বড় শহরের পাশে মুখ লুকিয়ে থাকা মেলাবাড়ি বস্তির ‘মে দিবস’ ও একটি শ্রমিক মহল্লার কথা। লিখেছেন রাতুল গুহ।
রোগা এক বছর ১২এর মেয়ে সে। হুগলী নদীর পূর্বতীরে তার বেড়ে ওঠা। আলো পাখাহীন ঘরে খেলে না সে পুতুল। সকালে স্কুলে যায়। টিফিনের পয়সা না দিতে পারা মা থমকে দাঁড়ায় বারোয়ারী উঠোনে। মেয়ে বাড়ি ফেরে। দু মুঠো খেয়ে কাজে যায় পাশের ফ্ল্যাট বাড়িতে। অবসর পেলে তার মন যায় মাতলার দেশে। ফেলে আসা ছেলেবেলায়। গোধুলীর ধুলো মেখে মেয়ে বাড়ি ফেরে। অন্ধকারের ঝুপড়ি ঘরে বাতাস খেলে না, বই নিয়ে বসে সে মোমের আলোয়। রাতের খাবারের অনিশ্চয়তা-মাখা চোখে ঘুম আসে ৷ এটা অচেনা কোনো জগৎ-এর কথা নয়। মেয়েটার নাম রচনা। আমাদের দেশের লক্ষ কোটি রচনাদের দিন কাটে এভাবেই। বড় শহরের পাশের মুখ লুকিয়ে থাকা শ্রমজীবীদের মহল্লার খুব চেনা ছবি এমনটাই।
গোধুলীর ধূসর ক্যানভাসে তবু রাঙা আলো খেলা করে। বহমান স্রোতের বিপরীতে কিছু ছেলেমেয়েকে টেনেছিল হোক কলরবের মিছিল। নেপালের ভূমিকম্পে ত্রান তুলেছিল তারা অকাতরে। তাদের উদ্যোগে শ্রীরামপুরের ক্ষেত্রশাহ মেলাবাড়ির ভেতরের বস্তিতে শুরু করা হয়েছিল বস্তির শিশুদের পড়া-আঁকা-নাচ-গান শেখানোর কাজ। বছর চারেকের কাজে কখনো ছেদ পড়েছে সাময়িক। কখনো ভীষণ উদ্দ্যমে বেড়েছে যাতায়াত। যদিও শ্রমিক মহল্লায় শ্রমিক দিবস পালন এই বছরই প্রথমবার।
সপ্তা খানেকের প্রস্তুতিতে ছোট ছেলেমেয়েরা নাচে গানে মাতিয়ে দিয়েছে ১লা মে’র সকাল। “আমরা সবাই রাজা”র তাল কেটে গৃহপরিচারিকা কিশোরী প্রশ্ন করেছে ‘রাণী’র কথাও নেই কেন? এভাবে ভাঙা গড়ার খেলা চলেছে। সুমনের গানে বেলা বেড়েছে। শ্রমিকের প্রাণের কাছাকাছি গান বা গানের ভাষা আমরা দিতে পারিনি।
“আমরা করবো জয় নিশ্চয়…”এর কোরাসে নেমে এলো প্রত্যয়৷ ভাঙা সুর। ভুল লিরিক্স। তবু শিহরণ বয়ে যাওয়া যৌথতা। এর পাশাপাশি ছিল লিটল ম্যাগাজিনের পসরা। সামাজিক বিষয়ের পত্রিকা। লিঙ্গ রাজনীতির পত্রিকা। শ্রমিকদের নিয়ে লেখা। ইত্যাদি।
সাংস্কৃতিক আসর শেষে শুরু হল স্বাস্থ্য শিবির। অভাবের সংসারে বড় হাসপাতালে যাওয়া যায় না। তাই বেড়ে যায় রোগের মাত্রা। খালি পেটে সারাদিন কাজের ফলে কারো কারো গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দেখা দিয়েছে। বস্তির ময়লা পুকুরে যাদের স্নান করা থেকে বাসন মাজা, তাদের কাছে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন অসম্ভব। নিত্যদিনের না-পাওয়ার কথা বারে বারে এসেছে তাদের মুখে। অসহায় চোখে আমরা চেয়ে থেকেছি। অপুষ্টির শিকার যুবতী মায়ের ভাঙা শরীরের দিকে। শিশুদের রুগ্ন দেহের দিকে।
দুপুর ৩টে নাগাদ স্বাস্থ্য শিবির মিটে যাওয়ার পর ঠিক হল বিকেলে বস্তি বাসীদের সাথে আরেক দফা আলোচনায় বসার৷
প্রথম দু’-চার জন থেকে ক্রমশ ২০-৩০ জনের সাথে বসা গেলো আলোচনায়। যার অধিকাংশই মহিলারা। গৃহপরিচারিকাদের পেশায় প্রায় সকলে। বেতনের পরিমাণ নিয়ে কথা উঠল যখন, সকলে সমবেত কণ্ঠে ছুড়ে দিলেন ক্ষোভ! ৫০০ থেকে ১০০০-এর মধ্যে এদের মাস মাইনে৷ বাড়ির পুরুষরা কেউ রিক্সা চালান৷ কেউ নির্মাণ শ্রমিক। আলোচনায় উঠে এলো শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার প্রসঙ্গ। বয়স্ক এক মহিলা ভোটের রাজনীতি নিয়ে তুললেন প্রশ্ন। এক সরকার পেরিয়ে অন্য সরকার আসে। বস্তিতে জলের সমস্যা মেটে না। ইলেকট্রিক লাইনের জন্য দরবার করেও পাওয়া যায় না। রাগ আর হতাশা মিলেমিশে যায় শেষ বিকেলের কথা বার্তায়। অবশেষে আরো একবার একজোট হওয়ার কথা বলেন মিটিংয়ে উপস্থিত সকল বস্তিবাসী। মধ্যবিত্ত আমরা শ্রমিকদের পাশে থাকার কথা দিয়ে আসি। মেদিবসের রাঙা রবি অস্তাচলে যায়।
রচনা-পূর্ণিমা-কালুদের এই বস্তি যেকোনো দিন উচ্ছেদ হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ে তছনছ হতে পারে বেড়া আর টালির চাল। শত দুঃস্বপ্ন নিয়ে শ্রমিক-শ্রেণির লড়াই। বেঁচে থাকা।
শ্রমিক আন্দোলনের ধূসর একসময়ে আমাদের মত মানুষের চেতনায় আজও বিকল্প নির্মাণের স্বপ্ন।
সভ্যতার পিলসুজের গায়ে জমা জমাট অন্ধকার মোছার তাগিদ৷ মেলাবাড়ি বস্তির কাজটা বিচ্ছিন্ন কোনো প্রয়াস নয়৷ দিন বদলের সন্ধানেই এই যাত্রা। আগামী পৃথিবীর জন্য।
লেখক ছাত্র আন্দোলনের কর্মী। ছবির সুত্রঃ অনির্বাণ দে ।