ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সজেন্ডার ডে অফ ভিজিবিলিটি – বাংলা মানে করলে দাঁড়ায় আর্ন্তজাতিক রূপান্তরকামী দৃশ্যমানতা দিবস। নিজেদের স্বত্ত্বা ও লিঙ্গ পরিচয় প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, সেইসব রূপান্তরকামী মানুষদের জীবনকে উদ্যাপনের জন্য ও তাঁদের লড়াইয়ের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতেই ১১ বছর ধরে এই দিনটি পালন হয়ে চলেছে। লিখেছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী ।
ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সজেন্ডার ডে অফ ভিজিবিলিটি – বাংলা মানে করলে দাঁড়ায় আর্ন্তজাতিক রূপান্তরকামী দৃশ্যমানতা দিবস। গত ২০০৯ সাল থেকে এই দিনটি পালন হয়ে আসছে প্রতি বছর ৩১শে মার্চ তারিখে। শুরুটা হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। রূপান্তরকামী আন্দোলনকর্মী রাচেল ক্র্যান্ডেল (Rachel Crandall)-এর উদ্যোগে শুরু হয় এই দিনটি উদ্যাপন, যা আজ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এর আগে পর্যন্ত যেসব রূপান্তরকামী মানুষেরা ঘৃণা-বিদ্বেষ-হিংসার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের স্মরণে বছরে একটি দিন পালন করা হত ‘ট্রান্সজেন্ডার ডে অফ রিমেম্বারেন্স’ হিসাবে। কিন্তু সব প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়িয়েও যাঁরা নিজেদের স্বত্ত্বা ও লিঙ্গ পরিচয় প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, সেইসব রূপান্তরকামী মানুষদের জীবনকে উদ্যাপনের জন্য ও তাঁদের লড়াইয়ের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতেই ১১ বছর ধরে এই দিনটি পালন হয়ে চলেছে।
ভারতবর্ষে এই দিনটির আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে একটা আলাদা গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। এমন একটি সামাজিক, রাজনৈতিক সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি যখন সব রকম প্রান্তিক স্বরকেই রাষ্ট্র দাবিয়ে রাখতে চাইছে। তাঁর মধ্যে যৌন ও লিঙ্গ পরিচয়ের প্রান্তিকতাও অবশ্যই পড়ে। রূপান্তরকামী মানুষদের দীর্ঘ বহু দশকের লড়াইয়ের স্বীকৃতি যেমন আসছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ার মধ্যে দিয়ে, তেমনি রাজনৈতিকভাবে তাদের যেন একরকমভাবে অদৃশ্যই করে রাখা হচ্ছে। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিভিন্ন দলের ঘোষিত প্রার্থীদের মধ্যে তাই রূপান্তরকামী কোনও মানুষ চোখে পড়েন না। অনেক সময়েই যে সামাজিক, রাজনৈতিক স্বীকৃতি সরকারি বা প্রশাসনিক তরফে আসে তা যেন ‘টোকেনিজম’-এর রাজনীতি।
অথচ ভুললে চলবে না গত ২০১৪ সালে ভারতের রূপান্তরকামী মানুষেরা মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট-এর নির্দেশ কার্যকরী হওয়ার ফলে পেয়েছেন নালসা (ন্যাশনাল লিগাল সার্ভিস অথরিটি) জাজমেন্ট, যেখানে তাঁদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, ভারতের সংবিধান অনুযায়ী তাঁরা সমস্তরকম মৌলিক অধিকার পেতে পারেন বলে জানানো হয়েছে এবং তাঁরা নিজেরাই নিজেদের লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণ করতে পারবেন এও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। এ কথাও এখানে উল্লেখিত যে লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে তাঁদের প্রতি কোনও রকম বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না। যদিও বাস্তবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা ও দৈনন্দিন জীবনে এই বৈষম্যের ছবিটা অত্যন্ত স্পষ্ট। তা সত্ত্বেও বর্তমান কেন্দ্র সরকার ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস (প্রোটেকশন অফ রাইটস্) বিল, ২০১৬ নামে এমন একটি বিল লোকসভায় পাশ প্রণয়নের চেষ্টা করল যা রূপান্তরকামী সম্প্রদায়ের জন্য অপমানজনক ও তাঁদের স্বার্থবিরোধী। যদিও এই বিল-এর বিরূদ্ধে সারা দেশব্যাপী রূপান্তরকামী মানুষেরা লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
