তথ্যের অধিকার আইনে (রাইট টু ইনফর্মেশন অ্যাক্ট) বদল আনতে চলেছে মোদী সরকার, যে বদলের ফলে তথ্য কমিশনগুলির টিকি বাঁধা পড়তে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। লিখছেন অস্মিতা বসু।
গত ১৯ তারিখ লোকসভায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং তথ্যের অধিকার আইনের বদলের জন্য একটি বিল আনেন। লোকসভায় হুলুস্থুলু হয়, অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমীন দলের সাংসদ আসাদুদ্দিন ওয়াইসি এই বিলটিকে সংবিধানের ওপর আক্রমণ বলে সমালোচনা করেন। কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর বিলটিকে বলেন ‘তথ্য আইন খতম করার বিল’, এই হইচইয়ের মধ্যে ২২৪ জন এমপি বিলটি পেশ হওয়ার পক্ষে এবং ৯ জন বিপক্ষে ভোট দেন ও বিলটি পেশ হয়।
কী আছে বিলে? তথ্যের অধিকার আইন, ২০১৫ অনুসারে, একজন তথ্য কমিশনারের বয়স হতে পারত সর্বাধিক ৬৫ বছর, চাকরির মেয়াদ ছিল সর্বোচ্চ পাঁচ বছর, ও বেতন ছিল সমপদের নির্বাচন কমিশনারের সমান। পাঁচ বছরের মেয়াদ ফুরোলে তথ্য কমিশনারকে চাকরি ছাড়তে হবে, এবং তিনি আর কোনোদিন ওই চাকরিতে ফিরতে পারবেন না। এমনটা কেন করা হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়, বেশি দিন চাকরিতে থাকলে চাকরি টিকিয়ে রাখা বা অতিরিক্ত সুবিধের জন্য একজন কমিশনার যাতে দুর্নীতিগ্রস্ত না হয়ে পড়েন। ২০০৫ সালে গৃহীত এই তথ্যের অধিকার আইন রচনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বেশ কিছু সমাজকর্মী, যাঁদের মধ্যে আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ অন্যতম। নতুন বিলে এই নিয়ম তুলে দেওয়া হয়েছে, বদলে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যে কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করে দেবে তথ্য কমিশনের চাকরি কতদিন থাকবে, মাইনে ইত্যাদি কেমন হবে, চাকরির কী কী শর্ত হবে। ফলত, কেন্দ্রীয় সরকারের বদান্যতার ওপর নির্ভর করবে কমিশনারের চাকরি, মাইনে ও অন্যান্য সুবিধা পাওয়া বা না পাওয়া। তার ফল কী হতে পারে, বুঝতে কষ্ট হয় না।
তথ্যের অধিকার আইন বলবৎ হওয়ার পর থেকে তথ্য চেয়ে জমা পড়েছে বহু আবেদনপত্র। এই আইন অনুসারে তথ্যের আবেদন করতে লাগে ১০ টাকা, স্বল্পমূল্যে তথ্য পাওয়া যায়, আবেদন করার ৩০ দিনের মধ্যে তথ্য জানাতে বা তথ্য কেন দিতে অপারগ তা জানাতে বাধ্য কমিশন। এসত্ত্বেও বছরের পর বছর কেটে গেলেও আবেদনপত্রের উত্তর আসে না, উত্তর না দেওয়ার জন্য আইনে বলা শাস্তিও হয় না। তবুও, গণতন্ত্র উদ্ধারের লড়াইয়ে এই আইনের অবদান অনস্বীকার্য। এই আইনের বলে বহু দুর্নীতি-অপকর্ম-অবহেলার তথ্য সামনে এসেছে, গণতন্ত্র শক্তি পেয়েছে, ভয় পেয়েছে গণশত্রুরা। এর ফলে প্রভাবশালীদের রোষের শিকার হয়েছেন তথ্য অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা। আইনত তথ্য জানার আবেদন করায় খুন হয়েছেন অন্তত ৬৭ জন, মারধোর-হুমকি-হেনস্থা ভোগ করেছেন আরও বহু।
