ভারতবর্ষে জাত ভিত্তিক রিসার্ভেশান একটা বিতর্কিত বিষয়। সংরক্ষণ এই জন্যে চালু হয়েছিল যে ভারতবর্ষ বাস্তবিক অর্থেই এক চরম অ-সমান বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থা। সংবিধান রচনার আগে থেকেই আম্বেদকর সংরক্ষণের দাবী তুলেছিলেন। সংবিধানে তা কার্যকরী হয়। এইবার প্রশ্ন আসে এই ‘Backward’বলতে ঠিক কাদের বোঝাচ্ছি। এখানেই একটা অন্য জায়গা থেকে শুরু করেছিলেন আম্বেদকার। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া ধরলে ভারতবর্ষে শতাব্দী প্রাচীন হাজার বছরের জাত-পাত ব্যবস্থা ও অস্পৃশ্যতার যে ভয়ানক শোষণ তাকে অস্বীকার করা হয়। কারণ শোষণ এবং বঞ্চনা হয়েছে জাতের ভিত্তিতে। বর্ণ-ব্যবস্থার জাঁতাকলকে কাজে লাগিয়ে। জেনারেল ক্যাটাগরির অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্যে ১০% সংরক্ষণ বিষয়ে লিখেছেন আদিত্য সরকার।
একটা গল্প শুনে আমরা সবাই বড়ো হয়েছি – একদা এক গ্রামে একজন গরীব ব্রাহ্মণ ছিলেন। কখনো গল্পের শুরুটা এভাবে লেখা হয়নি এক গরীব দলিত ছিল কিম্বা এক গরীব মাহার ছিল। ভারতবর্ষের বৈষম্যমূলক জাতিব্যবস্থায় বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক ভাবেও উপরের সারিতে ব্রাহ্মণেরাই। তাই এক গরীব ব্রাহ্মণকে নিয়ে আমারা গল্প লিখে সমবেদনা পাই!
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার 124 তম সংবিধান সংশোধনী বিলের প্রস্তাব আনে (আর্টিকেল ১৫ এবং প্রপোসড ক্লস-৬) যেখানে, জেনারেল ক্যাটাগরির অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্যে ১০% সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে।
বিভিন্ন বিরোধী দল গুলো সমর্থন করায় লোকসভা-রাজ্যসভায় এই বিল পাশও হয়ে যায়! এমনকি বিভিন্ন সংসদীয় বামদল গুলো অবধি একে সাপোর্ট করে। লোকসভায় যে ভোট পড়ে তাতে মাত্র তিনটি ভোট এই বিলের বিরুদ্ধে যায়! এই খানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য উঠে আসছে। শুরুতেই তা পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো। সত্যিই কি এটা উচ্চবর্ণের জন্যে সংরক্ষণ? অনেকে তা স্বীকার করতে নারাজ। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন বিলে কোথাও লেখা নেই এটা উচ্চবর্ণের জন্যে! কিন্ত তারা এটা বলছেন না যে – বিলে পরিষ্কার লেখা আছে যারা আগে থেকে কোনও রকম সংরক্ষণের আওতায় পড়েন যেমন SC ST OBC জনজাতির মানুষেরা, তারা এই সংরক্ষণের আওতায় পড়বেন না, SC ST OBC বাদ দিলে ভারতবর্ষের বাদবাকি অংশ তো উচ্চবর্ণ এবং কিছু উচ্চবিত্ত মুসলিম, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান। অর্থাৎ আদতে এই সংরক্ষণ উচ্চবর্ণের অর্থনৈতিক পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্যেই!
