ভাটপাড়ায় রাজনৈতিক জমি দখলের তৃণমূল বনাম বিজেপি‘র দাঙ্গা মুসলমান বিরোধী দাঙ্গায় রূপান্তরিত হওয়ার পিছনে অর্থনীতি এক বড়ো ভূমিকা পালন করেছে। অন্তত, মিশ্র অঞ্চলে মুসলমান ব্যবসায়ীদের উপর বাধাহীন এক তরফা আক্রমণ, বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে মুসলমান বস্তি উচ্ছেদ এবং মুসলমান নাগরিকদের ঘরছাড়া করার হিংস্র প্রচেষ্টা সে কথাই প্রমাণ করে। একাধিক স্বাধীন গ্রাউন্ড রিপোর্ট এবং হিংসাশ্রয়ী ঘটনার ডিজাইন, ভুক্তভোগীদের বয়ান, আক্রান্ত কোণঠাসা সম্প্রদায়ের শান্তি প্রতিষ্ঠার আকুল আবেদন ফিরিয়ে দেওয়ার পিছনে এই কথা প্রমাণ করে। লিখছেন কোয়েল সাহা।
আরও এক ইদ আসছে। ইদ উল আজহা। ত্যাগের উৎসব। দু‘মাস ব্যাপী রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত ভাটপাড়ায় উৎসবের দিন কেমন কাটবে হায়দার আলি, মেহেরুন বিবিদের? যথেষ্ট ত্যাগ কি তাঁরা ইতিমধ্যেই করেননি? এই তো মাস দু‘আড়াই হবে পবিত্র রমজান মাসে, সে খুশির ইদ, ইদ উল ফিতরের প্রাক্কালে, সর্বস্ব লুঠ হয়ে গিয়েছিল মহম্মদ হায়দার আলিদের। পুড়ে ছাই হয়েছে মেহেরুন বিবিদের মাথা গোঁজার ঠাঁই।
রাজ্যের মানুষের কথা থাক, ৩৬ কিলোমিটার দক্ষিণে মহানগরীতে সে খবরের ছবি তখনও সম্পূর্ণ অস্পষ্ট। কলকাতার ইতিউতি তখন কতিপয় নাগরিকের উদ্যোগে দু‘চারটি ‘সম্প্রীতির ইফতার‘ আয়োজিত হচ্ছে। অন্যদিকে, নির্বাচনী এবং নির্বাচন বহির্ভূত রাজনৈতিক জমি দখলের লড়াই কীভাবে জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে তখন তারই তুমুল পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলছিল ভাটপাড়া–জগদ্দল–কাঁকিনাড়া জুড়ে। যার শিকার হলেন প্রধানত মুসলমান ও দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ। দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের মৃত্যুর কথা বড়ো করে উঠে এলেও বিপর্যস্ত মুসলমান সম্প্রদায়ের কাহিনি নীরবতার সংস্কৃতির শিকার হল ফের। ১৯ মে শেষ পর্বের লোকসভা নির্বাচনের দিন থেকে টানা লাগামহীন সন্ত্রাস চলেছে ভাটপাড়া লোকসভার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। উত্তাপ কখনো বেড়েছে কখনো কমেছে। ২৬ জুলাই অর্থাৎ এই অঞ্চলের সন্ত্রাস শেষ বারের মতো সরজমিনে দেখার দিন পর্যন্ত, স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসেনি।
মহম্মদ হায়দার আলিদের কথায় ফিরে আসা যাক। ঘোষপাড়া রোডের ওল্ড পোস্ট অফিসের বিল্ডিংয়ের নীচে ৭৫ বছরের বৃদ্ধ হায়দারের তিন পুরুষের জুতোর দোকান পিঙ্কি শু সেন্টার। ইদ উপলক্ষ্যে স্বাভাবিক কারণেই দোকানে বেশি করে মাল তুলেছিলেন। ২৩ মে সন্ধ্যা ৭টা সবে ইফতার সেরে নমাজ পড়েছেন। দুই ছেলে গিয়েছে ইফতার করতে সেই সময় হঠাৎই প্রায় ৪০ জন হাতুড়ি–শাবল নিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়দার আলি দোকানে। নিমেষে লুঠ হয়ে যায় প্রায় ১৫ লক্ষ টাকার সামগ্রী। তছনছ করে দেওয়া হয় দোকানটি। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বৃদ্ধ হায়দার। তাকে মেরে নর্দমায় ফেলে দেওয়া হয়। এখানেই থেমে থাকেনি হিন্দুত্ববাদী দুষ্কৃতীরা। লুঠপাট চালায় লাগোয়া বাড়িতেও। লুঠ হয়ে যায় রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে বিরিয়ানি রান্নার বড়ো পাত্র, ওয়াটার পিউরিফায়ার থেকে পাখা। স্টিলের আলমারি ভেঙে তিনভরি সোনার গহনা, রুপোর বাসন এমনকী দৈনন্দিন পরার পোশাকও। ঘটনার অভিঘাতে কথা হারিয়েছেন হায়দার। এসব তথ্য জানিয়েছেন তাঁর ছেলে গোলাম ইয়াজদানি। লুঠ হয়েছে ইয়াজদানির ব্যাগ, সুটকেস, ট্রলির দোকানও। দোকান বলে যে কিছু ছিল তা বোঝার উপায় নেই। তাঁর দাবি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৮০ লক্ষ টাকা।
