প্রায় তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কলকাতার প্রেস ক্লাব-এর সামনে অনশনরত প্রায় ৪০০ জন স্কুল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ তরুণ-তরুণী। অভিযোগ, রাজ্য সরকারের অস্বচ্ছ নিয়োগ পদ্ধতিতে তাদের চাকরি আটকে রয়েছে। ২২ দিনের অনশনের পর কোথায় দাঁড়িয়ে তারা, কোথায় দাঁড়িয়ে সরকার, মিডিয়া ও নাগরিক সমাজ জানাচ্ছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী ।
জীবনপণ অনশন ১
বর্ধমানের মৌমিতা গরাই অনশন শুরু করার চার দিন পর কলকাতা প্রেস ক্লাবের সামনে অনশনরত অবস্থায় পড়ে গিয়ে মাথায় গুরুতর চোট পান। বাড়ি ফিরে স্ক্যান করলে দেখা যায় মাথার ভেতরে রক্ত জমাট বেঁধেছে। কিন্তু নাছোড় জেদ নিয়ে তিনি ফিরে এসেছেন অনশন মঞ্চেই। নির্জলা উপবাস চালাচ্ছেন। অনশনের ২১তম দিন ২০শে মার্চ ২০১৯ গণ কনভেনশন চলাকালীন বারবারই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। বন্ধুরা রীতিমত চিন্তিত। এমন শরীর নিয়েও কেন ফিরে এলেন জানতে চাওয়ায় স্পষ্ট জানালেন, “না হলে নিজেকে স্বার্থপর মনে হয়। সবাই এখানে এভাবে রয়েছেন আর আমি ফিরে যাব? মাঝেমধ্যে ওষুধপত্রের জন্য বাড়ি যেতে হলেও এখানেই ফিরছি।”
জীবনপণ অনশন ২
এই দিন জ্বর গায়েই অনশনে শামিল ছিলেন বহু তরুণ-তরুণী। জল আর ওআরএস ছাড়া কিছুই মুখে তুলছেন না তারা। বারেবারেই জ্ঞান হারাচ্ছেন কেউ কেউ। দীর্ঘ অনশনের কারণে প্রবল ডি-হাইড্রেশনজনিত অসুস্থতা, তীব্র গরম, ডেঙ্গি সবকিছুই শারীরিকভাবে তাদের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। রক্ত আমাশা শুরু হওয়ায় একজন অনশনকারী মুর্শিদাবাদে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তার অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি। গণ কনভেনশন-এর দিনই চরম অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনজন অনশনকারীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।
অনশনের ২১তম দিন দুপুর পর্যন্ত বাষট্টি জন অনশনকারী অসুস্থ হয়ে পড়ায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। দু’জন গর্ভবতী অনশনকারীর গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট হয়ে গেছে এই পরিস্থিতিতে। এই মুহূর্তে তারা বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তবে এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের উপরে সামাজিক ও পারিবারিক অসন্তোষ কিছুটা হলেও তৈরি হয়েছে বলে জানালেন তাদের অনশনরত সহযোদ্ধারা।
সরকার চরম উদাসীন তবু আশায় বুক বাঁধা
এস.এস.সি. যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চ-র তরফ থেকে তানিয়া সেন জানালেন, অনশন শুরু হওয়ার পর মাত্র দু’বার শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছে। একবার অনশনের শুরুর দিকেই। কিন্তু তখন তাঁর তরফ থেকে কোনওপ্রকার সাড়াই পাওয়া যায়নি। গণ কনভেনশন-এর আগের দিন ১৯ মার্চ অনশনকারীদের তিন জনের একটি প্রতিনিধিদল তাঁর সঙ্গে আবার দেখা করেন। “এইবারের দেখা হওয়াটা আমাদের কিছুটা হলেও আলাদা বলে মনে হয়েছে। উনি বললেন আমরা নির্বাচন কমিশন-এর অধীনে পড়ে গেছি। গেজেট-এ কী কী ভুল রয়েছে আমরা তা তাঁকে স্পষ্ট করে বোঝাতে পেরেছি। তিনি মৌখিকভাবে বলেছেন ‘দেখছি’। কিন্তু কোনও রকম মৌখিক প্রতিশ্রুতিতেই আমরা অনশন অবস্থান তুলব না। লিখিত প্রতিশ্রুতি সরকারের তরফ থেকে না-আসলে কোনওভাবেই আমাদের এই অনশন উঠবে না,” জানিয়ে দিলেন তানিয়া।
