যুদ্ধ, রাষ্ট্রবাদ এবং ‘কাশ্মীরি’


  • February 28, 2019
  • (0 Comments)
  • 1709 Views

উপমহাদেশে এখন যুদ্ধ পরিস্থিতি। পুলওয়ামা বিস্ফোরণের পরে দু-সপ্তাহ কাটতে না কাটতেই আমরা দেখলাম ভারতীয় বিমানবাহিনী কর্তৃক নিয়ন্ত্রণরেখা আক্রমণ। যুদ্ধবন্দী হলেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর পাইলট অভিনন্দন বর্তমান। আজ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ঘোষণা করেছেন, শান্তির বার্তা হিসেবে আগামীকাল পাকিস্তানের পক্ষ থেকে মুক্তি দেওয়া হবে অভিনন্দনকে। অন্যদিকে, আক্ষরিক অর্থেই গত কয়েক সপ্তাহ ধরে, নিরাপত্তাহীনতায় জর্জরিত কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ দুচোখের পাতা এক করেননি। দ্রুত ঘটে চলা ক্রমাগত ঘটনা -পরম্পরায় আমরা অনেকেই স্তব্ধ, বিমূঢ়। এই লেখায়, গ্রাউন্ডজিরোর পক্ষ থেকে, পুলওয়ামা বিস্ফোরণ পরবর্তী জাতীয় সামাজিক জীবনের ঘটনা প্রবাহকে তুলে ধরার চেষ্টা করলেন শৌনক মোদক

 

 

ঘটনাটি আমরা সবাই জানি ঘটেছিল, ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯। কাশ্মীরের পুলঅয়ামা জেলার লেথপোরা শহরে সি আর পি এফ- র একটি কনভয়কে আক্রমণ করে একটি গাড়ি। গাড়ির চালক আর বেঁচে নেই। কারণ, তিনি ছিলেন এক আত্মঘাতী বোমারু। যাদের আমরা সুইসাইড বোম্বার হিসেবেই সাধারণভাবে জানি। তাঁর নাম, আদিল আহমেদ দার। তাঁর বাড়ি পুলওয়ামা জেলাতেই। আক্রমণের দায়িত্ব স্বীকার করে পাকিস্তানী জিহাদী সংস্থা জইশ-ঈ-মহম্মদ। এই আক্রমণের ফলে মৃত্যু হয় চল্লিশাধিক সি আর পি এফ জওয়ানের। এই প্রতিবেদনটি অনেকাংশেই তারপরে কী ঘটেছে এই দেশে তা নিয়ে।

 

প্রথমতঃ, এটা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কাশ্মীর পৃথিবীর অন্যতম সামরিকীত বা মিলিটারাইজড অঞ্চল। কাশ্মীরের মানুষের প্রাত্যহিক জীবন অতিবাহিত হয় গভীরভাবে নিয়ন্ত্রিত এক সামরিকতন্ত্রের মধ্য দিয়ে। কাঁটাতার, বাঙ্কার, আইডি কার্ডের বেড়াজাল পেরিয়ে, সেসবের সাথে নিত্যদিন যুঝতে যুঝতেই কাশ্মীরের মানুষের দৈনন্দিন জীবন কাটে। কাশ্মীরে কোন নৈব্যক্তিক স্থান নেই। নিজের বাসস্থান, নিজের শোবার ঘরও সেখানে মিলিটারি শাসিত। যেকোনও মুহূর্তে হতে পারে সার্চ অপারেশন। এমনকী, কোন একটি বাড়িকে জঙ্গি -আশ্রয়ের ঘাঁটি মনে করে, সামরিক বাহিনী উড়িয়ে দিতে পারে গোটা বাড়িটিই। এহেন কাশ্মীরে, ঠিক কীভাবে একটি সিআরপিএফ কনভয়কে আক্রমণ করতে পারে আরডিএক্স বোঝাই একটি গাড়ি ? বিশেষতঃ, যখন কাশ্মীরে যারই কিছুদিন কাটানোর অভিজ্ঞতা আছে, তিনিই জানেন, মিলিটারি কনভয় যখন চলে কাশ্মীরের রাস্তা দিয়ে, তখন স্তব্ধ করে দেওয়া হয় বাকি যান চলাচল?

