ফ্যাসিবাদ একটা প্রবল সংগঠিত রাজনৈতিক শ্রেণিশক্তি। শ্রেণির রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট শক্তি। শ্রেণির মতাদর্শ রাজনীতি অর্থনীতি সংস্কৃতির সমস্ত কক্ষে প্রযোজিত কর্মসূচি নিয়ে সম্মিলিত একটি শক্তি। এই শক্তিকে লোকচক্ষু থেকে আড়াল করা যায় না। লিখছেন অশোক মুখোপাধ্যায়।
[১]
ফ্যাসিবাদ কি তবে এসেই গেল?
এই প্রশ্নটা এখন অনেক চিন্তাশীল মানুষের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশেষ করে যারা বামপন্থী মার্ক্সবাদী চিন্তা এবং কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত তাঁদের অনেকের মধ্যে। বিজেপি যে পরিমাণ গরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে এল নতুন লোকসভায়, তাতে ওদের পক্ষে এখন যা ইচ্ছে তাই করা সম্ভব হবে। দেশের আইন কানুন বলে কিছু আর থাকবে না। গণতান্ত্রিক স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলিকে এবার একে একে সরকারি মন্ত্রীসভার কুক্ষিগত করে ফেলা হবে। তার মধ্যে সিএজি, সুপ্রিম কোর্ট,ইউজিসি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক—সবই থাকবে। শ্রমিক ও কৃষকদের উপর আরও শক্তপোক্ত আক্রমণ নেমে আসবে। লাভদায়ক রাষ্ট্রীয় উৎপাদন ক্ষেত্রগুলিকে দেশি বিদেশি কর্পোরেটের হাতে বিনা মূল্যে তুলে দেওয়া হবে। অলাভপ্রদ হলে স্ক্র্যাপ। জমি জল অরণ্য দখল নিয়ে সাধারণ গরিব মানুষদের উচ্ছেদ করে কর্পোরেটদের হাতে বিনিয়োগ বিলাসিতার সাড়ম্বর ঘোষণা হতে থাকবে। তার থেকে নজর সরানোর জন্য দলিত এবং মুসলিমদের উপর নানা অছিলায় আক্রমণ আরও বাড়বে। নাগরিকত্ব নিয়ে পূর্বাঞ্চলে ছোবল আসতে থাকবে। আবার সেদিক থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে দিতে রামায়ণ মহাভারত থেকে আরও আবিষ্কারের ফোয়ারা উঠতে শুরু করবে। হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান ত্রি-হ-ফলা যুক্ত হিন্দু রাষ্ট্রের দ্রিমি-দ্রিমি আওয়াজ আরও জোরালো হয়ে বাজবে। ইত্যাদি।
যদি এইগুলোকে ফ্যাসিবাদের আগমন চিহ্ন হিসাবে ধরা যায়, তাহলে অবশ্যই সে আসছে। বেশ বুক চাপড়ে ডুগডুগি বাজিয়ে। রাম নাম “ফ্যাস” হ্যায় করতে করতে।
ফ্যাসিবাদ একটা প্রবল সংগঠিত রাজনৈতিক শ্রেণিশক্তি। শ্রেণির রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট শক্তি। শ্রেণির মতাদর্শ রাজনীতি অর্থনীতি সংস্কৃতির সমস্ত কক্ষে প্রযোজিত কর্মসূচি নিয়ে সম্মিলিত একটি শক্তি। এই শক্তিকে লোকচক্ষু থেকে আড়াল করা যায় না। কেন না যখন সে উত্থিত হয়, আসে এক প্রবল দাপট নিয়ে। দেশ দেশবাসী ও সমাজমানসের—যুক্তিবাদ, শুভাশুভবোধ, মুক্তবুদ্ধি, চিন্তাবৃত্তি, চিত্তবৃত্তি, দায়বদ্ধতা, নৈতিকতা—সমস্ত মঞ্চকে সে দখল নিতে আসে। ধনতন্ত্রের সঙ্কটের ফলে উত্থিত সমাজ বিপ্লবের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করতে। মার্ক্সবাদী বিচারে সমাজ বিশ্লেষণে যে শ্রেণিগত বিচারকেই সমস্যার স্বরূপ উদ্ঘাটনের চাবি হিসাবে ভাবা হয়, সেদিক থেকে ভেবে দেখলে অন্য রকম সিদ্ধান্তে যাওয়ার রাস্তা নেই। ফ্যাসিবাদ বার্ধক্যে জর্জরিত বুর্জোয়াদের একটা আবশ্যিক শ্রেণি কর্মসূচি। সেই কর্মসূচিতে আছে অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, মতাদর্শ, মনস্তত্ত্ব, এবং সর্বোপরি, একটা দীর্ঘমেয়াদি ধাপক্রমিক পরিকল্পনা।
কিন্তু সমস্যা হল, ফ্যাসিবাদকে আমাদের দেশের বর্তমান ফ্যাসিবিরোধীরা প্রায় সকলেই চিহ্নিত করে চলেছেন—না, শ্রেণির ভিত্তিতে নয়—একটি দলের ব্র্যান্ডে। দলটি যে ফাসিস্ত তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু শুধু সেই দলটার মধ্যেই ফাসিস্ত তাকত আশ্রয় নিয়ে বসে আছে, তার বাইরে বাকি সকলেই প্রতিফাসি শক্তি, সেই দলকে ভোটে হারিয়ে দিতে পারলেই ফ্যাসিবাদ পরাস্ত হবে—এই সরলীকরণ এক মারাত্মক রাজনৈতিক মরীচিকা।
জার্মানি ইতালির ইতিহাস আজ সকলেরই জানা। ফাসিস্ত দল সেখানেও ছিল। নানা কায়দাকানুন করে, মানুষকে বিভ্রান্ত করে, ভোটে জিতেই তারা প্রথমে সরকারে আসে। কিন্তু দল সরকার প্রশাসন সেনাবাহিনী গেস্টাপো বাদামি জামা—সব মিলিয়ে এক দুর্বৃত্ত মাফিয়া রাষ্ট্র হিসাবেই ফ্যাসিবাদ দেখা দেয়। এক দুর্দ্ধর্ষ সামরিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়ে সেই দুই ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র প্রথমে গোটা ইউরোপ প্রায় দখলে নিয়ে ফেলেছিল, তার পরে হাত বাড়িয়েছিল আফ্রিকার দিকে। জাপানকে দিয়েছিল এশিয়া লুটের দায়িত্ব ও ভাগ। জার্মানি ইতালি জাপান যুদ্ধে পরাস্ত হয়েছিল। ফ্যাসিবাদ হারেনি। জয়ী রাষ্ট্রগুলির নিশানের নীচে চলে গিয়েছিল কিছু কাল মুখ লুকিয়ে থাকার জন্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসিবাদ চলে গেল আমেরিকায়। রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান প্রবর্তিত এক কালা নির্দেশের ভিত্তিতে জনৈক সেনেটর জোসেফ ম্যাক্আর্থি প্রায় হিটলারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কমিউনিস্ট