পাথর ভাঙা, মূর্তি বানানো, পাথর ঘষা, সিমেন্ট কারখানা, নির্মাণ শিল্প, পাহাড় কেটে রাস্তা বানানোর মতো কাজে সরকারি হিসাবে সংগঠিত ক্ষেত্রের মোটামুটি এক কোটি ও এছাড়াও হিসাবের বাইরের অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক সংখ্যা যোগ করলে দেশ জুড়ে সিলিকোসিসে আক্রান্ত শ্রমিকের সংখ্যা আনুমানিক তিন থেকে চার কোটিতে পৌঁছবে। সম্প্রতি দেশ জুড়ে সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিকের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার দিকে নজর রেখে কলকাতায় একটি কনভেনশন-এর আয়োজন করা হয়েছিল। লিখছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
মৌত হামারা, অ্যায়শ তুমহারা/নেহি চলেগা নেহি চলেগা
হর হাথ কো কাম মিলে/ কাম সে হমে জান মিলে
সম্প্রতি দেশ জুড়ে সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিকের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার দিকে নজর রেখে কলকাতায় সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটি, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ ও আরও অনেকগুলি রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক সংগঠনের এক যৌথ মঞ্চ একটি কনভেনশন-এর আয়োজন করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েক জন আক্রান্ত শ্রমিক, তাদের পরিবার, নিহত শ্রমিকদের পরিবার-প্রতিবেশীরা তো ছিলেনই, এসেছিলেন মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের সমাজকর্মীরাও। সেই কনভেনশন-এই এই সমবেত শ্লোগান-এ শোনা গেল মৃত্যুকে রুখে দেওয়ার আন্দোলনের স্বর।
মধ্যপ্রদেশের আন্দোলনকর্মী অমূল্য নিধি যেমন জানালেন কীভাবে একজন সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিকের মৃত্যুর পর তার ফুসফুসটি আগুনে জ্বলেনি, যা চিরে দেখা যায় তা সাদা পাউডারের মতো পদার্থে ভর্তি। তাছাড়া রয়েছে চিকিৎসকদের অজ্ঞতা বা সরকারী চাপ, যারজন্য সিলিকোসিস নয়, অনেক সময়েই চিকিৎসা হয় যক্ষ্মার। তাঁরা লাগাতার আন্দোলন চালাচ্ছেন আক্রান্ত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ, পুর্নবাসন, মৃত শ্রমিকদের স্ত্রীদের বিধবাভাতা, পেনশন ইত্যাদির দাবীতে। আদায় করেছেন অনেকগুলিই। সেখানে সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিকদের পরিবারে এমজিএনআরইজিএ প্রকল্পে দু’শ দিনের কাজের ব্যবস্থা করতে ও মধ্যপ্রদেশ-গুজরাট সীমান্তে ৩৫টি বেআইনি পাথর খাদান বন্ধ করতে সমর্থ হয়েছেন তাঁরা।
রাজস্থানের মজদুর কিষান শক্তি সংগঠনের প্রতিনিধি জানালেন সিলিকোসিস কাদের কীভাবে হতে পারে সেই নির্ণয়ের কাজ সারা দেশে কিছুটা এগোলেও পশ্চিমবঙ্গে কিছুই এগোয়নি। এই নির্ণয়ে এক ধরনের ট্র্যাকিং পদ্ধতির কথাও বলেন তিনি। উল্লেখ করেন রাজস্থানে আসন্ন সিলিকোসিস পলিসি-র কথাও।
পশ্চিমবঙ্গের যে শ্রমিকেরা এসেছিলেন তাঁদের থেকে যে তথ্য পাওয়া গেল তা চমকে দেওয়ার মতো। অধিকাংশ শ্রমিকই যখন কোনও সরকারি হাসপাতালে সিলিকোসিস-এর চিকিৎসার জন্য যান, তখন তাঁদের প্রেসক্রিপশন-এ সঠিক রোগের নাম লেখা হয় না। বলা হয় যক্ষ্মা হয়েছে। যদি কেউ বলেন আসল রোগের নাম লিখতে স্পষ্টই তাঁদের বলে দেওয়া হয় যেহেতু তাঁরা সরকারের বিরূদ্ধে কেস করেছেন, আন্দোলন চালাচ্ছেন তাই তাঁদের উপর চাপ আছে সিলিকোসিস-এর নাম প্রেসক্রিপশন-এ না লিখতে, তাঁরা কোনওভাবেই সিলিকোসিস লিখবেন না! এটাই এই শ্রমিকদের জীবনের বাস্তব।
পশ্চিমবঙ্গের মিনাখাঁ-র সিলিকোসিস আক্রান্ত তরুণ শ্রমিক যখন হার না মানা জেদ নিয়ে লড়ে যাওয়ার কথা বলেও বলেন বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারাটাই তার এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চাওয়া তখন ঘরভর্তি মানুষের জেদ চুঁইয়ে পড়ে ‘সাডা হক ইত্থে রখ্’ শ্লোগানে।
