গতবার রামনবমীর সময় আসানসোল শিল্পাঞ্চল রক্তাক্ত হয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। সেই সমীকরণকে আরো মজবুত করে ভোটযুদ্ধে জিততে চাইছে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল। প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতায় এখনো বিষিয়ে আছে শহরের আকাশ-বাতাস। আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচনী প্রচারপর্ব নিয়ে সুমন কল্যাণ মৌলিক-এর প্রতিবেদন।
(১)
আবার এসে গেল পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে অহরহ আলোচিত ভারতবর্ষের পাঁচ বছরের কড়ারে অনুষ্ঠিত রাজসূয় যজ্ঞ সাধারণ নির্বাচন। দেখতে বেরিয়েছি আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচনী প্রচারপর্ব। বাজারি সংবাদপত্রের ভাষায় এটা ‘হাই প্রোফাইল’ কেন্দ্র। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সে জায়গাটার নাম চিত্রামোড়। এই নাম মাহাত্ম্যের কারণ এখানেই ছিল আসানসোলের সবচেয়ে জনপ্রিয় চিত্রা সিনেমা হল। বাবা মা’য়ের কাছে শুনেছি একটা সময় এখানে শচীন কর্তার সুরে কিশোর কুমারের মায়াবী কন্ঠে মহব্বতের দারুণ খতিতে ফেটে পড়তেন রাজেশ খান্না,কখনও রবিন হুডের আদলে সমাজের জঞ্জাল একার হাতে সরাতে রূপালি পর্দায় আগুন ওগরাতেন অমিতাভ বচ্চন। আমাদের ছাত্রজীবনে অর্থাৎ আশির দশকেও দেখেছি হাউসফুল সিনেমা হল,পাশের গলিতে পাঁচ কা দশের ফিসফিসানি। আজ অবশ্য সে রাম’ও নেই, অযোধ্যা’ও নেই। আর দশ’টা সিঙ্গেল স্ক্রিনের যা পরিণতি হয়েছে, চিত্রা সিনেমার ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছে। এক প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসরের মতো ফেলে আসা সময়ের ক্ষতচিহ্নকে বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পেল্লাই সিনেমা হল। শোনা যায় এক কর্পোরেট হাউস গোডাউন বানানোর জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া হল’টা কিনে নিয়েছে। এই মোড়ের পাশেই রয়েছে শাসক দলের সৌজন্যে স্থাপিত দু’মানুষ সমান এক বিশাল ফ্লেক্স। আর সেই ফ্লেক্সে একদা টলিউডের ফ্লপ অভিনেত্রীর সহাস্য মুখ। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, মুনমুন সেন ভোট চাইছেন। সেই ফ্লেক্সে আরেকজন আছেন। বাংলা সিনেমার একদা মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। ভোট বড় বালাই, তাই ভোট ভিক্ষের এই আয়োজনে বাঙালির গ্রেটা গার্বোর মায়াবী উপস্থিতি। সিনেমা হলের উল্টোদিকে আধা-খ্যাঁচড়াভাবে গড়ে ওঠা এক স্টেডিয়াম। আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে “এ হাত মুঝে দে দে ঠাকুর” ডায়লগের অনুকরণে মহামহিম ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি বিশিষ্ট নরেন্দ্র মোদী এখানেই আসানসোল বাসীর কাছে চেয়েছিলেন বাবুল সুপ্রিয়কে। রামগড়ের ঠাকুরের মতো অনিচ্ছায় নয়, আসানসোলের মানুষ সোৎসাহে বাবুলকে সংসদে পাঠিয়েছিলেন। গত পাঁচ বছরে আসানসোল বাসীর জন্য মাননীয় সাংসদ ঠিক কী কী কাজ করেছেন তা নিয়ে এলাকায় অনেক রসিকতা চালু থাকলেও, এবারেও তিনি বিজেপি প্রার্থী। অবশ্য এই ভীষনভাবে ফিল্মি রণাঙ্গনে আরও দু’জন প্রার্থী আছেন। একজন খনি অঞ্চলের শ্রমিক নেতা বামপন্থী প্রার্থী গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়, অন্যজন শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেস দলের প্রার্থী প্রাক্তন সেনাকর্মী বীরভূম নিবাসী বিশ্বরূপ মন্ডল।
