রাম–রহিম দ্বন্দ্বের চোরাস্রোত বসিরহাট লোকসভা নির্বাচনী ক্ষেত্রে বইছে। এই সমূহ সর্বনাশের গভীরতার হিসেব মিলবে আগামী ২৩ মে। কিন্তু ইতিমধ্যেই আরও এক সর্বনাশ ঘটে গিয়েছে এই নির্বাচনী ক্ষেত্রের মিনাখাঁ, সন্দেশখালি, হাড়োয়ায়। সেখানে পাথরের গুঁড়ো বুকে নিয়ে অসহায় দিন গুনছেন শিল্পাঞ্চল থেকে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকরা। মারণরোগ সিলিকোসিস রাম–রহিমে বাছবিচার করেনি। তবু মহিদুল, বঙ্কিম, ভাস্কর, সোলেমানরা নির্বাচনের ইস্তাহারে জায়গা করে নিতে পারল কই ! লিখছেন দেবাশিস আইচ ।
যুবক বয়সেই বুড়িয়ে গিয়েছেন মহিদুল মোল্লা। টানা দুই–এক কিলোমিটারের বেশি হাঁটতে পারেন না। হাঁপিয়ে যান। শ্বাস কষ্ট হয়। টিপ কল টিপে যে একটু জল ভরবেন — পারেন না। ভারী মাল বইতে পারেন না। মাঝে মাঝে কাশতে কাশতে রক্ত ওঠে। কত আর বয়স মহিদুলের। সমীক্ষার দলিলে লেখা আছে ৩৩ বছর।
মিনাখাঁর গলদা গ্রামের এই যুবক এক সময় মাঠেঘাটে চুটিয়ে কাজ করতেন। তবে নিয়মিত আয় ছিল না বেশি। তো আজ থেকে আট বছর আগে গ্রাম ছাড়লেন মহিদুল। আসানসোল, রানিগঞ্জ, কুলটিতে ফায়ার ব্রিকস উৎপাদনের বেশ কিছু কারখানা রয়েছে। মিনাখাঁর বহু যুবকই এই কারখানাগুলোতে কাজ করেন। সেই সূত্রেই তাঁর যাওয়া। দৈনিক ২০০–২৫০ টাকা মজুরিতো গ্রামে মিলবে না।
ওই শিল্পাঞ্চলে বালাকৃষ্ণ মিনারেলস, তারা মা মিনারেলস, লক্ষী স্টোন ফ্যাক্টরির কেউ ফায়ার ব্রিকস উৎপাদন করে, কেউ–বা ব্রিকস কারখানার জন্য কোয়ার্টজ পাথরের পাউডার উৎপাদন করে। মহিদুল অবশ্য তার কারখানার নাম বলতে পারলেন না। আসানসোলের জামুরিয়ার কথা মনে আছে। আর আছে এক বিকাশবাবুর নাম। তাঁকেই মালিক বলে জানতেন। মনে রাখবেনই বা কী করে? তাঁর না ছিল কাজে যোগ দেওয়ার কোনও চুক্তিপত্র না কারখানায় ঢোকা বেরনোর আইডিন্টিটি কার্ড। থাকবে কী করে! চাকরি তো হয় দালাল কিংবা আড়কাঠির মাধ্যমে। কারখানা থেকে বের হওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। কম্পাউন্ডের মধ্যেই থাকা–খাওয়া। এক রকম বন্দিজীবন।
কী জাতীয় কাজ করতেন? মহিদুল জানাচ্ছেন বল মিল, গ্রাইন্ডার ইউনিটের কাজ ছিল। সাধারণ ভাবে এই কারখানাগুলো কাজের প্রক্রিয়া হচ্ছে বড়ো বড়ো ক্র্যাশার মেশিনে পাথর ভাঙা তার পর সেই ছোট ছোট টুকরো মিলিং মেশিনে ফেলে পাউডার তৈরি করা। সারা কারখানা জুড়েই উড়ে বেড়ায় এই পাথরের ধুলো বা পাউডার। আশেপাশের গাছপালা, কারখানার শেড সবই সারা বছর ধুলোর চাদরে ঢাকা থাকে। কোনও কোনও ইউনিটে এমন পরিস্থিতিতে কাজ করতে হয় শ্রমিকদের যে, দু‘হাত দূর থেকে কেউ কাউকে স্পষ্ট দেখতে পায় না। এতই ঘন সেই ধুলোর ধোঁয়া । সারা শরীর, জামা–কাপড় ধুলোয় ধূসরিত হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ নাক–মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক দেয় বটে, তবে