সারা দেশের সঙ্গেই কলকাতাও ৪ঠা এপ্রিল সাক্ষী থাকল এমন এক মিছিলের যা মানুষের অধিকার আর গণতন্ত্রের কথা বলে, বলে – “নারী ও রূপান্তরকামী দিচ্ছে ডাক – ফ্যাসিবাদ নিপাত যাক।” যুদ্ধ-জিগির ও হিংসার বিরূদ্ধে, ঘৃণা ও বিভেদের রাজনীতির বিরূদ্ধে, এবং গণতন্ত্র, শান্তি, সংহতি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে এই মিছিল এক নতুন সময়ের বার্তা দেয়। লিখেছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী ।
“পথে নেমেছি মেয়ের দল
এই ভোটে চাই দিন বদল।”
কলকাতার রাজপথ কাঁপিয়ে হাজার হাজার মহিলা ও রূপান্তরকামী মানুষ যখন ‘আজাদি’-র শ্লোগান দিয়ে নির্বাচনের আগে ৪ঠা এপ্রিল রাস্তার দখল নিলেন তখন অর্ধেক আকাশ নয়, মনে করা স্বাভাবিক যে পুরো আকাশের দখল নিতেই প্রস্তুত তাঁরা। বিশেষ করে সংসদীয় রাজনীতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে যখন তাঁরা নিজেদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করছেন তখন নিজেদের অধিকারটুকু সুরক্ষিত করার জন্য এই মুহূর্তে তাঁদের পথে নামা ছাড়া কোনও উপায় নেই। কারণ তাঁরা জানেন যে নিজেদের দাবি যদি উঁচু গলায় না বলেন তাহলে ক্রমাগত তাঁদের প্রান্তিক করে রাখা হবে এবং হাতে ‘টোকেন’ হিসাবে কিছু প্রকল্প ধরিয়ে দিয়ে এই সরকার তাঁদের কেবলই গৃহবন্দী করে রাখার প্রয়াস করবে।
না হলে রাজস্থানের ভোটপ্রার্থী কীভাবে বলার সাহস রাখেন যে তিনি জিতে এলে সেখানে বাল্যবিবাহ চালু করবেন? কীভাবে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বলেন – মহিলাদের মুক্ত বা স্বাধীনভাবে ছেড়ে রাখা যায় না? তাদের ‘এনার্জি’ না কি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, না হলে তা মুল্যহীন, ধ্বংসাত্মক হয়ে যাবে। এই স্পর্ধা, এই দুঃসাহস জনপ্রতিনিধিরা পান কী করে! ভোটদাতাদের মধ্যে যে বিরাট সংখ্যক মহিলা থাকেন, তাঁদের প্রতি এই অবমাননাকর চিন্তার সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়াটা দরকার ছিল। আর তার জন্য রাজনৈতিক কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলের পতাকা ছাড়া মহিলা ও রূপান্তরকামীদের এই মিছিল সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সারা দেশের নিরিখে নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
একই দিনে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে সর্বস্তরের মহিলারা জোটবদ্ধ হয়ে পথে নেমেছিলেন। শ্লোগান আর দাবীতে সোচ্চার ছিল তাঁদের এই পথচলা। গত পাঁচ বছরে দেশ জুড়ে ক্রমাগত বাড়তে থাকা নারীর প্রতি মারাত্মক হিংসাত্মক কার্যকলাপ ও সেইসঙ্গে তাঁদের স্বাধীনতার পরিসরে হস্তক্ষেপ এরকম ব্যাপকভাবে তাঁদের পথে নামতে বাধ্য করল। রাষ্ট্র যখন তাঁর নাগরিকদের নিরপত্তা ও সম্মান নিজের হাতেই খর্ব করে তখন এছাড়া আর উপায় কী। ভাবতে অবাক লাগে যে দেশে নালসা জাজমেন্ট পাশ হয়ে গেছে সেখানে একটিমাত্র সর্বভারতীয় দল