ভোট শেষ ১৯মে, চূড়ান্ত ফল বেরিয়েছে ২৩শে। চারদিনের মধ্যে বাঙালির, মানে বাঙালি বামপন্থার, অর্থে বামপন্থী মনন ও কাজকম্ম লাফঝাঁপের যে চেহারা-ধাঁচ বা ট্রোপের সঙ্গে আমাদের কমবেশি আকৈশোর পরিচিতি, সেই চিহ্নদুনিয়ায় উথালপাথাল তোলপাড় ঘটে গেল। লিখেছেন সৌমিত্র ঘোষ।
রাজ্যে, দেশে, ভোট শেষ হবার আগেই লেখাটা তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা। নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। ভালোই হয়েছে একদিকে। যে বিষয়গুলো ভোট-পরবর্তী সময়ে সাদা ও সরল হয়ে ধরা দিচ্ছে, তা নিয়ে নানান ধন্দ ছিল আগে। ভোটের পরে নতুন কিছু ধন্দ, খটকা জন্মাচ্ছে নিশ্চিত, কিন্তু অনেকগুলো ব্যাপার প্রাঞ্জল, তা নিয়ে পাঁচরকম প্যাচাল পাড়ার অবকাশ আর আছে বলে মনে হয়না। ভোটে কী হল, মানে কে কম, কে বেশি ভোট পেল, কোন বিধানসভার কোন বুথে কে এগিয়ে পিছিয়ে থাকল, সেইসব সংখ্যাতাত্বিক বিশ্লেষণ চাদ্দিকে বিস্তর হচ্ছে, আরো হবে, হতে থাকবে। সেকারণে তা নিয়ে লম্বা ফিরিস্তি দিয়েও লাভ নেই। এই লেখার উদ্দেশ্য ভিন্ন, সে প্রসঙ্গে আসা যাক।
ভোট, বামপন্থা ও চিহ্নভূত
ভোট শেষ, এক্সিট পোল আদির ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে ১৯মে, চূড়ান্ত ফল বেরিয়েছে ২৩শে। চারদিনের মধ্যে বাঙালির, মানে বাঙালি বামপন্থার, অর্থে বামপন্থী মনন ও কাজকম্ম লাফঝাঁপের যে চেহারা-ধাঁচ বা ট্রোপের সঙ্গে আমাদের কমবেশি আকৈশোর পরিচিতি, সেই চিহ্নদুনিয়ায় উথালপাথাল তোলপাড় ঘটে গেল। চিহ্নদুনিয়া বলা হচ্ছে কেননা নিছক চিহ্ন নয় এমন বাস্তব দুনিয়াটা আগেই দুমড়েমুচড়ে ভেঙেচুরে একাকার, মানে নিশ্চিহ্ন। দীর্ঘকালের অভ্যেস মোতাবেক চিহ্নগুলি জিয়ন্ত ছিল এমন ধরে নেওয়া হত, সে সুযোগও আর থাকছে এমন ঠাওর হয় না। না হোক। চিহ্ন না থাকলেও চিহ্নের ভূত আমাদের অনেকেরই আত্মার অন্তরে (কিম্বা অন্ত্রে) ফিসফিস করবে, নতুন আশায় আমরা বুক বাঁধব। পরাজয় ক্ষণস্থায়ী, জয় চিরকালীন (আমরা করব জয়), ফলে ভোটের ফল যা-ই বলুক, চিহ্ন দুনিয়ায় আমাদের, মানে, বাঙালির, বাঙালি বামপন্থার, অর্থে বামপন্থীমনন, কাজকম্ম লাফঝাঁপের যে চেহারা-ধাঁচ বা ট্রোপের সঙ্গে আমাদের কমবেশি আকৈশোর পরিচিতি, তা চিহ্ন না হোক চিহ্নভূত হিসেবে বিদ্যমান থাকবে (জিন্দাবাদ কী ন হন্যতে), ফলে আমরাও থাকব, এমন ভেবে নেওয়া যায়।
যায় কি? ভূত নিয়ে কারবার করার মুশকিল হচ্ছে, যে ভূত সে-ই অবস্থান্তরে রক্তখেকো পিশাচও বটে, তলে তলে ভূতবাদুড়ের মতো রক্ত চুষে লাট করে দিচ্ছেনা, কে বলতে পারে? ভূত ও চিহ্ন নিয়ে গজল্লা করছি বলে এমনটি ভাববেননা যে দেরিদাপন্থী এক কূট প্রতর্কের (বছর বিশেক আগে দেরিদা সাহেব মার্ক্স ও মার্ক্সবাদকে হালফিলের উত্তর আধুনিক নিওলিবারল বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে স্রেফ হানাদারি প্রেত/প্রেতচিহ্ন বানিয়ে ছেড়ে ছিলেন) অবতারণা হচ্ছে। বামপন্থার সঙ্গে ভূত ও ভূততত্ত্বের ঐতিহাসিক যোগাযোগ — সেই পুরাকালে স্বয়ং মার্ক্স বলেছিলেন ভবিষ্যতের ঘাড়ে চেপে বসে আছে অতীতের ভূত। মার্ক্সপন্থী যে বিশ্বদর্শন এতাবৎকালের যাবতীয় বামপন্থার আপাত উৎস, সেখানে ভূত তাড়ানোর অব্যর্থ নিদান আছে। সে চর্চায় কালক্ষেপ না করে, মোদ্দা কথা, অর্থাৎ ভোটে ফিরি।
২০১৯-এর লোক সভা ভোট, যদ্বারা বামপন্থা স্রেফ কটকটে গেরুয়া রোদে এক ফোঁটা ফিকে লাল জলের মতো ভুস করে উবে যায়, অন্তত এই বাংলায়, যা ঐতিহাসিক ভাবে লাল, দুর্জয় ঘাঁটি ও দুর্বৃত্তনাশক। বাংলার বাইরে যে কুচি ভূখণ্ডে বাঙালির সরব ভোট-উপস্থিতি ছিল, যথা ত্রিপুরা, সেখান থেকে বামভূত ঝেড়ে বের করে দেওয়া হয়েছে বছর খানেক হল। এবার বাংলা, যা পর্যায়ক্রমে প্রতিবাদের, লড়াইয়ের, প্রতিরোধের, ব্যারিকেডের ও শেষমেশ পরিবর্তনের, যেখানে তেভাগা কাকদ্বীপ খাদ্যআন্দোলন, নকশালবাড়ি বিপ্লব, ৩৪ বছরের বাম রাজত্বের বিশ্বরেকর্ড ও সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম লালগড় এবং যার সংস্কৃতির এক সে বড়কর এক ইট কি ডিএনএ নির্মিত হয় নিখাদ বামপন্থায়, সেখানে বাম ভোট নেমে দাঁড়াল ৮ শতাংশের কমে, শুধু তাই নয়, উগ্র বাম বিরোধী ভাগওয়া চাড্ডিদের ভোট বেড়ে দাঁড়ালো চল্লিশ শতাংশে। এই চমৎকার (অথবা বিপর্যয়) কী করে সম্ভব হল?
