নেটওয়ার্ক অফ উওমেন ইন মিডিয়া, ইন্ডিয়া (NWMI) ও ফ্রি স্পিচ কালেক্টিভ (FSC) -এর দুই সদস্যের একটি দল গত ৩০শে অগাষ্ট থেকে ৩রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাশ্মীরে তথ্যানুসন্ধানের জন্য ছিলেন। দলটি তৈরি হয়েছিল স্বাধীন সাংবাদিক লক্ষ্মী মূর্তি ও গীতা সেশু-কে নিয়ে। তাঁদের তথ্যানুসন্ধানের মূল লক্ষ্য ছিল – কাশ্মীরের যোগাযোগব্যবস্থাকে সব দিক থেকে যেভাবে বিধ্বস্ত করে দেওয়া হয়েছে সেখানকার মিডিয়া/গণমাধ্যমের উপর তার প্রভাব। তাঁরা কথা বলেন, শ্রীনগর ও দক্ষিণ কাশ্মীরের নিউজ-সাইট ও সংবাদপত্রের ৭০-এরও বেশি সাংবাদিক, করেসপন্ডেন্ট ও সম্পাদকের সঙ্গে, স্থানীয় প্রশাসনের সদস্য ও নাগরিকদের সঙ্গে। গত ৪ঠা অগাষ্ট সেই রিপোর্টটি তাঁরা প্রকাশ করেছেন।
সুদর্শনা চক্রবর্তীর এই লেখাটি রিপোর্টের অনুবাদ নয়। বরং চেষ্টা করা হল, রিপোর্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি উঠে এসেছে তা পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার। ইংরেজি রিপোর্ট’টির লিংক দেওয়া রইল।
রিপোর্ট’টি-র মধ্য উঠে এসেছে কীভাবে কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতি স্বাধীন গণমাধ্যমের কন্ঠরোধ করছে। সাংবাদিকরা খবর সংগ্রহ, সত্যতা যাচাই ও তথ্য পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রবল নিয়ন্ত্রণের মুখে পড়ছেন, যার ফলে সঠিক তথ্য কোথাওই পৌঁছচ্ছে না, তৈরি হচ্ছে এক অস্বাভাবিক নৈঃশব্দ, যা নিঃসন্দেহে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। তাঁরা জানাচ্ছেন, “আমাদের অনুসন্ধানে উঠে এল কাশ্মীরের সংবাদমাধ্যমের এক ভয়ানক ও হতাশাব্যঞ্জক চিত্র। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সেনা অধ্যুষিত এলাকাগুলির একটিতে কাজ করতে গিয়ে তাদের প্রতি পদে অসম্ভব রকমের সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। তার মধ্যেও তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অকুস্থল থেকে খবর সংগ্রহের, দীর্ঘদিন যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ থাকায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যবসা ও অর্থনীতির উপর কী প্রভাব পড়তে পারে সেই সত্যি তুলে ধরার।”
এই ধরনের অকুস্থল থেকে কোনও রিপোর্টিং না হওয়ার কারণেই সরকার যে স্বাভাবিকতার গল্পটি তৈরি করছে তা পূর্ণতা পেয়ে যাচ্ছে। ‘নতুন কাশ্মীর’ তৈরির যে অফিশিয়াল দাবি করা হচ্ছে তা এভাবেই মান্যতা পেয়ে যাচ্ছে। অদ্ভূত বৈপরীত্যে কাশ্মীর থেকে রাগ, বিশ্বাস ভাঙায় যে মোহভঙ্গ বা বিচ্ছিন্নতার যে কন্ঠস্বর প্রকাশ পাওয়ার কথা তাকে স্তবন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। সরকারের এই যোগাযোগ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ও ক্ষতিকারক, কারণ তা ক্ষমতাসীনকে সুবিধা দিচ্ছে আর ক্ষমতার সামনে দাঁড়িয়ে সত্যি বলছে যে তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