মুর্শিদাবাদের মহঃ কামরুজ্জামান বিশ্বাস, পিনাকী ঘোষ বাকি সকলের মতই শারীরিকভাবে দৃশ্যতই বিধ্বস্ত। তবু সঠিক নিয়োগ পদ্ধতিতে চাকরি পাওয়ার ন্যায্য দাবির প্ল্যাকার্ডগুলি বুকের সঙ্গে চেপে শক্ত মুখে অনশনে রয়েছেন। বলছিলেন, “অসুস্থ হয়ে পড়ছি আমরা সকলেই। খাবার না-খাওয়ায় পেটের নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। স্যালাইন দিতে হচ্ছে অনেককেই। কিন্তু আমরা আশা করি আজকের কনভেনশন-এর পর একটা রাস্তা বেরোবেই। আমাদের দাবিটা তো খুব স্পষ্ট। আপ-টু-ডেট ভ্যাকান্সি করলে তো যাদের প্রাপ্য তারাই চাকরি পেতে পারি আমরা, আর সেই সংখ্যাটা অনেক। তবে আমরা যারা অনশন করছি তারা একটি বিষয়ে সকলেই একমত যে মৌখিক নয়, সরকারের তরফ লিখিত আশ্বাসেই আমাদের অবস্থান উঠবে। কত মানুষ আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, শুধু সরকার চরম উদাসীনতা দেখাচ্ছেন। দেখি কি হয়?”
ডায়মন্ড হারবার-এর মল্লিকা খানদারের কথার মধ্যে উঠে এল যেন তার সঙ্গে দিনরাত জেগে অনশন করে চলা তার বাকি সব সহযোদ্ধাদের বক্তব্যই। তাদের পরিবার মুখ্যত তাদের সঙ্গে রয়েছে। চরম শারীরিক বিপর্যয় সত্ত্বেও তাদের অনশন প্রত্যাহার করতে বলছেন না। রাজ্য সরকারের তরফ থেকে বিন্দুমাত্র সাড়া না পেলেও দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসে গণ কনভেশন-এর দিন তারা আশা প্রকাশ করছেন, নির্বাচনের দিন ঘোষণা হয়ে গেছে, সরকার নিশ্চয়ই এরপরে কোনও সদর্থক ভূমিকা নেবেন ও তারা তাদের প্রাপ্য চাকরিটি পাবেন। মল্লিকা যেমন বললেন, “চিন্তা, মানসিক অবসাদ, শরীর খারাপ সব সহ্য করে অনশন করছি, যা প্রাপ্য তার জন্য। ফল নিশ্চয়ই পাব।”
সরকার, প্রশাসনের অমানবিকতা
কথা হচ্ছিল অনশনকারী পূর্বিতা রায়ের সঙ্গে। জানালেন প্রথম দিন থেকেই সরকার ও প্রশাসন চরম ঔদাসীন্য দেখিয়ে চলেছেন। সামান্যতম মানবিকতা দেখাননি পুলিশ, প্রশাসন। প্রচন্ড রোদ, আচমকা ঝড়-জলেও তাদের মাথার উপর ত্রিপল টাঙানোয় কার্যত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। অঝোর বৃষ্টির সময়ে নিজেরাই ত্রিপল ধরে তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। বৃষ্টি থামামাত্রই পুলিশি নির্দেশে তা গুটিয়ে ফেলতে হয়েছে। রাত্রি ন’টার পর নিভিয়ে দেওয়া হচ্ছে আলোও। নারী, পুরুষ মিলিয়ে প্রায় ৪০০ অনশনকারীর নিরাপত্তা নিয়ে সরকার, প্রশাসন কোনও তরফেই কোনও মাথাব্যথা নেই।
পথচলতি মানুষেরাও এইদিন কনভেনশন-এ দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলেন। আগে এসে সংহতি প্রকাশ করেছেন নাগরিক সমাজের এমন বহু মানুষই সেদিন উপস্থিত ছিলেন। প্রেস ক্লাব-এর সামনেই প্রায় ত্রিশ বছরের পুরনো ঠাণ্ডা পানীয়, কেক-বিস্কুটের দোকান অর্জুন চৌধুরির। বললেন, “এরজন্য আমার দোকানদারির একটু অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু এদের দেখে যে কী কষ্ট লাগে! রোদ-ঝড়-জলের মধ্যে কতদিন হল বসে রয়েছে। মানবিকতার দিক থেকে অবশ্যই কিছু করা উচিত। প্যানেলে নাম আছে তবে কেন চাকরি পাবে না? শিক্ষায় এমন কথা মেনে নেওয়া যায় না। সরকার ব্যবস্থা না নিলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সম্পর্কেই খারাপ বার্তা যাচ্ছে।”
ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়া তো দূর, সরকারের তরফ থেকে সামান্য এই মানবিকতার কথাটুকুও এসে পৌঁছায়নি অনশনকারীদের কাছে। নেই শৌচালয়ের ব্যবস্থাও। কিছু সহমর্মী মানুষের উদ্যোগে মাত্রই এক, দু’দিন আগে হয়েছে বায়ো-টয়লেট-এর ব্যবস্থা।
গণকনভেনশন
এস.এস.সি. যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চ থেকে ডাক দেওয়া হয়েছিল ২০-এ মার্চ-এর গণকনভেনশন-এর। এই মঞ্চকে ‘অরাজনৈতিক’ বলে দেওয়া হয়েছিল শুরুতেই যাতে কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল এর থেকে মুনাফা না- লুটতে পারে। সঙ্গে যুক্ত অনশনকারী ইনসান, বৃন্দাবন, শর্মিলা কনভেনশন পরিচালনার সময়েও বারবারই বলছিলেন এই মঞ্চে যেন শুধুই তাদের সুনির্দিষ্ট দাবিগুলি নিয়েই আলোচনা করা হয়। স্কুল সার্ভিস কমিশন-এর পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে গেছেন তারা প্রত্যেকে, কৃতকার্য হয়েছেন, নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তাদের নিয়োগ হওয়া প্রয়োজন। অথচ দুর্নীতি আর অকর্মণ্যতায় এই প্রাপ্য সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। প্যানেল-এ নাম থাকা সত্ত্বেও চাকরি পাচ্ছেন না যোগ্য ব্যক্তি অথচ অন্যায়ভাবে প্যানেলে নাম না-থেকেও সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠরা চাকরি পেয়ে যাচ্ছেন।
মেধাতালিকাভিত্তিক প্যানেল হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। গেজেট-এর নিয়ম মানা হচ্ছে না। কারা প্যানেলভুক্ত হচ্ছেন, কারা ওয়েটিং লিস্ট-এ থাকছেন তা নিয়েও কোনও স্বচ্ছতা নেই। নিয়োগের অপেক্ষায় অনেকেরই চাকরির বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। যে নিরাপত্তার জন্য সরকারি চাকরির প্রত্যাশা থাকে অনেকেরই। তাই আজ তাদের ঠেলে দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। অনশনকারীরা নিজেরাই জানাচ্ছেন, অনেকেই নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য। সরকারি চাকরি পেয়ে পরিবারের হাল ধরবেন এমন স্বপ্নই দেখেছিলেন। অথচ আজ তাদের সামনে বিকল্প কোনও রাস্তাই খোলা নেই।
এসএসসি ছাত্র-যুব অধিকার মঞ্চ-এর এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, আমরা এম.এ, বি.এড/বি.পি.এড সম্পন্ন করা সত্ত্বেও সরকারের জীবিকা বিমুখ মনোবৃত্তির কারণে আমরা জীবিকাহীন। ২০১২ সালের দীর্ঘ ৪ বছর পর ২০১৬ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশন ‘নবম-দ্বাদশ’ স্তরে এবং ওয়ার্ক এডুকেশন, ফিজিক্যাল এডুকেশন স্তরে যে পরীক্ষা নিয়েছে তাও প্রহসনের নামান্তর। স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়ম ভঙ্গের কারণে এবং স্বচ্ছ মূল্যায়নের অভাবে আমরা অপেক্ষমান তালিকাভুক্ত শিক্ষক পদপ্রার্থীতে পরিণত হয়েছি। অথচ তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতিগ্রস্ততার কারণে প্রভাবশালীদের নাম তালিকাভুক্ত হয়ে যায়। তাই পর্যাপ্ত শূন্যপদ থাকা সত্ত্বেও সরকারের নিয়োগ বিমুখীনতা আমাদের হতাশাগ্রস্ত ও মৃত্যুমুখী করেছে। তাই চাকরির দাবিতে আমরা কারো প্ররোচনা ছাড়াই স্বেচ্ছায় আমরণ অনশনে অংশগ্রহণ করছি। আমাদের কোনো রকম শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি সাধন হলে, তার দায় সম্পূর্ণ সরকারের।
