গত ৯ মার্চ সিউড়িতে শতবর্ষ প্রাচীন সাহিত্য–সাধনা কেন্দ্র ‘বীরভূম সাহিত্য পরিষদ‘-এর উদ্যোগে এবং ‘সহমন‘-এর সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয় একটি আলোচনা চক্র। ফকির লালন সাঁইয়ের আর্তি ‘পড়শি যদি আমায় ছুঁতো / যম যাতনা সকল যেত দূরে‘ শিরোধার্য করে “বৈরিতা মুছে ফেলে সহজ সমাজের দিকে পৌঁছানোর এক বিনীত প্রয়াস, ‘সহমন‘।” ‘সমাজ প্রেক্ষিতে প্রতিবেশী ও পরিবেশ রক্ষা‘ শীর্ষক এই আলোচনায় অন্যতম প্রধান বক্তা ছিলেন গল্পকার, ঔপন্যাসিক ও সমাজকর্মী আয়েশা খাতুন। তাঁর বক্তৃতাটি এখানে প্রকাশিত হল।
পড়শিকে ছুঁয়ে দেখলে বা ছুঁতে দিলে কী কী হয়ে যেত এই আমাদের বহুত্ববাদী সমাজে, দেশে — এই বিষয় নিয়ে আজ দু’চার কথা বলা, সাহিত্যে কেনও এই কথাগুলো আমি আনি। সে কথা বলা।
আমার গল্পে আছে কতই-না সমাজের মিল-মহব্বতের কথা, অথবা দূরত্বের কথা। কিন্তু এই কথাগুলো কি কোনও মানুষকে, পাঠককে ছোঁয়? আজকের এই মঞ্চে এই সব কথা বলতে চাই। এই যে আমি এই পোশাকটা পরে আছি এটাকে বলে ‘পঞ্চিপাঢ়ান’। সহজ কথা লুঙ্গি- গামছা। এত কম দামের এই পোশাকের আসলে যাঁরা মালিক, তাঁরা খুব দামি মানুষ। আমি সেই সাঁওতাল মানুষদের সাহিত্যে আনতে চেয়েছি। আমি সুরুধানির কথা বলতে চেয়েছি আমার ‘সালুক ও সুরুধানি’ উপন্যাসে।
একটা স্কুলের কথা বলছি, ‘বিকল্প বর্ণপরিচয়’। আমার বাবা বিশ্বভারতীর ছাত্র ছিলেন। তিনি প্যাটেলনগরে বেসিক ট্রেনিং কলেজে পড়াতেন। পরে বলেছিলেন, বাচ্চাদের মানুষ করতে গেলে বেসিক স্কুলে গিয়েই ভাবনাকে ইম্পলিমেন্ট করতে হবে। তিনি আমাকে কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ বোঝাবার চেষ্টা করতেন। আমি ওসব বুঝতে চাইনি। তবুও কি করে যেন বুঝে ফেলেছিলাম রবীন্দ্রনাথের কিছু শব্দ একটি লাইন, “…পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।”
ওদিকে বাবা বার বার বলেছেন, যদি কোনোদিন তুমি সোশ্যাল ওয়ার্ক করো তবে এই পাড়াটাতে একটা স্কুল গড়ো। এই কথা বলে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ডেকে আনলেন সাঁওতালি ভাষাতে বা ‘রড়’-তে। সহজ পাঠের প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাগকে সাঁওতালিতে অনুবাদ করলেন। তিনি কেঞ, চরণ কিস্কু এদের পড়াতেন আর বলতেন, “আমাকে সাঁওতালি শিখিয়ে দে। আমি তোদের বাংলা শেখাব তোরা আমাকে সাঁওতালি শিখিয়ে দে।”
বাবা দুটি খণ্ডকে সাঁওতালিতে অনুবাদ করে দিয়ে বললেন, “যাও ওই কানাদিঘিতে। সেখানে গিয়ে ওই পাড়ার বাচ্চাদের পড়াও।” আমি বুঝেছি এই পাড়ার বাচ্চারা পড়তে এলেও শুকনো পাতার মতো ঝরে যায় কেন। সাঁওতালিতে তারা পড়ার সুযোগ পেলে পড়া আপনি হবে। ওদের মাতৃভাষা সাঁওতালি। বাংলাটা ওদের কাছে ইংরেজির মতোই কঠিন। যেমন অ-য়, অজগরটি আসছে তেড়ে, আ-য়ে, আমটি আমি খাব পেড়ে —
এই কথাগুলো ওদের মুখস্ত করতে হয়। তাই ভুলে যায়। ওদের চোখে খুব শরম। পড়া পারে না, তাই ওরা স্কুলে আসে না, নিজের ক্ষতি করে৷ শিক্ষকের সম্মান বাঁচায়। অন্যদেশ হলে সরকার শিক্ষক তাঁকেই রাখত, যে ওই ভাষাটা জানেন। মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের সমান। এই বাচ্চারা পড়তে শুরু করল। আমি সেই বাবার অনুবাদের সঙ্গে লিখলাম ‘বিকল্প বর্ণপরিচয়’।