সিলিকোসিস রোগটি কী, কীভাবে ছড়ায় তা নিয়ে ইতিপূর্বে গ্রাউন্ডজিরো-তে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। আরও একবার মনে করিয়ে দেওয়া যে এটি এক ধরনের পেশাগত রোগ, যা সিলিকার গুঁড়ো উড়ে নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে চলে যায়, এমন শিল্পক্ষেত্রে কাজ করা শ্রমিকদের হয়। এরফলে শ্রমিকদের ফুসফুস সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যায় ও এক বুক নিঃশ্বাসের জন্য কাতর হয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যু ছাড়া আর কোনও গতি থাকে না তাদের। গত দশ বছরেরও কম সময়ে পশ্চিমবঙ্গের শুধুমাত্র উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণায় ৪৭ জন তরুণ শ্রমিক মারা গেছেন।
পাথর ভাঙা, মূর্তি বানানো, পাথর ঘষা, সিমেন্ট কারখানা, নির্মাণ শিল্প, পাহাড় কেটে রাস্তা বানানোর মতো কাজে সরকারি হিসাবে সংগঠিত ক্ষেত্রের মোটামুটি এক কোটি ও এছাড়াও হিসাবের বাইরের অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক সংখ্যা যোগ করলে দেশ জুড়ে মোটামুটি তা আনুমানিক তিন থেকে চার কোটিতে পৌঁছবে।
এই কনভেনশন থেকে সরকারের কাছে যে দাবীগুলি উঠে আসে –
১) বেআইনিভাবে চলতে থাকা সমস্ত স্টোন ক্রাশার ও খাদানগুলিকে এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে।
২) এই সমস্ত বেআইনি কারখানার মালিকদের ও তাদের মদত দিয়ে চলা সমস্ত প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কঠোরতম শাস্তির বন্দোবস্ত করতে হবে। ভবিষ্যতেও যাতে এই রকমের শ্রমিক খুনের কারখানা জন্মাতে না পারে তা স্থায়ীভাবে সুনিশ্চিত করতে হবে।
৩) পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের সমস্ত সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিকদের তালিকা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নথিভুক্ত করতে হবে।
৪) যত রকম শিল্পক্ষেত্র থেকে শ্রমিকেরা এই মারণরোগের শিকার হন তাদের প্রত্যেকটিকে চিহ্নিত করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
৫) মাননীয় সুপ্রীম কোর্ট ও কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী অবিলম্বে ‘হরিয়ানা মডেল’ অনুযায়ী আক্রান্ত ও নিহত শ্রমিকদের জন্য – (ক) ক্ষতিপূরণ, (খ) পুনর্বাসন, (গ) পেনশন, (ঘ) চিকিৎসা, (ঙ) পরিবারের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও খাদ্য সুরক্ষার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।
৬) এই শ্রমিকদের ই.এস.আই, পি এফ এ-এর আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অসংগঠিত ও ঠিকা শ্রমিকদের ন্যূনতম সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
৭) ক্রাশার ও খাদানের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলিকে বিপজ্জনক হিসাবে চিহ্নিত করতে হবে এবং বিজ্ঞানসম্মতভাবে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৮) এই বেআইনি বন্দোবস্তের সঙ্গে ক্ষমতার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকার কারণে বিষয়টির দেখাশোনার জন্য একটি নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করতে হবে যার সর্বোচ্চ পদে থাকবেন কোনো আইনজ্ঞ। সদস্য হিসাবে বিজ্ঞানী, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী, পরিবেশবিদ, আক্রান্তদের প্রতিনিধি, সমাজকর্মী এবং সরকারের তরফে কোনও প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী এই কমিটিতে থাকতে পারেন।
৯) চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষাক্রমে রোগ ও তার সমাধানের উপর পাঠক্রম চালু করতে হবে।
১০) পেশাগত রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য সরকারী হাসপাতালে নির্দিষ্ট ওয়ার্ড, বেড ও আউটডোরে বিশেষ সুবিধার বন্দোবস্ত করতে হবে।