আমাদের দাবি –
১. স্কুল সার্ভিস কমিশন প্রকাশিত গেজেট পুঙ্খানুপুঙ্খ মেনে নিয়োগ – যেমন আপ-টু-ডেট ভ্যাকেন্সি প্রদান, ১:১:৪ রেশিওকে মান্যতা দেওয়া ইত্যাদি – না হওয়ায় আমরা ওয়েটলিস্টেড হয়েছি। তাই অনশনকারীদের চাকরি দিতে হবে।
২. স্কুল সার্ভিস কমিশন প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী আপ-টু-ডেট ভ্যাকেন্সি (চূড়ান্ত মেধা তালিকার ১৫ দিন আগের) প্রদান না-করায় এবং সেন্ট্রাল ইন্টারভিউ না হওয়ায় আমরা ওয়েটলিস্টেড ক্যান্ডিডেট-এ পরিণত হয়েছি। তাই অবস্থানের মধ্যে দিয়ে যে সকল ওয়েটলিস্টেড ক্যান্ডিডেট অনশনে বসেছে তাদের এমপ্যানেলডভুক্ত করতে হবে।”
এদিনের কনভেনশন-এ উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষাকর্মী, সমাজকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, ছাত্র প্রতিনিধিসহ অনেক মানুষ। মঞ্চটি অরাজনৈতিক হলেও আসলে যে কোনও মানুষ বা পরিস্থিতিই অরাজনৈতিক হতে পারে না, তাই উঠে আসে তাদের বক্তব্যে। একটি গণকনভেশন-এ আটকে না-থেকে বৃহত্তর নাগরিক সমাজের কাছে এই পরিস্থিতির কথা পৌঁছে দিতে হবে এমন বার্তা দেন সকলেই। ন্যায্য দাবি আদায়ের লড়াইতে অনশনকারীদের পাশেই সকলে থাকবেন বলে আশ্বাস দেন।
রাজনৈতিক মুনাফার ছক
নির্বাচনের দিন ঘোষণার পর থেকে এই ইস্যুটিকে অনেকেই রাজনৈতিক মুনাফা লোটার ছক হিসাবে দেখতে শুরু করেছেন। যেমন বারবারই নিজেদের সংগঠনের নামোল্লেখ করে ও নিজেদের কুক্ষিগত মিডিয়াকে সঙ্গী করে এনে অনশনের দখল নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবিভিপি (অখিল ভারত বিদ্যার্থী পরিষদ)। নির্বাচনের সময় রাজ্য সরকারের বিরূদ্ধে এমন একটি পরিস্থিতিকে নিজেদের তুরুপের তাস করতে চাইছে তারা। বিজেপি-আরএসএস মদতপুষ্ট এই ছাত্র সংগঠনের কাছে যদিও উত্তর নেই যে বিজেপি-র শাসনাধীন রাজ্যেও শিক্ষাক্ষেত্রে ঘটে চলা দুর্নীতি ঠেকাতে সরকারের ভূমিকা কী?
মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমের ন্যক্কারজনক ভূমিকা
সরকারি নিস্পৃহতারই আরেক রূপ যেন দেখতে পাই মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমে। কলকাতার প্রিন্ট বা টেলিভিশন কোনও সংবাদমাধ্যমেই গুরুত্ব দিয়ে উঠে আসেনি এই অনশন-আন্দোলনের কথা। একটি মাত্র ছবি বা ছোট একটি খবরের ঝলকেই তা সীমাবদ্ধ থেকেছে। কী দাবিতে এই আন্দোলন, সরকারের দুর্নীতি ঠিক কোথায়, প্রশাসনিক অপদার্থতা কোন পর্যায়ে পৌঁছালে লক্ষ লক্ষ চাকরীপ্রার্থীর নিয়োগ আটকে থাকে তা নিয়ে কোনও রিপোর্ট প্রকাশের আগ্রহ দেখায়নি তারা।