যে ব্যাখ্যাগুলো ঘোরাফেরা করছে তা সবাই কম বেশি ইতিমধ্যে জানেন, বিস্তারিত বলার দরকার নেই। মোদ্দায়, চার-পাঁচটি কারণ তুলে ধরা হচ্ছে। এক, বাংলার প্রধান বামপন্থীদল সিপিআইএম-এর সাংগঠনিক দুর্বলতা। দুই, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের অত্যাচারে তাড়িত হয়ে দলে দলে বামসমর্থক ভোটারের ভাগওয়া পার্টির দিকে ঢলে পড়া — হয় প্রতিশোধস্পৃহায় (তৃণমূল, দ্যাখ কেমন লাগে) কিম্বা নিতান্তই চামড়া বাঁচানোর চেষ্টায় (তৃণমূল যেখানে যেখানে হেরেছে সিপিআইএম-এর অফিস ইত্যাদি আবার খুলছে)। তিন, সংখ্যালঘু ভোটারদের বামসঙ্গ ত্যাগ করা। এর উল্টোপিঠেই, চার, সংখ্যাগুরু হিন্দু ভোটারদের স্বেচ্ছাবৃত গেরুয়ায়ণ —যাঁরা বামপন্থীদের ভোট দিতেন, তাঁরা ভারতীয় জনতা পার্টির ওরা-মুসলমান-আমরা-হিন্দু তত্ত্বে বিশ্বাস করে শিবির বদলে ফেলেছেন। পাঁচ, মোদী, ভারতীয় জাতি রাষ্ট্রবাদ, পাকিস্তান, পুলওয়ামা ও ঘরমে-ঘুসকে-মারা-হ্যায়। আর একটি ব্যাখ্যাও আছে, ইভিএম-এর যান্ত্রিক কারচুপি, যদিও সেটা প্রকাশ্যে বিশেষ কেউ বলছেন না।
ভোট, রাষ্ট্র্ববাদী বামপন্থা ও সমাজ
উপরোক্ত সবকটা কারণই কমবেশি ঠিক, ধরে নেওয়া যায়। ভোট থাকে, ভোট যায়, পদ্মপত্রে নীর যথা ভোট নিতান্তই, বস্তুত উদ্বায়ী, চিরকাল তা একজায়গায় জমে ক্ষীর হয়ে থাকবে, এমন ভাববার কোনও কারণ নেই। সমস্যাটা হচ্ছে, ভোট নির্ভর করে আমাদের চারপাশের সমাজ জীবন বদলায়, বদলাতে থাকে। অন্তত সেরকমটাই মনে হতে থাকে সর্বক্ষণ। ভোট দিয়ে সমাজ বদলানো যায় কি না, গেলেও সে বদল কদ্দিন স্থায়ী, সে সব প্রশ্ন বলতে গেলে সৃষ্টির আদিকাল থেকে অদ্যাবধি আছে, থাকবে। যা বলবার কথা, তা হচ্ছে, সমাজ, সমাজ-বদল ও বিশেষত বামপন্থার সামাজিক প্রকল্পটিকে ভোট, ভোটের ফলাফল ইত্যাদি থেকে পৃথক করে দেখা, বোঝা দরকার। না দেখলে আমাদের সমাজ দর্শন বুথ ওয়ারি ভোটফলের গোলমেলে অঙ্কের চৌহদ্দিতে আটকা পড়বে, টিভির পর্দা, বড়ো খবরের কাগজ ও সোশ্যাল মিডিয়ায় যে অঙ্ক এখন বছরভর মোদি হাওয়ার মতোই সহজলভ্য, হয়তো বা শেষহীন। ভোট/ভোটের অঙ্ক একেবারে বাদ দিয়ে নয়, কিন্তু ভোট ছাড়াও সমাজটা কীরকম, তা বোঝা দরকার। আমাদের এই বাম-লাল-সবুজ-গেরুয়া বাংলায় সেকাজটা নেহাত অসম্ভব নাহলেও কঠিন। কী গ্রামে কী শহরে ভোটনির্ভর রাজনীতির যে খাসদখল আমাদের সমাজজীবনে তৈরি হয়েছে গত কয়েক দশক ধরে, তার সমতুল কিছুর সন্ধান ভারতবর্ষের অন্যত্র খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ১৯৭৮-এ পার্টির নামে পঞ্চায়েত নির্বাচন শুরু হওয়া ইস্তক এই দখলদারি বাড়তে বাড়তে গেছে, শুরুতে যা সমাজজীবনে কমিউনিস্ট পার্টির আধিপত্য বাড়ানোর প্রকল্প ছিল, তা ক্রমে হয়ে দাঁড়িয়েছে পার্টিকর্মী ও নেতাদের জীবিকানির্বাহ ও ধনী হবার প্রক্রিয়ামাত্র। যেহেতু কী পঞ্চায়েত কী পুরসভা বিধানসভা, লোকসভা, এ রাজ্যে ভোট হচ্ছে সমাজের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টাকে সমাজগ্রাহ্য করে তোলার প্রধান উপায়, প্রাত্যহিক সমাজজীবনে ভোট/ভোটপ্রক্রিয়ার গুরুত্ব যত বেড়েছে, সমাজে তত বেশি করে প্রোথিত হয়েছে রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রক্ষমতার শিকড়বাকড়। ভোটে না-গেলে, না-জিতলে, নিদেনপক্ষে গ্রাম পঞ্চায়েত কী