তথ্যানুসন্ধান থেকে উঠে আসা মূল তথ্য
- সেইসব সাংবাদিকদের উপর নজরদারি, ইনফর্মাল ‘তদন্ত’ ও হেনস্থা, যারা সরকার বা নিরাপত্তাবাহিনীর বিরূদ্ধে যাচ্ছে এমন রিপোর্ট ছেপেছেন
- সঠিক তথ্য সাংবাদিকদের কাছ পর্যন্ত পৌছতে না দেওয়া
- হাসপাতাল সহ বিভিন্ন নির্দিষ্ট এলাকায় সাংবাদিকদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ
- ছাপার জন্য যেসব সুবিধা, পরিকাঠামো প্রয়োজন সেগুলি নিয়ন্ত্রণ করা
- তিনজন সাংবাদিক, যারা আর্ন্তজাতিক ভাবে পরিচিত এবং জাতীয় মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত ও যাদের সরকারী কোয়ার্টার দেওয়া হয়েছিল, তাদের মৌখিকভাবে কোয়ার্টার ছাড়তে বলা হয়েছে
- অফিশিয়াল কার্ফু ঘোষিত না হলেও এবং শাটডাউন-এর কোনও অফিশিয়াল নোটিস না থাকলেও সবরকম নিয়ন্ত্রণ
- ল্যান্ডলাইন কয়েকটি মাত্র জায়গায় কাজ করছে, কিন্তু যেখানে অধিকাংশ সংবাদপত্রের অফিস সেই প্রেস এনক্লেভ-এ নয়
- সাংবাদিকরা মেইল বা ফোন-এ সম্পাদকদের সঙ্গে কোনও খবর নিয়ে যোগাযোগ করতে পারছেন না, বিশেষত ফ্যাক্ট-চেক সংক্রান্ত বিষয়ে। ফলে জাতীয় মিডিয়া-এ খবর যেতে পারছে না
- কাশ্মীরের সংবাদপত্রে সম্পাদকের কন্ঠ এখন স্তব্ধ, পরিবর্তে সম্পাদকীয় পাতায় যাচ্ছে ‘সফ্ট’ বিষয়, যেমন ঘর পরিষ্কার রাখবেন কীভাবে, কোন্ ভিটামিন শরীর সুস্থ রাখতে প্রয়োজন ইত্যাদি
- মহিলা সাংবাদিকদের নিরাপত্তার অভাব
- স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের উপর আঘাত – সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এর ফলে বিপন্ন হচ্ছে ও কর্মরত সাংবাদিকদের চাকরিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে
- ‘নতুন কাশ্মীর’ তৈরির দাবী করে সরকার ‘স্বাভাবিকতা’র অর্থকেই নিয়ন্ত্রণ করছে
- কশ্মীরের যে কন্ঠস্বর বিশ্বাসভঙ্গ, বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া ও মোহভঙ্গের কারণে রাগে প্রতিবাদ করছে তাকে চুপ করিয়ে, অদৃশ্য করে রাখা হচ্ছে
ধরপাকড়, ভয় দেখানো ও তদন্ত
ইরফান মালিক ৫ই অগাষ্ট-এর পর প্রথম আটক হওয়া সাংবাদিক। কেন তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তার কোনও উত্তর ছিল না। তারও আগে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা নিয়ে ট্যুইট করায় অনন্তনাগের সাংবাদিক কাজি শিবলি-কে আটক করা হয়েছিল। স্পর্শকাতর খবরের জন্য সাংবাদিকদের পুলিশ ও তদন্তকারী আধিকারিকেরা জিজ্ঞাসাবাদ করছে ও সোর্স কারা জানাতে চাপ দিচ্ছে। কিছু প্রথম সারির সংবাদপত্রের সম্পাদকদের পরোক্ষে জানিয়ে রাখা হয়েছে তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর্ন্তজাতিক ও স্বাধীন জাতীয় সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত বরিষ্ঠ সাংবাদিক ফৈয়াজ বুখারি, এজাজ হুসেন ও নাজির মাসুদি-কে সরকারি আবাসন খালি করে দেওয়ার মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর্ন্তজাতিক মঞ্চে কাশ্মীরের কন্ঠ আটকানোর আরেকটি উদাহরণ হল বিখ্যাত কলমচি ও লেখক গওহর গিলানীকে ৩১শে অগাষ্ট বিদেশে যাওয়ার অনুমতি না দেওয়া।