এবং গণতান্ত্রিক দল ও ব্যক্তিবর্গের উপর ব্যাপক হামলা চালিয়েছিল। প্রায় এক দশক ধরে। হাওয়ার্ড ফাস্টের দুটো সমকালীন উপন্যাসে (পিকস্কিল ইউএসএ-১৯৫১ এবং সাইলাস টিম্বারম্যান-১৯৫৫), স্টিভ নেলসনের সমসাময়িক দুটি উপন্যাসে (ভলান্টিয়ার্স-১৯৫৩ ও ত্রয়োদশ জুরি-১৯৫৫), সেই সন্ত্রাসের দলিল সুন্দর ভাবে চিত্রিত আছে। ফ্যাসিবাদের কয়েকটি লক্ষণ—একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে রাষ্ট্রের নগ্ন সংলগ্নতা, সমস্ত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংশাসিত প্রতিষ্ঠানের উপর সরকারি খবরদারি, গণতান্ত্রিক অধিকার সংকোচন, বহুদলের পরিবর্তে দুই বা তিন দলের শাসন, ধর্ম, চর্ম, জাতি, বা দেশের নামে চিন্তাগত উগ্রতা, শ্রমিক চাষি ছাত্রযুব নারী আন্দোলনের পরিধি সংকুচিত করা, ইত্যাদি—আমেরিকা ইংল্যান্ড ফ্রান্স জাপান ভারত ও অন্যান্য দেশে একে একে নানা মাত্রায় ফুটে উঠতে থাকে। এইসময়ই আমেরিকা মার্শালপ্ল্যান এনে ইউরোপে জবরদস্তি অর্থনীতি রাজনীতি ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে শুরু করে। বিভিন্ন দেশে দক্ষিণপন্থী দল ও শক্তিকে, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী সংগঠনকে মদত দিতে থাকে। অন্য দিকে, ইন্দোনেশিয়া চিলি সহ বহু দেশেই সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ভয়াবহতম গণহত্যা চালিয়ে বিপ্লবী আন্দোলনের বিকাশকে রুদ্ধ করেছে। এইভাবে ফাসিস্ত রাজনীতি দেশে দেশে কখনও প্রকাশ্যে কখনও বা মুখ লুকিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
ফ্যাসিবাদ প্রায় সর্বত্রই ভোটে জিতে আসে। অন্তত জেতার ভাণ নিয়ে। কিন্তু ফ্যাসিবাদকে ভোটে হারানো যায় না। অন্তত এযাবত যায়নি। মাঠে ময়দানে লড়াই করে তাকে পরাস্ত করতে হয়েছে—যেখানে করা গেছে।
আমাদের দেশেও সমস্ত দ্রুপদী লক্ষণ সহ ফ্যাসিবাদের বিপদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। অনেক দিন ধরেই। ইদানীং অর্থনীতি রাজনীতি সমাজ সংস্কৃতি—সর্ব ক্ষেত্রে তার আগ্রাসন ভয়াবহ আকারে ফেটে পড়ছে। একচেটিয়া কর্পোরেট স্বার্থের সঙ্গে রাষ্ট্রের বেলাগাম মাখামাখি, সমস্ত গণতান্ত্রিক স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের উপর সরকারি ও শাসক দলের হস্তধৃত লাগাম, প্রায় সমস্ত গণ মাধ্যমকে কিনে বা ভয় দেখিয়ে এইচএমভি-তে পর্যবসিত করা, বিচার ব্যবস্থা ও সেনাবাহিনীর উপরেও প্রভাব বিস্তার, ভাষা ধর্ম সংস্কৃতির প্রশ্নে বৈচিত্র্যকে ধূলুণ্ঠিত করে এক রঙা শ্লোগানে মানুষকে উন্মত্ত করে তোলা, মেকি দেশপ্রেমের নামে সমস্ত সমালোচনার কণ্ঠরোধ করা—লক্ষ করলেই এই সব লক্ষণ চোখে পরিষ্কার ধরা পড়বে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নাগরিকতা প্রমাণের এক অসম্ভব দায় চাপিয়ে চার পাঁচটি পূর্বপ্রান্তীয় রাজ্যের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার হুমকি!
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হলে শুধু এ-দল ও-দল নয়, এই সব লক্ষণের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে।
[২]
হ্যাঁ, মোটা দাগের ফ্যাসিবাদ আরও মুখব্যাদান করে আসছে। তাকে সামলানোর কথা এখন থেকে ভাবতে হবে বৈকি। আর এই ভাবতে গেলেই শুধু মোটা দাগ নিয়ে মাথা ঘামালে হবে না। সূক্ষ্ম স্পর্শগুলি নিয়েও এক আধটু ভাবনাচিন্তা করতে হবে বৈকি। ভাবতে হবে, বিজেপি এই জায়গায় আসতে পারল কীভাবে।
লক্ষ করলে দেখা যাবে, বিজেপি যা যা বলেছে এবং করেছে, প্রায় কোনোটাই গুণগতভাবে নতুন নয়। পুরনো অ্যাজেন্ডা। হ্যাঁ, পরিমাণগতভাবে নতুন। ব্যাপক। মাত্রায়, দ্রুততায়, আওয়াজে। কিন্তু একটা তৈরি জমি সে পেয়ে গেছে। ফুটবলের ভাষায় বেশ কয়েকটা ডিফেন্স চেরা ক্রস। অনেক কাল ধরে পুনরাবৃত্তিক্রমে বানানো। পাশগুলো যে বাড়িয়েছে, এখন তাকে যদি বলেন, তুমি গোল দেওয়াটা ঠেকাও, সে কি পারবে? সে কি করতেও চাইবে?
বিজেপি-কে ঠেকাতে যারা কংগ্রেসের হাত ধরেছিল, তাদের হচ্ছে সেই বুদ্ধি।
একেবারে হুবহু।
ব্যাঙ্ক লুট, পাকিস্তান, কাশ্মীর, সন্ত্রাস, সরকারি ক্ষেত্র বিক্রি, (দেশি-বিদেশি) পুঁজির প্রতি উদার নীতি, জনকল্যাণ কর্মসূচি বর্জন, পরমাণু শক্তির নামে বোমা কার্যক্রম, গণতন্ত্র বিরোধী আইন, শ্রমিক বিরোধী আইন, কৃষক বিরোধী নীতি, মন্দির কূট, গোরক্ষা, গোমাংস ভোজন নিষেধাজ্ঞা, দাঙ্গা—একটাও কাজ বিজেপি প্রথম করছে না। সেই ১৯৪৭ সাল থেকে চলে আসছে। প্রাক-সেকুলার থেকে সেকুলার সংবিধানের আওতায় থেকেই। কংগ্রেস করে এসেছে। নেহরু ইন্দিরা রাজীব নরসিংহ মনোমোহন প্রমুখর হাতে হাত রেখে। ধীরে সুস্থে, ঠান্ডা মাথায়। শব্দ কম করে। সূক্ষ্মতা সহকারে। তখন যারা চেনেনি, বা চিনতে চায়নি, তারা যে এখনও চিনতে পারবে না—বোঝা যায়। তার হাত ধরে ফ্যাসিবাদের ক্রামান্বয়িক অভিযান ঠেকানোর কথা ভাবা, আর ফ্যাসিবাদকেই বলা, “তুমি ভায়া এখন এস না, আমাদের ভারি অসুবিধা হবে”—একই ব্যাপার!