 

স্বভাবতঃই, এই প্রশ্নটি উঠে এল এই ক্ষেত্রেও। একাধিক, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার এই প্রশ্নটিই করলেন, কীভাবে এই ঘটনাটি সম্ভব। বিশেষতঃ, লিউটেনান্ট জেনারেল মোহন ভাণ্ডারী যিনি কিনা উপত্যকায় দীর্ঘ বছর কাজ করেছেন, বললেন, সাধারণভাবে একটি কনভয় যাবার আগে, একজন উপরতলার অফিসারের নেতৃত্বে, কনভয় যে রাস্তা ধরে যাবে, তা আপাদমস্তক পরিস্কার করা হয়। বিশেষভাবে, দেখা হয় যে, কোনওভাবে যেন কোনও ল্যান্ডমাইন না থাকে, বা অনান্য অবরোধের মুখে না পড়তে হয় কনভয়টিকে। মিলিটারি ভাষায়, এই কনভয়ের চলাচলের জন্য বিশেষভাবে সাফসুতরো করা রাস্তার নাম স্যানিটাইজড জোন। (তথ্যসুত্রঃ ডেকান ক্রনিক্যাল) এছাড়া, আছে রাস্তায় রাস্তায় একাধিক চেকপোস্ট। কাজেই, সেই চেকপোস্টের বেড়াজাল ডিঙিয়ে ৩০০কেজি আরডিএক্স সমেত কীভাবে এই গাড়িটি চলে আসতে পারে, তা রীতিমতো ভাববার বিষয়।

 

সেই পরিপ্রেক্ষিতে, প্রায় একই কথা সোশ্যাল মিডিয়াতে লিখছেন কাশ্মীরের মানুষ। দেশের রাজনৈতিক মহল ও নাগরিক সমাজেও ঘটনাটিকে আখ্যা দেওয়া হল ইন্টেলিজেন্স ফেলিয়র বলে। বাংলায় যাকে বলা যেতে পারে, গোয়েন্দা ব্যর্থতা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলাতেও শোনা গেল একই সুর। তদুপরি, এও জানা গেল যে, ঘটনার কয়েকদিন আগে, একটি ভিডিও ক্লিপ আপলোড করা হয় একটি ব্যক্তিগত টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে। সেখানে এই আক্রমণের বিষয়ে স্পষ্টতঃই জানান দেওয়া হয়। জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের পক্ষ থেকে এই ভিডিওটির কথা জানানোও হয় বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থাকে। কিন্তু, তাঁরা এই বিষয়ে, তৎসত্ত্বেও, কোনও পদক্ষেপ নেননি।

 

স্বভাবতঃই, প্রশ্ন ওঠে, কীভাবে আমরা দেখব এই গোয়েন্দা ব্যর্থতাকে? শুধুমাত্র গাফিলতি? নাকি, এর পেছনে আছে, বৃহত্তর কোনও রাজনীতি? যেমন ধরুন, আক্রমণ ও বিস্ফোরণের অব্যবহিত পরেই জানা গেল আক্রমণকারী গাড়ির চালকের নাম ও পরিচয়। জানা গেল, যে বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে, তা হল, আরডিএক্স। আমরা দেখলাম, সোশ্যাল মিডিয়া ও কয়েকটি আন্তর্জাতিক খবরের ওয়েবসাইটে বিস্ফোরণের ভিডিও। সবই ঘটলো অতীব দ্রুত। আমাদের প্রায় নিঃশ্বাস ফেলার সময় না দিয়ে। কোনো প্রাথমিক তদন্ত হবার আগেই। এই মাত্রার একটি বিস্ফোরণ অবশ্যম্ভাবীভাবে একটি দেশের কাছে, একটি জাতির কাছে, অসাধারণ ঘটনা। যন্ত্রণাদায়কও বটে। কিন্তু, সেই ঘটনার অসাধারণত্ব, কিংবা জাতির যন্ত্রণা, এই দুটর কোনওটাকেই দেশকে ঠিকঠাক হজম করতে না দিয়ে, ঘটনাপ্রবাহ আমাদের স্তব্ধ করে দিতে থাকল।আবারও, সব কিছুই ঘটতে থাকল কোনো প্রাথমিক তদন্ত হবার আগেই। যেন, আমরা সিনেমাহলে বসে সিনেমা দেখছি। যেখানে শুধুই মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখে যেতে হয় যা কিছু ঘটছে সামনের পর্দায়। তাকে থামানোপ্রশ্ন করা , বা প্রতিহত করার ক্ষমতা থাকে না।

 