দুই, এটা সত্যি এখনো অবধি অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়ার মাপকাঠি ঠিক করা হয় নি। বিলের মধ্যে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। তাই অনেকেই বলছেন এটা নিয়ে বলবার কিছু নেই। কিন্ত ভুলে গেলে চলবে না, যাদের সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে তাদের বছরে মোট হাউসহোল্ড ইনকাম-এর ঊর্ধ্বসীমা আট লাখ! সরকারের পক্ষ থেকেই কিন্ত এইসব প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। ভারতের মতো দেশে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া অংশকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হাস্যকর।
তিন, অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া উচ্চবর্ণের সংরক্ষণের জন্যে দাবী আজ নতুন নয়। যখন ১৯৯০-এ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং-এর তত্বাবধানে মণ্ডল কমিশনের (কাজ সম্পূর্ণ হয় ১৯৮৩ তে) রিপোর্ট লাগু হয় তখন থেকেই উচ্চবর্ণের লোকেরা এর বিরোধিতা শুরু করে ও বলতে শুরু করে যে এরা জাতের ভিত্তিতে দেশকে ভেঙে দিচ্ছে, নীচ মানসিকতা, ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশেষত উত্তর ভারতে উচ্চবর্ণের ছাত্রদের বিক্ষোভ বড় আকার নেয়! এই আগুনকে ঠাণ্ডা করতে এই সময়েই ভিপি সিং এবং ’৯১ এ পিভি নারাসিমা রাও একটা অর্ডার নিয়ে আসে যে এরা উচ্চবর্ণের গরীবদের জন্যেও সংরক্ষণ আনবে। কিন্ত যেহেতু এটা কার্যকরী অর্ডার ছিল এবং সংবিধান বিরোধী ছিল তাই সুপ্রিম কোর্টের নয় বেঞ্চের জাজ একে খারিজ করে দেয় (সে সময়কার বিখ্যাত ইন্দিরা সাহানি কেস) – বলা হয় ভারতে কোথাও ৫০% এর বেশী সংরক্ষণ লাগু করা যাবে না। বর্তমানেই ৪৯% (এসসি এসটি ওবিসি) সংরক্ষণ আছে (তামিলনাড়ুতে ব্যতিক্রম) তার উপর ১০% যোগ হলে তা সুপ্রিম কোর্টের রায় কে বিরোধিতা করবে। সরকার এই কথা মাথায় রেখেই আগে সংবিধান সংশোধন বিল এনেছে। আইন হয়ে যাওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট তার শুধু রিভিউ করতে পারে কিন্ত পুরোপুরি বাতিল করার এক্তিয়ার সুপ্রিম কোর্টের নেই।
এবার দেখা যাক এই বিল আসলে ঠিক কাদের সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসছে এবং এর মধ্য ভাঁওতাবাজি কতোটা –
প্রথমত, যে সব পরিবারের মোট বার্ষিক আয় আট লাখের কম! পরিসংখ্যান জানান দেয় ভারতে ৯৫% লোকের বার্ষিক আয় এর কম। বলা হয়েছে এই বার্ষিক আয় – আট লাখ টাকা, ট্যাক্সের হিসেব অনুযায়ী যারা ডিক্লেয়ার করবে তারাই এর আওতায়। এটা কারা করে? যাদের মাসিক ইনকামই হয়তো ১ লাখের উপরে, তারা! এর সংখ্যা হল যারা ট্যাক্স দেয় তার ৩০% লোক। আর কতো জন লোক আমাদের দেশে আয়কর ট্যাক্স দেয়? মাত্র ৩%! মানে দেশের সব জনতার মাত্র ১% এর বাইরে থাকবে, বাদবাকি ৯৯% এই রিসার্ভেশান-এর আওতায়!
দ্বিতীয়ত,আপনার কাছে কৃষিজমি যদি ৫ একরের কম হয়। এখানেও পরিসংখ্যান বলছে দেশের ৮৬% মানুষ এর কম জমি নিয়ে থাকেন।
তৃতীয়ত, আপনার বাড়ির এলাকা যদি ১০০০ বর্গফুটের কম হয়! ভারতের ৮০% লোক ৫০০ বর্গ ফুটেরও কম বাড়িতে থাকেন।
কাজেই এই ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী জেনারেল ক্যাটাগোরির প্রায় ৯০%-এর উপরের লোকই অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে এবং সবাই এই রিসার্ভেশানের আওতায় আসবে। যদি সবাইকেই রিসার্ভেশান দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে আর একটা রিসার্ভেশান নিয়ে আসার কী দরকার ছিল?
