পশ্চিম বাঙলায় লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে রাজা বসুর পর্যালোচনা।
লোকসভা নির্বাচন ২০১৯ এর ফল প্রকাশ হবার পর থেকে ব্যারাকপুর, নৈহাটি, কোতুলপুর সহ বেশ কিছু জায়গায় বিজেপির সদস্য ও সমর্থকেরা ভাঙচুর করেছে তৃণমূলের পার্টি অফিস। আর তাতে দৃশ্যতই উল্লাস করতে দেখা গেছে সিপিআইএম কর্মী এবং সমর্থকদের। এর পরেও আর কে যে প্রমাণ চাইছে। আর কেনই যে। আসলে ভোটের অনেক আগে থেকেই রাস্তাঘাটে চলাফেরা করলেই জলের চেয়ে স্পষ্ট বুঝে নেওয়া যাচ্ছিল তলার দিকের সিপিএম কর্মীদের রকমসকম। যখন কংগ্রেসের সাথে জোটের ঠিক ছিল, তখন তো আরো বেশি ছিল এই প্রবণতা। একটা সময়কাল জুড়ে কং শাসকের হাতে মার-খাওয়া, পরিবারের কোনো না কোনো খুনের স্মৃতি নিয়ে-চলা সিপিএম কর্মী সরাসরি কং জোটকে ভোট দিতে অস্বীকার করছিল। আবার তৃণমূল তাদের প্রধান শত্রু। কেন্দ্রে বিজেপি তাড়াও আর রাজ্যে তৃণমূল তাড়াও — এই স্লোগানে সিপিএম-এর ভিতরে নাকি সামান্য দ্বিমতটুকুও হয়নি। ফলে স্লোগানের পরবর্তী অংশের মানে যা দাঁড়ানোর তাই দাঁড়িয়েছিল: রাজ্যে প্রতিটি তৃণমূল বিরোধী ভোটকে কেন্দ্রীভূত করতে চেয়েছেন তাঁরা, হ্যাঁ, বিজেপির পক্ষে নিয়ে যেতে হলেও। এভাবেই বাংলার বহু জায়গায় ব্যাপক জনভিত্তি বাড়িয়ে ফেলেছিল বিজেপি।
পরে যখন কংগ্রেসের সাথে জোট ভেস্তে যায় (অবশ্যই কোনো রাজনৈতিক আদর্শের জায়গা থেকে নয়, স্রেফ পারস্পরিক আসন ভাগাভাগি সংক্রান্ত মতানৈক্যের কারণে), তখনো যে সমস্যাটা রয়ে গিয়েছিল, সেটা হচ্ছে গ্রাউন্ড লেভেলে সিপিএম কর্মীদের কোনো দাপট অবশিষ্ট নেই, অন্য কথায় সংগঠন ভেঙে পড়েছে। ফলে তৃণমূলী লুম্পেনদের হাতে তাঁরা দ্যাখ না দ্যাখ নিগৃহীত হচ্ছিলেন। এই অবস্থায় তাঁরা চাইছিলেন একটা জুতসই শেল্টার। এবং সাথে সাথেই ওপরতলা থেকেও চুঁইয়ে নামছিল এই নির্দিষ্টতা যে আগে তৃণমূল তাড়াও, তার জন্য বিজেপিকে আনতে হলে সেও আচ্ছা। এ কৌশল কিছু নতুন নয়। ইতিহাস পড়লে বহু রাজত্বের অবসানই এমনভাবে হয়েছে দেখা যাবে। কিন্তু ইতিহাসের প্রায় সমস্ত পর্বের মতোই এক্ষেত্রেও সিপিএম যে ভুলটা করেছে সেটা হল নিজের ক্ষমতার তুল্যমূল্য বিবেচনায় গরমিল। তাঁরা বোঝেননি যে বিজেপি একবার ক্ষমতায় এলে বামফ্রন্টিদের অবশিষ্ট তুচ্ছটুকু গরজও ধুয়েমুছে সাফা হয়ে যাবে।
আবারও বলছি, এ প্রতিপাদ্যে পৌঁছতে সত্যিই কোনো গোয়েন্দা বা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হবার দরকার পড়ে না। শুধু পথে-ঘাটে-মাঠে চোখ-কান খোলা রাখলেই চলে। সব সিপিএম কর্মীরাই এ কথা জানতেন। আর এমনই করুণভাবে জানতেন তাঁরা যে বিজেপি-মুখী স্রোতোপ্লব সামলাতে না পেরে শেষতক সিবিআই-এর ক্লিনচিট পাওয়া স্বচ্ছতর বুদ্ধদেবকে দিয়ে খোলাখুলি বলিয়ে নিতে হয় তাঁদের, অস্বীকারের বার্তা – যে বিজেপিকে একটাও ভোট নয়। কিন্তু অনেক দেরিতে।