অর্থাৎ, কংগ্রেসের পক্ষে সত্যিই এই বিজেপি প্রযোজিত ফ্যাসিবাদ রুখতে আগ্রহ থাকতে পারেনা। বিজেপি-র কর্মসূচিগুলো বাই ডিফল্ট সবই কংগ্রেসের। ওরা এত কাল এই কাজগুলো একটু ঘোমটা টেনে রয়ে সয়ে চুপিসারে করছিল, বিজেপি এসে “রাম হনুমান” বলে হল্লাগুল্লা করে সেই সব কাজই দ্রুত সেরে ফেলছে। ওদের আবার তাড়া আছে। কেন্দ্রে রাজ্যে অনেকটা ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে। শ্রেণি প্রভুদের কাছে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এই ক্ষমতা চটজলদি হাতছাড়া না হয়। ফলে, সেই একই প্রভুদের সামনে রাহুল গান্ধীর পক্ষে এমন কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব নয় যে তারা নরেন্দ্র দামোদর মোদীর কাজগুলি বন্ধ করে দেবে। মন্দিরের বদলে চাষিদের স্বার্থ দেখবে। শ্রমিক বিরোধী আইন করবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলি বেচে দেবে না। সংখ্যালঘু ও দলিতদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। গোমাংসকে বারুদ হিসাবে ব্যবহার করবে না! সংবিধানকে বচনে নয়, যথার্থ অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা দান করবে! কাশ্মীর বা উত্তরপূর্বে সেনাবাহিনীর শ্বেত সন্ত্রাসে লাগাম পরাবে। আফস্পা, ইউএপিএ, টাডা প্রত্যাহার করে নিয়ে আইনের আইনি শাসন প্রবর্তন করবে। ইতি + আদি। না, নিজেরই বাপ ঠাকুরমা মহাদাদুর তৈরি ফসলকে দুটো ভোটের সংকীর্ণ স্বার্থে কাদায় ফেলে দেওয়া যায় না! নেহরু-গান্ধী পরিবারের ঐতিহ্য বলে কথা!
তার মানে এ নয় যে কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপি-র কোনো বিরোধ নেই। আছে। তবে সেই বিরোধ কেবল গদিতে বসে কে ফ্যাসিবাদের ভালো করে সেবা শুশ্রূষা করবে, তা নিয়ে। দলগতভাবে। কে করবে তা নিয়ে সমস্যা, কী করবে তা নিয়ে নয়।
অথচ দল হিসাবে সিপিআই(এম) বিজেপি-র “ফ্যাসিবাদ”-কে রুখতে চেয়ে(?) নির্বাচনী প্রক্রিয়ার শুরুতেই কংগ্রেসের হাত ধরতে চেয়েছিল। অনেক দিন ধরেই তাদের দলের রাজনৈতিক লাইন এই দিকেই খেলছে। বিশেষ করে সীতারাম ইয়েচুরি সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকে এই প্রবণতা বেশ শক্তি সঞ্চয় করেছে।
তারা কি উপরের কথাগুলো জানে না? অবশ্যই জানে।
জেনেশুনেও সেই কালো হাত ধরতে চাইছে কেন? নিছক ভোটের স্বার্থে?
খানিকটা তাই। আসলে সিপিআই(এম) দীর্ঘ দিন তিনটে রাজ্যে শাসক শ্রেণির ভূমিকা পালন করে এসে সেও এখন নিজেকে শাসকদেরই পংক্তিভুক্ত বলে মনে করে। দায়িত্বশীল দল। আগেকার সেই ট্রাম পোড়ানো বাস জ্বালানো বহ্নিভোজী স্বপ্নবিলাসী খ-বিহারী দল নয়। শিল্প গড়তে হবে। বাণিজ্য চাই। বেকারদের কাজ দিতে হবে। পুঁজির মসৃন চলাচল দেখভাল করতে হবে। মৌ স্বাক্ষর করার জন্য কর্পোরেট প্রতিনিধিদের সঙ্গে সপ্তনক্ষত্রী আয়াসকক্ষে বসে সভা এবং পান-ভোজনে অংশগ্রহণ করতে হবে। স্বভাবতই এর একটা সৎসঙ্গ দরকার হয়। গ্রুমিং। কংগ্রেস সেই জায়গাটা অনেকটা পূরণ করে দিতে পারে। সরকারি গদিতে আজ না থাকলেও কালকের কথা তাকে মাথায় রাখতে হয়। শিল্পায়ন, উন্নয়ন, বিনিয়োগ বন্ধুত্ব, তিন পয়সার বিজলি দানের চুক্তি, . . .।
তাই যদি হয়, বিজেপি-ই বা নয় কেন? শুধু কংগ্রেসই বা একা কেন?
যথার্থ। বিজেপি-ও গ্রাহ্য। ইতিমধ্যেই। আজ হয়ত গোপনে, আগামী দিনেই প্রকাশ্যে। আজকে শুধু কমলে ভোট হস্তান্তর, আগামী দিনে হয়ত কাস্তে-কমলে চোস্ত দোস্তিই তাদের স্বস্তি দেবে! যেমন গত শতকের শেষ-আশিতে বিজেপি-র সাথেই দোস্তি হয়েছিল। তাতে অসুবিধা তিল মাত্র নেই। তবে গণতন্ত্রে ভোটে নামতে গেলে একটা পক্ষ বিপক্ষ লাগে। একটা সময় কংগ্রেসকে ভয়ানক বিপক্ষ সাজিয়ে বিজেপি মুসলিম লিগ—সবার সাথেই বন্ধুত্ব করেছে সে। আজ আবার টিএমসি আর বিজেপি-কে বিপক্ষ দেখিয়ে কং-সঙ্গ-লালন করছে। যদিও এই মুহূর্তে টিএমসিই তার আসল এবং এক মাত্র বিপক্ষ। তার হাতেই সে ৩৪ বছরের মোগলাই-তখ্ত হারিয়েছে। দু চার বছর পরে টিএমসি যদি সিপিএম-এর মতো বন জঙ্গল জমি জল বিদ্যুৎ খয়রাতি করে কর্পোরেটের, পুরো না হোক, কিছুটাও বায়নানামা পেয়ে যায়, সিপিএম-এর একটুও অসুবিধা হবে না মমতা-মদন-পার্থ-র হাত ধরতে। আজ যেমন সে কংগ্রেসের কালো দিন ভুলে যেতে এবং ভুলিয়ে দিতে চাইছে, তখনও তেমনই সারদা রোজভ্যালি নারদ ছবি বিক্রি নেতা ক্রয় সবই বিস্মৃতির ফোল্ডারে ঢুকে যাবে! “কমরেডস্, এখন পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটলে চলবে না। সামনের দিকে তাকাতে হবে।”
এই ব্যাপারে দীর্ঘ দিন ধরে দুটো শব্দ এই জাতীয় “মার্ক্সবাদী”দের খুব সাহায্য করে আসছে। পরিস্থিতি আর ট্যাক্টিক্স।
[৩]
“কমরেড্স, এই মুহূর্তে আমাদের সামনে যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাকে আপনাদের ভালো করে বুঝে নিতে হবে! মার্ক্সবাদ কোনো আপ্ত বাক্য নয়। দুটো শ্লোগান মুখস্থ করে সারা জীবন তাই আউড়ে গেলে আমাদের চলবে না। পরিস্থিতি বদলাচ্ছে, আমাদের শ্লোগান একই থেকে যাবে—এরকম হয় না!!”—গম্ভীর বজ্রকম্প্র কণ্ঠে কোনো নেতা যদি কর্মীদের সামনে গুছিয়ে খানিকক্ষণ বলতে পারেন, ব্যস, কেল্লা ফতে! “এরকম একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্যে বসে আমরা কোনো বেইমান বিশ্বাসঘাতক দলের সঙ্গে হাত ধরে চলতে পারি না। আমাদের একাই চলতে হবে। জনগণের সামনে এই বার্তাটা আমাদের নিয়ে যেতে হবে।”—এইভাবে যিনি (দলের থিসিসে থাকলেও) বাম গণতান্ত্রিক ঐক্য গড়ে না তুলে একা একা চলার নীতির সপক্ষে ভাষণ দেবেন, কর্মীরা তাঁর কথাও বেদ-জ্ঞানে গ্রহণ ও প্রচার করবে। আবার আর এক দলের নেতা যদি আহ্বান জানান, “আমরা কি চুপ করে বসে থাকতে পারি? আমরা কি নিষ্ক্রিয় হয়ে সরে যাব? না, কমরেড্স, এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে আমাদের আগেকার জাতবিচারের মনোভাব ঝেড়ে ফেলতে হবে। হ্যাঁ, ওরাও আমাদের শত্রু। আমাদের অনেক কর্মীকে ওরা হত্যা করেছে। কিন্তু, বন্ধু, সবার আগে চাই জনগণের ঐক্য, দাঙ্গা নয়, শান্তি। ওরাও শান্তি চাইছে। দাঙ্গার পথ ছেড়ে আসতে চাইছে। তাই, অন্তত কিছু দিনের জন্য হলেও . . .।” এই সব বাক্য শুনেও মানবে না, তর্ক করবে, এমন মগজের পাটা কজনের আছে?