আর একটা ব্যাপার হল ধরুন দুজন জেনারেল ক্যাটাগরির ক্যান্ডিডেট। একজনের পরিবারের বার্ষিক আয় ১ লাখ আর একজনের আয় বছরে ৮ লাখ। দুজনেই এই রিসার্ভেশান এর আওতায়। স্পষ্টতই এক্ষেত্রে যার আয় বেশী সে-ই এগিয়ে থাকবে, তাহলে এই বিল অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকাদের কীভাবে উন্নতি ঘটাবে যদি এই সমস্ত অংশই সংরক্ষণের আওতায় পড়ে? যদি সরকারের প্রকৃত ইচ্ছেই জেনারেল ক্যাটাগরির গরীব মানুষদের উন্নতির জন্যে হতো তাহলে হয়ত অন্য রকম ভাবে এই গরিবি কে সংজ্ঞায়িত করা হত!
এবার নিজেদের মতো কিছু সহজ গণনা করা যাক। এখন ওপেন ক্যাটাগরি অর্থাৎ প্রায় ৫১% জনসংখ্যা। তার মধ্যে ধরে নিলাম কিছু সিট এসসি, এসটি, ওবিসি ওপেন ক্যাটাগরিতেই পেয়ে যায়। ধরে নেওয়া হোক ‘জেনারেল’দের জন্য রইল ৪০%। এর প্রায় পুরোটাই বর্তমানে ‘৮ লাখের কম আয়’-এর মানুষদের পাওয়ার কথা, কারণ প্রায় সকলের-ই আয় ৮ লাখের থেকে কম। মানে যেখানে আপনি হয়তো ৩০% সংরক্ষণ এমনিতেই পাচ্ছেন সেখানে আপনাকে বলা হল আপনার জন্যে ১০% রিসার্ভেশন আছে। একটা উদাহরন দিলে সুবিধা হবে ব্যপারটা বুঝতে। আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগে মেয়েদের জন্যে মেডিকাল কলেজে ১০% রিসার্ভেশান ছিল। তারপর সময়ের সাথে দেখা গেলো মেয়েরা এখন ৩০% কোথাও ৫০% এমনকি ৬০% অবধি চান্স পাচ্ছে। এখন যদি কেউ বলে আমি ১০% রিসারভেশান মেয়েদের জন্যে মেডিক্যাল কলেজে চালু করলাম। এটাকে আপনি কী বলবেন?
ভারতবর্ষে জাত ভিত্তিক রিসার্ভেশান একটা বিতর্কিত বিষয়। সংরক্ষণ এই জন্যে চালু হয়েছিল যে ভারতবর্ষ বাস্তবিক অর্থেই এক চরম বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থা। এবং সমাজের ‘মুলস্রোত’থেকে যারা পিছিয়ে পড়েছে বা ‘backward’তাদের সামাজিক আপলিফ্টমেন্ট-এর দায়িত্ব গোটা সমাজের। সংবিধান রচনার আগে থেকেই আম্বেদকর সংরক্ষণের দাবী তুলেছিলেন। সংবিধানে তা কার্যকরী হয়। এইবার প্রশ্ন আসে এই ‘Backward’বলতে ঠিক কাদের বোঝাচ্ছি। এখানেই একটা অন্য জায়গা থেকে শুরু করেছিলেন আম্বেদকার। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া ধরলে ভারতবর্ষে শতাব্দী প্রাচীন হাজার বছরের জাত-পাত ব্যবস্থা ও অস্পৃশ্যতার যে ভয়ানক শোষণ তাকে অস্বীকার করা হয়। তাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় আরও বেশী করে সেই কাঠামোকেই বাঁচিয়ে রাখা হয়। কারণ শোষণ এবং বঞ্চনা হয়েছে জাতের ভিত্তিতে। বর্ণ-ব্যবস্থার জাঁতাকলকে কাজে লাগিয়ে এবং সাংস্কৃতিক, সামাজিক, শিক্ষাগত বঞ্চনার সুযোগ নিয়ে যুগ যুগ ধরে উচ্চবর্ণের লোকেরা নিচু অংশকে শোষণ করে এসছে – এই বক্তব্যকে অস্বীকার করার জায়গা নেই কোথাও! আর যখন অধিকারের প্রশ্ন ফিরিয়ে দেওয়ার কথা আসে তখন কেন অর্থনৈতিক সংরক্ষণ?!