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের কন্ঠরোধ
৫ই অগাষ্ট-এর পর বেশ কিছু সংবাদপত্র ও পাক্ষিক তাদের প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। তিনটি প্রধান সংবাদপত্র ও প্রায় ছ’টি ছোট সংবাদপত্র মাত্র চার বা আট পাতা ছাপা হচ্ছে, কোনও কোনওটি সম্পাদকীয় ছাড়াই। সেগুলিও সংখ্যায় কম ছাপা হয়েছে ও সার্কুলেশন-এও সমস্যা হয়েছে। নিউজ সাইটগুলি যেগুলি সাহসী সংবাদ পরিবেশন করে থাকে, অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গেছে। সংবাদপত্র ও অন্য প্রকাশনাগুলি তাদের ওয়েবসাইট ৪ঠা অগাষ্ট-এর পর আপডেট করতে পারেনি।
এই তথ্যানুসন্ধানের উল্লেখযোগ্য দিক
- সেন্সরশিপ ও সংবাদের উপর নিয়ন্ত্রণ
- যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়ে এবং গতিবিধির উপর নিয়ন্ত্রণ করে সাংবাদিকদের খবর সংগ্রহে নিম্নলিখিতভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে
- যোগাযোগের সূত্র বা সোর্স থেকে কোনও রকম ঘটনা সম্পর্কে খবর বা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না ইন্টারনেট ও ফোন বন্ধ থাকায়
- গতিবিধি কমে যাওয়ায় ও নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় ঢোকার উপরে নিয়ন্ত্রণ জারি হওয়ায় প্রাথমিকভাবে খবর সংগ্রহ করা যাচ্ছে না
- প্রাথমিকভাবে তথ্যের সত্যতা যাচাই ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা যাচাই করাতেও বাধা দেওয়া হচ্ছে, আধিকারিকদের কাছ থেকেও কোনও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না, যার মানে দাঁড়াচ্ছে যে কোনও স্টোরি-র গ্রহণযোগ্যতাই প্রশ্নের মুখে পড়ছে
তাছাড়াও রয়েছে একটা ‘আনঅফিশিয়াল’ নির্দেশ কি ছাপা যাবে/যাবেনা সে বিষয়ে –
- উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিকেরা মিডিয়া অফিসে গিয়ে বলে এসেছেন কি কি বিষয়ে খবর ছাপা যাবে না – বিশেষত প্রতিবাদ, পাথর ছোঁড়া, নিয়ন্ত্রণ
- তথ্যানুসন্ধানী দলটি জানতে পারে যে বিজেপি সদস্যরা মিডিয়া অফিসগুলিতে ৭-৮টি স্টোরি নিয়ে আসছেন, যেগুলি প্রতিদিন একটি করে ছাপতে হব। এধরনের অফার খুবই লোভনীয়, বিশেষত যখন প্রকাশযোগ্য খবর করতে পারা যাচ্ছে না
- একটি স্পষ্ট পাকিস্তান-বিরোধীতা রয়েছে – মানে, ইমরান খান সম্পর্কে লেখা যাবে না, এমনকি খবরের কাগজের পাতাতেও। একজন পাকিস্তানি ক্রিকেটারের ছবি ছাপা হওয়ায় সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রের অফিসে পুলিশ হাজির হয়েছিল