পুরসভায় ক্ষমতায় না-এলে সমাজের কাছে আপনি মানে আপনার রাজনীতি ফালতু। সামাজিক কাজের, সমাজ বদলের কথা আপনার কাছ থেকে লোকে শুনবে না। অর্থাৎ, সমাজ বিষয়টা ভোট ওরফে পার্টি মারফত পুনর্গঠিত হচ্ছে, ফলে রাষ্ট্র / রাষ্ট্র ক্ষমতার সঙ্গে সামাজিক ক্ষমতা সমার্থক হয়ে উঠছে। যেহেতু সমাজ কোনও জায়গাতেই সমসত্ব নয়, একটাই সমাজও নয়, বাস্তবে যে রাষ্ট্র/সমাজ এক হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা একই ভাবে সর্বত্র ঘটছে তা নয়। কিন্তু আধিপত্যের একটা পেশীভাষা বা জোরের ভাষা বা প্রকাশ থাকে, রাষ্ট্র মানে পুলিশ-পেয়াদা-আমলা-হাকিম, পার্টি মানে পার্টির দাদা-গুন্ডা-মন্ত্রী-সান্ত্রী। এ সবের একটা আপাত দৌরাত্ম্য এবং তান্ডব থাকে, তা পেরিয়ে সমাজ, নিছক সমাজ, যেখানে বহু বছর ধরে মানুষ একসঙ্গে থাকে, বাঁচে, ভালোবাসে, গান গায়, ঝগড়া করে, সেটাকে ঠাওর করা যায় না, কালক্রমে লোকে সেটাকে ভুলেও যায়। অর্থাৎ সমাজ নিজেকে নিজে ভুলে যাচ্ছে, মনে রাখছে রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও দাপাদাপিকে। বাংলায় রাষ্ট্র মানে মুখ্যত দল, পার্টি, যে যখন ক্ষমতায় থাকে সে। অন্যত্র সর্বত্র হয়তো অতটা নয়, আমলাসাহি ও পুলিসপেয়াদাও পর্যাপ্ত ক্ষমতার অধিকারি। মোদ্দায়, সমাজ থাকে অথচ থাকে না, থাকলেও তা রাষ্ট্রের পেটের ভিতরে কি নিতান্তই অনুগত।
এখন, এরকমটাই হবার কথা ছিল কি? রাষ্ট্র তো আদতে, যেমন দীর্ঘকাল আগে মার্ক্স বলেছিলেন, সমাজের শরীরে পরজীবী আগাছা মাত্র, তা কী করে, কোন জাদুমন্ত্রে সমাজকে অতিক্রম করে, নিজেই সমাজ হয়ে দাঁড়ায়, সমাজকে প্রতিস্থাপিত করে নিজের অপচ্ছায়া দিয়ে? যদিও এই খেলাটা বিশ্বজুড়ে চলছে আজকাল, তর্কের প্রয়োজনে এইখেনে বাংলার কেসটা আলাদা করে বোঝা দরকার। দরকার এই কারণে যে বাংলায় এই উলটমাদারির দৃশ্যমান শুরুয়াত বামপন্থীদের হাত ধরে। অথচ বামপন্থীরা যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিয়ে রাষ্ট্রে গেলেন, তা নিছক ভোট মারফত নির্মিত হয়েছিল, এমন আদৌ নয়। উল্টে, সেই ক্ষমতার উৎসে নিরন্তর, লাগাতার এক ধরণের রাষ্ট্রবিরোধিতা ছিল। তেভাগা থেকে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম পর্যন্ত সামাজিক আন্দোলনের যে প্রবাহকে বাংলার বামপন্থীরা হামেহাল স্মরণ করেন, তা রাষ্ট্রের, রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন দলের আধিপত্যের বিরুদ্ধে সচেতন গণবিদ্রোহ ভিন্ন আর কী? বামপন্থা মানেই তো তাই, রাষ্ট্রের ও রাষ্ট্রক্ষমতার শরিক শাসকদের আধিপত্যের প্রাচীরে ফাটলের পর ফাটল তৈরি করা, করতে থাকা? সমাজে, সামাজিক ক্ষমতাসম্পর্কে বদল আসবে কী করে যদি না এই কাজটা করা যায়? ১৯৬৭-তে নকশালবাড়ি আন্দোলন হচ্ছে, ভোট দিয়ে, ভোটে জিতে, সমাজ বদলানো যায়না এই স্লোগান দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি ভাঙছে পাকাপাকিভাবে ১৯৬৯-এ, যুক্তফ্রন্ট সরকার তৈরি হচ্ছে কমিউনিস্টদের একাংশের উদ্যোগে, কিন্তু তার পরেও বামপন্থীরা, এমনকী যারা ভোটে জিতে সরকার গড়ায় বিশ্বাস করছিলেন, রাষ্ট্রবিরোধিতার এই বুনিয়াদি কাজটা ছেড়ে দেননি। ১৯৭৪-এ কৃষক আন্দোলন ছাত্র আন্দোলন হচ্ছে বাংলা জুড়ে, জরুরি অবস্থা জারি হবার পরেও নিঃশব্দে সংগঠন বিস্তার করছেন