আজ ৩১শে মার্চ রূপান্তরকামী পরিচয় উদ্যাপনের দিনে এই রাজনৈতিকভাবে দেওয়ালে পিঠ ঠেকা অবস্থায় অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন সেই মানুষগুলিই যাঁরা নিজেদের অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রান্তিকতা, প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে নিজেদের সম্প্রদায়ের অধিকার আন্দোলনের মুখ হয়ে ওঠেন। যেমন – সিন্টু বাগুই। গত ৯ই মার্চ ২০১৯ সিন্টু হুগলির লোক আদালতে বিচারকের আসনে বসেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় শেওড়াফুলির বাসিন্দা রূপান্তরকামী সিন্টু-র এই সম্মান এক বিশেষ প্রাপ্তি। সিন্টু জানালেন, নিজের জেলায় ও কলকাতায় রূপান্তরকামী সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালানোর সুবাদেই পরিচয় হয় হুগলি জেলা আইনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। তাঁর এই সম্প্রদায়ের বিষয়ে সচেতনতা তৈরির নানা উদ্যোগে অনেক সময়েই পাশে ছিলেন তাঁরা। এভাবেই পরিচয় হুগলি জেলা আইনি কর্তৃপক্ষের সচিব অনির্বাণ রায়ের সঙ্গে, যিনি নিজেও এই মানুষদের অধিকার ও সেই বিষয়ে সচেতনতা প্রসারে বিশেষ উৎসাহী। তিনিই সিন্টু-কে এই প্রস্তাবটি দেন, যা জেলা আইনি কর্তৃপক্ষের অন্য সদস্যরাও সানন্দে মেনে নেন।
অনির্বাণ রায় জানালেন – “নালসা জাজমেন্ট অনুযায়ী রূপান্তরকামী মানুষদের সঙ্গে তাঁদের লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে কোনওরকম বৈষম্য করা যাবে না। আর লোক আদালতে সুযোগ রয়েছে একজন সমাজকর্মীকে বিচারক হিসাবে নিয়োগ করার। তাই আমরা সিন্টু বাগুইকে তাঁর কাজের নিরিখে এই পদের জন্য যোগ্য বিবেচনা করে নিয়োগ করি। লোক আদালতে বিচারক হওয়ার জন্য সব সময়ে তথাকথিত শিক্ষিত হতেই হবে এমনটা নয়। আইনি বিষয়ে খুঁটিনাটি জানতে হবে তাও নয়। সহজাত বুদ্ধিমত্তা ও বিচারক্ষমতা থাকতে হবে। যা আমাদের মনে হয়েছিল সিন্টু-র মধ্যে চমৎকারভাবে রয়েছে। হুগলি জেলায় রূপান্তরকামী আরও অনেকেই রয়েছেন। কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত অবস্থানে থেকেও সিন্টু নিজের সম্প্রদায়ের জন্য যে লড়াই চালাচ্ছেন তাকেই আমরা স্বীকৃতি দিতে চেয়েছি। তিনি খুবই ভালভাবে তাঁর দায়িত্ব সামলেছেন।” শ্রী রায় আরও জানালেন ভবিষ্যতে হুগলি জেলা আইনি কর্তৃপক্ষ রূপান্তরকামী সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনাসভা, কর্মশালা ইত্যাদি আরও বেশি করতে আগ্রহী।
সিন্টু নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে বললেন, “আমি যখন সেজেগুজে লোক আদালতে ঢুকছি তখন অনেকেই হাঁ করে দেখছিলেন। কিন্তু তারপরে তাঁদের আচরণ স্বাভাবিকই ছিল। কৌতুহল অবশ্যই ছিল, কিন্তু তারা আমাকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করেননি। আমার কেস’টি ছিল বিএসএনএল-এর। তাদের প্রতিনিধি ও অন্য পক্ষও হাসিমুখে ও অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে আমার কথা শুনেছেন। জেলা আইনি কর্তৃপক্ষের অন্য সদস্যরাও আমাকে যথাযথ সম্মান দিয়েছেন। ‘সবাই মন দিয়ে জজ সাহেবের কথা শুনুন’ – এভাবেই বলেছেন। তাছাড়া অনির্বাণ স্যার তো ছিলেনই আমাকে সবকিছু হাতে ধরে শিখিয়ে দেওয়ার জন্য।” লোক আদালতের বিচারকের দায়িত্ব পাওয়া যে তাঁর নিজের দীর্ঘ অধিকার আন্দোলনে একটি নতুন অধ্যায় যোগ করল, মানছেন সিন্টু নিজেও।
