দরিদ্র রোগীদের কোনও সংগঠন নেই। কোনও রাজনৈতিক দলেরই দরিদ্র রোগীদের বিষয়ে কোনও ভাবনা নেই, দাবিপত্র নেই। তাঁদের বিশিষ্ট জন নেই। রোগীদের পক্ষে আগে কথা বলেছেন জুনিয়র ডাক্তাররা, নানা সময়ে গড়ে ওঠা তাঁদের সংগঠন। পুরনো কাগজপত্রে তার প্রমাণ রয়ে গিয়েছে। লিখছেন শুভেন্দু দাশগুপ্ত।
জুনিয়র ডাক্তাদের আন্দোলন শেষ হল।
সরকার তাদের দাবি মিটিয়ে দিল।
১৮ জুন, ২০১৯ সকালে কলকাতার দু’টি বাংলা খবর কাগজে পড়লাম দাবি মেটানোর তালিকা। আর একভাবে বললে আন্দোলন করে জুনিয়র ডাক্তাররা কী পেলেন—তার একটা হিসেব।
যতটা বুঝতে পেরেছি বলতে থাকি।
১: প্রতিটি হাসপাতালে ‘বিপদ অ্যালার্ম’ বাজার ব্যবস্থা থাকবে।কাদের ‘বিপদ’-এ অ্যালার্ম বাজবে? জুনিয়র ডাক্তারদের।
২: হাসপাতালে গোলমালের খবর দিতে ‘ডায়াল ১০০’-এর মতো ‘হেল্প লাইন’ থাকবে।
কাকে ‘হেল্প’ করার জন্য? জুনিয়র ডাক্তারদেরকে।
৩: প্রতিটি হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে কোলাপসিবল গেট থাকবে।
গেট খোলা রাখা ও বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত কে নেবেন? কীসের ভিত্তিতে নেবেন? প্রতি হাসপাতালের জন্য নির্দিষ্ট থানার অফিসার? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ? জুনিয়র ডাক্তাররা?
৪: রোগীর অবস্থা সম্পর্কে পরিবারের লোককে জানাবে জনসংযোগ অফিসার।
তিনি কি চিকিৎসক? তিনি কি রোগীর তাৎক্ষণিক সব প্রশ্নের ডাক্তারদের উত্তর জানেন? নাকি রোগীদের কাছ থেকে পাওয়া লিখিত প্রশ্নের ডাক্তারদের কাছ থেকে পাওয়া লিখিত জবাব জেনে নিয়ে জানাবেন? চিকিৎসা বিষয়ে কথা বলাবলি তো ডাক্তার রোগী সম্বন্ধে ভরসা, বিশ্বাস, জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রশ্ন, উত্তর বিনিময়।
[নিজে একসময় শিক্ষক ছিলাম, মনে হল পড়ুয়াদের অভিভাবকরা তাঁদের বিষয়ে জানতে আমার কাছে আসবেন না, শিক্ষালয়ের জনসংযোগ অফিসারের কাছে যাবেন]
৫: হাসপাতালের নিরাপত্তার (জুনিয়র ডাক্তারদের নিরাপত্তার) নজরদারিতে পুলিশের নোডাল অফিসার।
এরপরেও যদি হামলা হয়,পুলিশের বদলে সশস্ত্র পুলিশ? তারপর হলে আধা সেনাবাহিনী? তারপর হলে সেনাবাহিনী?
[৬০-এর দশকের শেষে কলেজের, ৭০-এর দশকের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। ‘দুর্বিনীত’ ছাত্র ছিলাম।প্রিন্সিপালের, হেড অফ দি ডিপার্টমেন্টের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখালেও তাঁরা কখনও শিক্ষালয়ে পুলিশ ঢুকতে দেননি।]
৬: হাসপাতালে ঢোকার সময় পুলিশের চেকিং। কী ধরণের চেকিং? বডি সার্চ? স্ক্যানিং?
বায়োমেট্রিক টেস্ট? ফটো আইডি কার্ড? রোগী পিছু দু’জন?
৭: স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যকর্মীদর নিরাপত্তায় কড়া মেডিকেয়ার আইন? সেটা কী? দরিদ্র শ্রেণির রোগীরা জানতে, বুঝতে, পড়তে পারবেন তো?
৮: সহজে চোখে পড়ে এমন জায়গায় থাকবে বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজিতে হোর্ডিং।
দূর দূর থেকে আসা রোগীদের পরিজনরা কীরকম ব্যবহার করবেন? শুধু সেই নির্দেশ?
আমার এক ডাক্তার বন্ধু সরকার-জুনিয়র ডাক্তার আলোচনা বিষয়ে দু’টি প্রকাশিত লেখা পাঠিয়েছে। দু’টিই ইংরেজি বয়ানে। আমি বাংলা বয়ানে নিয়ে আসার চেষ্টা করব।
একটি ‘রেকর্ড নোট অফ দি মিটিং অফ জুনিয়র ডক্টরস্ অ্যান্ড সিএম’।
১৭ জুন, ২০১৯।
মুখ্যমন্ত্রীর সাথে জুনিয়র ডাক্তারদের আলোচনার বয়ান। মোটামুটি বাংলা খবরের কাগজে যা বলা হয়েছে, যার ভিত্তিতে আমার এই লেখাটি।
কয়েকটি আরও কথা এই ইংরেজি নোটটিতে আছে বলে আমার মনে হয়েছে।
এক, রোগীর সাথে হাসপাতালে আসা লোকজনদের সরকারি পরিচয়পত্র নিয়ে আসতে হবে। পরিচয়পত্র থাকলে তাঁরা আর গোলমাল করবেন না?
দুই, হাসপাতালগুলিতে নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য নিরাপত্তা বিষয়ক যে ব্যবস্থাপনা ও যন্ত্রপাতি আছে, তাকে উন্নত করা হবে।
এমন উন্নত করা কোথায় গিয়ে শেষ হবে?
তিন, জুনিয়র ডাক্তাররা ১২ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন।
প্রস্তাবগুলি কি তাঁদের নিরাপত্তা বিষয়ে নাকি চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি বিষয়ে?
ডাক্তার বন্ধুর পাঠানো দ্বিতীয় লেখাটি পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসকদের সাতটি সংগঠনের জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস্-এর প্রতিবেদন। প্রতিবেদনে লেখা আছে জুনিয়র ডাক্তারদের দাবির বিষয়ে তাদের পুরোপুরি সমর্থন রয়েছে।
এবার দেখা যাক ‘দাবি করা’ ও ‘দাবি মেটানো’-র মূল জায়গাটি কী?
প্রায় সমস্ত দাবি ও দাবির উত্তরে ‘ব্যবস্থাপনা’ জুনিয়র ডাক্তারদের ‘নিরাপত্তা’ বিষয়ক।যা আসলে একটি ‘শক্তিশালী রাষ্ট্র’-র উপস্থিতির দাবি। ‘সশস্ত্র ব্যবস্থাপনা’, ‘নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাপনা’ প্রয়োগের দাবি এবং তার সরকারি সমর্থন।একটি দক্ষিণপন্থা রাজনীতিকতার ধারণা।
ন্যায়, ন্যায্যতা, সমতা,
পারস্পরিক সম্পর্ক, সহানুভূতি,
অসুবিধার অনুসন্ধান, অন্যায়ের কারণ খোঁজা এসবের দাবি কোথায়?
সুচিকিৎসা ব্যবস্থায় সরকারের দায় দায়িত্বের দাবি কোথায়?স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সরকারি পরিকাঠামো নিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের বানানো লিখিত প্রস্তাব কোথায়?
‘জুনিয়র ডাক্তারদের অধিকার’ বানানোর ভাবনা কোথায়?
৮ ঘণ্টার কাজ, সাপ্তাহিক ছুটি, ডাক্তার পিছু রোগীর নির্দিষ্ট সংখ্যা, লেখাপড়া করার জন্য ছুটি, রাজ্যের নানা ধরণের অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে স্বাস্থ্য বিষয়ে সমীক্ষার জন্য ছুটি ও ভাতা, রোগীর পরিজনদের সাথে কথা বলার জন্য নির্দিষ্ট সময় পাওয়া, উপকরণ না থাকলে সঙ্গে সঙ্গে যোগান পাওয়া, দিনের একটা সময়ে রোগীদের বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মত বিনিময়ের বাধ্যতামূলক সময় পাওয়া —এমন এমন সব বিষয় মিলিয়ে ‘অধিকার সনদ’ বানানো।
এর সাথে জড়িয়ে জুনিয়র ডাক্তাররাই বানাতে পারেন ‘রোগীর অধিকার সনদ’। দু’টি অংশকে মিলিয়ে। সেই দাবি কোথায়? আমরা অন্যরা আগে ‘রোগীদের অধিকার’ বানিয়ে দেখেছি ডাক্তারবাবুরা মেনে না নিলে এই অধিকার পাওয়া যাবে না।
সরকারের সাথে আলোচনা সেরে জুনিয়র ডাক্তারদের পাওয়া তালিকায় চোখ রাখলে মন বলবে সমাজের উচ্চবর্গের মেধাবী জুনিয়র ডাক্তাররা শুধু তাঁদের দিকটাই দেখলেন।
নিম্নবর্গের দরিদ্র অসহায় রোগীদের শুধু ‘দুর্বৃত্ততা’-র দিকটাই দেখলেন।
রাষ্ট্র এভাবেই ‘পক্ষ’ বানায়’, ‘প্রতিপক্ষ’ বানায়,পক্ষ নেয়।আমরাও রাষ্ট্রের পক্ষ বানানোর পাশে দাঁড়িয়ে যাই।
আমরা ভাবার সময়, দাবি বানানোর সময়, সিদ্ধান্ত বানানোর সময় ভুলে যাই জীবন্ত সমাজ বাস্তবতা। অন্য পক্ষের সমাজ বাস্তবতা।
একটা উদাহরণ। আমার বাড়ির পাশে একটি ‘বস্তি’। আজকাল এভাবে পরিচয় দেওয়া চালু হয়েছে, তাই বলছি ‘মুসলমান’ মানুষজনের ও ‘হিন্দু’ মানুষজনের অনেকদিনের পাশাপাশি বন্ধুতায় বসবাস।যখনই কেউ অসুস্থ হন, ১০ জনের কাছাকাছি মানুষজন হাসপাতালে দৌড়োন। কেউ ডাক্তারের সাথে কথা বলেন, কেউ ট্রলি নিয়ে আসেন, কেউ তক্ষুণি প্রয়োজনীয় ওষুধ আনতে, কেউ পরীক্ষা করাতে, কেউ রক্ত যোগাড়ে, কেউ টাকা নিয়ে আসতে, কেউ নিছক মানসিক মদত দিতে। এঁরা এভাবেই একসাথে থাকেন। নতুন মধ্যবিত্ত আমাদের মতন ‘একা একা’ হয়ে যাননি। এবারে প্রস্তাবিত ও স্বীকৃত নিয়মে এঁরা যেতে পারবেন না। এমন ‘সামাজিক কাজ’টি হাসপাতালের নতুন নিয়মে গেটেই আটকে যাবে। জুনিয়র ডাক্তারদের ‘নিরাপত্তা’ দিতে।
আন্দোলনে ছিলেন যাঁরা জুনিয়র ডাক্তারদের কাছে আবেদন, অনুরোধ যে পুরনো আন্দোলনগুলো জানুন, জুনিয়র ডাক্তাররা প্রাথমিক স্বাস্থ্য বিষয়ে, চিকিৎসা বিষয়ে, সরকারি স্বাস্থ্যনীতি, সরকারি ঔষধনীতি বিষয়ে কী কী দাবি তুলেছিলেন, নিজেরা কী কী উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কীভাবে নানা ধরণের জনস্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।কম জোরালো নয় সে ইতিহাস।
এখনকার নতুন ইমার্জেন্সিতে, নতুন স্বাস্থ্যনীতিতে, নতুন স্বাস্থ্যবীমা নীতিতে, নতুন শ্রমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় জুনিয়র ডাক্তারদের ভাবনা করা, লড়াই করার প্রয়োজন আরও বেড়ে গেছে।
দরিদ্র রোগীদের কোনও সংগঠন নেই। কোনও রাজনৈতিক দলেরই দরিদ্র রোগীদের বিষয়ে কোনও ভাবনা নেই, দাবিপত্র নেই। তাঁদের বিশিষ্ট জন নেই। রোগীদের পক্ষে আগে কথা বলেছেন জুনিয়র ডাক্তাররা, নানা সময়ে গড়ে ওঠা তাঁদের সংগঠন।পুরনো কাগজপত্রে তার প্রমাণ রয়ে গিয়েছে। এখনো বলতে
হবে তাঁদেরই। অন্য কোনও পথ নেই।
জুনিয়র ডাক্তাররা একবার ভেবে দেখুন এমন কাজে নামলেই দরিদ্রশ্রেণির রোগীদের ‘দুর্বৃত্ত পরিজন’রা ‘মেধাবী’ ডাক্তারদের গায়ে হাত তুলবেন না। হাতে হাত ধরবেন।
দু’জন ‘প্রতিপক্ষ’ এক ‘পক্ষ’ হয়ে উঠবেন। এই দু’টি ‘পক্ষ’ই আসল ‘প্রতিপক্ষ’-কে খুঁজে পাবেন, বুঝতে পারবেন, প্রতিরোধ করতে পারবেন। একসাথে।
লেখক শুভেন্দু দাশগুপ্ত গণআন্দোলনের কর্মী ।
Cover Image : Junior Doctors running a parallel OPD during their movement in the early eighties. Image source : Subhendu Dasgupta.
Don’t you worry. Govt. and doctors know well how to manage. Leave them alone to have peace in health front. Thanks.