সম্পাদক ও সাংবাদিকদের কন্ঠস্বর রুদ্ধ
(এই রিপোর্টে তথ্যানুসন্ধানীরা যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন তাঁদের ইচ্ছে ও নিরাপত্তার স্বার্থে নাম গোপন রেখে তুলে ধরা হয়েছে সম্পাদক ও সাংবাদিকদের বক্তব্য।)
১) “যদিও আমি প্রতিদিন আমার সংবাদপত্র প্রকাশ করছি, কিন্তু পাঠকদের কাছে নিজেকে খুবই অপরাধী বলে মনে করি কারণ আমি তাদের সামনে আসল ছবিটা তুলে ধরতে পারছি না। আমার সাংবাদিকরা তাঁদের সোর্স-দের সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগ করতে পারছেন না।”
২) “আমি ছাপাবন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্যাম্ফলেট প্রকাশ করা আমার কাজ নয়।”
৩) “আমাদের অনেকজন জেলা সাংবাদিক রয়েছেন অথচ জেলাগুলি থেকে একেবারেই কোনও খবর আসছে না। তাদের কোনও উপায় নেই আমাদের সাথে যোগাযোগ করার বা খবর পাঠানোর। এটা যেন একটা জিরো নিউজ জোন হয়ে গেছে।”
৫) “মিডিয়া সেন্টারে যখন আধিকারিকেরা কথা বলেন, হাসির রোল ওঠে, তাদের উত্তরগুলো এতটাই অদ্ভূত। আমরা যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, বলেছিলেন এগুলো নাকি অপারেশনাল ডিটেল, যা তারা আমাদের জানাতে পারবেন না।”
৬) “একটা বড় ধরনের সেল্ফ-সেন্সরশিপ চলছে।”
৭) “কাশ্মীরের স্থানীয় মিডিয়া, ভারতীয় আর আর্ন্তজাতিক মিডিয়ার মাঝখানে পিষে যাচ্ছে। আমরা কি নিজেদের কথাগুলো বলতে পারি? আমাদের কি নিজেদের বাস্তব আখ্যানের উপর আদৌ আর কোনও অধিকার আছে?”
৮) “ওরা আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে দেখে আমরা কে কি লিখছি। প্রত্যেকে নজরদারির মধ্যে রয়েছে।”
৯) “আধিকারিকদের কাছে পৌঁছানোর কোনও উপায় নেই। আমাদের স্টোরি হয়তো লেখা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কোনও আধিকারিকের কাছ থেকে অনুমোদন না পেলে সেটা ব্যবহার করব কীভাবে? এটা হচ্ছে একটা খবরকে আটকে দেওয়ার আরেকটা উপায়, যতক্ষণ পর্যন্ত না তা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে।”
১০) “স্থানীয় সাংবাদিকদের কাজ করতে না দিয়ে ন্যারেটিভ’টা সামলাতে বাইরের সাংবাদিকদের নিয়ে আসা হচ্ছে। আমি গত ২০-২৫ বছর ধরে কাজ করছি, আমার সাঙ্ঘাতিক খারাপ লাগে যখন দিল্লী ব্যুরো থেকে আমার সহকর্মীরা এখন স্টোরি করতে আসছেন। তাঁরা আমার সহকর্মী, আমি তাঁদের সাহায্য করছি – কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু আমার সারাক্ষণ মনে হয় ‘কেন’? আমি কি স্টোরি-টা লিখতে পারি না? আমার মনে হয় যেন আমাকে বিশ্বাস করা যায় না।”
১২) “আমাদের সংবাদপত্রের মালিকদের তো কাগজ বের করতেই হবে। …তাদের কাছে দুটোই উপায় থাকবে-প্রথম দু’মাস তারা আমাদের হয়তো পরিবার মনে করে বেতন দেবেন। কিন্তু দ্বিতীয় মাস থেকে তারা কি এতটাই উদার থাকতে পারবেন? তারপর কী হবে?”
