এই মুহূর্তে ভীমা কোরেগাঁও মামলা, বম্বে হাইকোর্ট এবং সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে আলোচ্য হয়ে উঠেছে ওয়র অ্যান্ড পিস। আইনজীবীর ব্যাখায়, তলস্তয়ের ধ্রুপদী উপন্যাস নয়, সাংবাদিক বিশ্বজিৎ রায় সম্পাদিত বইয়ের কথা বলতে চেয়েছেন বিচারপতি। যে বই পাওয়া গিয়েছে দেশদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত ভার্নন গঞ্জালভেসের ঘরে। অথচ, এই বইটি সাধারণ ভাবে দেশের জঙ্গলমহলে এবং বিশেষ ভাবে রাজ্যের জঙ্গলমহলে এক রক্তপাতহীন পরিবেশ ও শান্তি স্থাপনের প্রচেষ্টা এবং তার ব্যর্থতার কারণগুলি বিশেষ ভাবে বুঝতে সাহায্য করে। লিখছেন দেবাশিস আইচ।
২৫ নভেম্বর ২০১১। সংবাদমাধ্যম জুড়ে ভয়াবহ রকমের ক্ষতবিক্ষত একটি দেহ জানিয়ে দিয়েছিল লালগড় আন্দোলনের আপাত পরিসমাপ্তির কথা। দেহটি ছিল কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজির। তার ঠিক মাস নয়েক আগেই ৩৪ বছরের বামশাসনের অবসান ঘটেছে। ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই সময় রাজ্যের তিন সাংবাদিক ছিঁড়েখুঁড়ে দেখতে চেয়েছিলেন লালগড় পর্বটিকে। তাঁদের সম্পাদনায় প্রায় পিঠোপিঠি প্রকাশিত হল তিনটি বই। প্রথম বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১১ সালের বইমেলায়। ‘লালগড়, মতামত ও তথ্যের পূর্ণাঙ্গ দলিল’, সম্পাদনা শুভাশিস মৈত্র। দ্বিতীয়টি, ২০১২’র বইমেলায়, চিত্রদীপ চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ‘ব্রেকিং নিউজ জঙ্গলমহল’ এবং তৃতীয়টি ‘ওয়র অ্যান্ড পিস ইন জঙ্গলমহল: পিপলস, স্টেট অ্যান্ড মাওয়িস্ট’, সম্পাদনা বিশ্বজিৎ রায়, মে ২০১২। সারা দেশের প্রায় ৯০ জন সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, মানবাধিকার কর্মী, অধ্যাপক, সমাজতাত্ত্বিকের রচনায় ঠাসা এই বই তিনটি নানা ভাবেই লালগড় আন্দোলনের প্রেক্ষিত, আন্দোলনের ঘরের খবর, ব্যর্থতা এবং দেশের আদিবাসী অঞ্চলে মাওবাদী প্রভাব, মাওবাদী হিংসা এবং পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের স্বরূপ, রাজনৈতিক দল ও সরকারের নীতিহীনতাকে তুলে ধরেছে। এই মুহূর্তে ভীমা কোরেগাঁও মামলা এবং বম্বে হাইকোর্ট এবং সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে আলোচ্য হয়ে উঠেছে ওয়র অ্যান্ড পিস ইন জঙ্গলমহল অর্থাৎ তৃতীয় বইটি। আইনজীবীর ব্যাখায়, তলস্তয়ের ধ্রুপদী উপন্যাস নয়, সাংবাদিক বিশ্বজিৎ রায় সম্পাদিত বইয়ের কথা বলতে চেয়েছেন বিচারপতি। যে বই পাওয়া গিয়েছে দেশদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত ভার্নন গঞ্জালভেসের ঘরে। অথচ, এই বইটি সাধারণ ভাবে দেশের জঙ্গলমহলে এবং বিশেষ ভাবে রাজ্যের জঙ্গলমহলে রক্তপাতহীন পরিবেশ ও শান্তি স্থাপনের প্রচেষ্টা এবং তার ব্যর্থতার কারণগুলি বিশেষ ভাবে বুঝতে সাহায্য করে।
কেন এই তিন সংকলন, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা রেখেছেন তিন সম্পাদকই। শুভাশিস সংকলনের মুখবন্ধে জানাচ্ছেন, “এ বারে, কেন এই বই, তার সাফাই গেয়ে নেওয়া যাক। নকশালবাড়ির মতোই রাজনীতির ইতিহাসে লালগড় থেকে যাবে। কেন, কি পরিস্থিতিতে লালগড়ে আগুন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটি সরকার কতদূর অপদার্থ হতে পারে, তার তথ্য সংরক্ষণ, মূল কারণ বইটির পরিকল্পনার। একটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য। বইয়ের নাম লালগড় হলেও, ভূগোলের লালগড়ে আটকে থাকেনি বেশিরভাগ লেখাই। সেটা স্বাভাবিক ভাবেই ঘটেছে। কারণ মাওবাদ বিষয়টি আলোচনায় না এনে লালগড় আলোচনা হয় না।”