এনডিটিভির ওয়েবসাইট জানাচ্ছে, বিল পেশ হবে কি হবে না তার ওপর ভোটাভুটির সময়ে আসাদুদ্দিন ওয়াইসি দাবি করেন, ‘ডিভিশন’ হোক, অর্থাৎ কোন এমপি বিল পেশের পক্ষে ভোট দিচ্ছেন, আর কে বিপক্ষে, সেটাও নথিভুক্ত করা হোক। লোকসভায় কোনও মোশন গৃহীত হবে কি না সেটা সাধারণত ‘ভয়েস ভোট’ দিয়ে নির্ধারিত হয়, অর্থাৎ একবার যাঁরা মোশনের পক্ষে তাঁরা তারস্বরে ‘আয়’ অর্থাৎ হ্যাঁ বলে চ্যাঁচান, আর একবার যাঁরা বিপক্ষে তাঁরা একসাথে ‘নে’ অর্থাৎ না বলে চ্যাঁচান, যে চ্যাঁচানির জোর বেশি বলে লোকসভার স্পিকার মনে করেন সেই চ্যাঁচানির সিদ্ধান্তই গৃহীত হয়। হাস্যকর শুনতে লাগলেও এটাই সত্যি। এতে কতজন বা কোন সাংসদ কী সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছেন, তা আলাদা করে নথিভুক্ত হয় না। ‘ভয়েস ভোট’-এর বিকল্প হচ্ছে ‘ডিভিশন’। ওয়াইসি ‘ডিভিশন’ চাওয়ার পর, এনডিটিভির রিপোর্ট অনুসারে, কংগ্রেস ও তৃণমূল সাংসদরা ভোট না দিয়ে বেরিয়ে যান। কার কোন উপকারটি সাধিত করতে তাঁরা ওয়াক আউট করলেন, তা তাঁরাই জানেন।
২২ তারিখ, অর্থাৎ সোমবার এই প্রস্তাবিত বদল নিয়ে লোকসভায় আলোচনা হবে। এই বদলের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা জরুরি। আমাদের দেশে আইনের বদল বা সাধারণভাবে প্রশাসনিক বিষয় নিয়ে আলোচনায় সাধারণ মানুষকে যুক্ত করার কোনই চেষ্টা থাকে না সরকারপক্ষের, এমনকী প্রথাগত স্কুলের শিক্ষাতেও প্রশাসন কীভাবে চলে, কোনও ভারতীয় নাগরিকের কী কী অধিকার তা শেখানো হয় না। রোজগার ও চিকিৎসার ন্যূনতম নিরাপত্তা জোটানোর কঠিন লড়াইতেই শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন বহু, বহু মানুষ। তারও ওপরে রয়েছে অন্যান্য নানা বাধা। আর্থসামাজিকভাবে বঞ্চিত মানুষ সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে গেলে ‘এগুলো আবার কোত্থেকে চলে এল’ মার্কা ব্যবহার পান, অফিসারের স্বেচ্ছাচারী তড়পানি শুনতে হয়। অধিকাংশ সরকারি নথিপত্র আঞ্চলিক সহজবোধ্য ভাষায় না থাকার ফলে অন্যের দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করতে হয় অনেককেই।প্রশাসনের সাথে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক অনেকটাই রাজা-প্রজার মতো, যেখানে প্রজাকে হীন হয়ে থাকতে হয়। এর মধ্যে, উপরোক্ত সীমাবদ্ধতাগুলি সত্ত্বেও প্রজার ক্ষমতায়নে একটু হলেও সাহায্য করেছে এই তথ্যের অধিকার আইন। এই আইনের প্রস্তাবিত বদলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এসেছে তথ্যের অধিকারের লড়াইয়ের সাথে যুক্ত নানা মানুষের থেকে, এক প্রাক্তন মুখ্য তথ্য কমিশনারের থেকেও। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার, রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ এবং সেই প্রতিবাদের ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া, এই প্রস্তাবিত বদলের বিরুদ্ধে নানা জায়গায় লিখিত বা মৌখিক বক্তব্য রাখা, আলোচনা করা, নিজের এলাকার সাংসদকে ফোন করে এই বদলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে বলা ইত্যাদি নানা প্রস্তাব এসেছে বিভিন্ন গণআন্দোলনের কর্মীদের কাছ থেকে। অধিকাংশ সাংসদ এতদিন যা ভূমিকা পালন করেছেন, তাতে তাঁদের সদিচ্ছার ওপর ভরসা রেখে হাত তুলে বসে থাকা আত্মহত্যার শামিল। একমাত্র জনতার চাপেই তথ্যের অধিকার আইন মোদী সরকারের হাত থেকে বাঁচতে পারে।