কেমন বুঝছেন প্রার্থীদের? প্রশ্ন করতে তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়লেন আইনজীবী ও সমাজকর্মী অম্বিকা মুখোপাধ্যায়। পরিষ্কার বললেন যে আসনে এক সময় নির্বাচিত হয়েছেন হারাধন রায়, আনন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়, দেবেন সেন-এর মতো শ্রমিক নেতারা, সেখানে এই ধরনের ফিল্মি, রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক রহিত প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া আসলে আসানসোলের মানুষদের অপমান। তার আরও সন্দেহ, বোধহয় রাজ্যের শাসকদল আসনটা বিজেপি’কে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে তাই এই ধরনের প্রার্থী মনোনয়ন। অবশ্য শুধুমাত্র অম্বিকা নয়, শাসকদলের বহু সাধারণ সমর্থককে এবার একান্তে প্রার্থীর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখেছি, বিশেষ করে আগেরবার বাঁকুড়ার সাংসদ হিসাবে তার ব্যর্থ ভূমিকার কথা সর্বত্র প্রচারিত হওয়ার পর। অম্বিকার আরেকটি পর্যবেক্ষণ হলো যদিও বামেরা আসানসোল শিল্পাঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে কোন অনুকরণযোগ্য শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, ক্ষমতায় থাকাকালীন তাদের কাজকর্ম মোটেও সুবিধার ছিল না, তবুও এবারের নির্বাচনে বামপন্থীদের প্রার্থী তুলনায় স্বচ্ছ, মাটির কাছাকাছি। এই লেখা আসানসোলের নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে কোন আগাম সমীক্ষা নয়, আমাদের লক্ষ্য আসানসোলের মতো মিশ্র বসতিপূর্ণ, শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলটিকে অনুসন্ধান করা। তাই সপ্তাহ খানেক ধরে চেষ্টা করেছি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে, তাদের ভাবনা বুঝতে। বিচারের ভার পাঠকের।
(২)
চিত্রা মোড় থেকে ৭০০ মিটার পায়ে হেঁটে গেলে দেখা যাবে এক ধ্বংসস্তূপ। কেন্দ্রীয় সরকারের নিদান মেনে বন্ধ হয়ে যাওয়া শতাব্দী প্রাচীন রেল ওয়াগন তৈরি হওয়ার কারখানা বার্ন স্ট্যান্ডার্ড। অবশ্য এ মৃত্যুর মধ্যে কোন আকস্মিকতার উপাদান নেই। বরং আছে এক পরিকল্পিত চিত্রনাট্য মেনে ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাওয়ার করুণ ইতিহাস। একটা সময় আসানসোলকে বলা হতো মিনি ভারতবর্ষ। দেশের নানা প্রান্ত থেকে কাজের খোঁজে মানুষ এখানে এসেছেন। শিল্পের বিভিন্নতা, অনুসারী শিল্পের বিকাশ হয়ে উঠেছিল কর্মসংস্থানের প্রতীক। সেই কর্মমুখর দিনগুলির এক উজ্জ্বল অংশ ছিল এই ওয়াগন কারখানা। কারখানার সংকটের ইতিহাস পুরনো। ২০১০ সালে শ্রীমতী মমতা বন্দোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন ভারতীয় রেল কারখানাটি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু আজ একথা প্রমাণিত যে অধিগ্রহণ বলতে যে সব ব্যবস্থাদির কথা বোঝায়, আলোচ্য অধিগ্রহণটি সেই গোত্রের ছিল না। এটি ছিল প্রশাসনিক অধিগ্রহণ। ফলে কারখানার শ্রমিকদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে ভারতীয় রেল অধিগ্রহণের পরে কীভাবে কারখানাটিকে লাভজনক করে তোলা যায় সে ব্যপারে কোন চিন্তাভাবনা করা হয়নি। অথচ দেশের ওয়াগনের চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়ছে। ফলে সম্ভব ছিল ৩০০-৩৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে কারখানাটিকে পুনরায় লাভজনক করে তোলা।