বামপন্থীরা। ১৯৭৭-এ তাঁরা রাজ্যে ক্ষমতায়, ১৯৮২ নাগাদ বোঝা গেল ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারটা আর সাময়িক নড়বড়ে নয়, বরং বন্দোবস্তটি টেঁকসই, সামাজিক বিরোধিতা ও প্রতিরোধ সংগঠিত করার কাজটা ধীরে ধীরে তাঁরা বন্ধ করে দিলেন। পুঁজি ও রাষ্ট্রের সঙ্গে যুগপৎ দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী লড়াই চালিয়ে যেসব ট্রেড ইউনিয়ন তৈরি হয়েছিল, তারা হয়ে দাঁড়াল মুখ্যত দালালির আখড়া, মধ্যসত্ত্বভোগী এক জাতীয় নেতাদের পয়সা খাবার কল। বর্গারেকর্ডের ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থা শিকড় গেঁড়ে বসার পর থেকে, জমি ও বর্ধিত কৃষিমজুরির আন্দোলন প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। শিক্ষক-ছাত্র-সরকারিকর্মচারী ইত্যাদির শহুরে আন্দোলন বন্ধ হল কেননা সরকারে বামপন্থীরা, আন্দোলন করলে তা নিজের সরকারের বিরুদ্ধে যায়। অর্থাৎ, সরকারে টিঁকে থাকার জন্য, ভোটে জেতার জন্য, মূলে রাষ্ট্রবিরোধী এমন সব সামাজিক আন্দোলনের প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেওয়া হল। সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে যে সব সংগঠন বামপন্থীরা দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তুলেছিলেন, তাদের চরিত্র বদলাল, পুরোনো ও নতুন, যে সব সংগঠনের সঙ্গে বামপন্থীরা যুক্ত ছিলেন, তা হয়ে দাঁড়াল আগাপাছতলা পার্টিশাসিত। এর আগেই রীতিমতো ঘোষণা করে সিপিআইএম দল পার্টির দরজা হাট করে খুলে দিয়েছিল, যার অর্থ কোনো রকম আন্দোলনের সঙ্গে কোনোদিন যুক্ত ছিলনা এমন বিস্তর জনতা হু-হু করে পার্টি ভরিয়ে দিল, নেতা মন্ত্রী ও হল। বাকিটা, অর্থাৎ কী করে বামপন্থী শাসনের সঙ্গে যাবতীয় সম্ভাব্য অসম্ভাব্য দুর্নীতি ও বজ্জাতি সমার্থক হয়ে দাঁড়াল, কী করেই বা বামপন্থীরা নিওলিবারল পুঁজির পক্ষে প্রকাশ্যে ওকালতি শুরু করলেন, তা ইতিহাস, এবং খুব পুরোনো ইতিহাস নয়।
বাম এবং বাম-বাম: আবার চিহ্নদুনিয়ায়
বাংলায় যা ঘটল, তা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিও বটে। রাষ্ট্রের অংশ হয়ে, রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে, রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে সমাজে বিপ্লবী বদল ঘটানোর চেষ্টা দেশে-বিদেশের বামপন্থীদের একটা অংশ গত সোয়াশো-দেড়শো বছর ধরে করছেন। যে ইতিহাসপর্বের মধ্যে আমরা আছি, তা পুঁজিতান্ত্রিক, যার অর্থ আমাদের বিভিন্ন সমাজব্যবস্থা বিবিধ ভিন্নতা সত্বেও প্রধানত পুঁজিতান্ত্রিক ক্ষমতাসম্পর্কের অধীন। সেই ব্যবস্থায় যে রাষ্ট্র তৈরি হয়, তা কী করে, কোন যুক্তিতে বামপন্থার পক্ষে কাজ করতে পারে, যদি মনে রাখি, মনে করি, বামপন্থা মানেই পুঁজিতন্ত্র ও তার অনুপূরক রাষ্ট্রের নিরবচ্ছিন্ন, নিরন্তর সামাজিক বিরোধিতা? ভোট দেওয়া বা ভোটে অংশ নেওয়াটা সেই বিরোধিতার অঙ্গ হতে পারে না, এমন নয়। কিন্তু ভোটে জিতে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল ? সে উদ্দেশ্যে সমাজকে পার্টির মধ্যে, এবং কালক্রমে রাষ্ট্রের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলা ? এটাকে কোন যুক্তিতে বামপন্থা বলে দাগানো, দাগানো শুধু নয়, বিশ্বাস করা, করতেই থাকা যায় ?