তা কাজে লাগে না। মাস্কের সঙ্গে গামছা জড়িয়েও লাভ হয় না এমনটাই দাবি শ্রমিকদের। বিশেষজ্ঞদের মতে এই সিলিকা কণা এতোটাই মিহি যে সাধারণ ভাবে ব্যবহৃত মাস্কে তা রোধ করা যায় না। তা হলে প্রয়োজন এই মিহি ধুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উপযুক্ত সুরক্ষা উপকরণ বা যন্ত্রপাতি। তার কোনও বালাই নেই এই সমস্ত কারখানায়। সহৃদয় মালিকেরা কলাটলা খেতে দেন যাতে মুখ দিয়ে খাদ্যনালীতে প্রবেশ করা সিলিকা পাউডার যথাসম্ভব পরিষ্কার হয়ে শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্ত, শ্বাস প্রক্রিয়ার সঙ্গে ফুসফুসে গিয়ে জমা হয় এই ধূলিকণা। ফুসফুস ক্রমে পাথর কণা জমে জমে শক্ত হয়ে ওঠে। কাজ করার ক্ষমতা হারায়। কাজ করার ক্ষমতা হারায় শ্রমিকও।
গত ৪ এপ্রিল দিল্লিতে এই প্রথম সাফাই কর্মচারীদের সংগঠন ‘সাফাই কর্মচারী আন্দোলন’ মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার অধিকারের দাবি তুলে সাংগঠনিক ইস্তেহার প্রকাশ করল। নির্বাচনী ইস্তেহারের লক্ষ্য অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলি। খালি হাতে নাঙ্গা শরীরে জমাদার / ধাঙররা শহরের গালি পিটে প্রায় নিয়মিত হারে দমবন্ধ হয়ে মরে যায় । শহরের তাবড় আস্তাকুঁড়, নিকাশি নালা, ভূগর্ভস্থ পয়ঃপ্রণালী, আবর্জনার বৃহৎ তাগাড়, মরা পশুদের ভাগাড় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখে যাঁরা নগর ও নাগরিকের স্বাস্থ্যরক্ষা করেন সেই সব দলিতের দলিত ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার’ বা ধাঙরদের মর্যাদা তো দূরের কথা বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও স্বীকৃত নয়। অবশেষে জীবনের অধিকারের দাবিতে তাঁরা মুখর হয়েছেন। মুখর হয়েছেন শিক্ষা, কাজের মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশ, স্বাস্থ্যের অধিকারের দাবিতে। সর্বোপরি ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিংয়ের বিলোপের দাবিতে। সর্বোপরি ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিংয়ের বিলোপের দাবিতে। সমীক্ষা বলছে, কাজ করতে গিয়ে প্রতি তিনদিনে একজন জমাদারের মৃত্যু হয়। এ বছর প্রথম তিনমাসে মৃত্যু হয়েছে ৩৯ জনের।
সিলিকোসিসেও মৃত্যু–মিছিলের বিরাম নেই পাথর খাদান কিংবা কোয়ার্টজ পাউডারের কারখানায়। দীর্ঘকাল ধরে রোগে ভুগে তিলে তিলে মরে শ্রমিকরা। এ রোগ যাঁর বুকে বাসা বাঁধে তাঁর জীবনের নিশ্চয়তা নেই। শুধু তো সিলিকোসিস নয়, কয়লাখনির শ্রমিকদের নিয়ামোকোসিস, আসবেস্টোসিস, চা বাগানে কীটনাশক বিষক্রিয়া থেকে শুরু করে নির্মাণ শিল্পে যুক্ত শ্রমিকরা নানা পেশাজনিত রোগে জর্জরিত। আই এল ও‘র এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, ফি বছর বিশ্বে ২৪ লক্ষ মানুষ পেশাজনিত কারণে মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন ২০.