পরিস্থিতির মূল্যায়ন, আর পরিস্থিতির দোহাই—এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য কজন কর্মী মনে রাখতে এবং নেতৃত্বকে মনে করিয়ে দিতে পারে?
ট্যাকটিক্স।
এই আর একটা শব্দ, যার আড়ালে কমিউনিস্ট আন্দোলনে অনেক ভুল অনেক বেশরম কাজ পার পেয়ে যায়। বিজেপি আর কংগ্রেসের মধ্যে দ্বন্দ্ব মানে ভারতের বৃহৎ বুর্জোয়াদের দুটো বড় দলের মধ্যে, অর্থাৎ বুর্জোয়া শিবিরের মধ্যে দ্বন্দ্ব। আসুন, আমরা কৌশলগতভাবে সেই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাই। দুই ষাঁড়ের গুঁতোগুঁতিতে দুই ষাঁড়ই শেষে কাহিল হয়ে পড়বে। ক্ষমতাসীন দলকে দুর্বল করতে গিয়ে ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী দলও শক্তি হারিয়ে আমাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।
এই জাতীয় কথা শুনতে ভালোই লাগে। বুর্জোয়া শিবিরের দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে যদি সেই শিবিরকে দুর্বল করে দেওয়া যায়, আপত্তি করার কী আছে? কিচ্ছু নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, সত্যিই কি কমিউনিস্টরা আমাদের দেশে এই সব কৌশলে বুর্জোয়া শিবিরকে দুর্বল করতে পেরেছেন, নাকি তাদের আরও শক্তি যোগান দিয়েছেন? তাদের সঙ্কট থেকে বাঁচিয়ে তুলেছেন? আসন্ন বিপদ থেকে সম্মানের সঙ্গে উৎরে দিয়েছেন? ঘটনা তুলে তুলে ভেবে দেখেছেন কি?
সারা দেশে বামপন্থীরা ঐক্যবদ্ধ না হতে পারার ফলে, কংগ্রেসকে বিজেপি-বিরোধী শক্তি হিসাবে দেখানোর ফলে নির্বাচনী ফলাফলে কিছুই লাভ হল না। মাঝখান থেকে বামপন্থীরা ভোটের মানচিত্রে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। শোনা যাচ্ছে, ইয়েচুরিও প্রকাশ্যেই তা স্বীকার করেছেন এবং কিঞ্চিত সমর্থনও জানিয়েছেন বলে মনে হল। পশ্চিম বাংলায় তো টিএমসি-কে শিক্ষা দিতে চেয়ে সিপিআই(এম) গোপনে সরাসরি বিজেপি-কে এমন উজাড় হস্তে ভোট দান করেছে যে একটা বাদে বাকি সমস্ত আসনেই তাদের নিজস্বপ্রার্থীদের জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে।তা সত্ত্বেও বিজেপি এক একটি আসনে জয়লাভ করার খবরে সিপিএম শিবিরে কী উল্লাস! “কমরেডস্, আমাদের ট্যাক্টিক্স সফল। টিএমসি ঘায়েল হয়েছে। বাঘ এসে সোরেলটাকে অনেকটাই জখম করে দিয়েছে!”
না, এটা কিশোর কালিদাসী বুদ্ধি নয়। যদ্দুর মনে হয়, এ হল, শত্রু শিবিরেও বন্ধু আবিষ্কারের প্রশস্ত মন, উদার মহনীয়তা।
কে খেলল, আর কে খেলাল—বোঝা যাচ্ছে নিশ্চয়ই।
এরকম উদাহরণ আরও আছে। আর একটি যে মার্ক্সবাদী দল (এসইউসিআই) মাত্র দশ বারো বছর আগে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের টাটা-সালেম তোষক জনবিরোধী স্বৈরাচারী নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচনে এক “অগ্নিকন্যা”র হাত ধরে স্তালিন আর মাও থেকে উদ্ধৃতি ও উদাহরণ সহ এই শ্রেণিবিচার বর্জিত কৌশল ফলাতে গিয়েছিল, তার ফল কী হল? সিপিআই(এম)-কে সরিয়ে যাদের তারা প্রশংসার ফুল ছড়িয়ে ক্ষমতার আসনে তুলে দিয়েছিল, তারা নানা রকম জনমোহিনী শ্রীশ্রী ও খয়রাতি কর্মসূচির মাধ্যমেজনবিক্ষোভ ঠেকিয়ে রাখার কাজ করে চলেছে। মার্ক্সীয় পরিভাষায় যাকে প্রুধোনিক সংস্কার কর্মসূচি বলা হয়ে থাকে। অন্য দিকে, সাইকেল আর কেজি@২/- চালের বিনিময়ে মমতার সরকার আরও কঠোর হাতে ধর্মঘট সহ গণ আন্দোলনের গণতান্ত্রিক অধিকারের টুঁটি টিপে ধরেছে। ধর্মঘট করা যাবে না। আন্দোলনের জন্য জমায়েত করা যাবে না। ফৌজদারি বিধির ১৪৪-ধারা প্রযুক্ত এলাকার ক্ষেত্রফল বেড়েই চলেছে। ইউএপিএ হাতে বিরোধী কণ্ঠস্বর দমনের “উন্নয়নী” কর্মসূচি জোর বলবৎ! ফ্যাসিবাদের মিনি ট্রায়াল!! একটা খুব সাধারণ মিছিল বা পথ সভা করলেও পুলিশের অনুমতি নিতে হবে, এবং পুলিশকে বলা আছে—শাসক দলের মিছিল ছাড়া আর কোনো দল বা সংগঠনের মিছিল বা সভায় যেন অনুমতি না দেওয়া হয়। এই টিএমসি-কে এবং তার নেত্রী-কেই ২০০৮-১১ সালে রাজনৈতিক অজ্ঞতা অথবা শিশুপনা থেকে তিন বছর ধরে সেদিন এসইউসিআই নেতারা কত লম্বা লম্বা শংসাপত্র দিয়ে গেছেন!
কার ট্যাক্টিক্স আর কে সফল হল?