মুখ্যত ভোটকেন্দ্রিক হয়ে ওঠা, আদ্যন্ত গেঁজে যাওয়া, কখনোই, কদাচ বাম নয়, এমন এক রাষ্ট্রমুখী, রাষ্ট্র্ববাদী (স্টেটিস্ট অর্থে) ও পুঁজিতান্ত্রিক স্থিতাবস্থার সমর্থক রাজনীতি ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বামপন্থী প্রক্রিয়া বলে মানা যায়না। তাদের ভোট কমা না-কমা থেকে লাল বাংলা গেরুয়া হল বা ‘কমিউনিস্ট’রা সব ঝাঁকে ঝাঁকে হিন্দু হয়ে গেলেন, এমন সিদ্ধান্তে আসা নেহাতই নির্বোধ সরলিকরণ। যে ভূখণ্ডে কমিউনিস্ট দল ভোটে যাওয়া না-যাওয়া / সরকার করা না-করা নিয়ে আড়াআড়ি ভাগ হয়েছে, ভোট ও সামগ্রিক সংসদীয় ব্যবস্থার বিরোধিতা করে নতুন বিপ্লবী দল তৈরি হয়েছে, সেখানে সিপিআইএম এবং তার সহযোগী বাম দলেদের চরিত্র কার্যত কী, তা নিয়ে বামপন্থীদের মধ্যে নতুন সংশয় তৈরি হওয়ার কথা নয়, অন্তত যে বামপন্থীরা সিপিআইএমকে দীর্ঘদিন ধরে সংশোধনবাদী বলে চিহ্নিত করে আসছেন, তাঁদের মধ্যে তো নয়ই। অথচ তাই-ই ঘটছে। জাত-ধম্মো-কুল-গোত্র নির্বিশেষে যাবতীয় বিপ্লবী অ-সিপিএম বামপন্থীদের কাছে এবারের লোকসভা ভোটের ফলাফলটা বড়ো একটা ধাক্কা, সামলে উঠতে পারা যাবে কিনা সন্দেহ আছে।
এর কারণ খুঁজতে গেলে চিহ্ন ও চিহ্নদুনিয়ার যে কূটতর্ক দিয়ে শুরু করেছিলাম সেখানে ফিরতে হবে। চিহ্ন ব্যাপারটা আপত্তিকর নয়, চিহ্ন না-থাকলে ভাষা হয় না, ভাষা না-থাকলে সামাজিক যোগাযোগও গড়ে ওঠেনা। কিন্তু চিহ্ন মানে কী? ভাষাই বা কী? দীর্ঘকালের রাষ্ট্রবিরোধিতার সামাজিক অনুশীলন-অভ্যাস থেকে যে সব চিহ্ন অর্থবহ হয়ে উঠেছে, তা যদি পরিত্যক্ত হয়, চিহ্ন চিহ্ন থাকেনা। কোনও দলের নামের পাশে মার্ক্স, লেনিন, কমিউনিস্ট লেখা থাকলে বা তার ঝান্ডার রঙ লাল হলে ধরে নেওয়া যায় না, সে দল বামপন্থী। পাঁচ বছরে দুবার ব্রিগেড প্যারেড মাঠে লাখ লাখ লাল পতাকা দেখা গেলে কী অন্যত্র ঘটে যাওয়া লাল পতাকাচর্চিত এক মহতী শোভাযাত্রার ভিডিওছবি দেখে উত্তেজিত হলে এটা প্রমাণিত হয় না, সমাজজুড়ে বামপন্থার বুনিয়াদি কাজ চলছে, যা রাষ্ট্রবিরোধের, সমাজ বদলের, সাম্য প্রতিষ্ঠার। মুশকিলটা হচ্ছে যে, বামপন্থার যে জ্যান্ত সামাজিক প্রকল্প এক সময় এই বাংলায় আন্দোলনের পর আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে, তা বহুদিন যাবৎ সমাজবিচ্ছিন্ন, চিহ্ননির্ভর, ভাষাসর্বস্ব, সমাজে সে ঐতিহাসিক বামপন্থার শিকড় পর্যন্ত নেই। ষাটের সত্তরের ঝোড়ো সময়ে যে নকসালবাড়ি আন্দোলন সমাজমুক্তির ডাক দিয়েছিলো, তার উত্তরাধিকার থেকেও গত চল্লিশ বছরে সমাজে এমন কোনো নতুন বিরোধিতা এবং আন্দোলনের পরিসর নির্মিত হয়নি, যা স্থায়ী প্রভাব রেখে যেতে পারে। রাষ্ট্র ও পুঁজির, শাসকের ও শাসক দলের বিরোধিতায় যখন সমাজ বিস্ফারিত হয়েছে বারবার, সেই বিস্ফোরণ থেকে এ রাজ্যের তথাকথিত বিপ্লবীবাম, যা অ-সিপিআইএম, নিজেকে পুষ্ট করতে পারেনি। ২০০৬-৭ নাগাদ, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পরবর্তী সময়ে, এ বাংলায় রাষ্ট্র্ববাদী অ-বাম বামপন্থার বিপক্ষে, পুঁজিতান্ত্রিক উন্নয়নের ধারণার বিরুদ্ধে, পাড়ায় মহল্লায় স্বতঃস্ফূর্ত জনমত গড়ে উঠছিল। সেই জনমতকে সংহত করা তো গেলই না, তৃণমূল কংগ্রেসের মতো একটি পপুলিস্ট ও লুম্পেনপুষ্ট দল তা কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা দখল করল। ২০০৮ নাগাদ জঙ্গলমহল এলাকায় যে আদিবাসী-কুড়মি জনবিদ্রোহ দেখা দিল, মাওপন্থী কমিউনিস্ট দলের সর্বময় নিয়ন্ত্রণ সেই আন্দোলনকে নিয়ে গেল ব্যক্তিহত্যা ও সন্ত্রাসের সমাজবিচ্ছিন্ন আধিপত্যের পরিসরে। ফলে শক্তিশালী গণআন্দোলনের অস্তিত্ব সত্ত্বেও পুরো এলাকাটা চলে গেল পুলিশ আধাসামরিক বাহিনী ও তৃণমূলের কবলে, যাঁরা দুদিন আগে বিপ্লবী জনযুদ্ধ ও শ্রেণিশত্রু খতমে ব্যাপৃত ছিলেন, তাঁরাই রাতারাতি তৃণমূল হলেন, ইদানীং সম্ভবত গেরুয়া ঝান্ডাও হনুমানধ্বজাও তুলছেন।