১৩) “…আমি কার্ফুর প্রথম কয়েক দিন বেরোনোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু নিরাপত্তাবাহিনী আমার পরিচয়পত্রও স্বীকার করেনি। আমি একটা আর্ন্তজাতিক মিডিয়া হাউজ-এর জন্য কাজ করি, একজন স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্ট থেকে পেন ড্রাইভ-এ রিপোর্ট পাঠানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওরা জানতে পেরে আমাকে থামিয়ে দিয়েছিল।”
১৪) “আমরা যা দেখছি, তা লিখতে পারছি না। আমাদের তথ্য সব অস্বচ্ছই রেখে দিতে হচ্ছে।”
১৫) “ভবিষ্যতে সরকার আরও খারাপ কিছু করতে পারে। এরা এটা (যোগাযোগ বিধ্বস্ত করে দেওয়া) করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। একবার যখন এরা এরকম চেষ্টা করেছে, তখন সব জায়্গাতেই এরকমটাই করবে।”
১৬) “আমরা এখানে আজ যা দেখছি, তা হল প্রত্যেককে ক্ষমতাহীন করে দেওয়া – মূলস্রোতের রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী, সাংবাদিক, [সকলকে]।”
কাশ্মীরে বর্তমানে গণমাধ্যমে যে চরম সঙ্কটজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার জন্য দায়ী সবক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর প্রবল হস্তক্ষেপ, পুরোপুরিভাবে মৌলিক মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে নষ্ট করে দেওয়া। যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া, আর ইন্টারনেট ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেওয়া সমস্ত নাগরিকের জন্য অকল্পনীয় এবং অমানবিক সমস্যা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি মিডিয়ার কফিনেও শেষ পেরেকটি পুঁতে দিয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য নীচের পদক্ষেপগুলি চরম গুরুত্বপূর্ণ, এর একটিও কম হলে চলবে না –
১) যত দ্রুত সম্ভব ইন্টারনেট-এর উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে আর হাই স্পিড ইন্টারনেট সংযোগ দিতে হবে।
২) সাংবাদিক আর মিডিয়া হাউজগুলিকে প্রাধান্য দিয়ে সমস্ত ল্যান্ডলাইন আর মোবাইল ফোনের কানেকশন ফিরিয়ে দিতে হবে।
৩) সাংবাদিকদের অবাধ গতিবিধির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে, যাতে তারা ঘুরে সঠিক তথ্যের রিপোর্টিং করতে পারেন ও খবরের সত্যতা যাচাই করতে পারেন।
৪) সাংবাদিকদের উপর নজরদারি বন্ধ করতে হবে এবং তাদের থানায় ডেকে পাঠানো, গ্রেফতার ও আটকে রাখার ভয় দেখানো, ভুয়ো কেস দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
৫) স্থানীয়, জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক মিডিয়ার জন্য যেন সমান ব্যবস্থা থাকে, যাতে অফিশিয়াল তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনও বৈষম্য না হয়।
৬) সরকারী বিজ্ঞাপনের জন্য একটা স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।
৭) এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেখানে সাংবাদিকরা নিরাপত্তা ও সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে পারেন, তাঁদের উপযুক্ত বেতন ও কাজের প্রয়োজনীয় পরিবেশ বজায় থাকে। তৈরি হয় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপযুক্ত পরিসর।
কিছু কিছু কণ্ঠরুদ্ধ খবর