হুগলি জেলা আইনি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে যখন তিনি প্রস্তাবটি পান তখন তাঁর মধ্যে কিঞ্চিৎ দ্বিধা ছিল। আনন্দের সঙ্গেই একটা প্রশ্ন মনে উঁকি দিচ্ছিল যে তাঁর ভূমিকাটা ঠিক কী হবে। কর্তৃপক্ষ ও শ্রী রায়ের উদ্যোগে দ্রুতই অবশ্য সিন্টু দায়িত্ব বুঝে নেন ও লোক আদালতের দিন নিজের সম্পূর্ণ দক্ষতা দিয়ে তা পালন করেন। তিনি দায়িত্ব পালনের পর সংশ্লিষ্ট সকলেই তাঁর কাজের প্রশংসা করেন ও এই উদ্যোগকে স্বাগত জানান।
সিন্টুর পরিবারের সদস্যরা, তাঁর সম্প্রদায়ের বন্ধু মানুষেরা সকলেই তাঁর এই কৃতিত্বে খুশী। “আমার যাঁরা বোন, সহযোদ্ধা, সহকর্মী তাঁরা সকলেই খুব উৎফুল্ল। পাড়া থেকেও অনেকে এসেছিলেন, যাঁরা আমাকে চেনেন। তাঁরা আমি বিচারক নির্বাচিত হওয়ায় খুবই খুশি।”
সিন্টু রূপান্তরকামী হিসাবে হুগলি লোক আদালতে বিচারক হওয়ার সংবাদ প্রচারের পর আরও একটি বিষয় প্রচারে চলে আসে তা হল তাঁর যৌনকর্মীর সন্তান হিসাবে পরিচিতি। এই দ্বিতীয় পরিচিতিটি তাঁর জীবনের অন্যতম বড় সত্য এবং খুব ছোট থেকেই তিনি তাঁর মায়ের সম্মান, অধিকার ও পেশার স্বীকৃতির লড়াইতে শামিল। এই পরিচিতি তিনি সর্বত্রই দিয়ে থাকেন। সিন্টুর বক্তব্য, “ছোটবেলা থেকেই তো আমরা বুঝতে পারি ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড কত জরুরি। মা, বাবার পরিচয় কত বড়। স্কুলে পড়ার সময়েও বারেবারে আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে। আমি ছোট থেকেই মায়ের অধিকারের লড়াইয়ের মানে বুঝেছি আর সেটাই বোধহয় বড় হতে হতে আমাকে আমার রূপান্তরকামী পরিচয় ও আমার সম্প্রদায়ের অধিকারের লড়াইয়ের গুরুত্বটাও বুঝতে সাহায্য করেছে। পারিবারিক পরিচিতির থেকেও অনেক বেশি কঠিন নিজের লিঙ্গ পরিচিতি, যৌন পরিচিতির লড়াইটা। সেটা আমরা কখনওই ছাড়তে পারব না। আমরা তো প্রান্তিক, নিপীড়িত। পরিবার, সমাজ কেউই আমাদের অধিকার হাতে তুলে দেবে না। সেটা আমাদের আদায় করে নিতে হবে।”
আর্ন্তজাতিক রূপান্তরকামী দৃশ্যমানতা দিবস বা ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সজেন্ডার ডে অফ ভিজিবিলিটি নিয়ে সিন্টু মনে করেন নিজেদের অস্তিত্ব উদ্যাপন ও তা জানান দেওয়ার জন্য জরুরি, কিন্তু একটি দিন পালন করেই সবটা হয়ে যাবে না, “নিজেদের ক্ষমতা, দক্ষতা দিয়ে সমাজের সব জায়গায় আমাদের ভিজিবিলিটি বাড়াতে হবে, তাহলেই সমাজ আমাদের গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। আমরাও যে কারওর থেকে কম নয় তা প্রমাণ করতে হবে ও রাষ্ট্রের আমাদের প্রতি যে দায়িত্ব তা পালনেও সে বাধ্য থাকবে,” কলকাতার যৌনপল্লী সোনাগাছি অঞ্চলে রূপান্তরকামী মানুষদের সংগঠন আনন্দম-এর সেক্রেটারি সিন্টু-র স্পষ্ট বক্তব্য।
লোকাদালতে সম্মানীয় বিষারকের আসনে বসা সিন্টু ও তাঁর মতো আরও কয়েক জন প্রমাণ করেছেন তথাকথিত মূলস্রোত তাদের অস্বীকার করতে চাইলেও তাঁদের নিজেদের সংগ্রামের অভিজ্ঞতাই তাঁদের দৃশ্যমান করে তুলবে। রাষ্ট্রও তা দেখতে ও মানতে বাধ্য।
Cover Image Courtesy : https://charlottepride.org/6661/trans-day-of-visibility-get-involved-and-support-charlotte-trans-initiatives/
লেখক সাংবাদিক এবং ডকুমেন্টারি নির্মাতা।