অর্থাৎ, দূর থেকে আসল ট্যাক্টিক্স খাটাচ্ছে বুর্জোয়ারা। তাদের সেই “ট্যাক্টিক্স” সত্যিই সফল।
এই মুহূর্তে ভারতীয় বুর্জোয়াদের প্রয়োজন সিস্টেমকে বাঁচানো। সারা দুনিয়ার মতোই ভারতেও পুঁজিবাদ এখন বিপন্ন।না, অর্থনৈতিক সঙ্কটের জন্য নয়। কাঁচা মালের বাজার এবং বাজারের ভোগদখল সে রাষ্ট্র অস্ত্র এবং বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে আপাতত মোটামুটি পাকা করে রাখতে পেরেছে। সমস্যা অন্য জায়গায়। ভবিষ্যতের সুনিশ্চিতির ক্ষেত্রে। আমার এক ফেসবুকীয় অনুজ বন্ধু বর্ণালী মুখার্জীর অনুপম ভাষায়, “বর্তমান কালে পুঁজিবাদের সাংবিধানিক গণতন্ত্রের গর্ভে প্রতি নিয়ত যে যমজ সন্তান-ভ্রূণ জন্ম নিয়ে ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রতীক্ষায়—ফ্যাসিবাদ আর সমাজতন্ত্র—তাতে একটাকে খতম না করে অন্যটার সফল জন্ম গ্রহণ হতে পারছে না।” সমাজতন্ত্রের আগমনকে ঠেকাতে হলে তাকে ফ্যাসিবাদের ভ্রূণকে লালন করতে ও জন্ম দিতে হয়। ফ্যাসিবাদ এসে গেলে গণতান্ত্রিক ভড়ং সম্পূর্ণ বে-আব্রু হয়ে যায়। তাতে আবার আখেরে সেই সমাজতন্ত্রের পদধ্বনি বেজে ওঠে। ভারি মুশকিল।
এই সমস্যার সমাধানেই বিভিন্ন দল নিয়ে তাদের ভাবতে হয়।কে সমাজতন্ত্রের সেই ভ্রূণটাকে মেরে ফ্যাসিবাদের লালন নিশ্চিন্ত করতে পারে? বিজেপিকে নিয়ে তার আজ বাজারবড্ড খারাপ। ফাসিস্ত চক্রান্তের স্বরূপ অনেকটাই উদ্ঘাটিত।দেশে বিদেশে জনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী দল হিসাবে সে চিহ্নিত। মার্কিন মুলুকের টাইম পত্রিকার প্রচ্ছদেও বুর্জোয়াদের এই স্নেহের খোকা নিন্দিত! প্রধানত মুসলিম বিরোধী, সেই সঙ্গে খ্রিস্টান ও দলিতদের বিরুদ্ধেও সে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায়। ফলে দেশের বুর্জোয়া মুখটাতে ব্যাপক কালি লেগে যাচ্ছে। গোটা দলটাতে চোর জোচ্চোর লম্পট লুটেরা খুনে ধর্ষক দাঙ্গাবাজ সন্ত্রাসীতে ভর্তি। তারাই দলে দলে এখন কেন্দ্রে মন্ত্রী হচ্ছে! অন্য দলের সমস্ত অপরাধীদের জন্য সে এখন মা গঙ্গা। ঢুকে গেরুয়া উত্তীয় পরে টুক করে একটা ডুব দিলেই পাপমুক্ত! সংসদীয় গণতন্ত্রে গেল গেল রব উঠেছে। তাই বনেদি বুর্জোয়ারা এখন কংগ্রেসকেও আবার খানিকটা সামনে টেনে তুলতে চাইছে।ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু দলটার এখন বড়ই ছন্নছাড়া অনাথ অবস্থা। পরিবারের ঐতিহ্যের নামে লোক বেশি টানতে পারছে না!
বিকল্প শক্তি হিসাবে সেই বহুদিনের পরীক্ষিত চৌকিদার কংগ্রেসের ইজ্জত বাড়াতে হবে। বাড়িয়ে রাখতে হবে। মোহসৃষ্টিতে ব্যাপক সাহায্যকরে। যাতে ভবিষ্যতে বিজেপি হঠে গেলেও পুঁজিবাদ, ফ্যাসিবাদ বিপদে না পড়ে। এই কাজটা কে করে দেবে? দেশের এই ঘোর দুর্দিনে এই “মহান” কাজটা করে দেবার জন্য সিপিআই(এম) নিজেকে উৎসর্গ করেছে। কর্পোরেটদের কোনো একটা বিশ্বস্ত দলকে সামনে এনে সেই শ্রেণিকে আড়াল করার এই লঘু ক্রিয়াটাকে স্রেফ পুঁজিপতিদের “দালালি” বলে প্রচলিত স্থূল শব্দে চিহ্নিত করে সবটা বোঝানো যাবে না। ঘটনার সম্যগ উপলব্ধির স্বার্থে এর জন্য আমি একটা নতুন রাজনৈতিক শব্দবন্ধ প্রয়োগে আনতে চাই—বাফার (buffer), অর্থাৎ, ধাক্কাহারী (shock absorber)। এর ফলে ফ্যাসিবাদের সঙ্গে বিজেপি-র দলগত নাম একান্ত করে জড়িয়ে দিলে তার শ্রেণিগত ভিত্তি জনচক্ষুর আড়ালে চলে যাবে।
আমাদের দেশের মেহনতি জনগণের দুর্ভাগ্য, মনোপলি প্রাসাদের এই ট্যাকটিক্সকে বামপন্থীরা অনেকে মাঝে মাঝে নিজেদের ট্যাক্টিক্স ভেবে বসে।এইভাবেশোষক শ্রেণির ফাসিস্ত পরিকল্পনাকে জিতিয়ে দেবার ক্ষেত্রে সিপিআই(এম) এই বাফার ভূমিকাটা গ্রহণ করেছে। ফলে তাদের দলের যাঁরা ভাবছেন, তাঁরা একটা দারুণ কৌশল নিয়ে ফেলেছেন, তাঁরা জানেনই না, আসলে এই জাতীয় কৌশলের পরিকল্পনাকার কে বা কারা! কাদের হয়ে তাঁরা এই বাফারি খাটছেন!
কিংবা হয়ত জানেন।বা মাঝখানে ভুলে গেলেও আবার মনে পড়ে গেছে। এই প্রজ্ঞা তারা অর্জন করেছেন।দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে সিপিআই(এম) আবার সিঙ্গুর চাঁদমনি নন্দীগ্রামের সেই অকাল প্রয়াত ভয়াবহ স্বৈরশাহী দখলবাজ কর্মসূচিকে বাঁচিয়ে তুলতে চায়। সেই টাটার কেশাগ্র রক্ষার দাম্ভিক প্রতিশ্রুতি। সেই কৃষি জমি দখলের জন্য নন্দীগ্রামের বন্দুকবাজি। ইতিহাসের কী দারুণ রসবোধ!! সেখানেও হাওয়াই চটি ছিল। অন্য রকম!
