অধিকাংশ প্রতিবন্ধী মানুষ, সরকার, প্রশাসন কেউই জানেন না যে এখন আমাদের প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকার আইন আরপিডি অ্যাক্ট, ২০১৬ আছে। সেই অ্যাক্ট অনুযায়ী একজন প্রতিবন্ধী মানুষের যদি শারীরিক ক্ষতি করা হয় বা তার উপার্জনের সঙ্গে যুক্ত কিছুর ক্ষতি করা হয়, তাহলে শাস্তি অনেকটাই বেড়ে যায়।” বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, পুলিশ ছাড়া আর কোথায় অভিযোগ করতে পারেন তিনি? অবশ্যই জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও ডিসএবিলিটি কমিশন-এ অভিযোগ করা যায় ও করা উচিত বলে জানালেন শম্পা।
তড়িৎবরণের দোকান সকাল হতেই জুটা-র তরফ থেকে কাঁচ লাগিয়ে মেরামত করে দিয়ে গেছে। অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি দেখা করেছেন বারবার। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরেছে তাঁর পাশে আর্থিক সাহায্য নিয়ে দাঁড়ানোর আবেদন। এই সব উদ্যোগই সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু শম্পা প্রশ্ন তুললেন – “এখানে স্টেট-এর ভূমিকা কী? তার তরফ থেকেও ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য তড়িৎ-এর একজন প্রতিবন্ধী মানুষ হিসাবে। আশ্চর্যজনকভাবে স্টেট সে বিষয়ে চুপ। পুরো লড়াইটাই বিজেপি আর বামপন্থী পড়ুয়াদের মধ্যে দেখানো হচ্ছে। রাজ্য সরকার সেখানে কোনও ভূমিকাই নিচ্ছে না। নীরব।”
ফ্যাসিবাদের বিরূদ্ধে লড়াইয়ে প্রতিবন্ধী মানুষদের অবস্থান, তাদের পরিচিতির লড়াইও ঠিক কীভাবে এর সঙ্গে জুড়ে যায় বা যায় না তাই আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল তড়িৎবরণ দাসের ঘটনা। যে সরকার দাবি করে তারা প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকার আইন পাশ করেছে সেই সরকার গঠনকারী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা জয় শ্রীরাম চিৎকারে আতঙ্ক জাগিয়ে প্রতিবন্ধী মানুষের উপার্জনের সম্বল নষ্ট করে, শারীরিক আঘাত হানে সে ঘটনাও ঘটল।
বেরোনোর সময় চোখ গেল দেওয়াল লিখনে – ‘হাম করেঙ্গে রাজনীতি / হাম করেঙ্গে পেয়ার / এবিভিপি হোঁশিয়ার।’ এ শহরে তখন সন্ধ্যা নেমেছে আর হাজারও কণ্ঠে উঠে আসছে ফ্যাসিবাদকে এক ইঞ্চি জমি না ছাড়ার হুঁশিয়ারি – ব্যস্ত শহর তাকিয়ে দেখেছে সেই দীর্ঘ মিছিল।
সুদর্শনা চক্রবর্তী ডকুমেন্টারি নির্মাতা এবং স্বতন্ত্র সাংবাদিক।
All Images courtesy : Facebook wall of the student activists.