অর্থাৎ চিহ্নদুনিয়ার বাইরে বামপন্থা আর জ্যান্ত থাকল না, অন্তত বাংলায়। এরজন্য শুধুমাত্র সংসদীয় সংশোধনবাদী বামদের গাল পেড়ে লাভ নেই। ২০১১ সালে সিপিআইএম যখন ক্ষমতাচ্যুত হল, সেসময় বিপ্লবী বামদের প্রায় সবকটি খণ্ড ভেবেছিলেন পার্টিটা ভাঙবে, এবং দলছুট সিপিএম কর্মীরা অন্য ‘বাম বিকল্প’ খুঁজবেন। তাঁদের মনে হয়েছিল দলটিতে বিস্তর পোটেনশিয়ল বিপ্লবী বিদ্যমান, ঠিক দল পেলেই ঢুকে পড়বেন। একবারও মনে হলনা, সিপিআইএম মায় তামাম সরকারি দলগুলি যাবতীয় নেতাক্যাডার সমেত উপায়হীনভাবে ভোটনির্ভর, তাঁদের গোটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাষ্ট্রবিরোধী বামপন্থার প্রকল্প থেকে আলোকবর্ষ দূরে চলে গেছে, ফেরা সম্ভব নয়। সিপিএম-সহ অন্য প্রাতিষ্ঠানিক বামদলে ভাঙন শুরু হলো ঠিকই, কিন্তু তা থেকে লাভবান হলো তৃণমূল বা বিজেপি। অন্যদিকে, সিপিএম ভাঙার প্রত্যাশায় বসে থেকে থেকে দিনমাসবছর গেল, বিপ্লবী বামেরা নতুন কোনও সামাজিক কাজ করলেন না, কাজের কথা সেভাবে ভাবলেনও না, আন্দোলন তো দূরস্থান। যে সবেধন নীলমণি আন্দোলনটি তৈরি হল ভাঙড়ে, খানিক দূর গিয়ে সেটা মুখ থুবড়ে পড়ল। অনেকগুলো সংগঠন একসঙ্গে কাজ করছিলেন, জমি কমিটির মধ্য দিয়ে প্রথাসিদ্ধ চিহ্নকচলানো ছাড়াই এক নতুন সামাজিক সংগঠন গড়ে উঠছে, রাষ্ট্র ও পুঁজি বিরোধিতার নতুন সামাজিক পরিসর তৈরি হচ্ছে, মনে হয়েছিল। কোথায় কী, জমি কমিটির নেতা কর্মীরা এখন একটি বিশেষ ভ্যানগার্ড পার্টির সদস্য, ভাঙড় থেকে তাঁরা নকশালবাড়ি যান, লাল সেলাম বলেন, লাল ঝান্ডা তোলেন, তাঁদের নামের আগে সম্মানসূচক কমরেড বসে। কিন্তু নতুন আন্দোলন হায়, হয় না, না নকশালবাড়িতে না ভাঙড়ে।
গণতন্ত্র, বাংলা, বাঙালিয়ানা ও বাম বাঙালি
এতক্ষণ যে প্রসঙ্গে আসা হয়নি, সবাই যা কমবেশি জানেন, সময়টা সত্যিই বড় খারাপ যাচ্ছে। পুঁজি বাড়তে বাড়তে নিয়ন্ত্রণবিহীন, রাষ্ট্রকে পুঁজি থেকে আলাদা করে বুঝে ওঠা যায়না, সমাজ থেকেও। যেসব বাস্তব অবস্থা ও পরিস্থিতি থেকে বিরোধিতার বামপন্থী রাজনীতি পুষ্ট হতো, সেই অবস্থাগুলোও প্রতিদিন বদলাচ্ছে। প্রচলিত ও নতুন বামপন্থী রাজনীতি দুইই সর্বার্থে রাষ্ট্রপুঁজি কবলিত, আন্দোলন প্রতিদিন পরিণত হচ্ছে রাষ্ট্রবাদী দলে, অন্যদিকে চটজলদি সংগঠনহীন ইভেন্টে, যা রাস্তায় নামে, বিপ্লবও করে, কিন্তু টিকে থাকতে পারেনা। সমাজে মিশে থাকার, মিশে থেকে পুঁজিরাষ্ট্র বিরোধী বুনিয়াদি বামপন্থী রাজনীতি তৈরি করার যে ধীর দীর্ঘ প্রক্রিয়া, তা হবে কী ভাবে যখন সমাজ বলতে যা বোঝাতো কুড়ি বছর আগে, তা এখন দৃশ্যত নেই? থাকলেও, অত ধৈর্য আর সময় কার আছে? টিভি-স্মার্টফোন-কম্পিউটার কাঁপিয়ে ধেয়ে আসছে শেষহীন যতিহীন ডেটা ও ইমেজ প্রবাহ, ফেসবুকের নিউজফিডে প্রতিমুহূর্তে নতুন চমক। পোস্ট দিন, স্ক্রোল করুন, লাইক মারুন। ইভেন্ট খুলে ফেলে কলেজ স্কোয়ার থেকে হেদুয়া-শ্যামবাজার-ধর্মতলা মিছিল করুন, প্রচুর লাল সেলাম ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলুন, কার ব্যানার থাকবে থাকবে না তা নিয়ে তাত্ত্বিক তর্ক করুন। আপনার ইভেন্টে গড়ে পঞ্চাশ থেকে মেরেকেটে ২০০ জনের উপস্থিতি থাকবে, তাতে কী? আপনি আর একটা ইভেন্ট খুলবেন। নাহলে বিপ্লবী পোস্ট লিখে এবং কেচ্ছাখেউড় করে প্রমাণ করবেন যে আপনি/আপনার দোকানটাই একমাত্র ব্র্যান্ডেড বিপ্লবী। দিব্যি দিন চলে যাবে, যেমন যায়।