সম্ভবত এই জন্যই টিএমসি সম্পর্কেও তাদের প্রচারে ভুল বা ইচ্ছাকৃত অসত্য ধারণা থেকে যাচ্ছে। “মোদী-দিদি আঁতাত”। বিশ বছর আগে কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় মমতা ব্যানার্জীর ছিল উপরে ওঠার সমস্যা। যাকে ধরে উঠতে পারবেন, তারই হাত তিনি ধরে ফেলবেন। সে সোনিয়াই হোন, আর অটল। মোদীও তখন সই। সে যতই তিনি গুজরাতে শতাব্দের বীভৎসতম দাঙ্গা করে জিতে আসুন না কেন! কারণ, মুসলিম ভোটের চাইতেও সেদিন তাঁর কাছে জরুরি ছিল রাজ্য রাজনীতিতে বিকল্প মুখ হয়ে ওঠা।সে যেভাবেই হোক। এখন তাঁর সেই কাঁচা অবস্থা আর নেই। সিপিআই(এম)-এর ৩৪-সালা অপশাসন সৌজন্যে রাজ্যে এখন তিনি শাসক দলের নেত্রী। মোল্লাতন্ত্রে সুড়সুড়ি দিয়ে মুসলিম ভোট যতটা পারা যায় ধরে রাখা তাঁর কাছে এখন ভীষণ জরুরি। এদিকে বিজেপিও এখানে ঢুকতে চায়। বাংলায় বেশি করে এম-পি পেলে সারা ভারতে তার ইজ্জত বাড়ে। ফলে এখানে তাদের মধ্যে গদির দখল নিয়ে ব্যাপক সংঘাত আছে! না, কোনো নীতিগত বা আদর্শগত সংঘাত নয়। গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রের সংঘাত নয়। নিতান্তই স্বৈর-ক্ষমতা দখলে রাখার বনাম দখলে নেবার জন্য লড়াই। এবারের লোকসভা নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গে এটা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে।
এই ব্যাপারটা সিপিআই(এম)-এর মতো ভোটজ্ঞানী দল জানে না বা বোঝেনি—বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। বরং খুব বুঝেশুনেই ওপরে ওপরে এই প্রচারটা চালু রেখে ভেতরে ভেতরে তারাই আবার বিজেপি-র সাথে ভোট ভাগাভাগির খেলা চালিয়ে গেছে। রাজ্য স্তরে টিএমসি-কেই বড় শত্রু ধরে নিয়ে তারা বহু জায়গায় তলে তলে বিজেপি-র সুবিধা করে দিয়েছে। প্রকাশ্যে কংগ্রেসেরসাথে আঁতাত করতে গিয়েই (একই যুক্তি বা মনোভাবনা থেকে) গোপনে বিজেপি-র সাথেওবোঝাপড়া করার কৌশল মাথায় এসেছে।সদ্য বিগত নির্বাচনে সিপিআই(এম) প্রার্থীদের ভোটের সংখ্যায় হ্রাস এবং বিজেপি-র প্রার্থীদের ভোট বৃদ্ধির পারিসংখ্যানিক অভেদ এই সত্য বুঝতে খুবই সাহায্য করছে। রাজ্যের রাজনীতিতে নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক অবস্থানে নিয়ে ফেলার ঝুঁকি নিয়েই দলের নেতারা এই খেলায় নেমেছেন। নীলকমল নয়, লালকমলই রাজ্যে বিজেপি-কে বড় বড় মই যোগান দিয়েছে!
এই জন্যই বিজেপি-র বিরুদ্ধে তাদের আদর্শগত প্রচারের কণ্ঠ দুর্বল বা আসলে প্রায় নিঃস্বর হয়ে গেছে। নোট বাতিলের সময় সারা দেশে যে বিপুল জনবিক্ষোভ জমে উঠেছিল, তারা তাকে কাজে লাগিয়ে কোনো শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারি নীতিকে বড় আঘাত করতে চায়নি। এনআরসি নিয়ে তাদের কঠোর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নীরবতা ভীষণ ভাবে লক্ষণীয়। সঙ্ঘ পরিবারের অ্যাজেন্ডাগুলো নিয়ে তাদের প্রায় কোনো রাজনৈতিক প্রচারই নেই। বিজেপি-কে তারা কোনোভাবেই বিপদে ফেলতে চায়নি। টিএমসি-কে চোর বলে হঠাতে গিয়ে তারা আরও বড় ডাকাতকে ডেকে এনেছে।
তবে তাদের সেই কৌশল অচিরেই ব্যুমেরাং হয়ে দেখা দেবে।ব্যবহার করতে গিয়ে তারাই ব্যবহৃত হতে থাকবে। অবিলম্বে সাবধান না হলে সিপিআই-এর মতোই অল্প কিছু দিনের মধ্যে সিপিআই(এম)-ও দেশের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। সেই ১৯৭০-এর দশক থেকে কংগ্রেসের হাত ধরে স-স-সমাজতন্ত্রের দিকে যাত্রা শুরু করতে চেয়েছিল সিপিআই। মূলত তাদের মগজের প্রভু হয়ে বসা সোভিয়েত পার্টির কড়া নির্দেশে। তিন দশকের মধ্যেই দলটা ডোডো পাখির পেছনে গিয়ে লাইনে দাঁড়াল। এখন লাইব্রেরিতে গিয়ে খুঁজতে হয়। কংগ্রেস এবং বিজেপি-র পেছনে ফিল্ডিং খাটতে গিয়ে ইয়েচুরিও সেই একই ভবিতব্যের দিকে দলকে ঠেলে দিচ্ছেন না তো?
সমস্ত ভুল ট্যাকটিক্সের নিয়মই এই। যাদের ক্ষতি করতে চেয়েছিলাম, বলেছিলাম, তাদের ক্ষতি হয় না, বা হলেও কম হয়। নিজেদের ক্ষতিই বেশি হয়।
১৯২০-এর দশকে মুসোলিনি হিটলারের অভ্যুত্থানের আমলে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সামনে কমরেড জোসেফ স্তালিনের প্রদর্শিত সোস্যাল ডেমোক্রাসি বিরোধী ট্যাকটিক্স ইউরোপে ব্যর্থ ও ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। স্তালিনের কথাটা তো নীতিগতভাবে ভুল ছিল না, বা এখনও ভুল নয়: “সোস্যাল ডেমোক্র্যাসিকে পরাস্ত না করে পুঁজিবাদকে ধ্বংস করা যায় না।” পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটাতে হলে পুঁজি ও শ্রমের মাঝখানে আপসকারি শক্তি হিসাবে সমস্ত সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক শক্তিকে শ্রমিক আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে। বটেই তো! কিন্তু সেই দশকে কমিউনিস্টদের সামনে আশু সমস্যাটা ছিল ভিন্ন এবং তীক্ষ্ণ: সমাজতন্ত্রের নামাবলি পরেই ফাসিস্ত ও নাৎসি বাহিনী দুই দেশে শ্রমিক বিপ্লবের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপুল শক্তি সমাবেশ ঘটাচ্ছে, তার বিরুদ্ধেই তখন