কেনও এই পড়শিকে ছুঁয়ে দেখা? আমি ভুলতে পারিনি সুরুধানির কথা। বাবার হাতের পেটান খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে যাকে খুঁজে পেতাম সে যে সুরুধানি। না, আপনাদের মুখের ভাষায় ‘সুরধুনী’ না। একেবারে সুরুধানি। এই সুরুধানি আমাকে কোলে নিয়ে চলে যেত কাঠ ভাঙতে, চলে যেত নদী থেকে জল আনতে। আমি শিখেছি সুরুধানির কাছে থেকে নদীর বালি সরিয়ে সরিয়ে কী করে ঝরনার জল বার করতে হয়। তার কাণ্ঠায় সে আমার জন্য মেহেন্দি গাছ লাগিয়েছিল।
বাবার কাছে মার খেয়ে যখন সুরুধানির মাটি মাখা ছেঁড়া শাড়ির আঁচল ধরে তার পায়ের চিহ্নে পা দিয়ে দিয়ে যেতাম তখন সে আমাকে বলত, “কানদিস না কানদিস না, আমি তুকে মুন্দি বেটে পা রঙিন করে দুবো।” এবং সেই মেহেন্দিতে পা রাঙাবার অগাধ ভালোবাসায় বাবার হাতের মারের আঘাতের কথা সব ভুলে যেতাম। এমন পড়শিকে জানব না! এই সুরুধানিকে নিয়ে লিখব না? আবার এই সুরুধানি যখন বলাৎকারের পর বলাৎকারের শিকার হয় আর শেষ বাচ্চাটাকে জন্ম দিতে গিয়ে এই হিন্দু-মুসলমান সমাজের পুরুষের হাতে খুন হয়, এ কথা কি লিখব না? বেশ করব লিখব। আমি তার কাছে বেঁচে থাকার ঋণ করেছি। আমি এই সাঁওতাল মানুষদের কাছে থেকে কেবলি শিখছি, কেবলি শিখছি।
এই বিষয়েই আবার একটা উদাহরণ দিতে হয়। আমি কত যে শিখেছি ওঁদের কাছে। একদিন রুবন মারডি আর আমি বসে আছি। স্কুলের মাঠে। স্কুলের কোনও বাউন্ডারি ওয়াল নেই। রুবন আমার চেয়ে কয়েক বছরের ছোটই হবে। আমি বললাম, “জানিস রুবন রোদে মাঠের ঘাসগুলো মরে গেছে।” একথা শুনে কী বলল রুবন? বলল, “মরেছে কুথা? অরা তো লুকিন যেলছে আবার রিমিল ঝরলেই অরা বেরিন আসবে। দেখিসনি কি তুর হাড়ামবাবা কি মরে যেলছে? তাহলে তুর মুখে দাদু হয়ে কে বসে আছে? দাড়াকেনে সুময় হলেই বেরিন আসবে।” রুবন মারডির মৃত্যু দর্শন আমাকে অনেক শোক ভুলিয়েছিল। কেউ মরে না লুকিয়ে থাকে, সময় হলেই বেরিন আসবে? আমি পড়শিকে জানতে চাই।
এখন আমি আমাদের গ্রামের আর একটা উদাহরণ দেব। আমি আমাদের গ্রাম নিয়ে হাজার কাহিনি লিখে যাব যদি আমি দু’শো বছর বাঁচি, সে কথা লিখে ফুরোবে না। আমাদের গ্রামের নাম হেরুকা।৩৫০০ বছরের পুরাতন গ্রাম, ছিল বৌদ্ধদের অধিবাসভূমি। যুগে যুগে অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে আমার পুর্বের বংশধরেরা ধর্ম পালটেছে। কোথাও হিন্দু কখনও বৌদ্ধ, কখনও আবার মূলনিবাসী তো কখনও মুসলমান হয়েছে। ধরম পাল্টেছি বটে কিন্তু জিন পাল্টায়নি। আমার রঙ আজও মাটি আর গাছের বাকলের সাথে মিলে যায়।
