হাসপাতালে কঠিন নিরাপত্তা ব্যবস্থা, পুলিশ বসানো, হাসপাতালে ঢোকা নিয়ে, কার্ড নিয়ে কড়াকড়ি করা এমন সব প্রস্তাবের কথা বলায় ‘রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ’-এর কথাটা সামনে চলে আসে। তাতে জুনিয়র ডাক্তাররা হয়তো আরাম বোধ করবেন। কিন্তু দরিদ্র শ্রেণীর অসুস্থ মানুষের অসহায়তার সমাধান কি হবে? লিখেছেন শুভেন্দু দাশগুপ্ত।
ডাক্তার আন্দোলন চলছে।
আন্দোলন নিয়ে নানা খবর ছাপা হচ্ছে কাগজে, নানা মত শোনা যাচ্ছে টেলিভিশনে, অন্য অন্য মাধ্যমে। বিশিষ্টজনেরা পথে হাঁটছেন।
সবটাই হয়তো ঠিক। কিন্তু আরও গভীরে গিয়ে ভাবার দরকার, কাজ করা দরকার। যাঁরা ডাক্তারদের মেরেছেন, তাঁরা অন্যায় করেছেন। কোনও কিছুর প্রতিবাদ ‘মারা’ নয়।
ডাক্তারদের আন্দোলন এই প্রথম নয়। আমাদের বন্ধু ডাক্তাররাও নানা সময়ে আন্দোলন করেছেন। সেই সব আন্দোলনে আমরাও জড়িয়ে ছিলাম। সেই আন্দোলনে রোগীদের বিষয়, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার বিষয়, সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, চিকিৎসার সাথে সম্পর্ক যুক্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, যেমন পানীয় জল, শৌচাগার, পুষ্টিকর খাবার এমন সব নানা সংযুক্ত বিষয়ের কথা উঠতো।
একবারের কথা বলা যাক। একজন রোগীকে একের পর এক সরকারি হাসপাতালগুলিতে ভর্তি করতে গিয়ে ব্যর্থ হবার পর কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিচারালয়ে গিয়ে রোগীদের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হবার অধিকার নিয়ে আবেদন জানায়। আবেদন গ্রাহ্য হয়।সরকারি হাসপাতালে একজন রোগীর ভর্তি হবার অধিকার স্বীকৃত হয়। কিন্তু তা কাজে পরিণত হয় না। রোগীদের, বিশেষত গরিব রোগীদের কোনও ‘অধিকার’ নেই।
আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ দরিদ্র। এটা তথ্য দিয়ে প্রমাণ করা যায়, কিন্তু কেউ তা নিয়ে প্রশ্ন করেন না। এবং দরিদ্র বলেই অসুস্থ, এটা সম্পর্কযুক্ত। এখন অন্য একটা সম্পর্কযুক্ত হয়েছে দরিদ্র বলেই অসুস্থ এবং অসুস্থতার জন্যই আরও দরিদ্র। ডাক্তার দেখানোর খরচ, নানা পরীক্ষার খরচ, ওষুধের দাম বেড়েই চলেছে। সরকারি মদত কমেই চলেছে। অন্য অন্য সব দরকারি পরিষেবার মতো সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবায় অব্যবস্থায় বেসরকারি পুঁজির চিকিৎসাব্যবস্থা, হাসপাতাল বেড়েই চলেছে। মধ্যবিত্তরা কোনও রকমে ধারদেনা করে যেতে পারলেও দরিদ্র শ্রেণির পক্ষে তা অসম্ভব। নিরুপায়ের মতো দরিদ্র শ্রেণির মানুষরা তাই প্রাণপণে আঁকড়ে ধরছেন সরকারি হাসপাতাল। বাঁচার জন্য ভরসা করছেন সরকারি হাসপাতাল। আঁকড়ে ধরছেন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসায় সামনে থাকা জুনিয়র ডাক্তারদের। দূর দূর থেকে হাসপাতালে আসছেন, মাটিতে শুয়ে থাকছেন, পরীক্ষা আর ওষুধের জন্য ছোটাছুটি করছেন, আশা রাখছেন, নিরাশ হচ্ছেন, মন খারাপ হচ্ছে, রাগ হচ্ছে, ‘ক্ষোভ’ জন্মানোর অবস্থা তৈরি হচ্ছে, যা আমাদের সবারই হয় নানা সময়ে নানা কারণে।
আমাদের আবেদন, সরকারি হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তার বন্ধুরা নিজেরা বসুন, সরকারি হাসপাতাল, সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা, দূর দূর জায়গা থেকে আসা রোগীদের অবস্থা, দরিদ্র শ্রেণির রোগীদের অবস্থা, হাসপাতাল চত্বরে রোগীদের ও রোগীদের সঙ্গে আসা স্বজনদের প্রাপ্য ব্যবস্থা, তাদের প্রত্যাশা এমন সব বিষয় জানার চেষ্টা করুন, সমীক্ষা করুন, সমীক্ষার ফল নিয়ে আলোচনা করুন, প্রতিবিধানের উপায় বলুন। জুনিয়র ডাক্তাররাই সবচেয়ে ভালো পারবেন। নয়তো হাসপাতালে কঠিন নিরাপত্তা ব্যবস্থা, পুলিশ বসানো, হাসপাতালে ঢোকা নিয়ে, কার্ড নিয়ে কড়াকড়ি করা এমন সব প্রস্তাবের কথা বলায় ‘রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ’-এর কথাটা সামনে চলে আসে। তাতে জুনিয়র ডাক্তাররা হয়তো আরাম বোধ করবেন। কিন্তু দরিদ্র শ্রেণির অসুস্থ মানুষের অসহায়তার সমাধান কি হবে?
অনেককাল আগে আমরা ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী’ পত্রিকার তরফে তখনকার অবস্থায় ‘রোগীদের অধিকার’ বানিয়ে লিখে নানা চিকিৎসক সংগঠনের মত চেয়ে পাঠিয়েছিলাম, কোনও চিকিৎসক সংগঠন মত দেননি। আজকে যাঁরা আন্দোলনে আছেন তাঁরা দুটো অধিকার বানাতে পারেন। ‘জুনিয়র ডাক্তারদের অধিকার’ আর তার সাথে মিলিয়েই ‘দরিদ্র রোগীদের অধিকার’।
রোগীরাও জানলেন, জুনিয়র ডাক্তাররাও জানলেন, দরিদ্র শ্রেণির রোগীরা জুনিয়র ডাক্তারদের কাছে কতটা চাইতে পারেন, জুনিয়র ডাক্তাররা তাঁদের কতটা দিতে পারেন।দু’দল মিলে সরকারকে বলতে পারেন সরকারকে কী কী দিতে হবে। সবটা মিলে এমন একটা ব্যবস্থা, পরিবেশ, যাতে দরিদ্র রোগীরা বাঁচবেন, জুনিয়র ডাক্তাররা নিশ্চিন্তে মন দিয়ে দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা করতে পারবেন।
এখন সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা এই দুজনেরই বিষয়। অথচ এখন এই সময়ে অনেকে আসছেন, ঢুকছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা জুনিয়র ডাক্তার আর গরিব রোগীদের বিষয়। আর তাতে সামাজিক অবস্থানের বিচারে প্রাথমিক দায়িত্ব জুনিয়র ডাক্তারদেরই। তাঁরা এই বিষয়ে কোনওরকম সহায়তা চাইলে আমরা তাঁদের কাছে যেতে পারি।
লেখক শুভেন্দু দাশগুপ্ত গণআন্দোলনের কর্মী ।