গত ২৬ মে, ২০১৯, যশোর রোডের গাছেদের ডাকা প্রথম জনশুনানি হয়ে গেল। এই জনশুনানি ডেকেছিল গাছেদের পরমাত্মীয় ভাবা কিছু তরুণ তরুণীরা। উপস্থিত ছিলেন যশোর রোড গাছ বাঁচাও কমিটির ছেলে মেয়েরা, ছাত্রছাত্রী ও উৎসাহী মানুষেরা, এসেছিলেন পরিবেশকর্মীরা, স্থানীয় মানুষ ও ব্যবসায়ী সমিতির সভ্যরা। পরিবেশকর্মী অমিতাভ আইচ-এর প্রতিবেদন।
গত ২৬ মে, ২০১৯, যশোর রোডের গাছেদের ডাকা প্রথম জনশুনানি হয়ে গেল। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে সেটা আবার কী? গাছেরা আবার জনশুনানি করবে কী করে? প্রকৃতপক্ষে এই জনশুনানি ডেকেছিল গাছেদের পরমাত্মীয় ভাবা কিছু তরুণ তরুণী এবং এলাকার মানুষ। পাঠক মনে করে দেখতে পারেন যে ঐতিহাসিক যশোর রোডের বারাসাতের চাঁপাডালি মোড় থেকে বাংলাদেশের পেট্রাপোল বর্ডার পর্যন্ত প্রায় ৫৯কিমি রাস্তা চওড়া ও ফোর লেন তৈরি করার নাম করে বছর দুয়েক আগে রাজ্য সরকারের নির্দেশে হঠাৎ করে রাস্তার ধারে ১৫০-২০০ বছরের পুরানো বিশাল বিশাল প্রায় ৪০০০ মহীরুহগুলিকে (প্রধানত রেইন ট্রি ও মেহগনি গাছ) কেটে ফেলার তোড়জোড় শুরু করে এবং বেশ কয়েকটি কেটেও ফেলা হয়।
এলাকার পরিবেশপ্রেমী ও সংবেদনশীল মানুষ বাঁধা দিলে তারা কোনও বৈধ কাগজ দেখাতে পারেনা। বিষয়টি আদালতে যায় এবং প্রকাশ্যে আসে যে কোনো রকম নিয়মনীতি ও আইন না মেনেই একাজ হচ্ছিল। আদালতে সরকারপক্ষ বলে তারা নাকি ৪০০০ গাছ কাটতে চাননা, খালি এই অঞ্চলে যে পাঁচটি রেলওয়ে লেভেল ক্রসিং আছে তার উপর পাঁচটি ওভার ব্রিজ করার জন্য তারা মাত্র ৩৫৬টা গাছ কাটতে চাইছেন। কোর্টে সরকারপক্ষ অলটারনেটিভ প্ল্যান্টেশন প্ল্যান জমা দেয় এবং পরে কোর্ট নিযুক্ত নিউট্রাল অবজারভাররা গিয়ে দেখেন সেই নথি ভুয়ো, মানে প্ল্যানে দেখানো জমিতে কোনও প্ল্যানটেশন করা যাবে না, কারণ জমিটাই নেই। এটাই শেষ নয়, কোর্টের অবজারভাররা গাছগুলিকে দেখে তাজ্জব হন এবং এইগুলিকে হেরিটেজ বলা উচিৎ একথা রিপোর্টে লেখেন। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক মহামান্য আদালত একটি খিচুড়ি মার্কা রায় দেন। তাতে ৩৫৬টি গাছ কাটার আপাতত অনুমতি দেওয়া হয় এবং রাস্তা সম্প্রসারণ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। যেহেতু ওভারব্রিজ ১২০ ফুটের, তাই রাস্তা ১২০ ফুট চওড়া হলে সব গাছই কাটা পড়বে এই স্বাভাবিক আশঙ্কায় আন্দোলনকারীরা, “এপিডিআর” ও “যশোর রোড গাচ বাঁচাও কমিটি” সুপ্রিম কোর্টে নতুন করে মামলা করে, সেই মামলায় আদালত গাছ কাটার উপর স্থগিতাদেশ জারি করেছে। সামনের জুলাই মাসে তার পরবর্তী শুনানি।
এমত পরিস্থিতে আশপাশ থেকে আসা রোজকার খবরা খবরের মাধ্যমে এই পরিবেশ আন্দোলন, উন্নয়ন ও মানুষের জীবন-জীবিকা বিরোধী কিনা এই প্রশ্ন আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রী, পরিবেশকর্মী ও সাধারন মানুষের মধ্যে সবসময়তেই উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল। বস্তুত এই ঘটনার শুরু থেকে আজ অবধি সরকার পক্ষকে দিয়ে কোনও ভাবেই ইআইএ (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অয়াসেসমেন্ট) –এর অন্তর্গত কোনও গনশুনানী করানো যায়নি। স্বাভাবিক ভাবেই আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় পণ্য পরিবহন, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সড়ক পরিবহন, অ্যাম্বুলেন্স, দমকল ও পরীক্ষাদিতে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের যানজটে আটকে যাওয়া, যাতায়াতের সমস্যা ও সর্বোপরি ঝড়ে গাছের ডাল বা পুরো গাছ পড়ে প্রাণনাশের আশঙ্কাও সত্যিই কিছু প্রাণনাশের ঘটনা বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে আসছিল। এই পরিস্থিতিতে কোর্টের লড়াই এর সাথে সাথে এবং কাঠ মাফিয়াদের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে, এলাকার মানুষের সাথে নিবিড় জনসংযোগ এর ভিত্তিতে, এই শতাব্দী প্রাচীন ও কোটি কোটি টাকার ইকোলজিকাল সার্ভিস ভ্যালুযুক্ত ও হেরিটেজ গাছ গুলিকে বাঁচিয়ে একটি সর্বগ্রাহ্য সমাধানের লক্ষ্যে, আন্দোলনরত তরুণ-তরুণীরা ঠিক করেন তারা আদালতের আগামী শুনানি পর্যন্ত মানুষের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন, যতরকম বিকল্প আছে তার সন্ধান করবেন এবং সেটা করতে গিয়ে তাদের যদি গাছতলায় রাত্রিবাস করতে হয় তাও করবেন। এছাড়াও প্রতি রবিবার বিকেলে একেকটি এলাকায় বসবে গাছেদের গনশুনানি।