সর্বাত্মক বিরোধী ঐক্য গড়ে তুলে প্রতিরোধ করতে হবে। বিপ্লব করা নয়, বিপ্লবের প্রয়োজনীয় পরিসরকে, বিপ্লবী শক্তিকে, বাঁচিয়ে রাখাই সেদিনকার আশু কর্তব্য ছিল। সেটা না বুঝে আপ্তবাক্যের মতো যে কৌশল নেওয়া হয়েছিল, তাতে জার্মানি ও ইতালির কমিউনিস্ট আন্দোলন খুব অল্প সময়ের মধ্যে কার্যত নিঃশেষ হয়ে গেল। ১৯৩৫ সালের পরে কমিনটার্নের সপ্তম কংগ্রেসে দিমিত্রভ থিসিসে যখন পুরনো ভুল সংশোধন করে সেই সার্বিক ঐক্যের শ্লোগান তোলা হল, তখন আসলে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইউরোপের অনেক দেশেই তখন ফ্যাসিবাদ জাঁকিয়ে বসে গেছে। বিপ্লব এবং বিপ্লবীদের তখন বেছে বেছে দেশে দেশে কোতল করছে। সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিয়ে কিছু মার্ক্সবাদী দল ও নেতা আজও স্তালিনের সেই সোস্যাল ডেমোক্র্যাসি সংক্রান্ত ফরমুলাই আওড়ে চলেছেন।
কিন্তু আবার সেই স্তালিনেরই ১৯৩৯ সালের সামরিক ট্যাকটিক্স—মলোতভ-রিবেনট্রপ রুশ জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি—সফল হয়েছিল। অন্তত দুবছরের জন্য যুদ্ধকে পিছিয়ে দিয়ে হাতে কিছুটা প্রস্তুতির সময় পেয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অত ভয়ঙ্কর শক্তিশালী জার্মান সামরিক বাহিনীকে লাল ফৌজ শেষ পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। একই ভাবে, ১৯৩৮-৪৫ সময় কালে জাপানের চিন আগ্রাসনের সময়, কমরেড মাও সে-তুং-এর ট্যাকটিক্স—ভয়ঙ্কর কমিউনিস্ট বিদ্বেষী চিয়াং কাইশেক পরিচালিত কুওমিন্তাং দলের হাত ধরে জাপানের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট গড়ে তুলে ঐক্যবদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ চালানো—সফল হয়েছিল। ১৯৪৫ সালের শেষে জাপান যখন যুদ্ধে হেরে চিন থেকে পালিয়ে গেল, চিয়াং কাইশেকের পেছনে এসে আমেরিকা স্বয়ং দাঁড়িয়েও চিন বিপ্লবকে আর আটকাতে পারেনি।
সঠিক ট্যাকটিক্সের পরিণতি এই রকমই সাফল্যে উজ্জ্বল হয়। আর যে ট্যাকটিক্স প্রয়োগের ফলে শত্রুপক্ষের, বুর্জোয়া শিবিরের শক্তি ক্রমশ বাড়তে থাকে, তারা আরও গুছিয়ে নেয়, বুঝতে হবে, সেই ট্যাকটিক্স এই শিবিরই আমাদের পাতুপুতু করে খাইয়ে দিয়েছে! তারা খাইয়েছে নেতাদের। নেতারা কর্মীদের খাওয়াচ্ছেন। কর্মীরা জনগণকে খাওয়াতে গিয়ে ঝাড় খাচ্ছেন। গোটা কমিউনিস্ট আন্দোলনেই এখন মীরাবাঈ সিন্ড্রোম।
[৪]
ছয় দল বা আঠের দল—সংখ্যাটা যাই হোক, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী দলগুলির যে মাঝে মাঝে মুদ্দাভিত্তিক ঐক্য চোখে পড়ে, সেটা কেন নির্বাচনেও সম্প্রসারিত হল না—এক বিস্ময়! আমার ধারণা, এসইউসিআই-সি এবং সিপিআইএমএল-লিবারেশন উদ্যোগ নিলে এরকম একটা ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার দিকে হয়ত ইতিবাচক অগ্রগতি হতেও পারত। পশ্চিম বঙ্গে এটা ঘটলে সারা দেশেই এর একটা শুভ সূচনাকারী বার্তা দেওয়া যেত। শ্রমিক কৃষক কর্মচারি শ্রেণি এবং দলিত, মুসলিম, আদিবাসী ও অন্যান্য আক্রান্ত গোষ্ঠীগুলিকে বোঝানো যেত, তাদের পাশে বামপন্থীরা আছে।
মানে, থাকতে চাইলে। চাইছে কিনা সেও এখন প্রশ্নের মুখে। জল জমি জঙ্গল খনি পাহাড় বেচে দেব না—এরকম ঘোষণা এখন সিপিআই(এম)-ও করতে পারছে না, কেন না, তারা এখন আবার সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম চাঁদমনি ফরমুলায় ফিরে যেতে চাইছে। শিল্পায়ন, বেকার সমস্যার সমাধান—ইত্যাদি চিরাচরিত বুর্জোয়া রাজনৈতিক আওয়াজের আড়ালে। তথাপি, অন্যান্য বামপন্থীরা চাইলে তারা অন্তত চাপ তৈরি করতে পারত সেই ফরমুলায় ফিরে যাওয়ার আত্মঘাতী ঘোষণার থেকে সিপিআই(এম)-কে সরিয়ে আনতে। দলটা বড় বলেই সিপিআই(এম) দলের ভেতরেও বাম-মনস্ক কর্মীদের এক বিরাট অংশের মধ্যে এই চাপ প্রবলভাবে বর্তমান! দলীয় আনুগত্যের দাবি যাই হোক, তাঁদের বেশির ভাগই এখনও পর্যন্ত বামপন্থী আন্দোলনের শিবিরের অংশ। এই সত্যটা ভুলে যাওয়া কারও উচিত নয়। ফলে ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রচার চালাতে চালাতে এই ঐক্যর প্রশ্নকে সামনে এনে তাকেও ট্যাকটিক্স হিসাবে কাজে লাগানো যেত। বাস্তবে উচ্চবর্গীয় নেতা আর মাঠে ঘাটের কর্মীদের মধ্যে বাস্তবে বিদ্যমান এই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগানোর মধ্যেই বরং একটা কৌশল ফলপ্রসূ হতে পারত।
তবে, সেটাও বুঝলে এবং লাগাতে চাইলে। সেই সব বামপন্থীরাও এটা চাইছে কিনা সেও এখন প্রশ্নের মুখে। তাদেরও হয়ত অন্য অঙ্ক, অন্য অ্যাজেন্ডা, মাথায় ঘুরছে। নির্বাচনে যেই জিতুক বা হারুক, ফ্যাসিবাদকে ঠেকানোর জন্য আপাতত কিছু করার নেই, শুধু সিপিআই(এম)-এর কর্পোরেটালি মুখোশ আরও উন্মোচিত হোক, সোস্যাল ডেমোক্র্যাসিকে পরাস্ত করার সেই ধ্রুপদী স্তালিনীয় আহ্বানই তাদের মুখে এবং বুকে এখনও সতেজ, তাতে বিপ্লবের বদলে প্রতিবিপ্লব শক্তিশালী হলেও! তারা হয়ত ভাবছে, সিপিএম ফিকে হয়ে গেলে তারা কিছু ফাঁকা জায়গা পেয়ে যাবে। ঘুঁটে-গোবরের সেই চিরায়ত শাস্ত্র!