কিন্তু যে কোন মূল্যে কর্পোরেটদের হয়ে কাজ করতে দায়বদ্ধ নরেন্দ্র মোদীর সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প তুলে দিতে বলিপ্রদত্ত। তাই ওয়াগন কারখানা বন্ধ হলো। কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ হারালেন। কারখানার গেটে কুশল সেনগুপ্তের সাথে দেখা। জানালেন শেষ বেলায় অকাল অবসর নেওয়া শ্রমিকদের পি.এফ সেটলমেন্টের কাজ চলছে। করুণ মুখ করে বললেন – কোন লড়াই হলো না, সবাই মিলে চেষ্টা করলে কারখানাটা বাঁচানো যেতো।
তবে ওয়াগন কারখানা বন্ধ করাই বিদায়ী সাংসদের একমাত্র উজ্জ্বল কীর্তি নয়। এর সঙ্গে যুক্ত করুন আরেকটি বন্ধ হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা হিন্দুস্থান কেবলস্। রূপনারায়ণপুর ইউনিটে ৫০০ জন চাকরি করতেন। কখনও প্রতিরক্ষামন্ত্রক অধিগ্রহণ করবে তো কখনও আবার অন্য কোন কেন্দ্রীয়মন্ত্রক – সাংসদ কর্তৃক ধারাবাহিক মিথ্যা প্রচারের পর ২০১৭ সালের ৩১শে জানুয়ারি কারখানার গেটে তালা পড়লো। কিন্তু শুধুমাত্র সাংসদকে দোষারোপ করে বন্ধ কারখানার গল্প শেষ হতে পারে না। ইতিহাস সাক্ষী যে আসানসোল দূর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে আশির দশক থেকে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে গেলেও, তা রোধ করতে কোন লড়াকু প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়নি।হিন্দুস্থান কেবলস ও বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের ক্ষেত্রে একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল। সর্বভারতীয় মান্যতাপ্রাপ্ত ট্রেড ইউনিয়নগুলির অ্যাজেন্ডার মধ্যে রাস্তায় নেমে প্রতিরোধ বা সমাজের অন্যস্তরের মানুষদের যুক্ত করে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা – কোনটাই ছিল না। আন্দোলনহীনতা ও প্রতীকি আচার-আচরণের মধ্যে প্রতিবাদকে সীমিত রাখার যে অনুশীলন এ রাজ্যের মূলধারার ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা করেছেন, এই কারখানা দু’টির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। গণবিচ্ছিন্নতার ফলে হাজার দু’য়েক শ্রমিকের সমস্যা তাদেরই থেকে গেছে, সাধারণ মানুষের মধ্যে কোন হেলদোল দেখা যায়নি। তাই কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার পর যখন এলাকার সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় (ইনি আবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও বটে) বীরদর্পে ঘোষণা করেন যে এটা কেন্দ্রীয় সরকারের এক সাহসী সিদ্ধান্ত – তখন এলাকার মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন না।
(৩)
কয়লা অঞ্চলের ভাবনা ছাড়া আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের ভোটের খবরাখবর অনেকটা শিবহীন যজ্ঞের মতো। এই লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে আছে এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ কয়লাসম্পদ সমৃদ্ধ একের পর এক কয়লাখনি। ভূগর্ভস্থ খনি যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে খনি অঞ্চলের পরিবেশ ধ্বংসকারী খোলামুখ খনি। ৯০’এর দশকে চালু হওয়া সংস্কার কর্মসূচীর নামে এখানে ব্যক্তি মালিকানার বিভিন্ন “কোল প্যাচ” শুরু হয়েছে। তাই কয়লা অঞ্চলের ছবিটা বহুমাত্রিক। একদিকে সরকারি কোল কোম্পানি ইস্টার্ণ কোলফিল্ডের অধীন সরকারি কর্মী যাদের ন্যুনতম মাইনে ৪০,০০০ টাকা। অন্যদিকে, ঠিকা শ্রমিকের দল যারা একই কাজ করে খুব বেশি হলে মাসে ১৫,০০০-১৮,০০০ টাকা রোজগার করে। বহু জায়গায় সরকার-নির্ধারিত ন্যুনতম মজুরিও মেলে না। নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছেন কয়লা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষ?