সরকারের অঘোষিত নির্দেশ এক্ষেত্রেও কাজ করেছে কি না জানা নেই। তবে সরকার ও সংবাদমাধ্যমের এই সম্মিলিত নীরবতা চোখে পড়ার মতো। এদিনের গণ কনভেনশন-এ বেশ কিছু তথাকথিত পরিচিত মুখের সমাবেশ ঘটলে আচমকাই তাদের মধ্যে খানিক সাময়িক তৎপরতা চোখে পড়ে। অনশনকারীদের থেকেও এই মুখেদের আকর্ষণ সম্ভবত তাদের কাছে কিঞ্চিৎ বেশিই ছিল।
তবে সবচেয়ে ন্যক্করজনক ঘটনাটি ঘটেছে কলকাতা প্রেস ক্লাব-এর ভেতরে। প্রেস ক্লাব-এর বাইরে ২১ দিন ধরে অভুক্ত অনশনকারীরা যখন একের পর এক অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, কাতরভাবে জানাচ্ছেন তাদের দাবি তখন প্রেস ক্লাব-এর ভেতরে আলো ও শব্দের সমারোহে শুরু হয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন। গ্রাউন্ডজিরো-র প্রতিনিধিরা ভেতরে গিয়ে সংগঠকদের কারওর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে সেই মুহূর্তে কারওর দেখা পাওয়া যায়নি। উপস্থিত সকলেই নিজেদের খাবার, আলোচনা ও উৎসব শুরুর অপেক্ষায় ব্যস্ত ছিলেন। প্রেস ক্লাব-এর সদস্য এক সাংবাদিককে যখন প্রশ্ন করা হয় বাইরের অনশনকারীদের প্রেক্ষিতে ক্লাব-এর ভেতরের এই অনুষ্ঠান তার কাছে দৃষ্টিকটু মনে হচ্ছে কি না, তিনি জানান “আমার কিছুই মনে হচ্ছে না। সাংবাদিকদের কিছু মনে হতে নেই।” এরপর কার্যতই তিনি অযাচিতভাবে প্রেস ক্লাব-এর ভেতরে প্রবেশ করা, অনুষ্ঠান বন্ধ করতে চাওয়া হচ্ছে কি না, সাংবাদিকসুলভ প্রশ্নে রাজনৈতিক গন্ধ রয়েছে ইত্যাদি বলেন, যদিও তিনি বা তার সঙ্গে জুড়ে যাওয়া কেউই ২১ দিনের অনশনকারীদের জন্য একটি শব্দও খরচ করেননি।
ঝলমলে আলো আর উচ্চকিত শব্দে বসন্তের উল্লাসে চাপা পড়ে যাচ্ছিল হ্যান্ড-মাইক হাতে অনশনকারী ও কনভেনশন-এ অংশগ্রহণকারীদের চাকরির দাবি।
সংহতিতে তৈরি হয় বহুস্বর
মালদার জিকেসিআইইটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ-এর ছাত্ররা মতোই কয়েক মাস আগে এই শহরে লাগাতার আন্দোলন, অনশন করে গেছেন। এস.এস.সি. চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনে পাশে দাঁড়িয়েছেন তাঁরাও। দু’দিন আগেই জিকেসিআইইটি স্টুডেন্টস’ ইউনিটি-র দুই প্রতিনিধি সংহতি জানিয়ে গেছেন কলকাতায়। তারা যৌথ আলোচনার পর পরবর্তীতে একসঙ্গে কর্মসূচির কথাও ভাবছেন। এর পক্ষ থেকে শাইন জাহেদি জানালেন, “সরকারি গাফিলতিতে সাধারণ মানুষের জীবন আজ দুর্বিষহ। সামনে ভোট। গতবারের মতো একই পদ্ধতিতে আরও একবার আমরা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচিত করব। কিন্তু এরা কতটা জনগনের প্রতিনিধি? এদের কাজটাই বা কী? বর্তমানের এস.এস.সি. আন্দোলন, গত ৩ বছরের জিকেসিআইইটি আন্দোলন চোখে আঙুল দিয়ে তাদের ব্যর্থতাই দেখিয়ে দেয়।”
সরকার, প্রশাসনের তরফ থেকে তাদের সমস্যা সমাধানের কোনও সূত্র এখনও মেলেনি। শাইন জানালেন জেলাশাসককে চিঠি দিয়ে তারা জানিয়েছেন তাদের দাবির দ্রুত নিষ্পত্তি না-হলে তারা অনশন শুরু করবেন।