অন্য দিকে এমন বহু র্যাডিক্যাল বামপন্থী গ্রুপ দেশে আছে, যারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর বাম ঐক্যের কথা বলে, কিন্তু প্রথমেই শর্ত দেয়, সেই ঐক্যে সিপিআই(এম)-এর থাকা চলবে না। ফলে, তারা কেন ঐক্যের কথা বলে, কিসের দিকে তাকিয়ে বলে সেটাও আমার কাছে স্পষ্ট নয়। এই মুহূর্তে ভারতে বা পশ্চিমবঙ্গে যে সিপিআই(এম)-এর সঙ্গেই যে সব চাইতে বেশি সঙ্খ্যক বামপন্থী কর্মী আছে, তাদের না পেলে যে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সৈন্যশিবির দুর্বলই হবে—এ সত্য তারা কীভাবে ভুলে থাকে আমার বোধগম্য নয়। বরং সেই শক্তিকে কীভাবে টেনে আনা যায়, এবং “আমাদের” সঙ্গে ধরে রাখা যায়—সেটাই তাদেরও কৌশল হওয়া উচিত। বা শেখা উচিত। অবশ্য—আবারও বলি—শিখতে চাইলে। এই শিক্ষাগুলির স্বার্থেই মার্ক্সীয় সংস্কৃতিতে ট্যাক্টিক্স নামক জিনিসটির উদ্ভাবন ঘটেছিল। চালাকি হিসাবে নয়। গণ আন্দোলন পরিচালনার ইতিবাচক কায়দাকানুন হিসাবে। বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের শ্রেণি শাসন রক্ষার জন্য অনেক রকম নমনীয় আচরণ শিখে নিয়েছে। পুঁজিবাদ বিরোধী শক্তিগুলির এখনও ধ্রুপদী কেতাবি শিক্ষাগুলির বাইরে বেরনোর মানসিক প্রস্তুতিই হয়নি। আত্মসমর্পণের জন্য এক দল নানা রকম নমনীয়তা শিখে ফেলেছে। সংগ্রামের জন্য, ঐক্যের জন্যও যে নমনীয়তা দরকার সেটা শিখতে—বা শেখা যে দরকার সেটা বুঝতেই, কিংবা নমনীয়তা মানেই যে নীতি বিসর্জন নয় তাও বুঝতে—আমাদের প্রচুর সময় ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। ফ্যাসিবাদ যতই ধুন্ধুমার গতিতে এগিয়ে আসুক, আমরা খালি বিশুদ্ধতার অঙ্ক কষে চলেছি।
আর একটা কথা।
ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করার জন্য নির্বাচনে জয়লাভ একটা বড় ধাপ, কিন্তু একমাত্র ধাপ বা এমনকি প্রধান ধাপও নয়। বর্তমান প্রজন্ম হয়ত জানেই না, ১৯৫০ বা ‘৬০-এর দশকে পশ্চিমবাংলায় রাজ্য সরকারে কংগ্রেস বিরাট গরিষ্ঠতা নিয়ে সমাসীন থাকলেও কলেজে কলেজে ছাত্র সংসদ, স্কুলে স্কুলে শিক্ষক সংগঠন, কারখানাগুলিতে শ্রমিক ইউনিয়ন ইত্যাদি সবই ছিল বামপন্থীদের একচ্ছত্রভাবে আয়ত্তাধীন। কংগ্রেস সেখানে দাঁতও ফোটাতে পারত না। জনসঙ্ঘের নাম, শ্যামাপ্রসাদের নাম, আমরা আমাদের স্কুল জীবনের শেষ (১৯৭০) অবধি শুনিনি। সেকালে দেখেছি, পাড়ায় একজন কংগ্রেসের কর্মী থাকলেও তাকে লোকে পাত্তা দিত না, সামাজিক ভাবে তার অবস্থা ছিল বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। মাঝখানে গত চল্লিশ পঞ্চাশ বছরে বামপন্থীদের বিধায়ক সাংসদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেল, সরকারেও অনেক দিন তারা ছিল। কিন্তু সংগ্রামের মঞ্চগুলি প্রায় সবই তাদের হাতছাড়া হয়ে গেল।
সরকারি ক্ষমতা হারিয়েও ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী আন্দোলন আজ আবার সেই জায়গায় ফিরে যেতে পারে—যদি সে তার লক্ষ্য এবং পদ্ধতি সঠিভাবে নির্ধারণ করতে পারে। লক্ষ্যের কথাটাই আগে বলি। অর্থনীতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রশাখাগুলিকে বজায় রাখা, ব্যক্তি মালিকানাধীন পুঁজিকে বাড়তি সুবিধা প্রদান না করা, বেআইনি জমি দখল বন্ধ করা, কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্পের ক্ষেত্রে ভর্তুকি বহাল রাখা, দুর্নীতি শক্ত হাতে রোধ করা; রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমস্ত অগণতান্ত্রিক আইন প্রত্যাহার, নাগরিক নথীকরণ প্রক্রিয়া প্রত্যাহার, কাশ্মীর ছত্তিসগড় উত্তর পূর্বাঞ্চলে সেনা নিপীড়ন বন্ধ করা; গোরক্ষা নয় মানুষ রক্ষার জন্য আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ, সংখ্যালঘু ও দলিতদের উপর আক্রমণ বন্ধ করা, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রশমন করা, রাষ্ট্রীয় কাজে ধর্মনিরপেক্ষতা কঠোরভাবে মেনে চলা, নেতা মন্ত্রী আমলাদের প্রকাশ্য ধর্মচর্চা নিষিদ্ধ করা—ইত্যাদির দাবির ভিত্তিতে সমস্ত বামপন্থী শক্তির সম্মিলিত মঞ্চ গড়ে তুলতে হবে। এই সব দাবি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রচার চালাতে ও গণ আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে। নির্বাচনেও সেই ঐক্যবদ্ধ মঞ্চের তরফে এই মুদ্দাগুলিকে সামনে রেখেই অংশগ্রহণ করতে হবে। সঠিক লক্ষ্য ও উপায় বলতে এই সমস্ত কাজগুলিকেই বুঝতে হবে।
বিজেপি-র পক্ষে বেশি দিন রাম ভুজিয়া আর পুলওয়ামার পুলটিস দিয়ে জন বিক্ষোভকে চেপে রাখা সম্ভব হবে না। মানুষের রুটিরুজির উপর তাকে হামলা চালাতে হবেই। আম্বানি-আদানির জন্য রাম রাজত্ব আর আম জনতার জন্য “ওখানেই মন্দির”—খুব বেশি দিন বেশি লোককে বোকা বানিয়ে রাখতে পারবে না। বামপন্থী দলগুলিকে তৈরি হতে হবে এখন থেকেই। ওরা যদি ভাঁওতা দিয়ে মানুষের মগজের দখল নিতে পারে, তাঁরাই বা—যদি সত্যিই আন্তরিকভাবে চান—যুক্তি তথ্য দিয়ে তা পুনর্দখল করতে পারবেন না কেন? নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া উন্নত করে, কয়েকটি মৌলিক গণ মুদ্দাকে হাতিয়ার করে বিক্ষোভ আন্দোলনের কৌশল এখন থেকেই তাদের ভেবে রাখতে হবে। আর আন্দোলনের নতুন কায়দাকানুনও তাদের মাথা খাটিয়ে বের করতে হবে। ইউরোপীয় ধর্মঘট আর গান্ধীর ধর্না আইন অমান্য তো অনেক হল। এ সব দিয়ে আর চলবে না। বুর্জোয়ারা এই সব কায়দাকে কীভাবে জল ঢেলে নরম করে দিতে হয় শিখে ফেলেছে। তাদের এতে গায়ে লাগে না। গায়ে লাগবে, আন্দোলনের এমন কিছু নতুন আকারের কথা ভাবতে হবে। সকলে মিলে। মাথা ঠান্ডা করে।
একটি ইংরাজি কবিতার স্বকৃত বাংলা তর্জমা দিয়ে প্রসঙ্গটি আপাতত শেষ করি:
হাল ছেড় না বন্ধু
– জন গ্রিনলিফ হোয়াইটিয়ার
যেদিন শুধুই বিড়ম্বনা, এমন দিন তো আসে,
যে পথে যাই যেদিক তাকাই ভরা কেবল ত্রাসে;
অর্থ যখন ফুরিয়ে আসে, ঋণের বোঝা ভারি,
হাসতে গেলে বেরিয়ে পড়ে দীর্ঘশ্বাস তারই;
সঙ্কটময় জীবন যেন পাহাড়ি এক ঢাল—
বিশ্রাম নাও বুঝলে সাথী, ছেড়ে দিও না হাল।
সাফল্য যে পরাভবের উল্টোদিকের ধাপ,
ঘন মেঘের কালোছায়ায় দেখবে সাদা ছাপ;
হয়ত যখন ভাবছ তুমি মঞ্জিল খুব দূরে,
আসলে প্রায় পৌঁছে গেছ, অন্তিম দিশপুরে।
কঠিন লড়াই, কঠোর আঘাত, করছে বেসামাল,
খারাপ সময়, বন্ধু এখন দিও না ছেড়ে হাল।।
[অনুবাদ – ২৫ মে ২০১৯]
অশোক মুখোপাধ্যায় প্রাবন্ধিক ও লেখক। সেস্টাসের সম্পাদক।