ছাড়া আর কারওর প্রার্থী তালিকায় কোনও রূপান্তরকামী প্রার্থী নেই! কোনও সর্বভারতীয় দলের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো-তে জায়গা পায়নি যৌনকর্মী বা গৃহশ্রমিকদের শ্রমের অধিকারের কথা। আদিবাসী, বনবাসী মানুষেরা তাঁদের জীবন-জীবিকার স্বাভাবিক অধিকার থেকে রাষ্ট্রের দ্বারা বঞ্চিত হচ্ছেন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, পেশা, যৌন ও লিঙ্গ পরিচয় সবকিছুর ভিত্তিতে ক্রমশ নাগরিকদের একেকটি খোপে বন্দী করে দেওয়া হচ্ছে আর তারমধ্যেও প্রান্তিকতম করে দেওয়া হচ্ছে শরীর ও মনে যাঁরা মহিলা তাঁদের কন্ঠকে, তখন নির্বাচনের আগে এভাবেই এক জোটবদ্ধ পথ হাঁটা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় বটেই। এই অবস্থায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তাঁদের দায়িত্ব আরও একবার মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে বৈ কি।
দেশজোড়া এই নারী ও রূপান্তরকামীদের মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন রাজনৈতিকভাবে যাঁরা সচেতন সেইসব ব্যক্তি নারী, রূপান্তরকামীরা, সংগঠন যাঁরা মহিলাদের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে চলেছেন বা যাঁরা পড়ুয়া, তুলনামূলকভাবে নতুন আন্দোলনকর্মী। এই মিছিল #দিন বদলের জন্য নারীদের মিছিল। এই খোলা মঞ্চে বিভিন্ন গোষ্ঠীর নারী, রূপান্তরকামী মানুষেরা সোচ্চার হয়েছেন নিজেদের দাবীতে। এই মিছিলের দাবী – শান্তিপূর্ণ দেশ, হিংসাবিরোধী দেশ, সকল নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা হয় এমন দেশ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ হয় এমন দেশ, সবরকম বিদ্বেষ ও বৈষম্য মুছে যাওয়া দেশ। আর এই বদল মহিলাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছাড়া, নির্বাচনে প্রভাব ফেলা ছাড়া উপায় নেই।
প্রথম ভোট দিচ্ছেন প্রমীলা ভুইঁঞা, আজাদ ফাউন্ডেশন থেকে গাড়ি চালকের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তিনি এসেছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগণা থেকে। কেন এসেছেন প্রশ্ন করায় মৃদু স্বরে বললেন, “দেশে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে লড়াই তা চাই না, একটা আন্দোলন চলছে। আমি চাই ভোটে যে জিতবে সে যেন পাবলিক-এর খেয়াল রাখে, সবার মধ্যে যেন সমতা থাকে,” প্রমীলার হাতের কাট-আউটে লেখা ‘ডেমোক্রেসি’।
সুন্দরবনের বিজয়নগর দিশা থেকে এসেছিলেন তাপসী মন্ডল। বিভিন্ন কবির উক্তি লেখা ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, যেখানে বৈচিত্র্যের মধ্যে মিলের কথা বলা হচ্ছে। নিজেই উৎসাহের সঙ্গে বললেন তাঁর মিছিলে যোগ দেওয়ার কারণ – “অধিকারের জন্য আমরা মেয়েরা রাস্তায় নেমেছি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য সব কিছুতেই অনেক প্রকল্প ঘোষণা হলেও আমরা কতটুকু সুবিধা পাই? খেলাধূলো করে যে মেয়েরা তারও তো কোনও সুবিধা পায় না। যারা ট্রান্সজেন্ডার কত অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত থাকেন। গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য পরিষেবা অমিল। এই সব আমরা ভোট দিয়ে বদলাতে চাই।”