স্থানীয় মিডিয়াগুলি হেনস্থা এড়াতে বা নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে তথাকথিত ‘সেফ’ খেলছেন, ফলত তাদের কর্মীরা কোনও কাজই করতে পারছেন না। বলা যেতে পারে এক ধরনের নিজেদেরই আরোপিত ‘সেন্সরশিপ’ চলছে। নিরাপদ থাকার জন্য এখন আর কেউ ‘এক্সক্লুসিভ’-এর কথা ভাবছেন না, সব সংবাদপত্র একই খবর ‘কভার’ করছে। অনেক স্থানীয় সাংসবাদিকরা জানালেন তাঁরা মূল অফিস থেকে নির্দেশ পাচ্ছেন যাতে এমন খবর না করেন, যাতে তাঁরা গ্রেফতার হয়ে যেতে পারেন বা শারীরিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। এই বাধ্যবাধকতার জন্য স্থানীয় মিডিয়া বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর কভার করতে পারছে না –
- জেলাগুলি থেকে অল্পবয়সীদের আটক ও অত্যাচারের খবর। স্থানীয় মানুষেরা জানিয়েছেন রাত্রে গ্রামে ঢুকে পুলিশ ১২ বছর থেকে শুরু করে ছেলেদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। অল্প সময়ের জন্য তাদের আটকে রেখে, মারধোর, অত্যাচার করে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেককেই অন্য জায়গার জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে আর তাদের নামের তালিকা টাঙিয়ে দেওয়া হচ্ছে জেলা কমিশনারের অফিসে। পুলিশ স্টেশন ও জেলা কমিশনারের অফিসে শুধুই তুলে নিয়ে যাওয়া ছেলেদের মায়েদের ভিড়।
- গত এক মাসে কাশ্মীরের স্বাস্থ্য পরিষেবার ন্যক্কারজনক ছবি উঠে আসার পর, সরকারী মুখপাত্র প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি রোহিত কানসাস সরকারী হাসপাতালে অস্ত্রপচারের বিশদ বিবরণ দিতে পারেন, অথচ যে মুহূর্তে সাংবাদিকরা আরও বিশদ তথ্য জানতে চান (পেলেট-এ আহতের সংখ্যা কত), তাদের প্রশ্ন সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া হয়।
- পেলেট-এ আহতের মোট সংখ্যার কোনও সঠিক তথ্য নেই। ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্মীদের মিডিয়ার সাথে কথা বলা নিষিদ্ধ। আহতদের সঙ্গে কথা বলার কোনও সুযোগ নেই, তাদের পরিবারেরা মিডিয়ার সঙ্গে ভয়ে কথা বলছে না,পাছে তাদের ছেলেদের মিথ্যে কেস-এ ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়।
- সাংবাদিকদের অধিকারে হস্তক্ষেপ খোদ একটা না বলা আখ্যান, যেহেতু তাঁরা নিজেরা ‘খবর’ হতে চান না, তাদের হেনস্থা, তাদের উপর তৈরি হওয়া চাপ অজানাই থেকে যায়, ‘রিপোর্ট’ হয় না।
মহিলা সাংবাদিকদের অবস্থা
সেনাবাহিনীর অত্যধিক উপস্থিতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মহিলা সাংবাদিকদের পক্ষে তথ্য সংগ্রহ ও তাঁরা যে সংস্থার হয়ে কাজ করেন সেখানে রিপোর্ট ও ছবি পাঠানো এক বিরাট চ্যালেঞ্জ-এর মুখে পড়েছে। প্রচুর সমস্যার মুখে দাঁড়িয়ে তাঁরা প্রশাসনকে বাধ্য করেন মিডিয়া ফেসিলিটেশন সেন্টার’টিতে তাঁদের ব্যবহারের জন্য একটি কম্পিউটারের ব্যবস্থা করতে। গতিবিধির উপর নিয়ন্ত্রণ ও সেনা অধ্যুষিত রাস্তাঘাটের জন্য খবর সংগ্রহে বেরোনোটাই তাঁদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অধিকাংশের নিজস্ব কোনও পরিবহনের যান না থাকায় সমস্যা বেড়েছে। পরিবার তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত থাকায় কোনওরকম ঝুঁকির জায়গায় তাঁরা স্বভাবতই যেতে পারছেন না। মহিলা চিত্রসাংবাদিকরা তার মধ্যেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এই যে একটা ভয়ানক বদল ও তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের একটা ধারাবাহিক চিত্র-মুহূর্ত তৈরি করে রাখার। একজন জানিয়েছেন কীভাবে সেনাবাহিনী অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন বা সেনার বিরূদ্ধে কোনওরকম প্রতিবাদের ভিডিও বা ছবি তোলায় বাধা দিচ্ছে।