প্রবীণ মহম্মদ নুর আনসারি চটকলের এক হাজার টাকা মাসিক পেনসনের অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক। বাড়িতে ছ‘টি মুখ। ছেলে চটকলেরই বদলি শ্রমিক। স্থাবর সম্পত্তি বলতে একটি মাত্র ঘর আর রান্নার ছোট এক টুকরো জায়গার বাসস্থান। বাড়ির সামনে একটি পান–বিড়ির গুমটি এবং সাইকেল সারানোর দোকান দিয়েছিল আনসারি পরিবার। ২৩ মে ওই একইদিনে প্রায় একই সময় আক্রান্ত হয় নুর আনসারির বাড়ি। লুটেরাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সংসারের হাঁড়িকুড়ি, গ্যাস সিলিন্ডার–ওভেন, জামা–কাপড় মায় ক্লাস টেনের মাদ্রাসা ছাত্রী ইয়াসমিন পারভিনের বইখাতা। লুঠ হয়েছে দোকানের সর্বস্ব। স্থানীয় ব্যবসায়ী বিলাস রামের (নাম পরিবর্তিত) লুঠপাটকারীরা সবাই বিজেপি‘র সমর্থক। তাঁর মতে এরা সব নব্য বিজেপি। পুরনো বিজেপি কর্মীরা এই ঘটনায় যুক্ত নয়।
২৩ মে শুধুমাত্র ঘোষপাড়া রোড নয়, আক্রান্ত হয় কাঁকিনাড়ার বারুইপাড়া মসজিদ সংলগ্ন এলাকাও। ওইদিন রাতে এলাকার বেশ কিছু মুসলিম বাড়িতে সর্বস্ব লুঠপাট করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ ১৯ তারিখ ভোট শেষ হওয়ার পর থেকে দফায় দফায় মুখে কাপড় বাঁধা সমাজবিরোধীরা এই এলাকায় ঢুকে মুসলিমদের এলাকা ছেড়ে যাবার জন্য হুমকি দিতে থাকে। সন্ত্রাস আরও তীব্র করার জন্য তারা নিয়ন্ত্রিত ভাবে ফাঁকা রাস্তায় বোমা ফাটায়। ভয়ে এবং পরিস্থিতির চাপে অনেকেই বাড়ি বন্ধ করে কয়েকদিনের জন্য এলাকা ছেড়ে চলে যায়। এমনই একজন মেহেরুন বিবি।
বছর পঞ্চাশের মেহেরুন মূলত পরিচারিকার কাজ করেন। তিন মেয়ে ও এক ছেলে বিবাহিত অন্যত্র থাকেন। আরও দুই মেয়ে বাড়িতেই সেলাই করে এবং দুই ছেলে শিল্পাঞ্চলে মাল বওয়ার মতো দিনমজুরির কাজ করেন। বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ায় সেলাই মেশিন সহ যাবতীয় সবকিছু পুড়ে যায়। প্রশাসনের নজরে আনার আশায় প্রায় পাঁচ সপ্তাহ পোড়া বাড়ি পরিষ্কার করেননি মেহেরুন। অবশেষে নতুন করে সব কিছু শুরু করার জন্য পরিবারের সবাই মিলে হাত লাগিয়েছেন।
একই দিনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় আসমা বিবিদের বাড়ি–ঘরে। আসমা বিবি জানান, কয়েকদিন ধরেই উত্তেজনা বাড়ছিল। ২৩ তারিখ সন্ধ্যা থেকে তা চরম আকার নেয়। বাড়ির পুরুষরা মিল ও অন্যান্য কাজ থেকে না–ফেরায় মহিলারা পাশেই একটি নির্মীয়মান বহুতলে আশ্রয় নেয়। রাত ন‘টায় পুলিশের উপস্থিতিতেই সমাজবিরোধীরা একের পর এক বাড়িতে আগুন লাগাতে শুরু করে বলে অভিযোগ। আসমা বিবিরা ওই বহুতল থেকে নেমে আসার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দিয়ে জানিয়ে দেয়, এই বাড়ি থেকে বেরোলে আর নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। আসমা বিবি মেয়ের বিয়ের জন্য সোনার সামান্য গহনা তৈরি করে রেখেছিলেন। লুঠ হয়েছে তাও।