চিত্রদীপ সম্পাদিত বইটি’র সব লেখকই এ রাজ্যের সাংবাদিক। যাঁরা দীর্ঘ লালগড় পর্বে ধারাবাহিক ভাবে জঙ্গলমহলে পড়ে থেকেছেন। চিত্রদীপ জানাচ্ছেন, “এখানে যারা লিখেছেন, সম্ভবত নিজের পাড়াকেও তারা জঙ্গলমহলের থেকে কম চেনেন। অবশ্যই তাগিদ থেকেই তাদের এসব জানতে, চিনতে হয়েছে। …প্রতিটি সংবাদমাধ্যমেরই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এখানে তার বাইরে বেড়িয়ে এসে প্রত্যেকে লিখেছেন ব্যক্তিগত ডায়েরি।…চেষ্টা হয়েছে তথ্য আর তত্ত্বকে সরিয়ে রেখে একটা অন্য জঙ্গলমহল তুলে ধরার।”
বিশ্বজিৎ রায় সম্পাদিত বইটির মূল সুর ও বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। এবারে বিস্তারিত আসা যাক।
ক্ষমতায় আসার পর পরই তৃণমূল সরকারের সমর্থনেই জঙ্গলমহলে শান্তি দৌত্য শুরু হয়েছিল। ছ’ছজন মধ্যস্থতাকারী সরকার ও মাওবাদীদের মধ্যে শান্তি আলোচনা শুরুর প্রাথমিক কাজও শুরু করেছিলেন। কিষেণজি’র ক্ষতবিক্ষত লাশ সংবাদমাধ্যমে ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সে প্রচেষ্টার সেখানেই ইতি ঘটে। কেন? এখানেই এই বইটির গুরুত্ব। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই এই বইটির জন্ম। বিশ্বজিৎ সম্পাদকীয় নোটে জানাচ্ছেন, মৃতজাত শান্তি প্রক্রিয়া শুধুমাত্র রাজ্য সরকার, মাওবাদী এবং সরকার নিয়োজিত মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলে দেয়নি, পাশাপাশি পর্যায়ক্রমিক ভাবে ক্ষমতায় ও বিরোধীপক্ষে থাকা রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি ও মিডিয়াকেও প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ২০০৪ সালে অন্ধ্রপ্রদেশে শান্তি প্রক্রিয়ার ডাক দিয়ে মাওবাদী নেতা আজাদের হত্যাকাণ্ড এবং বিতর্ক, পারস্পরিক দোষারোপ এবং সমালোচনার কথাও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে সম্পাদকীয় নোটে। এই হত্যাকাণ্ড এবং বিতর্কের খোঁজ শুধু নয়, সম্পাদক সঠিক ভাবেই মনে করেছেন শান্তি স্থাপনার সমস্যাটির উত্তরটি খুঁজতে হবে দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের খনিজ-সমৃদ্ধ জঙ্গলমহলের আদিবাসী প্রধান অঞ্চলে — যার একটি অংশ পশ্চিমবঙ্গ — এবং সেই অঞ্চলে ফেটে পড়া অঘোষিত গৃহযুদ্ধের বৃহত্তর আলোকে। প্রায় ৫৫০ পৃষ্ঠার, চারটি বিভাগে বিভাজিত এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নথি সমৃদ্ধ ক্রোড়পত্রে ভরা বইটিতে নানাদিক ধরেই এই প্রশ্নের উত্তরই খুঁজতে চাওয়া হয়েছে যে, কেন শান্তি কেবলই অধরা থেকে যায়।