কথা হচ্ছিল সিটু কর্মী কৌশিক হালদারের সঙ্গে। তার বক্তব্য একমাত্র বামপন্থীদের প্রার্থীই (গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জী) শ্রমিকশ্রেণীকে প্রতিনিধিত্ব করেন। সম্প্রতি এলাকার ১৬টি ভূগর্ভস্থ খনি বন্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্তকে আপাতত রুখে দেওয়া খেছে যৌথ আন্দোলনের মাধ্যমে, যার নেতৃত্বে ছিলেন বামপন্থীরা। তারা ঠিকা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি তুলছেন। পরিবেশ ও কর্মসংস্থান ধ্বংসকারী খোলামুখ খনি নিয়ে তারা অবশ্যই উদ্বিগ্ন কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে খোলামুখ খনি বন্ধ করতে হবে – এমন দাবির সঙ্গে তারা একমত নন। তাহলে কি গরীব মানুষের ভোট এবার বামপন্থীদের ঘরে ফিরবে? – কৌশিক আশাবাদী কিন্তু নিশ্চিত নন। “কারণ বামপন্থী চেতনার বিকাশ না হওয়ার কারণে এখনও শ্রমিকরা রাজনীতির সময় ধর্মীয় প্রচারে ভেসে যান।“ সদ্য হওয়া শিল্প ধর্মঘটে কয়লা শ্রমিকদের অংশগ্রহণ সর্বাত্মক ছিল না। তবে কৌশিকের বক্তব্যের বিপরীত বক্তব্য’ও কম নেই। গত একবছর ধরে ইসিএফ-এর ঠিকা নিরাপত্তারক্ষীদের কাজ হারানোকে কেন্দ্র করে ধারাবাহিক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কখনও ঠিকা শ্রমিকদের সমর্থনে সদর্থক ভূমিকা নিতে পারেনি। এখনও বহু মানুষ তাদের কাজ ফিরে পাননি। এই মানুষদের মধ্যে সংসদীয় বামেদের প্রভাব নেই বললেও চলে। প্যাচগুলিতে অমানবিক শ্রমিক শোষণ চললেও সবাই নিশ্চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করেছেন। এই শোষণ থেকে প্রাপ্ত মুনাফা একদিকে যেমন বেসরকারি কোন কোম্পানির পকেট গরম করছে, তেমনই সেই মুনাফা থেকে পরোক্ষভাবে লাভবান হচ্ছে সরকারি কোল কোম্পানিগুলি। স্থায়ী শ্রমিক ও ঠিকা শ্রমিকের মধ্যে বেতনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্যকে কমানোর কোন আন্দোলন আজ কয়লা অঞ্চলে নেই।
কয়লাখনি অঞ্চলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ধ্বস ও আগুনের সমস্যা। ঔপনিবেশিক সময় থেকে অবৈজ্ঞানিক মুনাফাসর্বস্ব কয়লা খননের ফলে এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বসপ্রবণ, বহু জায়গায় বছরের পর বছর রাবণের চিতার মতো আগুন জ্বলছে। খনি অঞ্চলের প্রবাদপ্রতিম সাংসদ প্রয়াত হারাধন রায় খনি অঞ্চলের মানুষদের এই অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এক ঐতিহাসিক জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন। সেই মামলার বক্তব্য ছিল দেশের ভূগর্ভস্থ সম্পদ উত্তোলন করতে গিয়ে মাটির ওপরে বহু প্রজন্ম ধরে বসবাসকারী মানুষেরা যদি বিপন্ন হন তবে সেই মানুষদের যথাযোগ্য ক্ষতিপূরণসহ পুনর্বাসন দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সেই মামলা তথা আন্দোলন চালাতে গিয়ে হারাধন রায় নিজের দলে (সি পি আই এম) একঘরে হন, শেষে বহিষ্কৃত হন। শেষবয়সে দৃষ্টিশক্তিহীন কপর্দকশূন্য এই মানুষটি দলত্যাগ করে গড়ে তোলেন, ‘খনি ও খনি অঞ্চল বাঁচাও সমিতি’। তাঁর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে সংগঠনটি লুপ্ত হয়।