অনশন আন্দোলন কি দুর্নীতিগ্রস্ত, উদাসীন সরকারের উপর প্রভাব ফেলতে পারবে? “না, অনশনটা প্রতীকী। এরসঙ্গে আমরা নানা কর্মসূচি গ্রহণ করব। পথনাটক করে মালদার প্রতিটা গ্রামে গিয়ে বোঝাব কীভাবে স্কিল ইন্ডিয়া, ডিজিটাল ইন্ডিয়া, এগিয়ে বাংলা, বিশ্ব বাংলা দিয়ে সাধারণ মানুষকে দুর্বিষহ অবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। কিছু করতে না-পারলেও অন্তত এই ঘুণ ধরা সরকারি ব্যবস্থার বিরূদ্ধে সজোরে একটা ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করব, নিজেদের আসল দাবিগুলো প্রতিটা মানুষ যেন আদায় করতে শেখে, যেন এরপর থেকে রাজনৈতিক দলগুলো মিথ্যা বিকাশ, উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে মানুষের দাবিগুলি ভুলিয়ে দিতে না পারে, রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের সুবিধাজনক কিছু দাবি মানুষের দাবি বলে যেন চালিয়ে দিতে না পারে,” বক্তব্য শাইন-এর।
সামনেই নির্বাচন। ক্ষমতা দখলের লড়াই সরকার, বিরোধী দুই পক্ষেরই। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, তাদের ন্যায্য দাবির আন্দোলন যেন তার আড়ালে না-চলে যায়। শিক্ষাক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের বিরাট দুর্নীতি সামনে চলে এলে নির্বাচনে তার প্রভাব পড়বে। তাই অবজ্ঞা আর উদাসীনতা দিয়ে, সংবাদমাধ্যমে উপেক্ষা করে সাধারণ মানুষের নজর এড়িয়ে রাখা হচ্ছে। এরই মাঝে জোরালো বিরোধীর অভাবে ধর্মের তাস খেলা রাজনৈতিক দল দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। এর মাঝে আন্দোলনকারীদের যুক্তিপূর্ণভাবে জোটবদ্ধ থাকা, নাগরিক সমাজের ব্যপক অংশগ্রহণই এই লড়াইকে জোরদার করতে পারে।
লেখক সাংবাদিক এবং ডকুমেন্টারি নির্মাতা।
ভয়ানক ও ভীষন দূর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি। যে রাজ্যে সরাসরি ঘুষের মাধ্যমে নিয়োগ পত্র পাওয়া যায় সেখানে এটাই স্বাভাবিক। দেশের ৯৮% শতাংশ মানুষ মাসে দদশ হাজার টাকা রোজগার করতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে কিছু ছেলে মেয়ে সরকারি চাকরি পাবে কি পাবে না তা নিয়ে সমাজ চিন্তিত না হওয়ারও কথাই বটে। আর এটাও বড় কঠীন সত্য এই যে চাকরি পেয়েও পাইনি বলে অরাজনৈতিক আন্দোলন, যতো গেড়ো তো সেখানেই, এই সব ছেলে মেয়েদের কতো জন নিজেদের চাকরির বা জীবিকার দাবী ছাড়া কোন রাজনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশ বিষয়ে কোনদিন কোন আন্দোলন দাবী দাওয়া করেছেন কিনা যথেষ্ট সন্দেহের, বরঞ্চ বলা যায় অধিকাংশই করেন নি, আর চাকরি পেয়ে গেলে আরও মাথা ঘামাবেন না। তবে এসবই সরকারের মানসিকতার কোন এলিবাই নয়। গঙ্গাা নদীর জীবন রক্ষায় দিনের পর দিন অনশন করে চলেছেন যে তরুন সন্ন্যাসী, সে এদেরই বয়সী, সুন্দরবনের যে প্রান্তিক মানুষগুলো দুবেলা কি করে খাওয়ার জুটবে তার নিশ্চয়তা নেই, ছুটেছে উত্তরাখন্ড, গঙ্গাকে বাঁচাও বলে। নিজের ছোট দুঃখ আর বঞ্চনার যন্ত্রণা সাথে দেশ ও সমাজের বড় দুঃখ আর অবিচার কে মেশাতে না পারলে কোন আন্দোলনই স্বার্থক হয় না। আশা করি সরকার নির্বাচন কমিশনের সাথে কথা বলে এদের একটা বন্দোবস্ত করবেন। এও আশা করবো শিক্ষক হয়ে এরা ছাত্রদের মানুষের মতো মানুষ হতে শেখাবেন, ভালো ভাবে পরাবেন। খালি নোট, টিউশন, ডিএ আর ঠিকমতো প্রমোশন হলো কিনা এটা নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন না। এটাও আশা করবো সরকার কিছু করতে না পারলেও অমানবিক আচরন করবেন না। আর কেন এরা চাকরি পাননি বা কবে পাবেন এটা নোটিশ করে জানিয়ে দেবেন। কারন জীবন ও সমাজের আরও বড় দায় আছে, কাজও।