২ লক্ষ শ্রমিক এবং দুর্ঘটনায় শিকার হয়ে মারা যাচ্ছেন ৩.৮ লক্ষ জন। পরিসংখ্যানটি কিছুটা পুরনো এবং মনে রাখতে হবে চিত্রটি সার্বিক নয়। আমাদের মতো দেশে যেখানে পেশাজনিত রোগের অস্তিত্বই স্বীকার করা হয় না, শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের অধিকার তো দূরের কথা। কারখানার খাতায় যেখানে শ্রমিকদের নাম–ধাম–পরিচয়টুকুই থাকে না, সেখানে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থার পরিসংখ্যান সত্যের থেকে বহুদূরেই অবস্থান করে।
ঝাড়খণ্ডের দিকে চোখ ফেরালে দেখতে পাব, পাথর ভাঙা ক্রাশার এবং র্যামিং মাস ইউনিটে এবং দূষণকারী শিল্পে সিলিকোসিসে আক্রান্ত শ্রমিকের সংখ্যা ২৫-৩০ লক্ষ। ৫৫ শতাংশ ক্রাশার শ্রমিকদের মধ্যে সিলিকোসিস পাওয়া গিয়েছে। ভয়াবহ তথ্য এই যে কোয়ার্টজ কারখানার রামিং মাস উৎপাদনকারী শিল্পে সিলিকোসিসে মৃত ও আক্রান্ত শ্রমিক ৮০ শতাংশ। এই শিল্পে শ্রমিকদের গড় আয়ু ৩৩ বছর।
শুধু তো মহিদুল মোল্লা নয়, মিনাখাঁর বঙ্কিম মণ্ডল, ভাস্কর মণ্ডল, নবকুমার মণ্ডল, আবুল পাইক, রহমান মোল্লারাও সিলিকোসিসে আক্রান্ত। ২০১৮ সালের ২২ অগস্ট পর্যন্ত ওসাজ-এর তথ্য অনুযায়ী শুধু মাত্র মিনাখাঁ ব্লকে দু’শোর বেশি মানুষ সিলিকোসিসে আক্রান্ত। এর মধ্যে ১৯-২০ জনের অবস্থা সঙ্কটজনক। সন্দেশখালি ব্লকে ১৫০ জন আক্রান্তের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। হাড়োয়া ব্লকে মিলেছে আরও ৫০ আক্রান্তকে। এঁরা সকলেই আসানসোল, রানিগঞ্জ শিল্পাঞ্চলে বিভিন্ন সিলিকা গুঁড়ো উৎপাদনকারী কোয়ার্টজ চূর্ণ, কয়লা খনির বর্জ্য পেষাই এবং ফায়ার ব্রিকস তৈরির কারখানায় ২০০৫ সাল থেকে কাজ করতেন। পার্শ্ববর্তী ঔরঙ্গাবাদ, গয়া জেলার শত শত পরিযায়ী শ্রমিকও এ রাজ্যে এই কাজে যুক্ত। সারা রাজ্যে সমীক্ষা করলে দেখা যাবে আক্রান্ত শ্রমিকের সংখ্যাটি ঢের বেশি। ২০১৪ সালে মিনাখাঁয় সিলিকোসিসে আক্রান্তদের বিষয়টি ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের নজরে আনে অকিউপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অফ ঝাড়খণ্ড বা ওসাজ। কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী সিলিকোসিসে মৃত ৯ জনের পরিবারকে রাজ্য সরকার ৪ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এছাড়াও রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ১৩৩ জনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, এক্স রে করা হয়। সম্প্রতি কলকাতায় ওসাজের পক্ষ থেকে ওই অঞ্চলের আরও ৪৫ জনের এক্স রে পরীক্ষা করা হয়েছে। তবে মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী আক্রান্তদের কেউ এখনও নির্দিষ্ট ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পাননি। রাজ্যের শ্রম ও স্বাস্থ্য