বামপন্থার সংসদীয় ও বিপ্লবী ফেসবুক-অবতার, দুটিই আসলে রাষ্ট্রপুঁজি আরোপিত সামাজিক স্থিতাবস্থার পক্ষে যায়। শুধু পক্ষে যায়না, তা স্থিতাবস্থাগ্রস্ততায় আক্রান্ত হয়। অথচ, ইতিহাসের শিক্ষা, পৃথিবীর অন্যত্র যেখানেই বামপন্থার বিপ্লবী ও সংসদীয় রাষ্ট্রবাদের প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে, স্থিতাবস্থাও নড়ে গেছে, ফ্যাসিবাদী বা ফ্যাসিবাদী চরিত্রের ডানপন্থা মাথাচাড়া দিয়েছে। বামপন্থা মানে যে নিরবচ্ছিন্ন বিরোধিতার নির্মাণ, পুঁজিরাষ্ট্রের আধিপত্যের বিরুদ্ধে সামাজিক চৈতন্যের প্রতিরোধ গড়ে তোলা, রাষ্ট্রদখল বা রাষ্ট্রক্ষমতার অংশ হয়ে তা যে শুধু ফুরিয়ে যেতেই পারে, এই শিক্ষাও আমরা ভুলে যাই, যেতে থাকি। রাষ্ট্রের মধ্যে আমরা জনকল্যাণ খুঁজি, পুঁজিশাসন পুঁজিনিয়ন্ত্রণ চাই, ভেবে নিই যে ডানপন্থা ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম। হিটলার মুসোলিনী ফ্রাঙ্কো পুরোনো কিস্যা, পৃথিবী তখন অন্যরকম ছিলো, পুঁজিতন্ত্রের সঙ্গে সংগঠিত বামপন্থার সমানে সমানে লড়াই চলছিলো। হালফিলের ইতিহাসের শিক্ষা, সংগঠিত ও অসংগঠিত বাম উভয়ত নিরন্তর ঢুকে যাচ্ছে রাষ্ট্র ও পুঁজি নির্মিত ও শাসিত এক প্রত্যক্ষবাস্তবের(এম্পিরিকাল) গহ্বরে। এই ঐশ্বরিক প্রত্যক্ষবাস্তবের মধ্যে বাজার ভিন্ন যা আছে তা হলো রাষ্ট্র ও তার পেশীবহুলতা, যা থেকেও আসলে নেই তা হচ্ছে যুক্তিনির্ভর(র্যাশনাল) ও ন্যায়পরায়ণ (ইথিকাল) গণতন্ত্রের প্রকল্পটি। বাজার থাকবে, পুঁজি থাকবে, মুনাফাবৃদ্ধির তাগিদ থাকবে, অথচ রাষ্ট্র নমনীয়, জনকল্যাণমুখী ও ‘বামপন্থী’ হয়ে উঠবে, এই সোস্যাল ডেমোক্রাটিক(কিম্বা লিবরল) খোয়াবটি যে বস্তুত খোয়াবমাত্র, এই ঐতিহাসিক শিক্ষা গ্রাহ্য না করে আমরা ধরে নিই যে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মধ্যে সর্বজনগ্রাহ্য ও অপরিবর্তনীয় একটি যুক্তিক্রম অর্থাৎ রিজন আছে, তা ফ্যাসিবাদী বিপদকে আটকাতে পারে। এই ভাবনা থেকেই আমরা কংগ্রেসের পুনরুত্থান কল্পনা করে উৎসাহিত হই, সিপিএমের মধ্যে বামপন্থী সম্ভাবনা আবিষ্কার করি, কিছুতেই কিছু না হলে অর্থাৎ বিজেপি চল্লিশ পার্সেন্ট ভোট পেলে মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তৃণমূলের দিকে অসহায় প্রত্যাশায় তাকিয়ে থাকি। অথবা ভাবতে থাকি, লাল বাম বাংলায় একি হল হায়! কিম্বা চৈতন্য লালন বিদ্যাসাগর রবি ঠাকুর নজরুলের সোনার বাংলায় গেরুয়া হনুমান লঙ্কাদহন চালায় কেন? অথবা ফেসবুকে আরো আরো পোস্ট দিই, তাতে বিস্তর বাণী থাকে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের মরণপন লড়াইয়ের অঙ্গীকার থাকে। সত্যিকারের কিছু করি না। বাংলার সংস্কৃতি যে অজর অমর অব্যয় কিছু নয়, তা যে কাল্পনিক একটি নির্মাণমাত্র, বাঙালিয়ানার ভিতরে ইলিশ মাছ রবি ঠাকুর লালন চৈতন্য এবং আখাম্বা মুসলিমবিদ্বেষ যে স্বচ্ছন্দ সহবাস করতে পারে, সেটা আমরা ভুলে যাই। ভুলে যাই যে আমাদের সামাজিক