এবারে ভেবে দেখা যাক সমাজের বৃহত্তর বাম অংশের ‘ভোট ফর লেফট’ আহবানের মান্যতা, এবং সিপিএমের সেই আহবানের যোগ্য হয়ে উঠতে পারার সম্ভাবনার কথা।
প্রথমতঃ, যে অন্যান্য — মূলত ‘শহুরে র্যাডিকাল’ — বাম গোষ্ঠীগুলি সিপিএমের পক্ষে ভোট দেওয়ার প্রচারে নিজেদের নিয়োজিত করলেন, তাঁরা শুধু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধতা ছাড়া এ জোটের কোনো যৌক্তিকতা দর্শানও নি, সম্ভবত নিজেরাও জানেননি বা দরকার মনে করেননি। বিজেপি কেন্দ্রীয় ফ্যাসিস্ত শক্তি, আর তৃণমূল রাজ্যে ফ্যাসিস্ত। ফলে সিপিএমকে ভোট দিলেই একমাত্র ফ্যাসিবিরোধী অবস্থান নেওয়া হবে — এই ছিল তাঁদের সরল ব্যাখ্যা। কিন্তু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড় ঘটিয়ে আসা সিপিএম, সরকারি পলিসির দিক থেকে সম্পূর্ণ নয়া উদারনৈতিক দিকে ঝুঁকতে-থাকা সিপিএম, কর্পোরেটগুলোর হাতে জল-জমি-জঙ্গল বিকোতে-থাকা সিপিএম, এবং তার জন্য প্রয়োজনে গ্রীন হান্ট-সালওয়া জুডুম-ইউএপিএ সমর্থন-করা সিপিএম আজ হঠাৎ একদিনে (বা অল্প কিছুদিনে) বিনা প্রশ্নে ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রধান শক্তি হয়ে গেল কী যাদুতে তা বোধগম্য হয়নি অনেকেরই। এবং সবচেয়ে মজার যেটা, সিপিএম নিজেও কিন্তু অন্যরকম কোনো কথা বলেনি — সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড়-এর জন্য ভুল স্বীকার করেনি, দেশজুড়ে চলতে-থাকা জল-জমি-জঙ্গলের লড়াইতে অংশ নেবার চেষ্টাও করেনি কোথাও (করলে, সুধা ভরদ্বাজ প্রমুখের মতো তাঁদেরও কেউ না কেউ গ্রেপ্তার হতেন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হতেন, কোথাও না কোথাও), সেজ বিল এ রাজ্যে সিপিএমই প্রথম এনেছিল — সে বিষয়েও তাদের নতুন মূল্যায়ন জানা যায় না। একমাত্র মধ্যস্তরের জমি-মালিক চাষিদের জন্য দুটো লক্ষ্যণীয় কিষান মার্চ ছাড়া সিপিএম স্রেফ বেপাত্তা। অথচ বৃহত্তর বাম জোট হয়ত হতেই পারত সিপিএমকে অন্তত কিছুটা নিজেদের গোঁয়ার্তুমি ছেড়ে বার করতে পারলে। অন্যান্য সংসদীয় ও অসংসদীয় বামেরা সে চেষ্টা করতেও পারতেন। কেননা একথা বোধহয় এক নিরুপায় সত্যি যে সব নেতিবাচকতা সত্ত্বেও বিরাট সংখ্যার বামপন্থী মানুষ এখনো সিপিএম কর্মী পরিচয়ে কাজ করে চলেছেন। তাঁদের নেতাদের মতো তাঁদের সবার হৃদয়বৃত্তিতে (বা মস্তিষ্ক সঞ্চালনক্ষমতায়) পচন ধরেনি।