এরকম কোনও ফুটেজ থাকলে মুছে ফেলতে বাধ্য করছে। কিছু ক্ষেত্রে মহিলা সাংবাদিকরা আত্মীয় সেজে পেলেট-এ আহত বা সেনার মারে আহতদের কাছে হাসপাতালে পৌঁছতে পেরেছেন। এ কথাও নিঃসন্দেহে সত্যি যে কাশ্মীরি মহিলাদের কাছে মহিলা সাংবাদিকরা অনেকটাই পৌঁছতে পেরেছেন। এতেই উঠে আসছে যেসব তথ্য তা হল – যোগাযোগ বন্ধ হওয়া, সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত উপস্থিতি ও যাতায়াতের উপর নিয়ন্ত্রণের জন্য গর্ভাবস্থার শেষ পর্যায়ে থাকা মহিলারা, অসুস্থরা বা যাদের পরিবারে কেউ অসুস্থ তাদের কি অসম্ভব অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। অথচ প্রশাসনিকভাবে খবর রটানো হচ্ছে যে ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে ও হাসপাতালও নিয়মমাফিক চলছে।
প্রকাশনা ও ওয়েবসাইটগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়া, চাকরি চলে যাওয়া, ফ্রিল্যান্সারদের নিদারুণ সমস্যা
কাশ্মীর এমন এক অঞ্চল যা গত তিন দশক ধরে অবিরাম রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও তার ফলে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে গণমাধ্যমে। তবে গত এক মাসের সমস্যা সবকিছু ছাপিয়ে গেছে। অথচ গত কয়েক বছরে সংবাদপত্র, পত্রিকা ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম-এ কাশ্মীরে বেশ উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছিল।
অফিশিয়াল সূত্রে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী – জম্মুতে ২৪২টি আর কাশ্মীরে ১৭২টি – মোট ৪১৪টি প্যানেলভুক্ত সংবাদপত্র আছে। এই ১৭২টির মধ্যে ৬০টি উর্দু ও ৪০টি ইংরেজি সংবাদপত্র। ১০০টি দৈনিক সংবাদপত্র, বাকিগুলি পাক্ষিক বা সাপ্তাহিক। দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ ইনফর্মেশন অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস(ডিআইপিআর), গভর্নমেন্ট অফ জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর বার্ষিক প্রায় ৪০ কোটি টাকার বিজ্ঞপনের বাজেট নিয়ন্ত্রণ করে।
২০১০ থেকে কেন্দ্রের ডিরেক্টোরেট অফ অ্যাডভার্টাইসিং অ্যান্ড ভিশ্যুয়াল পাবলিসিটি থেকে বিজ্ঞাপন আসা বন্ধ হয়ে গেলে সংবাদপত্রগুলি ডিআইপিআর-এর উপর অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফেব্রুয়ারিতে তারা দু’টি প্রধান ইংরাজি সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে কাশ্মীরের মিডিয়া জগতে।
- অনেকগুলি স্বাধীন সংবাদপত্রে সরকারী বিজ্ঞাপনের উপর আগে থেকেই নিষেধাজ্ঞা জারি থাকায় মিডিয়াতে অর্থনৈতিক চাপ ছিলই। এখন বেসরকারি ব্যবসা থেকে যেটুকু রেভেন্যু আসত তাও এই পরিস্থিতিতে অনেকটাই কমে গেল।
- প্রধান সংবাদপত্রগুলিতে প্রায় ৭৫% কর্মী ছাঁটাই করতে হয়েছে, সিনিয়র কর্মীরা প্রায় ৩০% পর্যন্ত কম বেতন নিচ্ছেন।
- কাশ্মীরের সাংবাদিকদের কাছ থেকে কম খবর আসার কারণ যেমন অধিকাংশ জাতীয় সংবাদপত্র বা পত্রিকা বুঝতে পারছে, তেমনি একটা আশঙ্কা কাজ করছে যে এমনভাবে বেশি দিন চলবে না এবং তারা খুব শীঘ্রই তাদের চুক্তি খোয়াবেন।
- এক সাংবাদিক জানিয়েছেন, “আজ সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ, আমি এখনও বেতন পাইনি।”