জুন মাসের প্রথম দিকে এই এলাকা স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে থাকে। ১০ জুন হঠাৎই ফের আক্রান্ত হয়। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর বাড়ির সামনে পরিবার সহ বসে ছিলেন অ্যাংলো ইন্ডিয়া জুট মিলের শ্রমিক মহম্মদ হালিম ও মহম্মদ মুস্তাক। ২২ নম্বর গলিতে পাশাপাশি বাড়ি তাদের। রাত দশটার সময় হঠাৎই গলির দু‘মুখ থেকে বোমাবাজি শুরু হয়। ডানদিক থেকে আসা বোমা হালিমের মাথায় লাগে। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর স্ত্রী রুবি পরভিনের (৪২) কাঁধে আঘাত লাগে এবং হাড় ভেঙে যায়। চোখে গুরুতর আঘাত লাগে ছোট ছেলে কাবরেজ আলমের (১৩)। আহত হন বড়ো ছেলে পারভেজ আলমও। অন্যদিক থেকে আসা আরেকটি বোমার আঘাতে গুরুতর আহত হন মহম্মদ মুস্তাক। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও সেখানেই মারা যান। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে মহম্মদ হালিমের পরিবারের চিকিৎসার জন্য তিন লক্ষ টাকা দেওয়া হয়। এছাড়া বড়ো ছেলেকে সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। জানা গিয়েছে নিহত দুই শ্রমিক কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
প্রায় দু‘আড়াই মাস ব্যাপী ভাটপাড়া–কাণ্ডে পুলিশের ভূমিকায় সব মহলই কমবেশি ক্ষুব্ধ। কখনো অভিযোগ উঠেছে, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে তৃণমূল মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীরা বিজেপি প্রভাবিত এলাকায় হামলা চালিয়েছে, কখনো অভিযোগ উঠেছে বিজেপি মদতপুষ্ট সমাজবিরোধীরা তৃণমূল নেতা–কর্মীদের উপর হামলা চালিয়ে তাদের ঘরছাড়া করেছে এবং দলীয় দফতর দখল করে নিয়েছে। পুলিশ–প্রশাসন তাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই দুই অভিযোগের মধ্যেই সত্যতা রয়েছে। আবার এ কথাও সত্য, বিশেষভাবে মুসলমান ব্যবসায়ী, সাধারণ নাগরিকদের দোকানপাট, বাড়িঘরে বিজেপি আশ্রিত সমাজবিরোধীদের লুঠপাট, আগুন লাগানো, এলাকা ছাড়া করার ঘটনায় পুলিশ কোনোরকম নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। পরিস্থিতি সম্পূর্ন ভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় রাজ্য প্রশাসন পুলিশি ব্যবস্থা জোরদার করার স্বার্থে ভাটপাড়ার ১২টি ওয়ার্ডকে কেন্দ্র করে নতুন ভাটপাড়া থানা স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০ জুন এই থানা উদ্বোধনের দিনই পুলিশের গুলিতে দুজনের মৃত্যু হয়।
স্থানীয় মানুষদের বয়ান অনুযায়ী ২০ জুন কাঁকিনাড়া রিলায়েন্স জুটমিল সংলগ্ন এলাকায় গণ্ডগোল বাঁধে। বোমাবাজিও হয়। সকাল ১১টা নাগাদ মিল শ্রমিকদের মর্নিং শিফটের ছুটির সময় পর পর বোমা পড়ে। অভিযোগ, পুলিশ সে দিকে নজর না–দিয়ে ওই এলাকা থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে কাঁকিনাড়ায় কাছারি রোড এলাকায় গুলি চালায়। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যান পেশায় ফুচকাওয়ালা সতেরো বছরের রামবাবু সাউ। গুলিবিদ্ধ হন আরও এক ফুচকাওয়ালা ধরমবীর সাউ (৪৫)। প্রাথমিক ভাবে তাঁকে ভাটপাড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার সময় পথেই মারা যান ধরমবীর। রামবাবুর রক্তাক্ত দেহ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বার বার পুলিশকে আবেদন জানান তাঁর কাকিমা মণিকা সাউ। অভিযোগ, পুলিশ তাঁর কথা তো শোনেইনি উল্টে দেহ তুলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাধা দেয়। প্রায় ৪০ মিনিট রাস্তায় পড়ে থাকার পর ব্যারাকপুর বিএন বোস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে রামবাবুকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের ছেলে রামবাবু। তাঁর বাবা বছর পাঁচেক আগে মারা যান। ছেলের শোকে প্রায় উন্মাদ মা। দুই ভাই ও মায়ের সংসারে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়া রামবাবুই ছিলেন একমাত্র রোজগেরে। তাঁর আসল নাম রহিত সাউ। দায়িত্ববান রহিতকে ভালোবেসে সকলে রামবাবু বলে ডাকত। নিত্যদিন ফুচকার পশরা নিয়ে টিটাগড়ে যেতেন রাম। ধরমবীর সাউয়ের বাড়িতে রয়েছেন স্ত্রী নমিতা দেবী, ছেলে নবম শ্রেণির ছাত্র সুজয় সাউ এবং মেয়ে, ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী নাতাশা। পরিবারের বক্তব্য ধরমবীর ফুচকা তৈরির উপাদান কিনতে বাজারে গিয়েছিলেন। আর সকালের চা–জলখাবার খেতে বেরিয়েছিলেন রামবাবু।
এই দিলের গুলি চালনার ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন স্থানীয় ভারতী বিদ্যাপীঠের শিক্ষক প্রদীপ সাউ। গোলমালের আঁচ পেতেই তিনি বিদ্যালয়ের গেট বন্ধ করতে যান, তখন গুলি এসে লাগে তাঁর হাতে। গণ্ডগোল দেখে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছিলেন সন্তোষ প্রসাদ (২৪) একটি গুলি তাঁর পেটে লাগে। কাছারি রোড ও ঘোষপাড়া রোডের প্রায় মোড়ে তাঁদের মিষ্টির দোকান জয়গুরু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। মোট পাঁচজন পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন বলে বেসরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে।
আরও এক ফুচকা বিক্রেতার খুনের খবর পাওয়া গিয়েছে। তিনি কাঁকিনাড়া ২০ নম্বর গলির বাসিন্দা লালন সাউ (৩২)। তাঁর গলাকাটা দেহ উদ্ধার হয় বাড়ির কাছেই একটি পুকুর থেকে। যৌনাঙ্গও কেটে নেওয়া হয়েছিল। কেটে নেওয়া মাথাটি বস্তাবন্দি করে নৈহাটি লোকালের ভেন্ডার কামরায় তুলে দেওয়া হয়েছিল। সেই ট্রেন পরবর্তীতে হাসনাবাদ লোকাল হয়ে হাসনাবাদের পথে বারাসতে পৌঁছালে সেখানে মাথাটি উদ্ধার হয়।
প্রতক্ষ্যদর্শী, মানবাধিকার কর্মী এবং সিটিজেন রিপোর্টারদের থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই সন্ত্রাস ও ধ্বংসলীলার শিকার আরও বহু এলাকা এবং বহু মানুষ। রাজ্য প্রশাসন যথারীতি ক্ষয়ক্ষতি, আহত–নিহত, ঘরছাড়া, ক্ষতিপূরণ কিংবা গ্রেপ্তার বা আটক বিষয়ে কোনও তথ্য প্রকাশ করেনি। এর পরেও ক্ষয়ক্ষতি বিষয়ক আরও কিছু অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
ঘোষপাড়া রোডঃ
# ইরফান কমিউনিকেশন লুঠ করার পর তা বিজেপি পার্টি অফিসে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
# একই ভাবে বিজেপি পার্টি অফিসে বদলে গিয়েছে মানিকপীরে মহম্মদ জাভেদের ঘর, কামরুদ্দিন মিট শপ, গুড্ডু চিকেন সেন্টার।
# লুঠ হয়েছে ৭ নম্বর গলির জমিরাউল্লার খান টেলিকম। মহম্মদ কালামের পরিবার টেলিকম।
দড়মা লাইনঃ
এই অঞ্চলে অতি দরিদ্র মুসলিম পরিবারের ৩২টি ঘরে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালানোর পর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাঁদের মধ্যে আছেন মিল শ্রমিক, ভ্যান ও রিক্সা চালক এমনকী কাগজ–প্লাস্টিক কুড়িয়ে বেঁচে থাকা পরিবারও।
টিনা গোডাউনঃ