সমূহ চৈতন্যের যে উজ্জ্বল অর্জন, তা বাঁচিয়ে রাখতে গেলে সচেতন রাজনৈতিক সংগ্রাম চালাতে হয়, ঢিলে দিলে হয় না। ঘাড়ের ওপর ভাগওয়া গুন্ডারা বিষাক্ত নিশ্বাস ফেলছে, এই সব কথা প্রকাশ্যে আলোচনা করার সুযোগ আর বেশিদিন থাকবে বলে মনে হয় না। আমাদের প্রচলিত বামপন্থী আখ্যানটি সমাজ সপাটে প্রত্যাখ্যান করেছে, স্রেফ ইফতার পার্টি আর কলেজস্ট্রিট টু হেদো লোকাল মিছিল করে তার পুনরুজ্জীবন সম্ভব নয়। ত্রিপুরা সাক্ষী, চাড্ডিরা বাম দেখলেই ক্যালায়, সংসদীয় বিপ্লবী ভেদ করেনা। একটু ভাবি বরং সবাই মিলে। ফেসবুকে না লিখে কথা বলি, দেখা করি। একটু থমকে দাঁড়াই, পিছনে তাকাই, সামনে দেখি, পাড়া-প্রতিবেশীরা কে কী বলছেন, শুনি। মোদীর গুণগান করলেও শুনি। দুদিন ইনকিলাব জিন্দাবাদ লাল সেলাম মুলতুবি থাক, সঙ্গে যাদবপুরের মশাল মিছিল। পৃথিবী বিপুলা কাল নিরবধি এবং কোনও দুঃসময় স্থায়ী হয় না, শাস্ত্রে বলেছে।
পাদপূরণ
সবই তো না হয় হলো। কিন্তু অতঃকিম? এর পর কি হবে সত্যি সত্যি? ভোটব্যবস্থা থেকে যদি রাষ্ট্রবাদ ছাড়া আর কিছু না জন্মায়, এবং বুর্জোয়া গণতন্ত্র বললেই যদি ধরে নিতে হয় ফ্যাসিবাদ-নির্মাণের আঁতুড়ঘর, এর পর থেকে বামপন্থীদের কি সার্বিক ভোট বয়কটের চূড়ান্ত যুদ্ধে নামতে হবে? অন্যদিকে, রাষ্ট্র আর সরকার কি এক? ভোট দিয়ে মানুষ জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করছেন, সেই প্রতিনিধিরা সরকারে যাচ্ছেন, এটা কি সামাজিক, গণতান্ত্রিক একটি প্রক্রিয়া নয়? সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক দলগুলোর রাজনৈতিক চরিত্র কি এক, যে স্রেফ ‘রাষ্ট্রবাদী’ বলে সবাইকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে? সবিনয়ে ও কিছু অসহায়ভাবে বলি, সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এই লেখকের সাধ্যাতীত, দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র, সরকার, ভোট, গণতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ ইত্যাদি শেষবিচারে শব্দ, বড়জোর শব্দময় ধারণামাত্র, এদের কোনটাই সামাজিক অবস্থা-অবস্থান-পরিপ্রেক্ষিত নির্বিশেষে চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয় অর্থ বহন করে না। অথচ, বর্তমান সময়ের যে প্রত্যক্ষবাস্তবের আমরা বাসিন্দা, সেখানে যে কোন শব্দ/ধারণা/অর্থ অমোঘ হয়ে দেখা দিতে পারে, শাসক/বাজারের ইচ্ছামাফিক ইতিহাস ও সময়প্রবাহকে ইচ্ছামতো দুমড়োনো মুচড়োনো যায়। বামপন্থার, বামপন্থী রাজনীতির কাজ, শব্দ ও চিহ্ন নিয়ে কালক্ষেপ না করে, ইতিহাসের সঙ্গে সমাজকে আবার যুক্ত করা, সমাজের ভিতরে যে সব বিরোধিতা আগ্নেয়গিরির মতো সুপ্ত হয়ে থাকে, তাদের জ্বালামুখ খুলে দেওয়া। রাষ্ট্র ফ্যাসিবাদী হবে না কল্যাণমুখী হবে সে বিচারের চাইতে অনেক জরুরী, তা সমাজকে তাঁবে রাখতে, বশ করতে পারছে কিনা। বামপন্থীদের কাছে সেই রাষ্ট্র গ্রহণীয় যা দুর্বল, সামাজিক আন্দোলন যাকে প্রভাবিত করতে পারে। অন্যদিকে, ডানপন্থীদের, ফ্যাসিবাদের পছন্দ শক্তিশালী রাষ্ট্র। আমাদের দুর্ভাগ্য, বাংলায় এবং অন্যত্র, বহুদিন ধরেই বামপন্থীরা রাষ্ট্র ও সমাজকে এক/অভিন্ন করে দেখছেন। এই দেখাটা সচেতনভাবে না বদলালে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে আমাদের উপায়হীনভাবে রাষ্ট্রনির্ভর হয়ে থাকতেই হবে।
লেখক সৌমিত্র ঘোষ সামাজিক ও পরিবেশ আন্দোলন-এর কর্মী।