- বহু সাংবাদিকই ফ্রিল্যান্সার, যারা জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক ওয়েবসাইট ও প্রকাশনার জন্য লেখেন। তেমনই একজন জানিয়েছেন –“২০শে অগাষ্ট অবশেষে আমার মেইল’টা খুলতে পেরে দেখি আমার ১২টা অ্যাসাইনমেন্ট রয়েছে। একটারও উত্তর দিতে পারিনি আমি।”
ইন্টারনেট নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার সমস্যা
ইন্টারনেট নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় সাংবাদিকদের কাজ করতে চরম সমস্যা হচ্ছে। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় নতুন সব পন্থা বের করছেন তারা। তবে তা খুবই ক্লান্তিকর আর সর্বক্ষণ নজরদারির ভয় তো থাকেই।
- শুরুর দিকে কিছু সাংবাদিক অন্য জায়গার সহকর্মীদের কাছে পেন ড্রাইভ-এ করে রিপোর্ট পাঠাতেন।
- কিছু সাংবাদিক রাজ্যের যেসব জায়গায় ইন্টারনেট আছে সেখানে গেছেন।
- কিছু সাংবাদিক দেখেছেন যে অন্যত্র বিশ্বাসযোগ্য সহকর্মী বা আত্মীয়ও পাচ্ছেন না, যেখানে তাদের মেইল খুলতে পারেন কারণ তারা দু’ধাপ ভেরিফিকেশন-এর ব্যবস্থা রেখেছেন।
স্থানীয় মিডিয়া-র অবহেলা
স্থানীয় মিডিয়ার সাংবাদিকেরা দিল্লী থেকে আসা জাতীয় মিডিয়া-র সঙ্গে প্রশাসনের ব্যবহারে দৃশ্যতই বিরক্ত। শুরুর দিকে যখন তারা আসেন তখন তাদের প্রশাসন ও সেনাদের অবাধ গতিবিধির জন্য ব্যবহার্য লাল পাস দেওয়া হয়, যেখানে স্থানীয়দের জন্য ছিল সাধারণ নাগরিকদের ব্যবহার্য সাদা পাস।
বাইরের মিডিয়াকে রিপোর্ট পাঠানোর জন্য ইন্টারনেট সংযোগও দেওয়া হয়। অথচ তাদের সবচেয়ে বড় খবরগুলি স্থানীয় সাংবাদিকরাই করতে পারেননি।
আর্ন্তজাতিক সাংবাদিকরা ও কাশ্মীর উপত্যকার বাইরে থেকে আসা জাতীয় মিডিয়ার সাংবাদিকরাও পুরোপুরি স্থানীয় মিডিয়ার উপর নির্ভরশীল। স্থানীয় সাংবাদিকদের জন্যই তারা ঘুরে খবর সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু যোগাযোগে নিষেধাজ্ঞা জারি যে আসলে কাশ্মীরের কন্ঠস্বরই রুদ্ধ করে দিয়েছে।
স্থানীয় সাংবাদিকেরা এক ধরনের হতাশা আর দূরে সরিয়ে দেওয়া অনুভব করেন যখন তাদের পরিবর্তে দিল্লী বা অন্য কোনও জায়গার ব্যুরো সাংবাদিকদের খবর করতে পাঠায়। একজন সাংবাদিক জানালেন, “আমি স্টোরিটা অন্যরকমভাবে লিখতাম। এটা স্পষ্ট যে ওরা আমার রিপোর্ট’টা চায় না। তাই এখন আমি আর কিছুই ফাইল করি না।”
কাশ্মীরের ক্ষমতার খেলায় মেতে থাকা বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাঝে পড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেখানকার মিডিয়া। এরকম প্রেক্ষাপটে কাশ্মীর ওয়ার্কিং জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন, কাশ্মীর ইয়ং জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন ও নবনির্বাচিত গর্ভনিং বডি-র সদস্যদের নিয়ে তৈরি হওয়া কাশ্মীর প্রেস ক্লাব-ই আশার আলো দেখাচ্ছে।
স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারার অক্ষমতা সাংবাদিকদের মনের উপরেও গভীর ছাপ ফেলছে, তারা মনে করছেন নিজেদের মানুষদের ভরসার সম্মান রাখছেন না তারা। তাদের সবার কথাই যেন বললেন এক সাংবাদিক, “এঁদের কথাগুলোই আমাদের বলার কথা ছিল, কিন্তু আমরা পারছি না। অসহায় লাগছে। কাশ্মীরিরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন, কারণ আমরা কাশ্মীরের স্টোরি রিপোর্ট করতে পারছি না।”
Cover Image Courtesy: www.voanews.com
All other images taken from the report: NEWS BEHIND THE BARBED WIRE