১৯ মে রাত, ২১, ২৩ ও ২৪ জুন এই এলাকায় হামলা হয়। হুমকি দেওয়া হয় এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার। আক্রান্ত হন কাগজ–প্লাস্টিকের ভাঙা বাতিল সামগ্রী কুড়িয়ে বিক্রির কারবারি থেকে সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ। তাঁদের মধ্যে আছেন কাগজ কুড়ানি শায়েদা খাতুন, সাধারণ মধ্যবিত্ত কলিমুন্নিসা, জাবির খান, রেহানা খাতুন, শাবানা বিবি, মুন্নি খাতুন এমনকী গা–ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা গীতা দেবী ও জনৈক সন্তোষ।
বারুইপাড়াঃ
এই অঞ্চলের ২২ নম্বর গলির মহম্মদ হাদিস তাঁর সর্বস্ব খুইয়েছেন।
রুস্তম গুমটিঃ
# নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরদিন ২৪ মে সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ এই এলাকায় মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের কাপড়–জামার দোকান নিউ লুক গার্মেন্টস–এ হামলা চালায় মুখঢাকা ১৫–২০ জন দুষ্কৃতী। প্রায় ৭০ হাজার টাকার পোশাক লুঠ হয়। দোকান লাগোয়া বাড়ি থেকে নিয়ে যায় রঙিন টিভি।
# রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ একই ভাবে ওয়াকার হাসানের মোবাইলের দোকান থেকে আড়াই লক্ষ টাকা এবং সংলগ্ন ঘর থেকে আলমারি ভেঙে সোনা ও নগদ মিলিয়ে প্রায় ৬০ হাজার টাকা লুঠ করা হয়।
# আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ভ্যারাইটি সেন্টার।
জগদ্দল বড়ো মসজিদ এলাকাঃ
# মহম্মদ আয়ুব, ফুটপাতের জামাকাপড়ের দোকান। প্রায় ২৪ হাজার টাকার পোশাক লুঠ হয়েছে বলে আয়ুবের অভিযোগ।
# আব্দুল সামাদ। তাঁর দোকান সোনু ফুটওয়্যারের দরজা ভেঙে ৭০ হাজার টাকার জুতো, সিলিং ফ্যান এবং এলইডি বালব নিয়ে গিয়েছে সমাজবিরোধীরা।
# হাসান আলি। মোবাইল সারানোর, ই–টিকিটের ব্যবসা। হারিয়েছেন মোবাইল, ল্যাপটপ। খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আলো, পাখা।
কাঁকিনাড়া জামা মসজিদ এলাকাঃ
এই অঞ্চল বার বার আক্রান্ত হয়েছে। অভিযোগ, কাছারি রোড এলাকা থেকে সশস্ত্র বাহিনী ইট–পাটকেল, অস্ত্রশস্ত্র, বোমা নিয়ে আক্রমণ শানিয়েছে। পুলিশ কিংবা র্যাফও সেই আক্রমণ সামলাতে ব্যর্থ হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে মসজিদ, দীর্ঘ এলাকা জুড়ে সাধারণ মুসলিম বাড়ি ভাঙচুর হয়। বহু মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন।
# পুলিশের সামনে লুঠ হওয়ার অভিযোগ উঠেছে মহম্মদ ইসমাইলের মোবাইলের দোকান।
# পুড়েছে মহম্মদ খুরশিদের কাঠমান্ডু টেলারিং শপ এবং মিরাজের কসমেটিক্স ও প্লাস্টিকের সামগ্রীর দোকান।
শান্তির খোঁজ
নৈহাটিতে শান্তির জন্য নাগরিক পদযাত্রা, বিদ্বজ্জনদের এবং মানবাধিকার কর্মীদের ভাটপাড়া পরিদর্শন, বামপন্থীদের মিছিলের বহু আগেই শান্তির আবেদন জানিয়েছিলেন বারুইপাড়া মসজিদের ইমাম মৌলানা মহম্মদ মোহাজিরি এমনকী নিহত মহম্মদ হালিমের ভাইপো মহম্মদ কামারুদ্দিন এবং নিহত মহম্মদ মুস্তাকের ছেলে মহম্মদ ইস্তিয়াক। ২৬ মে স্থানীয় পুরপিতার সঙ্গে দেখা করে দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এবং শান্তি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য প্রার্থনা করেন ইমাম। কিন্তু, উচ্চতর নেতৃত্বের অনুমতি ছাড়া কিছু করা যাবে না বলে ফিরিয়ে দেওয়া হয় সেই প্রস্তাব।
কেন এই সন্ত্রাস?