এই আমার গ্রামের একটা কাহিনি বলি, যা আমি আমার ‘তেহাই’ গল্পে লিখেছি। মহরমের চাঁদ উঠেছে। গ্রামে তখন মহরম হতো। ইমাম হোসেন, হাসানকে মনে রাখার জন্য। এখন এ গ্রামের মানুষেরা শতকরা ৯৮ জন মহরম মানেন না, করেন না। ভারতে মুসলমান তথা ইসলামের আবির্ভাব, প্রচার, প্রসার হয়েছিল সুফি,দরবেশ, পির, ওলি, আওলিয়াদের হাত ধরে। কিন্তু গত ১৯৬৭-৬৮ সাল থেকে ওহাবি-ফরাজি’র মতোই দেওবন্দ ভাবধারা প্রবাহিত হবার পরিবেশ তৈরি হয়। এখন এই গ্রামের এই ভাবধারার মানুষেরা মনে করেন, আমি যদি আল্লাহকে পেতে চাই তবে আল্লাকেই খুঁজব, কেনও তাঁর বাহকদের পিছু নেব? কারণ আল্লাহ এবং আমি সমানে সমানে মুখোমুখি হতে চাই। যেখানে মানব সৃষ্টির সময় আল্লাহ তাঁর অতি কাছের ফেরিস্তা আজিজুলকে বলেছিলেন, আদমের কাছে মাথা নত করো। সে করেনি। ঠিক তেমনি এখন দেওবন্দি ভাবধারার মানুষ নিজের কাছে নিজে মাথা নত করেন না।
সেই গ্রামের আগের মানুষের মহরম করার গল্প বলি। আগের দিনের মানুষ ইমামের নামে জমি দান করতেন। সেই জমি চাষ করতেন ঢুলিরা। চুক্তি থাকত মহরমে ঢোল বাজিয়ে দিতে হবে। ওঁরা নিজেদের ঢোলের গা লাল ও সবুজ কাপড়ে বেঁধে বোঝাত যে জহরে, কহরে মৃত্যু।
এই মহরমের কথা বলতেই মনে পড়ে যায়, গ্রামের মেয়েদের সাজ-সজ্জার কথা। মঞ্জিলের দিনে তাদের যত দামি শাড়ি- কাপড়-গহনা বার করে বাক্সো থেকে। ভোরে উঠে বাড়ির যাবতীয় কাজ। মঞ্জিল মাটির, সিন্নি, ইমামের দুলদুল ইত্যাদি কাজ সেরে এবার নিজেকে সাজায় — তসরের বাসন্তী রঙের শাড়ি, বা নীল-লাল প্রতীকী শাড়ি ,তেঁতুল বিছে হার, তিন ছড়া মাদুলি, সেকা, টায়েরা, মানিকলোটন আর তার সঙ্গে আঁচলে বাঁধা মাছকাঠি ইত্যাদি দিয়ে। এই যে মঞ্জিল বিদায়ের মিছিল, বাজনা বাজছে — ঢিলোগ ডিডিগ ঢিলোগ তাং, ঢিলোগ তাং ইগ ডিগাডিগ…। ওদিকে লালুনানা মরসিয়া ধরেছেন, “উঠিল মহরমের চাঁদ তুমি দেখা দিও না,তুমি দেখা দিলে পরে ইমাম হোসেন রবে না।” হায় হোসেন করে লাফিয়ে ওঠা। এই মাতম চলে যাচ্ছে খদি মোল্লার আস্তানা থেকে ধীরে ধীরে ডাস পুকুরের পাড়ে পাড়ে ওদিকে ভাঙা বেড়া ধরে পড়েছে সাপিয়াদের ঘরে মেয়েদের মিছিল। ভাঙা প্রাচীরকে পরদা করে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েদের টায়রা পরা কপাল। কপালে চাঁদ-তারা ঝোলানো মানিকলোটন। এই মানিকলোটন ঝোলানো কপাল একবার প্রাচীরের উপরে একবার ছলকে দেখা যায়, একবার চাঁদ ডোবার মতো ডুবে যায়। এই সব মেয়েদের গহনা পরা কপালের সারি ভেসে যায় ভাঙা প্রাচীরের আড়ালে আবডালে। এমন সময় আবার মরসিয়া গেয়ে ওঠেন ফজেলনানা, “আসছে রে তোর হানিফচাচা উড়ছে লিসানা, কী হায় হোসেনা…”
যাঁরা ঢুলি তাঁদের নাতি শ্যামচরণ ঢুলি, বি এ ক্লাসে পড়া ছেলে ফ্লুট বাজাচ্ছে। ছিপছিপে গড়ন টিকলো নাক আর বাজনার তালে তালে শরীরের মৃদু দোলে প্রাচীরের ওপাশে থাকা মেয়েদের চোখে ঘোর তো লাগবেই একটু। এমন মানিকলোটন পরা কপাল প্রাচীর টপকে ছলকে উপরে উঠে ডগোমগো করে দেখে, সেও গেয়ে ওঠে এক রসিকতার মরসিয়া, “গামছা পরে মাতম করে কাদা লাগে না কি হায় হোসেনা!” (সে বছর মহরমের চাঁদ উঠেছিল শ্রাবণ মাসে। মানুষ তাই কাদার ভয়ে গামছা পরে মাতম করেছিল।)
শ্যামচরণের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে প্রেম হয় তার পর এক অনাবিল আনন্দে কেবল দৌড়ানো। দৌড় আর থামে না। এখনও দৌড়ায় কারণ পিছনে উঠেছে এক ঘরপোড়া মেঘ, এক সিঁদুরে মানুষ। একজন কথা সাহিত্যিক হিসাবে পড়শি সঙ্গে একাত্ম হয়ে বাস করতে চাই পড়শির সঙ্গে পেতে চাই এক তৃপ্তির আনন্দ।
সৌজন্য : বীরভূম সাহিত্য পরিষদ ও সহমন।