‘এনআরসি অসমের ব্যাপার’, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাজ্যের উন্নয়ন নিয়ে বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রীর এই নব বোধোদয়, তার কার্য–কারণটি ঠিক কী কী! লিখছেন দেবাশিস আইচ।
এনআরসি অসমের ব্যাপার। ওটা অসম অ্যাকর্ডে বলা আছে। মুখ্যমন্ত্রী উবাচ। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাজ্যের উন্নয়ন নিয়ে বৈঠকের পর। এই বিবৃতি অর্ধসত্য। এনআরসি বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নবীকরণের কাজ অসমেই চলছে। এ কথা সত্য। কিন্তু, প্রশ্ন হল এনআরসি যদি অসমের সমস্যাই হয়, তবে এত উদ্বিগ্ন কেন সারা দেশ? কেন এত লেখাজোখা, এত ফুটেজ খরচ। কেন কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে বেঙ্গালুরু কিংবা মুম্বাইয়েও নির্মাণ হচ্ছে ডিটেনশন ক্যাম্প। অন্যান্য, রাজ্যেও এই বন্দিশিবির নির্মাণের নির্দেশ জারি হয়েছে। কেন অমিত শাহ নির্বাচনী বক্তৃতায়, দলীয় সভায়, সংসদে ‘উইপোকা’র বিরুদ্ধে দেশজোড়া যুদ্ধ ঘোষণা করে চলেছেন? আরও বড় কথা অসম তো বিদেশি কোনও রাষ্ট্র নয় যে সে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে এড়িয়ে যাব। এই ১৯ লক্ষ বাদ পড়া মানুষের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ অসমের জনজাতি, গোর্খা, এমনকী অহোম জনগোষ্ঠী ভুক্ত (৬.৭০ লক্ষ)। বাকি বড় দুই অংশের ভাগিদার বাঙালি হিন্দু (৬.৯০ লক্ষ) ও বাঙালি মুসলমান (৪.৮৬ লক্ষ)। অসমের গোয়েন্দা সূত্রে পাওয়া ‘অসমিয়া প্রতিদিন’ এর তালিকা অন্তত তাই বলছে। দেশভাগ পরবর্তী সময়ে এ দেশে এত বড় বিপর্যয় কখনো নেমে আসেনি। দ্বিতীয়ত, অসম চুক্তিতে এনআরসি রূপায়নের কথা কোথাও বলা নেই। এনআরসি রূপায়িত হচ্ছে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মামলার প্রেক্ষিতে, ২০১৪ সালে দেশের শীর্ষ আদালতের এক রায়ে। অবশ্যই অসম চুক্তি সে মামলার প্রণোদন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিবরণ, মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রের কোনও প্রস্তাব নেই। একথা সত্য। কিন্তু প্রশ্ন, তবে কি এতদিন চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে কানে হাত না-দিয়ে চিলের পিছনে ছুটে বেড়ালেন তিনি? আমরাও? রাজনীতিকরা ছুটতে ভালোবাসেন, ছোটাতেও। কখনও মুখের সামনে গাজর ধরে ছোটেন ও ছোটান, কখনও-বা ছোটান ডান্ডা মেরে। মমতা রাজনীতিক, অতএব ব্যতিক্রমী নন। সরকারি প্রস্তাব নেই বলে তো সারা দেশে নাগরিক পঞ্জি রূপায়নের তোড়জোড় চলছে না এ কথাও তো ঠিক নয়। এ সত্য তিনিও তো সম্যক ভাবে জানেন।
কিন্তু, এই যে নব বোধোদয় ‘এনআরসি অসমের ব্যাপার’, তার কার্য-কারণটি ঠিক কী কী! তার নানা কটু কিংবা সরস ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছেন বিরোধী রাজনীতিকরা। বাংলার ‘শার্লক হোমস’ রাজীব কুমারের উপর আইনি রক্ষাকবচ উঠে যেতেই নাকি সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দরবারে। শ্বেত পতাকা না-ওড়ালেও পরনে তার ট্রেড মার্ক শ্বেতশুভ্র শাড়ি। বন্ধুত্বের হলুদ গোলাপে দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর চার হাত এক হওয়া। নিন্দুকেরা বলছেন, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। আমরা আমজনতা, সহজেই স্মৃতিভ্রংশ হয় আমাদের। নিত্যদিন সংসারের প্যাঁচপয়জার সামলে কত আর রাজনীতির সাতকাহন মনে রাখা যায়? কিন্তু, এই এনআরসি-ই বলুন কিংবা নাগরিক পঞ্জি সেতো জীবনমরণ সমস্যা হয়ে ঘিরে ধরেছে। দু’বেলা তাড়িয়ে দেব, মারব-ধরব বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ভুলব বললেই কি আর ভোলা যায়?