প্রায় দু‘মাস ব্যাপী সন্ত্রাসের পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। তার প্রধান কারণের একটি অবশ্যই ভাটপাড়া ও সন্নিহিত এলাকার রাজনৈতিক ক্ষমতা কার হাতে থাকবে সেই প্রশ্নে। অবিসংবাদিত ভাবে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে। বিশেষ ভাবে বিধায়ক ও ভাটপাড়া পুরসভার চেয়ারম্যান অর্জুন সিংয়ের হাতে। অর্জুন বিজেপি–তে যোগ দিলে সমীকরণ বদলে যায়। ব্যারাকপুর লোকসভা আসন, ভাটপাড়া বিধানসভা রক্ষায় যেমন মরিয়া হয়ে ওঠে তৃণমূল, তেমনই তা কেড়ে নিতে সমানভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠেন অর্জুন। ২০১৪ সাল থেকেই ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে হিন্দুত্ববাদী প্রভাব বাড়তে শুরু করেছিল। তৃণমূলের অন্যতম প্রধান নেতা মুকুল রায় বিজেপি দলে যোগ দিলে ধর্মীয় মেরুকরণের পাশাপাশি বিজেপি‘র পক্ষে রাজনৈতিক পাল্লাও ভারী হতে থাকে। রাজনৈতিক ক্ষমতা বর্তমানে ধর্মীয়–রাজনৈতিক ক্ষমতায় বদলে গিয়েছে।
মেরুকরণের উৎস সন্ধান
২০১৮ সালে মার্চ মাসে রামনবমীর মিছিল ঘিরে ভাটপাড়ায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস – এর রিপোর্ট থেকে জানা যায়, এই মিছিলে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন তৃণমূল বিধায়ক অর্জুন সিং এবং ভাটপাড়া মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ইন কাউন্সিল মহ. মকসুদ আলম। আলম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান, মিছিল শুরুর কিছু সময়ের মধ্যে ধারালো অস্ত্রধারী বিজেপি সমর্থকরা দলে দলে মিছিল ‘হাইজ্যাক‘ করে নেয়। এবং ‘বিজেপি মার্কা স্লোগান‘ দিতে থাকে। মিছিল অস্ত্রহীন ও অরাজনৈতিক হবে বলেই কড়া নির্দেশ ছিল। কিন্তু, মিছিলের রাশ উদ্যোক্তাদের হাত থেকে চলে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান উদ্ধৃত করে সংবাদপত্রটি জানায়, এক শ্রেণির মিছিলকারীর স্লোগানের বিরোধিতা করে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। এর পর দু‘দলের মধ্যে ইট–পাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ি হয়। ঘটনাটি ঘটে জামা মসজিদ সংলগ্ন এলাকায়। মিছিলের সামনের অংশ তখন কাঁকিনাড়া স্টেশনের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। ইট মারামারির খবর সেখানে পৌঁছতেই একদল যুবক স্টেশন এলাকায় মৌলানা আবুল কালাম আজাদ–এর একটি মূর্তি ভেঙে ফেলে। এর পর সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকটি গাড়িতে আগুন লাগানো হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মকসুদ খান নামে এক বেলুন বিক্রেতা।
শুধু ভাটপাড়া নয় ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের একাধিক বিধানসভা এলাকায় তৃণমূল বিধায়ক ও নেতৃত্ব রামনবমী মিছিলের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মূলত অবাঙালি নাগরিকদের ধর্মীয় অনুভূতির চাপ ও ভোট এবং সঙ্ঘ পরিবার ও বিজেপি‘র পালের হাওয়ায় ভাগ বসাতেই এটা ছিল তৃণমূলের নরম হিন্দুত্বের রণকৌশল। কার্যক্ষেত্রে যা হিতে বিপরীত হয়েছে। কেননা ২০১৪ সাল থেকেই রাজ্যে এবং বিশেষভাবে ‘মিনি ইন্ডিয়া‘ বলে কথিত শিল্পাঞ্চল গুলিতে সঙ্ঘ পরিবার তার হিন্দুত্ববাদী প্রচারের জাল বিস্তার শুরু করে। ২০১৬ সালে ব্যারাকপুর লোকসভার অন্তর্গত এবং ভাটপাড়া লাগোয়া নৈহাটি শিল্পাঞ্চলের হাজিনগরে ঘটে যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। স্রেফ দুর্গাপুজোর ভাসান ও মহরমের মিছিলকে সাম্প্রদায়িক ইস্যু করে।