তা, যেমন কথা তেমনই কাজ। প্রথমদিন এই শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন যশোর রোড গাছ বাঁচাও কমিটির ছেলে মেয়েরা, ছাত্রছাত্রী ও উৎসাহী মানুষেরা, এসেছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতির সভ্যরা ও পরিবেশকর্মীরা। আলোচনা সভার মুখ্য আহবায়ক ছিলেন তরুণ ছাত্র-ছাত্রীরা। আলোচনায় উঠে এল স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মত, যে তারা কোনও মতেই গাছ কাটা পড়ুক চাননা এবং গাছের সাথে তাদের দোকান ও রুজিরুটি জড়িত। এলাকার মানুষ প্রশ্ন তোলেন ঝড়ে গাছের ডাল পড়ে মানুষ মারা যাচ্ছেন এবং কোনও সরকারি সাহায্যেও আসছেনা। বিষয়টি নিয়ে জোরালো আলোচনা হয় ও গাছের রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়টি নিয়ে বনদপ্তর ও ডিএমকে চিঠি এবং কয়েককটি বিশেষ উদ্যোগের কথা হয়, যার কয়েকটিতে এলাকার মানুষও যুক্ত থাকবেন। যদিও বিষয়টি কোর্টের বিচারাধীন থাকায় উপযুক্ত অনুমতি নিয়ে একাজ করার কথা বলা হয়। মামলার সাম্প্রতিকতম অবস্থান নিয়ে সবাইকে অবগত করেন গাছ বাঁচাও কমিটির তরুণরা। পরিশেষে সকলকে একটি অলটারনেটিভ ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান সাদা বোর্ডে মার্কার দিয়ে রীতিমতো ছবি এঁকে বোঝান তরুণ পরিবেশ কর্মী পাভেল। যাতে খুব সুস্পষ্টরূপে উঠে আসে যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এতটুকুও ক্ষতি না করে কীভাবে যশোর রোডের সমান্তরাল দুটি রাস্তা ও চাকদা-বনগাঁ রোড ব্যবহার করেই এই পণ্যপরিবহন সম্ভব যাতে পণ্যপরিবহনের জন্য যশোর রোড চওড়া করা এবং গাছ কাটার এতটুকুও দরকার নেই। রেলওয়ে লেভেল ক্রসিং এলাকায় ট্র্যাফিক জ্যাম এড়ানোর জন্য গঙ্গা ও বিবাদি বাগের হেরিটেজ বাড়িগুলির তলা দিয়ে যে ভাবে টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) দিয়ে মাটির উপর সব অবিকৃত রেখে মেট্রো টানেল করা হয়েছে সেই প্রযুক্তি ব্যবহারের কথাও ওঠে।
উপস্থিত সকলকে এটা জানানো হয় যে গাছ বাঁচিয়ে এলাকার যাতায়াত সমস্যার সমাধান কী করে সম্ভব এবং এই গাছগুলি কেন বাঁচানো দরকার তা সরকারের সব মহলে ও রাজনৈতিক মহলে একটি যৌথ পরিবেশ কমিটির পক্ষ থেকে তথ্য নির্ভর চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে এবং সরকারের দপ্তরগুলি বিশেষ করে পরিবেশ ও বনদপ্তর এর মধ্যে এবিষয়ে নিজেদের মধ্যে পত্র বিনিময় করেছেন।
সিদ্ধান্ত হয় আপাতত এই মিটিংগুলি এলাকায় এলাকায় চলবে, সমস্ত আলোচনা নথিবদ্ধ করা হবে এবং ভবিষ্যতে ছাপানো নথি আকারে সমস্ত বিকল্প সামনে আনার কথা হয়, যা সরকার, কোর্ট সবার কাছে যাবে। একটি গার্ডিয়ান অব দ্য ট্রিজ বা গাছেদের অভিভাবক তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, যেখানে কাজ ভাগ করে সবাই একেকটি গাছের দেখভালের দায়িত্ব নেবেন।
আলোচনা শেষ হতে সন্ধে গড়িয়ে যায়, তখন শিশুরা খেলা শেষে ঘরে ফিরছে, আশেপাশের গাছগুলিতে পাখিরা ভিড় জমিয়েছে, প্রাণের হুল্লোড় পড়ে গেছে চতুর্দিকে। একটা মন ভালো করে দেওয়া ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। সবাই মিলে এগিয়ে চললাম একটু চায়ের সন্ধানে, গলা বড়ো শুকিয়ে গেছে, সেই চায়ের দোকান যেটা পাভেল ও তার বন্ধুদের রাতের আস্তানা এখন।
লেখক অমিতাভ আইচ পরিবেশ আন্দোলন -এর কর্মী।
Excellent initiative. The report is very good. Thanks to all related.