তাহলে আপনাকেই প্রশ্ন করা যাক মুখ্যমন্ত্রী। ‘ব্যাপার’ যখন অসমের তখন কেন আগ বাড়িয়ে রাজ্যের মন্ত্রী, বিধায়ক, সাংসদদের পাঠিয়েছিলেন অসমে? রাজ্যে এনআরসি চালু করার জন্য যখন কোনও কেন্দ্রীয় প্রস্তাব নেই, তখন কেন এতদিন গলার শির ফুলিয়ে বলে গেলেন, এ রাজ্যে এনআরসি চালু করতে দেবেন না? কেন এনআরসি বিরোধী সর্বদলীয় প্রস্তাব গৃহীত হল বিধানসভায়? কেন সিঁথি থেকে শ্যামবাজার মহামিছিল? এনআরসি নিয়ে সাংবাদিকদের বক্তব্যে বিরক্ত হলেও শেষ পর্যন্ত জানিয়েছেন, আপনি বাংলায় এনআরসি করবেন না। স্বস্তি আপাতত এটুকুই।
বিশ্বাস করুন, শার্লক কুমারের ভবিষ্যৎ নিয়ে রাজ্যের মানুষ আদৌ বিচলিত নন। বিচলত নন গায়েবি-গোয়েন্দা ধরা পড়লে কত রাজনীতিকের মুখ পুড়বে। রাজ্যের মানুষ বিচলিত নাগরিক পঞ্জি নিয়ে, বিচলিত ইভিপি বা ইলেক্টরস ভেরিফিকেশন প্রোগ্রাম বা সাদা বাংলায় ভোটারদের তথ্য যাচাই কর্মসূচি নিয়ে। কেননা, অনেকেই মনে করছেন, ইভিপি আসলে দেশ জুড়ে নাগরিক পঞ্জি তৈরির প্রথম ধাপ। আতঙ্ক পরিণত হয়েছে আত্মহত্যায়। বাংলার প্রথম ‘এনআরসি শহিদ’-এর নাম কি তবে মিলন মণ্ডল?
ইভিপি–ই কি ভবিষ্যতের এনআরসি?