‘আমরা এক সচেতন প্রয়াস‘ এর রিপোর্ট বলছে, দাঙ্গার সলতে পাকানো শুরু ২০১৪ সাল থেকে। হঠাৎই নৈহাটি অঞ্চলে বজরঙ্গ দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, দুর্গা বাহিনী‘র মতো সংগঠন সক্রিয় হয়ে ওঠে। পাশাপাশি, সকালে গঙ্গার তীরে তলোয়ার চালানোর প্রশিক্ষণ, আরএসএস–এর প্রশিক্ষণ শিবিরের কার্যকলাপ বাড়তে থাকে। ক্রমে ক্রমে যে কোনো ধর্মীয় উৎসবই ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে। এলাকায় চিরাচরিত রামনবমী উৎসবে যেমন অস্ত্রের ঝনঝনানি শুরু হয় তেমনই মহরমের মিছিলেও অস্ত্র ও লোকবলের দাপট দেখা যেতে শুরু করে। এই ২০১৪ সালেই স্থানীয় গায়ত্রী পরিবারের পক্ষ থেকে হঠাৎ গায়ত্রী পুজোর আয়োজন করা হয়। দীর্ঘ কয়েক দশকের রীতি ভেঙে গায়ত্রী পুজোর মিছিল হাজিনগরের চশমাবাবার মাজারের সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা ছিল বলে লোকবিশ্বাস। তাঁর সম্মানে মাজার বানিয়ে দিয়েছিলেন বাবাভক্ত ব্যবসায়ী হিরালাল সাউ। মাজারকে কেন্দ্র করে হিন্দু–মুসলমানের মধ্যে চুক্তি হয় যে, এই মাজারের সামনে দিয়ে যেমন কোনো বিসর্জনের মিছিল যাবে না তেমনই মাজার সংলগ্ন এলাকায় বড়ো রাস্তা ও প্রকাশ্য স্থানে কোনো গরুর মাংসের দোকান থাকবে না। দীর্ঘকালের পারস্পরিক বিশ্বাসের উপর ভিত্তির উপর স্থাপিত এই মৌখিক চুক্তি হিন্দুত্ববাদীদের প্ররোচনায় প্রথম ভাঙল গায়ত্রী পরিবার। চিড় ধরল পারস্পরিক বিশ্বাসে। এই ঘটনাচক্র ভাটপাড়াতেও দীর্ঘকাল ঘটে চলেছে। তা না হলে অর্জুন সিং–কে রামনবমীর মিছিলের উদ্যোগ নিতে হয় না।
দাঙ্গার অর্থনীতি
দ্বিতীয় কারণ অর্থনৈতিক। রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকলে অর্থনৈতিক ক্ষমতাও করায়ত্ত হয় এ কথা ঠিক। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত দাঙ্গারও এক অর্থনৈতিক দিক থাকে। এবং তা হল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শ্রেণি, বর্ণ ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষদের জমি, বসতি, ব্যবসা থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে উচ্চশ্রেণি, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। ভাটপাড়ায় রাজনৈতিক জমি দখলের তৃণমূল বনাম বিজেপি‘র দাঙ্গা মুসলমান বিরোধী দাঙ্গায় রূপান্তরিত হওয়ার পিছনে এই অর্থনীতি এক বড়ো ভূমিকা পালন করেছে। অন্তত, মিশ্র অঞ্চলে মুসলমান ব্যবসায়ীদের উপর বাধাহীন এক তরফা আক্রমণ, বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে মুসলমান বস্তি উচ্ছেদ এবং মুসলমান নাগরিকদের ঘরছাড়া করার হিংস্র প্রচেষ্টা সে কথাই প্রমাণ করে। একাধিক স্বাধীন গ্রাউন্ড রিপোর্ট এবং হিংসাশ্রয়ী ঘটনার ডিজাইন, ভুক্তভোগীদের বয়ান, আক্রান্ত কোণঠাসা সম্প্রদায়ের শান্তি প্রতিষ্ঠার আকুল আবেদন ফিরিয়ে দেওয়ার পিছনে এই কথা প্রমাণ করে। মুসলমানরা তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন কিংবা ভোটের দিন, আশু পরবর্তী সময়ে এবং আরও পরবর্তী সময়ে ব্যারাকপুর লোকসভা দখলে রাখার জন্য অর্জুন সিং এবং বিজেপি কর্মী–সমর্থকদের উপর তৃণমূলের আক্রমণ, ভাটপাড়া বিধানসভা রক্ষার জন্য মদন মিত্রের নেতৃত্বে জনৈক সমাজবিরোধী আনোয়ার বাহিনীর সহায়তায় এলাকা দখলের অপচেষ্টাই ভাটপাড়ার মুসলমান বিরোধী দাঙ্গার এক ও একমাত্র কারণ নয়। ভাটপাড়া অঞ্চলে বিজেপি‘র আক্রমণের শিকার হয়েছেন তৃণমূলের বাঙালি, অবাঙালি সমর্থকরাও। ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে তাদের অনেকেই ঘরছাড়া হয়েছেন কিন্তু তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের হিংস্র দলীয় রাজনীতির মিল রয়েছে। যা, এ রাজ্যের রাজনীতির চিরাচরিত পরাম্পরা। ভাটপাড়ায় তা বিশেষ ভাবে জাতিকেন্দ্রিক কি না তা পরীক্ষা সাপেক্ষ। কিন্তু তৃণমূলের বাঙালি হিন্দু সমর্থকদের উপর আক্রমণ অবশ্যই অর্থনৈতিক জমি দখল, একচেটিয়া ব্যবসা, প্রোমোটারির লক্ষ্যে চালিত নয়।