দপ্তরের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর এটুকু আলোর রেখা দেখা গিয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হল এই ধুলো, পাথর–কয়লার মিহি গুঁড়োর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিষয়ে আদৌ কি কোনও শ্রমিক–স্বাস্থ্য নীতি রয়েছে? বলে ফেলা ভালো রাজ্যস্তরে তো দূরের কথা কোনও জাতীয় নীতিই নেই। ফ্যাক্টরি অ্যাক্ট ১৯৪৮, দ্য মাইনিং অ্যাক্ট ১৯৫২, সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত আইনি অধিকার ইএসআই ১৯৪৮ এবং ১৯২৩ সালের ওয়ার্কমেন কম্পেনসেশন অ্যাক্ট সহ অন্যান্য আইনে শ্রমিকদের পেশাগত নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক অধিকার রয়েছে। এই মৃত্যুপুরীগুলি প্রমাণ করে এই সমস্ত আইন, আইনি রক্ষাকবচগুলিকে মালিকরা চূড়ান্ত অবহেলা করে চলেছেন। চলতে পারছেন সরকার এবং শ্রমিক সংগঠনগুলির চরম উদাসীনতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণেই।
নির্বাচনের প্রাক্কালে সাফাই কর্মচারীরা জীবনের অধিকার দাবি করে ইস্তাহার প্রকাশ করেছে। জীবনের অধিকার মহত্তম মৌলিক অধিকার। সিলিকোসিসে আক্রান্তদের জন্য লেখা হয়ে ওঠেনি কোনও নির্বাচনী ইস্তাহার। আসলে এই শ্রমিকদের জন্য আজও রাজ্য কিংবা দেশব্যাপী তেমন কোনও শক্তিশালী নিজস্ব সংগঠন গড়ে ওঠেনি। বৃহৎ শ্রমিক সংগঠনগুলির সিলিকোসিস কিংবা এই জাতীয় পেশাগত রোগের প্রতিরোধে কোনও বিশেষ ভূমিকা লক্ষ করা যায় না। কিন্তু, খাদান, খনি, কারখানাগুলি শ্রমিকের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। স্বাস্থ্যের অধিকারও যে মানবিক অধিকার তা ভুলিয়ে ছেড়েছে। এই শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য এখনই জরুরি নির্দিষ্ট নীতি প্রস্তুত করা। শ্রমিকদের আইনি অধিকার, মানবাধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, পরিবেশ সংরক্ষণকে এই নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শ্রমিকদের পেশাগত ও স্বাস্থ্যের নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করতে সরকার, শ্রমিক ইউনিয়ন, মালিকপক্ষকে দায়বদ্ধ করে তুলতে হবে। সর্বস্তরে সচেতনতা প্রসারও জরুরি। আরও এক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। না, কোনও রাজনৈতিক দলের সামনে সিলিকোসিস এবং পাথরভাঙা মৃত্যুপুরীগুলি প্রশ্ন চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়নি। দেশের নাগরিকদের প্রতি এই অবহেলা হত্যাকাণ্ডের সামিল। এই দায় কেউ এড়িয়ে যেতে পারে না।
ফিচার ছবি: সিলিকোসিসে আক্রান্ত সহস্রাধিক শ্রমিকের মালঞ্চ থেকে মিনাখা প্রতিবাদ মিছিল।
দেবাশিস আইচ সাংবাদিক ও সমাজকর্মী, বর্তমানে গ্রাউন্ডজিরোর হয়ে সাংবাদিকতা করছেন।
(This report was originally published on 9th April 2019. It has been updated on 9th May, 2019)