এদিনের মিছিলের একটা বড় অংশ ছিলেন রূপান্তরকামী মানুষেরা। সুপ্রীম কোর্টের ২০১৪ সালের নালসা রায়ের বিরূদ্ধে গিয়ে বর্তমান কেন্দ্র সরকারের আমলে এসেছে ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস্ প্রোটেকশন অফ হিউম্যান রাইটস্ বিল। দেশজুড়ে লাগাতার আন্দোলন চলছে তার বিরূদ্ধে। সরাসরি কেন্দ্র সরকার বিরোধী, তাদের সাম্প্রদায়িক নীতি বিরোধী শ্লোগান উঠে আসছিল রূপান্তরকামী, সমকামী মানুষদের মধ্যে থেকে। দেখা গেল প্ল্যাকার্ড – “মোদি তুমি দুষ্টু লোক/তোমার মাথায় উকুন হোক”। কথা হচ্ছিল রূপান্তরকামী জুলি-র সঙ্গে। বললেন, “দেশে যাতে গণতন্ত্র বজায় থাকে সেটা দেখা এখন আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। আমাদের দাবি যে আমাদেরও আর পাঁচজন মানুষের মতো বাঁচার অধিকার দিতে হবে। বর্তমানে দেশের পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সবদিক থেকেই আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। ভোট দেওয়ার সময় মনে রাখব আমরা যেন স্বাধীনভাবে, সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারি।”
বর্ষীয়ান সমাজকর্মী নির্মলা বন্দোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন মিছিলে। কেন ২০১৯-এর নির্বাচনের আগে এই মিছিল গুরুত্বপূর্ণ জানতে চাওয়ায় বললেন – “দেখুন, এই মিছিলটায় সব ধরনের মেয়েরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপস্থিত হয়েছেন। কারণ তাঁরা নির্বাচনে নিজেদের মতপ্রয়োগের গুরুত্ব বুঝেছেন। আরও বেশি করে নিজেদের জীবিকা, সুরক্ষা, শ্রমের অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকারের কথা তাঁদের বলতেই হবে।”
এদিনের মিছিলে সমস্ত পরিসর থেকে সব বয়সের মহিলা ও রূপান্তরকামী মানুষেরা যোগ দিয়েছিলেন। গৃহশ্রমিকেরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন যৌনকর্মীরা, পড়ুয়া থেকে শিক্ষিকা, সমাজকর্মী থেকে নাট্যকর্মী হাজির হয়েছিলেন সকলেই দেশজুড়ে চলা ফ্যাসিবাদের বিরূদ্ধে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করার জন্য। ডায়মন্ড হারবার থেকে এসেছিলেন তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়া রিঙ্কু খাতুন। রিঙ্কুর বক্তব্য “মেয়েরা অনেক কিছু পায় না। তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়া, বাড়ির বাইরে বেরোতে না দেওয়া এগুলোর মুখোমুখি হই সব সময়ে আমরা। আমাদের অধিকারগুলো যেন আমাদের থেকে কেড়ে না নেওয়া হয়। নিরাপত্তার অভাব বোধ করি আমরা সব সময়ে। সন্ধ্যা হলে বাড়ির বাইরে বেরোনোটাই সমস্যার। এই সবকিছুর বিরূদ্ধে একজোট হয়েই তো এই মিছিল!”
তপতী হালদার যেমন তাঁর প্রতিবেশীদের থেকে শুনে এই মিছিলে এসেছিলেন। কেন? “আসব না কেন? আমাদের মেয়েদেরই তো সবচেয়ে বেশি অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়। ঘরে, বাইরে সবচেয়ে বেশি লড়তে হয়। অথচ ভোট হলে আমাদের কেউ যেন পাত্তাই দেয় না। আমাদের কথারও গুরুত্ব আছে। এটা বোঝাতেই এই মিছিলে আসা।” তহসিনা বানু যেমন বহুদিন ধরেই সমাজকর্মী। কিন্তু তাঁর পরিবারে বারবার বাধা দেওয়া হয়েছে কাজ চালিয়ে চাওয়ার জন্য। সন্তানের জন্ম, সন্তানের অসুস্থতাকে কারণ বলা হয়েছে। তাঁর স্বামীও কখনও গুরুত্ব দেননি। মিছিলে আসার আগে পর্যন্ত বলেছেন – “মেয়েদের মিছিল আর কত বড় হবে?” তারপর রাস্তায় যখন প্রায় ২০০০-এর কাছাকাছি মহিলাকে একসঙ্গে পথে মিছিলে হাঁটতে দেখেছেন তখন ফোন করে তহসিনাকে জানিয়েছেন যে আজ তিনি বিশ্বাস করলেন মেয়েরাও বড় কাজ করেন। তহসিনার মতো আরও অনেকের মিছিলে আসার সাফল্য সম্ভবত এখানেই। নিজের পরিবার থেকেই তো দিন বদলের কাজ শুরু হয়।
মিছিলে ছিলেন অনেক গৃহশ্রমিক মহিলা। তাঁদের শ্রমের অধিকারের দাবিই বৃহত্তরভাবে তাঁদের রাজনৈতিক দাবি হয়ে উঠছিল। ন্যূনতম মজুরি, ন্যায্য ছুটি, কাজের জায়গায় সম্মান, মাতৃত্বকালীন ছুটি দাবি উঠেছে এইসবেরই। নির্বাচনের প্রচার বা ম্যানিফেস্টোয় ভোটপ্রার্থী রাজনৈতিক দলগুলি যতই এগুলিকে উপেক্ষা করুন না কেন, ভোটদাতাদের এক বড় অংশের দাবি না শুনলে প্রকারান্তরে তাঁরাই সমস্যায় পড়বেন।
নিজের প্রতিবন্ধী সন্তান ঋত্ত্বিকা বসুকে সঙ্গে নিয়ে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন সুরমিত্রা বসু। যে সরকার প্রতিবন্ধী মানুষদের ‘দিব্যাঙ্গ’ বলে দায়িত্ব সারেন, অথচ প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকারের আইন থাকা সত্ত্বেও তার রূপায়ণে কাজ করেন না, তাদের বিরূদ্ধে স্বর তুলেছেন তিনি। বললেন, “নির্বাচন তো প্রতি পাঁচ বছর অন্তর আসে। সব নির্বাচনই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে আমরা এমন একটা সময়ে এসে পৌঁছেছি যেখানে আমাদের নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিক অধিকার, মৌলিক অধিকার সবই বিপন্ন। প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য আইন হলেও তা প্রয়োগে সরকার কোনও কাজ করেনি। এই অবস্থায় পথে নামা ছাড়া উপায় কী?”
সারা দেশের সঙ্গেই কলকাতাও এদিন সাক্ষী থাকল এমন এক মিছিলের যা মানুষের অধিকার আর গণতন্ত্রের কথা বলে, বলে – “নারী ও রূপান্তরকামী দিচ্ছে ডাক – ফ্যাসিবাদ নিপাত যাক।” যুদ্ধ-জিগির ও হিংসার বিরূদ্ধে, ঘৃণা ও বিভেদের রাজনীতির বিরূদ্ধে, গণতান্ত্রিক পরিসরে হস্তক্ষেপের বিরূদ্ধে এবং গণতন্ত্র, শান্তি, সংহতি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে এই মিছিল এক নতুন সময়ের বার্তা দেয়। পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোয় যে নারী ও রূপান্তরকামীদের বহুস্বর শোনা যায় তা শ্লোগান তোলে আসিফার ধর্ষণ ও হত্যা থেকে আফস্পা-র বিরূদ্ধে, রোহিত, নাজিবের মৃত্যু আর হারিয়ে যাওয়ার বিরূদ্ধে, গৌরি লঙ্কেশ, কালবুর্গী, পানেসরের হত্যার বিরূদ্ধে, পছন্দের খাবারের জন্য খুন হয়ে যাওয়ার বিরূদ্ধে, দলিত মানুষদের অপমানের বিরূদ্ধে, আদিবাসীদের উচ্ছেদের বিরূদ্ধে, বলে – “হাম ভারতকে নারী হ্যায়/ফুল নেহি চিঙ্গারি হ্যায়”, যে স্ফূলিঙ্গ সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, যা ফ্যাসিবাদের হাত থেকে লড়াই করেই ছিনিয়ে নেবে ‘আজাদি’, ‘স্বাধীনতা’।
লেখক সাংবাদিক এবং ডকুমেন্টারি নির্মাতা। ছবির সুত্রঃ লেখক।