১৯ মে লোকসভা ভোটের দিন ভাটপাড়ায় যুযুধান দু‘দলই এলাকা দখলে মরিয়া হয়ে ওঠে। তুঙ্গে ওঠে অশান্তি। এরই মধ্যে সংখ্যালঘু অঞ্চলে মুখে কাপড় বাঁধা সমাজবিরোধীরা মুসলমানদের এলাকা ছাড়া করার হুমকি দেয়। ভয় দেখাতে যথেচ্ছ বোমাও ছোঁড়া হয় বলে অভিযোগ। মুসলমানরা বিজেপি–কে ভোট দেবে না এই আশঙ্কায় এমন হুমকি দেওয়া হতে পারে। ভোট–প্রচারে প্রার্থী অর্জুন সিং–এর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে তিনি বলেছেন, কুড়ি শতাংশ ভোটের কোনও প্রয়োজন নেই। ঈঙ্গিত স্পষ্টত মুসলমানদের দিকেই। ২৩ তারিখ ভোটের ফল বিজেপি‘র অনুকূলে যেতেই ব্যাপক সংখ্যালঘু বিরোধী লুঠতরাজ শুরু হয়। স্থানীয় মানুষেরা জানান, ২৪ মে সকাল এগারোটা নাগাদ বারুইপাড়া অঞ্চলে প্রায় শ‘খানেক লোক মুসলমানদের পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য শাসাতে থাকে। এর পর থেকে নিয়মিত ভাবে হুমকি, ভয় দেখানো, মুড়ি–মুড়কির মতো বোমা ছোঁড়ার ঘটনা চলতেই থাকে। যার জেরে ১০ জুন মহম্মদ হালিম ও মহম্মদ মুস্তাক বোমার আঘাতে মারা যান। স্থানীয় বাসিন্দা ও ওয়াকিবহালের মতে, এলাকাটি ইতিমধ্যেই নির্মাণ ব্যবসায়ী ও প্রোমোটারদের নেকনজরে পড়েছে। ফ্ল্যাটবাড়ি নির্মাণও শুরু হয়েছে। যেহেতু ভাটপাড়া পুরসভা তৃণমূলের দখলে ছিল, তাই প্রোমোটাররা মূলত তাদেরই অনুগত। অর্জুন সিংয়ের দলবদল, পুরসভায় অনাস্থা, নির্বাচন ইত্যাদি কারণে নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। প্রধান বাস রাস্তা, ফেরিঘাট, বড় শহরের সঙ্গে সুগম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণেই প্রমোটার ও ব্যবসায়ীদের কাছে এই অঞ্চলটি নির্মাণ ব্যবসার জন্য উপযুক্ত। দাঙ্গা ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করে মুসলমান বসতিগুলি তুলে দেওয়া গেলে তাদের পোয়াবারো। আর ২৩ মে‘র পর শুধু ব্যারাকপুর লোকসভা নয়, ভাটপাড়া বিধানসভাও বিজেপি দখল করে। পরবর্তীতে পুরসভাতেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিজেপি। লোকসভা, বিধানসভা ও পুরসভা তিনটিই বর্তমানে একরকম অর্জুন সিংয়ের পরিবারের কবজায়।
বারুইপাড়া, টিনা গোডাউন, রুস্তম গুমটি ছাড়াও মিশ্র অঞ্চলগুলিতেও বেছে বেছে মুসলিম ব্যবসায়ীদের আক্রমণ, দোকান দখলের মধ্যে একই পরিকল্পনা রয়েছে। আক্রমণের নির্দিষ্ট আঞ্চলিক ব্যাপকতা প্রত্যক্ষ করে এমনও কথা অনেকে বলছেন যে, এ যেন রুস্তম গুমটি থেকে নয়াবাজার — যে অঞ্চলে মুসলিমদের অপেক্ষাকৃত ঘন বসবাস — এই সামগ্রিক এলাকা থেকেই তাদের উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা। আশঙ্কা সত্যি হলে এও এক সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও সমাজতাত্ত্বিকদের মতে, গুজরাতের পর রাষ্ট্রীয় মদতে গণহত্যা সংগঠিত হচ্ছে না। যা হচ্ছে তা হল নিয়ন্ত্রিত ও ধারাবাহিক দাঙ্গার মধ্য দিয়ে মুসলিমদের আর্থিকভাবে পঙ্গু এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে একঘরে করে দেওয়া। আরও বেশি করে ঘেঁটো বন্দি করা। এখন সঙ্ঘী ডিজাইন। ভাটপাড়া তা প্রত্যক্ষ করল।
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ সন্দীপ সিনহা রায়, সুজাত ভদ্র ও দেবাশীষ পাল।
কোয়েল সাহা গনতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের কর্মী ।
ছবি: সন্দ্বীপ সাহা।
Total report in an article.good information and analysis.It should have mentioned what to be taken to stop such type of facts in future.