নির্বাচন কমিশন বলছে — ‘না’। নাগরিক পঞ্জির সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের এই তথ্য যাচাই কর্মসূচির কোনও যোগ নেই। মানুষ কমিশনকে বিশ্বাস করছে না। কমিশন বলছে, সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়াচ্ছে, মানুষ তাতে বিভ্রান্ত হচ্ছে। কমিশন নিশ্চয় সত্যি বলছে। খাতায়-কলমে, সরকারি বিজ্ঞপ্তি কিংবা গেজেট নোটিফিকেশনে কোথাও লেখা নেই তথ্য যাচাই কর্মসূচি ভাবী নাগরিক পঞ্জির পয়লা ধাপ। বাংলার মানুষ ঘর পোড়া গরু, সে সিঁদুরে মেঘ দেখছে। সে প্রতিবেশী রাজ্য অসমের খবর রাখছে। কীভাবে অসমের বিশেষ করে বাঙালি দলিত ও মুসলমানরা গোছা গোছা দলিল হাজির করার পরও পঞ্জি-হিংস্রতার শিকার হচ্ছেন, হয়ে এসেছেন সে খবর আজ আর অজানা নয় বাংলার বাঙালির কাছে। প্রতিনিয়ত নিজের রাজ্যে দেখছে মুরলীধর লেনের ঘোষগুষ্টি এনআরসি পাচন হাতে মানুষকে সন্ত্রস্ত করে চলেছে।
এতো গেল সাধারণ মানুষের অবিশ্বাসের কথা। নির্বাচন কমিশনের কথাতে বিশ্বাস করছেন না সাধারণ মানুষ। ‘অসমের ব্যাপার’ বলে হাত তুলে নিলে বিশ্বাস করবেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। কেননা, দেশে ক্ষমতায় যারা, নীতি নির্ধারক যারা, এক দেশ এক দল এক ঝান্ডা, এক নেতা’র মতো ফ্যাসিস্ত নীতির প্রবক্তা যারা — সেই তাদের অন্যতম প্রধান মুখপাত্র দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কোনও রাখঢাক গুড়গুড় না-করে আবারও পরিষ্কার করে জানিয়েছেন, অসমের মতো নাগরিক পঞ্জি তৈরির কাজ সারা দেশেই জন্যই বিবেচনা করা হবে। “আমরা দেশের বাকি অংশে এনআরসি প্রসারিত করব এবং একটি ন্যাশনাল রেজিস্টার অভ সিটিজেন (এনআরসি) প্রণয়ন করব।”
কেন? কাদের জন্য তা? এবার আর ‘উইপোকা’ বলে গাল দিচ্ছেন না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। উল্টে প্রশ্ন করছেন, ভারতীয়রা কি বেআইনি ভাবে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, রাশিয়ায় বসবাস করতে পারেন? উত্তর দিচ্ছেন নিজেই, ‘না’। ফের পালটা প্রশ্নে শুধোচ্ছেন, তবে আমাদের দেশে কেন অন্য দেশের নাগরিকরা আইনি দলিল ছাড়া বাস করবে? সঙ্গত প্রশ্ন নিঃসন্দেহে। তাহলে উপায়? “তাই আমি বিশ্বাস করি সারা দেশে এনআরসি রূপায়িত করতে হবে।” দিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রী যখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাজ্যের উন্নয়ন নিয়ে শলাপরামর্শে ব্যস্ত, ঠিক একইদিনে ঝাড়খণ্ডের রাঁচিতে অমিত শাহ নাগরিক পঞ্জির পক্ষে সওয়াল করেছেন এই ভাবেই। (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ওয়েব ডেস্ক, ১৮ সেপ্টেম্বর, সন্ধে ৫.৩৩ মিনিট।)
আর নাগরিক পঞ্জি বাংলায় রূপায়িত হলে নাগরিকদের সব সরকারি তথ্য, দলিল দস্তাবেজ মজুত তো করতেই হবে। সেখানে নির্বাচন কমিশনের তথ্য যাচাই কর্মসূচি নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করবে এর মধ্যে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। তাঁরা যাচাই করতে ঝাঁপাবেন তাও দোষের নয়। মমতা কেন মোদি সকাশে — তা নিয়ে বিরোধী রাজনীতিকরা খেউরে ব্যস্ত। অতএব ব্লক অফিসে অফিসে এখন প্রাণ বাঁচানোর মান বাঁচানোর লড়াই। নামের একটা ভুল বানান, বয়সের হেরফের, একই ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন দলিলে মুখার্জি আর মুখোপাধ্যায়, মহঃ আর মহম্মদ জাতীয় অসঙ্গতি এক ধাক্কায় যে তাঁকে সন্দেহজনক বিদেশি বলে চিহ্নিত করা দেবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে? প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা ফলপ্রসূ হোক। আর যদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয় তবে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়াই ভালো — এনআরসি বাংলা মানবে না।
লেখক স্বতন্ত্র সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী।