প্রাপ্য সম্মান, আর্থিক নিরাপত্তা আজও অধরা গৃহশ্রমিকদের


  • June 17, 2019
  • (0 Comments)
  • 1331 Views

আর্ন্তজাতিক শ্রম সংগঠন ২০১১ সালে গৃহপরিচারিকা/পরিচারকদের কাজকে শ্রমিকের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য কনভেনশন ১৮৯ প্রকাশ করে এবং ১৬ জুন তারিখটিকে আর্ন্তজাতিক গৃহশ্রমিক দিবস হিসাবে বিশ্বজুড়ে পালন করতে শুরু করে এবং তাদের কাজের জায়গায় সুষ্ঠু, সঠিক, সম্মানজনক পরিবেশ তৈরির ডাক দেয়। গৃহশ্রমিকদের কাজের জায়গায় বৈষম্যের কথা লিখছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

 

সন্ধ্যা প্রামাণিক বলছিলেন কাজের জায়গায় বৈষম্যের কথা। জল চাইলে নিয়োগকারী বলতেন মুখ হাঁ করতে, জল ঢেলে দিতেন, জলের পাত্র ছোঁয়া নিষেধ ছিল, যদি কখনও কিছু খেতে দিতেন হাত পাততে বলে উঁচু করে দিয়ে দিতেন। এই অসম্মান এক সময়ে মেনে নিতে না পেরে সন্ধ্যা বলেই ফেলেছিলেন, “দিদি মরে গেলে তো তুমি, আমি সব এক জায়গায় যাব, তাহলে কেন আমার সঙ্গে এরকম কর?” উত্তর এসেছিল, “ঠিকই বলছিস, কিন্তু যতক্ষণ শ্বাস আছে, ততক্ষণ তো অন্যথা করতে পারব না।”

 

জানকী প্রামাণিক বলছিলেন শীতের ভোরে বৃষ্টিতে ভিজে কাজের জায়গায় পৌঁছেছিলেন। নিয়োগকারীর মা এক কাপ চা বানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু নিয়োগকারী তা দেখে চা’টি নিয়ে সটান ফেলে দেন। বয়স্কা মা সহানুভূতিশীল ছিলেন, মেয়ের আচরণের জন্য জানকীর কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন। জানকী বললেন, “আমি কিন্তু তারপর থেকে ওই বাড়িতে আর জলস্পর্শ পর্যন্ত করি না।”

 

বাসন্তী মাঝি, রাণু প্রামাণিক কাজ করে চলেছেন দীর্ঘ বহু বছর ধরে। অত্যধিক পরিশ্রম, খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম ইত্যাদি কারণে বয়স চল্লিশের কোঠাতে পৌঁছতেই আরথ্রারাইটিস, হজমের সমস্যার মতো অসুখ বাসা বেঁধেছে শরীরে। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন যেসব জায়গায়, সামান্য অসুস্থতা বা শরীর খারাপের জন্য কিছুদিন ছুটি নিলেই বিনা নোটিসে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিচ্ছেন। বেতনের টাকাও মেটাচ্ছেন না অনেক সময়ে।

 

সন্ধ্যা, জানকী, বাসন্তী, রাণু, কামিনী, রেণুকা, পুষ্পা, সুষমা, শান্তি — এঁদের ছাড়া কিন্তু মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত, আকাশছোঁয়া মাল্টিস্টোরিড থেকে সাধারণ গৃহস্থ বাড়ি, নিউক্লিয়ার বা যৌথ পরিবার – যেমনটাই হোক না কেন, অচল হয়ে পড়বে। হ্যাঁ, আরও অসংখ্য মানুষের মতোই এঁরা গৃহশ্রমিক। কিছুদিন আগে পর্যন্তও যাঁদের পরিচিতি ছিল গৃহপরিচারিকা, অবশ্য রোজকার কথ্য ভাষায় আমরা অন্য শব্দের সঙ্গেই পরিচিত, যাতে শব্দটির সনাতনী স্নেহ নয় বরং আধুনিক অসম্মানটাই বেশি চোখে পড়ত। কিন্তু এখন এই মানুষগুলির লড়াই শ্রমিকের স্বীকৃতির জন্য। কারণ একমাত্র তা হলেই কাজের জায়গায় তাঁদের বিভিন্ন দাবিদাওয়াগুলি সুরক্ষিত হবে।

 

আর্ন্তজাতিক শ্রম সংগঠন ২০১১ সালে গৃহপরিচারিকা/পরিচারকদের কাজকে শ্রমিকের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য কনভেনশন ১৮৯ প্রকাশ করেন এবং ১৬ জুন তারিখটিকে আর্ন্তজাতিক গৃহশ্রমিক দিবস হিসাবে বিশ্বজুড়ে পালন করতে শুরু করে এবং তাদের কাজের জায়গায় সুষ্ঠু, সঠিক, সম্মানজনক পরিবেশ তৈরির ডাক দেয়। এখনও পর্যন্ত বিশ্বের ২৫টি দেশে এই কনভেনশনটি গৃহীত হয়েছে। ভারতবর্ষে গৃহশ্রমিকদের জন্য একটি আইন তৈরির জন্য ২০১৭ সালে একটি বিল পেশ করা হয়েছে। আর্ন্তজাতিক শ্রম সংগঠনের কনভেনশন-এ যে বিষয়গুলির উল্লেখ রয়েছে – (১) কাজের জায়গায় সম্মানজনক পরিবেশ বজায় রাখতে হবে, (২) গৃহশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি থাকবে, (৩) তাদের দল তৈরি, জোট বাঁধা, ইউনিয়ন তৈরির অধিকার থাকবে, (৪) মালিক অর্থাৎ নিয়োগকারী ও শ্রমিকদের মধ্যে একটি চুক্তিপত্র থাকবে, (৫) নির্দিষ্ট ছুটি নির্ধারিত থাকবে, (৬) কাউকে যেন জোর করে গৃহশ্রমিকের কাজে নিয়োগ না করা হয়, (৬) গৃহশ্রমিক হিসাবে যেন শিশুশ্রমিক না থাকে, (৭) এক মাস অন্তর যেন বেতনের ব্যবস্থা থাকে, (৮) যৌন হেনস্থার মতো ঘটনা প্রতিরোধের যেন ব্যবস্থা থাকে ইত্যাদি।

 

একটু নজর করলেই বোঝা যায় এই উল্লিখিত বিষয়গুলির মধ্যে অধিকাংশই প্রতিদিন আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত গৃহশ্রমিকদের ক্ষেত্রে অনুপস্থিতই রয়ে যায়। কারণ সমাজ স্বীকৃত পেশাগুলির মধ্যে এখনও এই কাজকে যথেষ্ঠ সম্মানের চোখে দেখা হয় না। অথচ গৃহশ্রমিক রেণুকা সিং যেমন বললেন, “আমাদের মধ্যে ৯০% মহিলার সংসার, সন্তান নির্ভর করে আমাদের রোজগারের উপর। কারণ অধিকাংশের স্বামীরা নেশা করেন বা কোনও কাজই করেন না বা যেটুকু সামান্য রোজগার করেন তাও উড়িয়ে দেন।” অর্থাৎ কায়িক পরিশ্রমের এই কাজটি অধিকাংশ মহিলাই সংসার চালাতে বা সংসারে আরও কিছুটা স্বচ্ছলতা আনতে বেছে নিচ্ছেন। সুতরাং স্বেচ্ছায় যখন কেউ এই পেশায় আসছেন — এখন অনেক জায়গায় আবার তাদের কাজের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে — তখন আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে যেখানে কাজের বাজার সংকীর্ণ, সেখানে এই পেশাকে সম্মানজনক পেশার স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে বইকি।

 

তবে এর অন্য দিকটিও তো রয়েছে। যে মুহূর্তে শ্রমিকের স্বীকৃতি দেওয়া হবে তখনই সরকারের উপর অনেকটা দায়িত্ব এসে পড়বে। একে তো বাড়ির কাজ, গৃহস্থালির কাজ বলে এক ধরনের অবজ্ঞা রয়েইছে। তার উপর শ্রমিক বলে স্বীকার করে নিলে সামাজিক সুরক্ষা সহ আরও নানাবিধ সুবিধা ও দাবি-দাওয়ার দিকেও সরকারকে নজর দিতে হবে। সেই দায়িত্ব নিতে এখনও কোনও আগ্রহ প্রশাসনিক স্তরে দেখা যায়নি। যদিও বছর দুয়েক আগে পশ্চিমবঙ্গে গৃহশ্রমিকদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনরত একটি সংগঠন রাজ্য সরকারের কাছ থেকে ইউনিয়ন-এর স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। দেশের নানা প্রান্তেই সংগঠন তৈরি করে তারা অধিকার আদায়ের জন্য লড়ছেন। কয়েক’টি রাজ্যে এর সুবাদেই ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হতে পেরেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সামাজিক সুরক্ষা যোজনাতে যদি গৃহশ্রমিকরা নিজেদের অর্ন্তভুক্ত করান তাহলে ৬০বছর বয়স হলে তাঁরা মাসে ১৫০০ টাকা পেনশন পেতে পারেন। কিন্তু এক্ষেত্রে বাসন্তী মাঝির মতো গৃহশ্রমিকের প্রশ্ন, “আচ্ছা, আমরা অনেকেই তো ৪০ বা ৪৫ বছর বয়সের পর শারীরিক কারণে হয়তো কাজ করতে পারি না? আমরা কী এই পেনশন পাব?”

 

আলোচনা এগিয়ে নিয়ে গেলেই বোঝা যায় বৃদ্ধ বয়সে কর্মহীন হয়ে পড়া ও তারপর কী করে জীবন চলবে সেই নিয়ে তাঁরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকেন। কারণ অধিকাংশ মহিলার স্বামীই কর্মহীন, সন্তানদের ভরসাতেও তাঁরা থাকতে পারেন না। যতক্ষণ শারীরিক পরিশ্রমের ক্ষমতা থাকে ততক্ষণ গৃহশ্রমিক শিখা সরকারের কথা অনুযায়ী, “শরীর যতক্ষণ চলবে ততক্ষণ খাটব। কিন্তু বুড়ো বয়সে আমাদের কীভাবে চলবে তা যেন সরকার একটু ভাবে।” প্রৌঢ়া শিখার ছেলে মারা গেছেন, পুত্রধবূকে নিয়ে তিনি থাকেন। নাতি ছোট বলে সেই পুত্রবধূরও কাজে বেরোতে সমস্যা হয়। তাই এইরকম গৃহশ্রমিকের কাজে বেরোনো মহিলাদের  শিশুসন্তানদের রাখার জন্য কোনও ব্যবস্থার কথাও তিনি ও আরও অনেকেরই মনের কথা।

 

সময়ের সঙ্গেই বদলাচ্ছে গৃহশ্রমিকদের নিয়োগের পদ্ধতিও। সরাসরি নিয়োগ ছাড়াও এখন ব্যাঙের ছাতার মতো সর্বত্র গজিয়ে উঠেছে ‘সেন্টার’ যাদের মাধ্যমে আয়া ও গৃহশ্রমিকদের নিয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু শান্তি মন্ডল, রীনা বড়ুয়া, দীপা মাঝির মতো অনেকেরই অভিযোগ সেন্টার থেকে ঘণ্টায় টাকা বেঁধে দেওয়ায় তাঁদের কম মজুরিতে অত্যধিক পরিশ্রম ও নিয়োগের সময় যা বলা হয় তার থেকে অতিরিক্ত কাজ করিয়ে নেওয়া হয়। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে  সেন্টারকে দেয় অংশ, যাতায়াত ভাড়া, ছুটি করলে কাটা যাওয়া টাকা সব মিলিয়ে মাসের শেষে যে টাকাটা তাঁরা হাতে পান, তা এসে পৌঁছায় যৎসামান্যতে। এর ফলে পরিশ্রম মাত্রা ছাড়ালেও বেশি টাকা রোজগারের জন্য তাঁরা অনেক বাড়িতে কাজ ধরতে বাধ্য হন।

 

গ্রাম থেকে অনেকেই এখন শহরে এসে রোজগারের চেষ্টায় এই পেশাকেই বেছে নিচ্ছেন। তাঁদের সমব্যথী হয়েও অনেক গৃহশ্রমিকেরই দাবি নিজেদের মধ্যে মাসিক বেতন বা মজুরি নিয়ে একটা সমঝোতা থাকা দরকার। সকলেই দিনের শেষে সংসার চালাতেই কাজ করছেন, ফলে অতিরিক্ত কম বেতনে কেউ কাজে রাজি হয়ে গেলে বেতনের ক্ষেত্রে দরকষাকষির জায়গাটিই কিন্তু আদপে নষ্ট হচ্ছে। এই সুযোগটি নিচ্ছেন নিয়োগকারীরা। কম বেতনে কেউ রাজি হলে দীর্ঘদিনের গৃহশ্রমিককেও বিনা নোটিসে, কখনও বিনা বা সামান্য অজুহাতে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিচ্ছেন। বিশেষত পুজোর আগে বোনাস না দিয়ে ছাড়িয়ে দেওয়ার উদাহরণ রয়েছে প্রচুর। হয় ন্যূনতম মজুরি বেঁধে দেওয়া, নতুবা গৃহস্থালির প্রতিটি কাজের জন্য আলাদা মজুরি ঠিক করে একটি গড় মজুরি নির্ধারণের দাবি জানালেন অনেকেই।

 

গৃহশ্রমিক রেণুকা সিং খুব স্পষ্টভাবে বললেন নির্দিষ্ট কতগুলি দাবির কথা – (১) মাসে ৪টি ছুটি, (২) পুজোয় বোনাস, (৩) বছরে একবার বেতন বৃদ্ধি, (৩) নিয়োগকারী ও শ্রমিকের মধ্যে একটি চুক্তিপত্র, যাতে কোনও পক্ষই বিনা নোটিসে কাজ ছাড়াতে বা ছাড়তে না পারেন ও গৃহশ্রমিকদের কাজের জায়গায় নিরাপত্তা থাকে। তিনি আরও জানালেন বহু মহিলাই কাজের জন্য শহরে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন, তাদের জন্য সরকার কম খরচে আবাসনের ব্যবস্থা করলেও ভালো হয়। দীপা মাঝি-ই যেমন এক বাড়িতে ১২ ঘণ্টা কাজ করেন ৬০০০ টাকা মাসিক বেতনে, যদিও রোগী দেখার কাজ, কিন্তু সংসারের সমস্ত কাজই সামলাতে হয় সঙ্গে। তাঁর স্বামী চেন্নাইতে রঙমিস্ত্রির কাজ করেন, সন্তান থাকে ওড়িশায় ঠাকুর্দা-ঠাকুমার কাছে। দীপা ১৬০০ টাকা ভাড়ায় কলকাতায় থাকেন, সঙ্গে বিদ্যুতের বিলের খরচ আলাদা।

 

এ বছরের আর্ন্তজাতিক গৃহশ্রমিক দিবসের আগে গৃহশ্রমিকদের অধিকার আন্দোলন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কাজ করা সংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চ গৃহশ্রমিক অধিকার অভিযানের পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রী ও শ্রমমন্ত্রীকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে যেখানে দাবি জানানো হয়েছে ন্যূনতম মজুরির তালিকায় গৃহশ্রমিকদের নাম নথিভুক্ত করার, প্রত্যেক গৃহশ্রমিককে শ্রমিক কার্ড দেওয়ার, শ্রমিক-মালিক-সরকার পক্ষকে নিয়ে একটি বোর্ড তৈরি করা।

 

পশ্চিমবঙ্গে কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে গৃহশ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে ‘পরিচিতি’। এই দিনটি উপলক্ষ্যে আয়োজিত তাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ‘পরিচিতি’র বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলা গৃহশ্রমিকদের সমাধান দলের সদস্যরা ও তাদের সঙ্গে কাজ করা ভলেন্টিয়ার-রাও। তেমনি একজন টুম্পা মান্না জানালেন, গৃহশ্রমিকদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন সবচেয়ে বেশি বাধা আসে নিয়োগকারীদের কাছ থেকেই। তারাই এদের জোট বাঁধতে বাধা দেন, বলেন এধরনের উদ্যোগে যুক্ত না হতে। তবে এটাও ঠিক এ ধরনের দীর্ঘ আন্দোলনের ফলেই অন্তত ছুটির ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও বদল আনা সম্ভব হয়েছে।

 

এই অনুষ্ঠানেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারে ডেপুটি লেবার কমিশনার হিসাবে কর্মরত ডঃ কিংশুক সরকার আহমেদাবাদ ও কলকাতায় করা গৃহশ্রমিকদের উপর একটি সমীক্ষার তথ্যও তুলে ধরেন। তিনি বেশ কিছু জরুরি কথা তুলে ধরেন। যেমন,  (১) নির্দিষ্ট বেতনে কতটা কাজ করা হবে সেক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনা, (২) আহমেদাবাদে কম টাকায় কাজ না করার যৌথ মানসিকতা আছে, কলকাতায় যেটির অভাব আছে, (৩) গৃহশ্রমিকদের নিজেদের কাজের বিষয়ে হীনমন্যতা কমিয়ে এটিকে অন্য যেকোনও পেশার মতোই সম্মানের জায়গায় দেখতে হবে, যাতে বেতন নিয়ে দর কষাকষি সঠিকভাবে করা যায়, (৪) গৃহশ্রমিকদের জন্য জাতীয় পলিসি, তাদের জন্য বোর্ড তৈরি করা নিয়ে আলোচনা চালু রাখা। সমস্যা হিসাবে তিনি বলেন অনেক বাড়িতেই বেতন কমিয়ে অন্য কিছু সুবিধা যোগ করে দেওয়া, ছুটি দিলেও তার বদলে অন্যদিন অতিরিক্ত কাজ করিয়ে নেওয়া, অসুস্থাজনিত ছুটি না থাকা, কাজের মাঝে বিশ্রামের ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদির কথা। একমাত্র আইন আসলেই এগুলির পরিবর্তন সম্ভব। আবার আইন হলে নিয়োগকারী ও গৃহশ্রমিকের মধ্যে যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থাকে তা কতটা থাকবে তা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়। একটি উল্লেখ্য বিষয় হল, বর্তমান বহু আবাসনেও গৃহশ্রমিকদের কাজে নিয়োগের আগে পরিচয় পত্র নেওয়া, তা পুলিশের কাছে জমা দেওয়া, আবাসনে ঢোকা-বেরোনোর জন্য কার্ড ইত্যাদি রয়েছে। এগুলি সবই নিয়োগকারীর সুরক্ষার কথা চিন্তা করে ও গৃহশ্রমিকদের উপর একটি সন্দেহের চিহ্ন রেখে। অন্যদিকে নিয়োগকারীদের কোনও পরিচয়পত্র বা গৃহশ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় কোনও নথিই কিন্তু থাকে না। আচমকা কাজ ছাড়িয়ে দেওয়া বা যৌন হেনস্থার মতো ঘটনায় তাঁরা কিন্তু অসহায়, অসুরক্ষিতই থাকেন। এই বিষয়টির উল্লেখ করে তাঁরাও নিয়োগকারীদের তরফ থেকে পরিচয়পত্রের দাবি জানান।

 

‘পরিচিতি’র পক্ষ থেকে অঞ্চিতা ঘটকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম নিয়োগকারীদের সঙ্গে কোনওরকম আলোচনার কথা ভবিষ্যতে তাঁরা ভাবছেন  কি না? তিনি জানালেন, এই ধরনের ইচ্ছা ভবিষ্যতে তাঁদের অবশ্যই রয়েছে। তার পরিকল্পনা ধীরে ধীরে শুরু করছেন। কারণ এক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে। দু’তরফের মধ্যেই আলাপ-আলোচনায় যাতে স্বচ্ছতা আসে দেখা দরকার। নিয়োগাকারীদের বক্তব্য শোনাও প্রয়োজন। তবে গৃহশ্রমিকদের সংগঠিত করাটা খুবই প্রয়োজনীয়। আসলে যেকোনও পেশাতেই বিশেষত গৃহশ্রমের মতো পেশা যেখানে নিয়োগকারী ও নিযুক্তের মধ্যে ব্যবধান অনেকটাই নানাভাবে কমে আসে, সেখানে মানবিকতা থাকাটা জরুরি হয়ে পড়ে। মাঝবয়সী ভক্তি মিস্ত্রির স্বামী, ছেলে কেউই কোনও কাজ করেন না। তিনি ২৯ বছর একটি বাড়িতে কাজ করে এসেছেন, কাজ শুরু করেছিলেন ১৫০-২০০ টাকা বেতনে যা শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছিল ২২০০ টাকায়। তিন দিন কামাই করা তাঁকে তৎক্ষণাৎ কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। “আমি রান্নাঘরে জল খেতে ঢুকেছিলাম ধাক্কা মেরে বের করে দিল, মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল,” চোখের জল সামলে নেন ভক্তি।

 

পেশা যাই হোক, সম্মান প্রত্যেক মানুষেরই প্রাপ্য, অধিকার। হয়তো কাজের জায়গায় অনুপস্থিতি অসুবিধা তৈরি করে। কিন্তু তার পরিণাম বিনা নোটিসে ছাঁটাই বা অপমানজনক ব্যবহার কোনও অবস্থাতেই হতে পারে না। গৃহশ্রমিকদের প্রতিদিনের সামাজিক অবস্থানে নিয়োগকারীরা সেটা যেন ভুলে না যান।

 

সুদর্শনা চক্রবর্তী সাংবাদিক এবং ডকুমেন্টারি নির্মাতা। ছবির সুত্রঃ লেখক। 

 

Share this
Leave a Comment