কেন, এই সবিশেষ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে চেয়ে সাংবাদিক ও সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায় বইটির প্রথম বিভাগ ‘মমতা অর মাওয়িস্ট: হু ফেইলড পিস?’ অংশে যেমন রাজ্যের জঙ্গলমহলের তিন মধ্যস্থতাকারীর বক্তব্যকে স্থান করে দিয়েছেন। তেমনই, ‘এক্সপেরিয়েন্স ইন অন্ধ্র, ছত্তিসগড় অ্যান্ড এলসহোয়ার’ শীর্ষক দ্বিতীয় বিভাগে ওই অঞ্চলের শান্তি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি এবং সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিদের মূল্যবান মতামতকেও স্থান দিয়েছেন। যাঁদের মধ্যে একদিকে রয়েছেন, সুজাত ভদ্র, অশোকেন্দু সেনগুপ্ত, ছোটন দাস-এর মতো ব্যক্তিত্ব, অন্যদিকে ভারভারা রাও, কে বালাগোপাল, জি হরগোপাল, নন্দিনী সুন্দর, বিনায়ক সেনরা। বইটির একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর জুড়ে লালগড় আন্দোলন বিষয়ে সুজাত ভদ্র, কিষেণজি ও অমিত ভট্টাচার্য’র বিতর্ক। দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকায় যা প্রকাশিত হয়েছিল।
চল্লিশ জন লেখকের মধ্যে প্রথম জন মহাশ্বেতা দেবী। তাঁর লেখায় রয়েছে বামফ্রন্টের কঠোর সমালোচনা, আবার সন্তোষ রানার মতে, মমতা কিংবা মাওবাদী কেউই গণতন্ত্রের পরোয়া করেন না। প্রবীণ সাংবাদিক এবং ‘ইন দ্য ওয়েক অব নকশালবাড়ি’র লেখক সুমন্ত ব্যানার্জি তো মনেই করেন, শান্তি দৌত্যে সামিল হওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং বিদ্বজ্জনরা ‘একটা পূতিগন্ধময় কপটতা ও সুবিধাবাদী পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন’। এ জাতীয় সমালোচনার সম্পর্কে পরিচিত অন্যতম মধ্যস্থতাকারী অশোকেন্দু সেনগুপ্ত দীর্ঘ আলোচনায় লালগড় আন্দোলনের শুরু থেকে শান্তি আলোচনার ব্যর্থতার ইতিবৃত্ত নির্মোহ ভঙ্গিতে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন। এছাড়াও আলোচকদের মধ্যে রয়েছেন, রণবীর সমাদ্দার, অমিত ভাদুড়ী মনোরঞ্জন মহান্তি, গৌতম নাভালখা, নিবেদিতা মেননরাও। লক্ষ্য, অধরা শান্তি ও গণতন্ত্রের পুনঃস্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি করা।
এমন একটি বই দলিত-আদিবাসীদের শোষণ-বঞ্চনার সমব্যাথী, সমমর্মী শিক্ষাবিদ ভার্নন গঞ্জালভেসের ব্যক্তিগত বইয়ের সংগ্রহে থাকাটা কোনও অবাক করার মতো বিষয়ই হতে পারে না। যদি না রাষ্ট্র এবং তার স্তম্ভেরা বই কিংবা জ্ঞানার্জনকে একটি দেশদ্রোহী বস্তু ও প্রক্রিয়া বলে মনে করে। রাষ্ট্র বিরোধী ডাইন শিকারের উন্মত্ততায় বইয়ের তাক উজার করে আদালতে হাজির করা কোতোয়ালের ধর্ম। যুগ যুগ ধরে তা হয়েছে। কিন্তু, বিচারপতি সারঙ্গ কোটোয়াল তো প্রশ্ন তুলবেন, ‘কেন’? বইগুলি কি নিষিদ্ধ? কেন নিষিদ্ধ? যদি তা না হয় তবে একজন নাগরিক কী পড়বে, কেন পড়বে তার সীমা নির্দ্ধারণ করতে পারে না বিশ্বের কোনও আদালত। প্রশ্নও তুলতে পারে না। পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থা নতুন ভারতে যে এক মর্মান্তিক প্রহসনে পরিণত হয়েছে ওয়র অ্যান্ড পিস বিতর্ক আমাদের সেই দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। তলস্তয় না রায় — এ শাক দিয়ে মাছ ঢাকার পুরনো গল্প। দুর্গন্ধ বেরিয়ে পড়েছে।
Immaterial whether it is Tolostoy or Biswajit Roy’s books,the state is adamant to accuse these great persons because they have accused the system. Same history as we saw in Nazi’s era.Bertolt Brecht was marked as culprit.So nothing abnormal!