ভারতবর্ষের মতো দেশে এইভাবে অর্থনৈতিক সংরক্ষন লোক ঠকানো ছাড়া আর কিছুই নয়। যদি সত্যিই দেশের বঞ্চিত শোষিত পিছিয়ে থাকা বর্গের মানুষের উন্নতি ঘটাতে হয় তাহলে দেশে যা খালি চাকরির পদ পড়ে আছে তাকে ভর্তি করে দেওয়া দিয়ে শুরু করতে হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় ৪ লক্ষ চাকরির পদ এখনও খালি, গোটা দেশে ২৫ লক্ষ চাকরির পদ এখনও খালি। ‘পিছিয়ে পড়া বর্গের’লোকের মধ্যে এখনও বেশির ভাগ জায়গাগুলোতে এসসি এসটি ওবিসি পদ খালি পড়ে আছে। কেন সঠিক উপায় নিয়ে রিসার্ভেশানকে লাগু করা হচ্ছে না এখনও?
হ্যাঁ এটা অবশ্যই বিতর্কিত বিষয়, রিসার্ভেশান চালু হওয়ার পর কেটে গেছে প্রায় অনেক বছর। কতটা সার্থক এবং সফল হয়েছে এই ব্যবস্থা। ঠিক কীভাবে একে লাগু করলে একে আরও কার্যকরী করা যাবে। কী হবে এর ব্যবহারিক রূপ। ছোটবেলা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষায় আমাদের কোথাও বলাই হয় না আমাদের সমাজে একটা অলিখিত রিসার্ভেশান আগে থেকেই রয়েছে। মন্দিরের পূজারি জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণরাই হন। আর রাস্তা নর্দমা পরিষ্কার করার লোকেরা হন দলিত। যদি আমাদের যাত্রা হয় বৈষম্যহীন সমাজের দিকে, তবে এই হাজার বছরের পুরনো সুপ্রোথিত বর্ণব্যবস্থার জাঁতাকল ভেঙে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে – তার জন্যে রিসার্ভেশান হয়তো খুবই দুর্বল হাতিয়ার, কিন্তু তার ব্যবহার আবশ্যিক। পাশাপাশি প্রশ্ন তুলতে হবে অনেক সমাজিক অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে। যে দেশে চাকরির সংখ্যা এতো কম, প্রাথমিক শিক্ষার বেহাল দশা, বেকারত্বের ছড়াছড়ি, অস্পৃশ্যতার নামে এখনও মানুষকে খুন করা হয় সেখানে শিক্ষাগত এবং সামজিক ন্যায়-এর লড়াইটা আরও বড়ো।
যদি আবার বিলের দিকে চোখ ফেরাই তাহলে বুঝবো কিভাবে ভোটের আগে একটা বিরাট অংশের মানুষকে রিসার্ভেশানের আওতায় এনে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার মানুষের সমস্যা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। একটু তলিয়ে ভাবলে বোঝা যাবে বর্তমানে ঠিক কতোখানি অংশে চাকরির ক্ষেত্রে এই সংরক্ষণ লাগু হয়। কখনো আপনি এই কেন্দ্রীয় সরকারের নেতা মন্ত্রীদের থেকে এই ব্যপারে কিছু বলতে শুনেছেন? শুনবেন না। কারণ এই সরকার বিগত পাঁচ বছরে এই রকম সরকারি কোনও ডেটা বেরই করে নি। এবং যাতে এই ধরনের তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে না পৌঁছায় সে জন্যে সব সময় তথ্য বিকৃত করেছেন, লুকিয়েছেন, মুছে দিয়েছেন! Economical and Political weekly-র একটা রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে যতো চাকরি রয়েছে তার মধ্যে শুধুমাত্র ১৮% চাকরির উপরেই সংরক্ষণ নীতি চালু আছে। এই সংস্থারই রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১২ সালে ৮৫৬ লাখ লোক মাসিক বেতন পাওয়া চাকুরীজীবী। তার মধ্যে মাত্র ২৫৬ লাখ লোক সরকারি জায়গায় চাকরি করেন। এখানেই শেষ নয়, তথ্য আরও বলছে এর মধ্যে ৪০% লোক অস্থায়ী চুক্তিতে কাজে যোগ দেন অর্থাৎ কনট্র্যাকচুয়াল চাকরি যেখানে কোনও সংরক্ষণ লাগু হয় না। মানে ৬০% লোকের চাকরির উপরেই এই নীতি লাগু হয়। অর্থাৎ আমাদের দেশের ১২৫ কোটি জনতার মধ্যে মাত্র ১ কোটি ৫৪ লাখ লোকের চাকরির উপরেই এই সংরক্ষণ চালু আছে। তাই রিসার্ভেশান এর বিরোধিতা না করে গোটা দেশ জুড়ে যেভাবে সরকারি স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়-এর সংখ্যা ও অন্যান্য সমস্ত জায়গায় চাকরি কমছে তা নিয়ে আওয়াজ তোলা প্রয়োজন। প্রসঙ্গত এই সরকার নাকি গোটা দেশে সরকারি কলেজে ১০ লাখ সিট বাড়ানোর প্রস্তাব এনেছে। মনে পড়ে যাচ্ছে ২০০৭ সালে যখন ইউপিএ সরকার ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে আসে তখনও সিট বাড়ানোর কথা বলেছিল, সেই কথা মতো তা বেড়েছে কি? তথ্য কিন্ত অন্য কথা বলছে। ২০০৪-২০০৫ এই সময় সরকারি চাকরির অনুপাত ছিল ২৩.২% যা কিনা ২০১১-১২-এ কমে দাঁড়ায় ১৮.৫% -এ। আর বর্তমান বিজেপি সরকার তো এমন কোনও ব্যবস্থাই রাখেনি যাতে করে সঠিক তথ্য পরিবেশন করা যায়!
প্রসঙ্গত কিছু কথা বলে রাখা ভালো। সমাজের মননে রিসার্ভেশান নিয়ে অনেক ধরনের বক্তব্য চলে। আমরা যারা সেই অর্থে উচ্চশিক্ষায় পড়াশোনা করছি এমন বিদ্যার্থী, তারা বহু সময় চেনা পরিচিত বন্ধুদের মধ্যে কাউকে কাউকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলি এই দ্যাখো এ রিসার্ভেশান-এর সুবিধা নিয়ে এসছে। অথচ তাদের ছাড়া আমাদের কোনও SC বা ST বন্ধু আছে কি? তাদের বাদ দিয়ে কতজনের সাথে আমাদের রোজকার ওঠা বসা? তাদের বেশীর ভাগ অংশটাই এখনও পড়ে আছে নর্দমা পরিস্কারের কাজে, আপনার বাড়ির কাজের লোক হয়ে। তাদের কতজন কে আমি-আপনি চিনি? আমার আপনার হিংসা শুধু তাদের জন্যে যারা ওই নর্দমার ক্লেদ পেরিয়ে আমাদের সাথে রোজ উঠছে বসছে। যারা রিসার্ভেশানের বিরোধিতা করে এতো শক্তি খরচ করে গলা ফাটিয়ে দেয়, তারা যদি জাত-পাত ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্যে একটু সময় দিতেন তাহলে আর রিসার্ভেশানের দরকার হতো না। মজার বিষয় হল যারা এতদিন ‘সংরক্ষণ’-এর আইডিয়াটাই তুলে দেওয়ার কথা বলতেন, এর বিরোধিতা করে লম্বা লম্বা বিতর্ক করতেন তারাই আজ এই উচ্চবর্ণ সংরক্ষণকে সমর্থন করছেন।
আসলে রিসার্ভেশান এমন একটা বিষয় যা নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলই নিজের ছবি ‘নোংরা’করতে চায় না। যেমন ২০১৩ তে কংগ্রেস ভোটের আগে শেষ চেষ্টা হিসেবে জাঠ সংরক্ষণ-এর প্রস্তাব এনেছিল, বিজেপি সেসময় বিরোধিতা করেনি! আজ বিজেপিও একই জিনিস করছে, আর বিরোধী দলেরা ভাবছে সমর্থন না করে আমরা কেন খারাপ হতে যাবো!
সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ, রিসারভেশান কখনই দারিদ্র দূরীকরন কর্মসূচি ছিল না। সমস্যা হচ্ছে আজকে আমরা একে সেই জায়গাতেই নামিয়ে নিয়ে এসছি। সরকারের বিভিন্ন স্কিম এর মতো আজকে রিসার্ভেশানকেও আমরা একই রকম মনে করি। যে দেশের মাত্র ২.৫% ব্রাহ্মণ, অথচ পরিসংখ্যান হিসেবে বিচার করলে সমস্ত সরকারি ক্ষেত্র এবং বেসরকারি ক্ষেত্র তো বটেই — বহু জায়গাতেই উচ্চ বর্ণের বাড় বাড়ন্ত অথচ উল্টো হিসেবে দেশের ৫০% এর বেশী লোক SC ST OBC মুসলিম সম্প্রদায় ভুক্ত। তাহলে রিসার্ভেশান একটা প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন এবং সে জন্যেই প্রোমোশন থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষাতেও একে চালু করা হয়েছে। যদি অর্থনৈতিক সংরক্ষন হয় তাহলে কোনও ভাবেই তারা সেই জায়াগাগুলোতে উঠতে পারবেন না। প্রতিনিধিত্বের কোনও অংশই থাকবে না। ভয় লাগে যখন প্রচলিত বামপন্থী দলগুলো এই বিলকে সমর্থন করে বসে।
আজকের বিশ্বায়ন আর পুঁজির অবাধ বিকাশের ফলে অনেক জায়গাতে দেখবও বটে এই কাঠামো খানিকটা ভেঙেছে। রয়েছে কিছু উদাহরন যেখানে চতুর্বর্ণের হায়ারার্কিকাল কাঠামো ভেঙে ভেঙে অনেক উচ্চবর্ণ আজ আগের অর্থনৈতিক অবস্থান ধরে রাখতে পারছেন না। অনেক এসসি এসটি ওবিসি অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছল। কিন্ত একই সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে ভারতবর্ষের বুকে কিভাবে বেড়ে চলছে দলিত হত্যার সংখ্যা, কুপিয়ে খুন করা হচ্ছে, প্রকশ্যে দিবালোকে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়ি ঘর। আমাদের ভেতরে ভেতরে ফল্গুধারার মতো এখনও তীব্রভাবে আছে বৈষম্য। আপনার মূল কাঠামোর মধ্যেই মিশে আছে চিরায়ত সামন্ততান্ত্রিক শোষণ অথবা প্রাক্ পুঁজিবাদী যুগের কাঠামোর নানা অবক্ষয়িত রূপ। আমাদের মনে রাখতে হবে ভারতবর্ষে সোশ্যাল/সামাজিক রিফর্ম এর এই লড়াই এখনও অধরা রয়ে গেছে। উচ্চবর্ণের যে আধিপত্য তা এখনও রন্ধ্রে রন্ধ্রে। রিসার্ভেশান এটাকে খানিকটা কমিয়ে আনার একটা লড়াই। যতদিন এই পিছিয়ে পড়া অংশের সামাজিক স্তরের ক্রমোন্নতি না হচ্ছে, তাদের শিক্ষাগত মানের উত্তরন না ঘটছে, কর্মক্ষেত্রে যতদিন না তাদের উন্নতি ঘটছে ততদিন এই ধরনের “অর্থনৈতিক সংরক্ষণ”-এর মতো পদক্ষেপ লোক দেখানো, ভাঁওতাবাজি, যা কিনা সেই বিশেষ ব্যবস্থাটাকেই টিকিয়ে রাখে। প্রকৃত অর্থে আমাদের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার এই উচ্চবর্ণের আধিপত্য বজায় রাখতে চায় ভারতীয় হিন্দু সমাজে, তাদের কোনও সদিচ্ছা নেই এই বর্ণব্যবস্থাকে ধ্বংস করার – তাই উচ্চবর্ণের এই ১০% সংরক্ষণ ভোটের আগে জুমলাবাজি, লোক ঠকানো, সমাজের বুনিয়াদি সমস্যা (শিক্ষা,চাকরি,স্বাস্থ্য) থেকে সাধারণ মানুষের নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু না।
Source :
Reservations in India: Almost every Indian now covered by one quota or another | India News – Times of India @MIUI | https://m.timesofindia.com/india/almost-every-indian-now-covered-by-one-quota-or-another/articleshow/67429441.cms
ফিচার ছবি : feedingtrends.com
লেখক একজন ডাক্তার ও রাজনৈতিক কর্মী।