তবে এই আপোষহীন মানুষটি বেঁচে থাকতেই তাঁর লড়াই-এর প্রাথমিক জয়টি দেখে যেতে পেরেছিলেন। সর্বোচ্চ আদালত এক অন্তর্বর্তী আদেশে পুনর্বাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২৬১০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে, যার মধ্যে ২৩৪ কোটি টাকা কোল কোম্পানি সরকারি কোষাগারে জমা করে। কথা ছিল “আসানসোল-দুর্গাপুর ডেভেলপমেন্ট অথরিটি” পুনর্বাসন প্রকল্প সম্পাদন করবে। তারপর দু’দশক ধরে দামোদর ও অজয় দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে, কিন্তু পুনর্বাসনের কাজ একচুলও এগোয়নি। কি বামপন্থী, কি দক্ষিণপন্থী – সবার সীমাহীন ঔদাসীন্য ও অনিচ্ছা ধীরে ধীরে কয়লাঞ্চলকে ঠেলে দিচ্ছে অনিবার্য পতনের দিকে। অথচ ভোটের বাজারে এই জ্বলন্ত সমস্যাটি একটা ফুটনোট হিসেবেও থাকছে না।
(৪)
রিয়া রায় কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী। বাজারি সংবাদমাধ্যমে আজকাল আমাদের দেশকে ‘রিপাবলিক অফ ইউথ’ বলে ডাকা শুরু হয়েছে। রিয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি ভাবছে ওরা। রিয়ার উত্তর, তারা সবাই চাকরির সুযোগ আগামী দিনে কেমন হবে, তা নিয়ে চিন্তিত। যে দেশে প্রধানমন্ত্রী বছরে ২ কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি দেন, সেখানে কর্মহীনতার ভয়ানক অবস্থা নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা ভাববে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রিয়া এটাও বলতে ভুলল না, যে তার চেয়েও অনেক বেশি আলোচনা হয় পাকিস্তানকে সার্জিকাল স্ট্রাইকের মাধ্যমে কীভাবে যোগ্য জবাব দেওয়া গেছে, তা নিয়ে। এই একই কথা একটু অন্যভাবে শুনলাম পড়াশোনা শেষ করে সদ্য মিউজিক টিচারের পদে যোগ দেওয়া তরুণী সঙ্ঘমিত্রা মুখার্জীর গলায়। চিত্রতারকা বা গায়ককে প্রার্থী করা, তার মতে, দলগুলির রাজনৈতিক অবক্ষয়ের প্রতীক। কিন্তু আজকালকার মানুষরা রাজনীতি নিয়ে ভাবেই না। প্রার্থীদের একটা ‘এন্টারটেনমেন্ট ভ্যালু’ আছে। সবাই আজ এটা মেনে নিয়েছে। সে-ও মানতে বাধ্য হচ্ছে। তবে আশার কথা, রিয়া বা সঙ্ঘমিত্রা বিশ্বাস করে, যে অন্য ভাবনা বা বিকল্পের প্রয়োজন আছে। তবে সেটা ভোটের রাজনীতির বাইরেই খুঁজতে হবে।
(৫)
কোন কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে শিল্পাঞ্চলের ভোট? রাজনৈতিক দলগুলির অবস্থাই বা কেমন? কথা হচ্ছিল পেশায় প্যারা-টিচার ও সিপিএম কর্মী সোমনাথ গুপ্তের সঙ্গে। প্রত্যয়ী সোমনাথ অনেকটাই নিশ্চিত, যে আসানসোল তথা সমগ্র রাজ্যে বামপন্থীরা এবার ভোটে ভালো ফল করবে। কারণ, ২০০৮-পরবর্তী সময় থেকে যে মানুষেরা নানান কারণে বামপন্থীদের প্রতি বিরূপ হয়েছিলেন, সোমনাথের ধারণা, তাঁরা এবার বামমুখী হবেন। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক কর্মসূচি, ব্রিগেড সমাবেশে উপচে পড়া ভিড় সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। ঠিক উল্টো মত বারাবনী বিধানসভা কেন্দ্রের, মির্জাপুর গ্রামের তৃণমূল কর্মী পরিমল মণ্ডলের। তাঁর মতে, যেভাবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গরীব মানুষের স্বার্থে একের পর এক প্রকল্প নিয়েছেন, তা প্রমাণ করেছে, এ সরকার গরীব মানুষের প্রকৃত বন্ধু। এই গরীবদের ভোট তৃণমূল ছাড়া আর কেউ পাবে না। আবার রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের রমেশের দাবি, বিজেপি ইতিমধ্যেই আসানসোলে জিতে গেছে। ঘোষণাটাই যা বাকি। তাঁর মতে, এই ভোট ধর্মের সাথে অধর্মের, মোদীই আজ পুরুষোত্তম রামের প্রতিনিধি। তাঁর সাথে তর্ক জুড়লাম। কথাপ্রসঙ্গে এল নোটবন্দীর ব্যর্থতা, বছরে দু’কোটি চাকরির ভুয়ো প্রতিশ্রুতি, প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা দেবার ‘জুমলা’। হিন্দিভাষী রমেশ তর্কে আগ্রহী নন। তাঁর সোজাসাপটা কথা, আগে পাকিস্তান ও চীনের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে। সেটা একমাত্র সম্ভব নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে।
এই দলগত সমীকরণ, ঝাঁ-চকচকে প্রচার, কুৎসার নিরন্তর বর্ষনের আড়ালে ঢেকে যাচ্ছে মানুষের কথা, তাঁদের জীবন-জীবিকার সমস্যার কথা। গলায় অসহায়তা নিয়ে কথা বলছিলেন লিটল ম্যাগাজিন কর্মি ও পেশায় শিক্ষিকা মিঠু বণিক। শহরের এক উদ্বাস্তু কলোনিতে বাড়ি তাঁর। ছোটবেলায় দেখেছেন, গল্প শুনেছেন, কীভাবে নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ওপার বাংলার ছিন্নমূল মানুষেরা গড়ে তুলেছিল কলোনি। বামপন্থার সেই ঐতিহ্য পরিত্যাগ করে আজ সেখানে দক্ষিণপন্থার দাপট। সমস্ত আলোচনার কেন্দ্রে ছদ্ম দেশপ্রেম, সার্জিকাল স্ট্রাইক, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রসাধনী উন্নয়নের একটেরে গল্প।
আর এই সবের মধ্যে অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো বয়ে চলেছে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ। গতবার রামনবমীর সময় এই শিল্পাঞ্চল রক্তাক্ত হয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। সেই সমীকরণকে আরো মজবুত করে ভোটযুদ্ধে জিততে চাইছে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল। প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতায় এখনো বিষিয়ে আছে শহরের আকাশ-বাতাস। খনি অঞ্চলের এক পোড় খাওয়া শ্রমিক নেতা কথাপ্রসঙ্গে টেনে আনলেন ট্রোজান হর্সের কথা। এঁদের অনেকেরই ভোট এবার অন্য দলের বাক্সে পড়বে। আর যাঁরা রুজি-রুটির লড়াই, নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন, তাঁদের আজ বামপন্থার নতুন দিশা খুঁজতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক বামপন্থার বিপ্রতীপে সংগ্রামী বামপন্থার অনুসন্ধানই পারবে নতুন লড়াইয়ের ইতিহাস তৈরি করতে। শুধু আসানসোল নয়, গোটা দেশেরই আজ বিকল্প রাজনীতির বড় প্রয়োজন।
লেখক একজন স্কুল শিক্ষক ও গনতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের কর্মী।
Excellent piece of true journalism but where is the way out? I think a complete turmoil is going on but mass is the ultimate judge, we have to keep faith on people, they will understand everything and give birth true leaders like Kanaialal etc.