অতএব, দ্বিতীয়ত, এই বৃহত্তর বাম সমাজ যে নীতিতে ‘ডিফিট বিজেপি বাই ভোটিং ফর লেফট’ করতে চেয়েছিলেন, এ রাজ্যের প্রেক্ষিতে তার গোড়ায় গলদ ছিল। পুনরাবৃত্তি হলেও বলি, অতীতেও বারবার কংগ্রেসের সাথে জোটে যেতে রাজি হওয়া সিপিএম-এর সাধারণ কর্মীদের মধ্যে দক্ষিণপন্থী শক্তিকে ভোট দিতে পারার ক্ষেত্রে কোনো জড়তা কাজ করছিল না। অতঃপর রাজ্যে তৃণমূল হটাও বলতে যে বিজেপিকে ভোট দেওয়া যেতেই পারে এ কথা বুঝে নিতে তাঁদের কোনো অসুবিধে হয়নি। অথচ বৃহত্তর বামেরা একগুঁয়ে একবগগা ভাবে বলে চললেন ‘ভোট ফর লেফট’। এই হ্যাশট্যাগের টার্গেটদের মধ্যে বেশ কিছু ভোট বয়কটপন্থী মানুষ ছিলেন। ছিলেন অনেক নোটাপন্থী মানুষও। এঁদের সবার মাথায় এই স্লোগান গেঁথে দিল এই নিরুপায়তা যে একটাও ভোট নষ্ট করলে — অর্থাৎ সিপিএমকে না দিলে (সে ভোট বয়কট বা নোটা হলেও) — তা সরাসরি ফ্যাসিস্ত শক্তি তৃণমূলের পক্ষে দাঁড়ানো হবে। ফলে সিপিএম শহুরে দিগভ্রান্ত বামেদের একটা অংশের ভোট পেল। কিন্তু অন্য দিকে বৃহত্তর যে বাম সমাজ সত্যি সত্যি ফ্যাসিবাদের অবসান চান, তার বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে চান, তাঁরা নিঃশব্দে সন্দেহজনক বাম জোটের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
অতএব পড়ে রইল তৃণমূলের অসংস্কৃত অনাচার বা খোলামেলা কুশাসন, যা থেকে বাঁচতে বিজেপিকেই একমাত্র সম্ভাব্য বিকল্প ধরে নিলেন মানুষ। ভোটের ফলাফলে তার স্পষ্ট প্রভাব পড়ল।
তৃণমূলের ভোট ২০১৪ লোকসভার (৩৯.০৫%) থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৩.২৯%, ২০১৬ বিধানসভায় যা ছিল ৪৫.৭১%। গত লোকসভায় বিজেপি ছিল ১৭.০২%, যা এবারে প্রায় ৪০%। এবং লক্ষ্যনীয়ভাবে বামফ্রন্টের ভোট ২৯.৭১% থেকে কমে প্রায় ৮% এর আশেপাশে। অর্থাৎ বিজেপির বেড়ে যাওয়া ভোট আর বামফ্রন্টের কমে যাওয়া ভোট প্রায় সমান। এ হয়তো পুরোপুরি সমাপতন নয়। সেইসঙ্গে আরো মনে করে নেওয়া যায় যে বামপন্থী মুসলিম ভোটের একটা বড় অংশ এবার তৃণমূলে জমা হয়েছে, যা নাহলে তাদের ভোট আরো কমত। আর সত্যি কথাটা হল বিজেপির সাম্প্রদায়িকতাই বলি, বা তৃণমূলের অপশাসন — কোনোকিছু নিয়েই সংসদীয় বামেদের কোনো স্পষ্ট ইতিবাচক প্রচার ও পদক্ষেপ ছিল না। বিজেপির একের পর এক হিন্দু মৌলবাদী উত্তেজনা, এবং তাদের উপর্যুপরি শ্রমিক-কৃষকবিরোধী আইনী ও বেআইনী বর্বরতার বিপরীতে সিপিএম কোনো সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারেনি। তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রচারেও তাদের সরকারি নীতি, ভাঙর-নোনাডাঙা-ভাবাদীঘি-যশোররো
লেখক একজন সামাজিক কর্মী।
ছবির সূত্র: Facebook।