এবং, ততোধিক দ্রুততার সাথে জানা গেল আরও একটি জিনিস। ছত্তিশগড়ের রায়পুরে আক্রান্ত হয়েছেন চারজন কাশ্মীরী ছাত্র। পরবর্তী আটচল্লিশ ঘন্টায় ভারতের অন্যত্র বসবাসকারী কাশ্মীরীদের উপর আক্রমণের হার ও তীব্রতা বাড়তে । দেরাথাকে দুনের কাশ্মীরী ছাত্রদের উপর আক্রমণের কথা মোটামুটি গোটা ভারতবর্ষ আজ অবগত। জানে কেমনভাবে ২০ জোন কাশ্মীরী ছাত্রী বন্দী করে রেখেছিলেন নিজেদের, হস্টেলের মধ্যে, আক্রমণকারীদের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে। এই তীব্রতায় না হলেও, আক্রমণের খবর পাওয়া গেল সুলানা, আম্বালা, গাজিয়াবাদ, এমনকী খাস কলকাতা ও নদীয়া থেকেও। জম্মুতে শুরু হল কাশ্মীরী-মুসলমান বিরোধী দাঙ্গা, ঘরছাড়া হলেন কাশ্মীরী মুসলমান সম্প্রদায়ের বহুমানুষ, ভাঙচুর করা হলো তাঁদের গাড়ি, বাড়ি সহ অনান্য সম্পত্তি। আর, যেখানে সরাসরি আক্রমণ ঘটলোও না, সেখানেও কাশ্মীরীদের মধ্যে তৈরি করা হল তীব্র ভীতির বাতাবরণ। এমনিতেই, ভারতবর্ষের অন্যত্র বসবাসকারী কাশ্মীরীদের সাথে কথা বললে, একথা জানা খুব কঠিন নয় যে, তাঁরা সাধারণভাবেই বেঁচে থাকেন একধরনের কুরে কুরে খাওয়া নিরাপত্তাবোধহীনতার মধ্য দিয়ে। কিন্তু, এই একের পর এক আক্রমণের মধ্য দিয়ে সেই নিরাপত্তাবোধহীনতা পেল এক মূর্ত আকার। বলা ভালো, রাষ্ট্র ও হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষ থেকে একযোগে এই মূর্ত আকার দেওয়া হল।

 

সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে পোস্টে এই কাশ্মীরীবিরোধিতা অতীব প্রত্যক্ষ এবং ভয়াবহ আকার ধারণ করলো। এসবের কিছু নমুনা নীচে তুলে ধরলাম:

 

খেয়াল করে দেখুন, ‘কাশ্মীরী’ শব্দটির ব্যবহার এসব ক্ষেত্রে। ‘কাশ্মীরী যেন একটি সমসত্ত্ব একক। ‘কাশ্মীরী’দের মধ্যে যেন কোন জাতপাত বিভাজন ও বিরোধ নেই, শ্রেণি বিভাজন নেই, অন্তরদ্বন্দ্ব নেই, রাজনৈতিক বা মতাদর্শগত বিভাজন ও বিরোধ নেই। এবং, ধর্মীয়, বর্ণভিত্তিক বা জাতপাতভিত্তিক স্টিরিওটাইপ বা গতে বাঁধা ছাঁচ সৃষ্টির এইটাই তো প্রক্রিয়া। তাই না? কাশ্মীরী উপত্যকার সাথে ভারতীয় রাজনীতি তথা জনমানসের সম্পর্ক অতীব জটিল। সেখানে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে গত সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা রাজনৈতিক বিরোধ।

 

সেই জটিলতার ইতিহাস ও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে যাওয়া এই লেখাটির পরিসরে সম্ভব নয়। কিন্তু, গত এক সপ্তাহ ধরে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে কাশ্মীরীদের অপর আক্রমণ, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট এবং আক্রমণের ভিডিও শেয়ার করার মধ্য দিয়ে একটি বিশেষ বাতাবরণ তৈরি করা হল। সেই সামাজিক বাতাবরণ দাঁড়িয়ে আছে একটি রাজনৈতিক বোঝাবুঝি ও আখ্যানের ওপর। সেই আখ্যানের ভিত্তিভূমি হল, প্রতিটি কাশ্মীরীই আসলে পাকিস্তান প্রেমী “জঙ্গি”, “আতঙ্কবাদী”। কাজেই, কাশ্মীর ও কাশ্মীরী বৈষয়িকতা সংক্রান্ত যে বোধ ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক জনমানসের মননে —পরোক্ষভাবে — তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসা হলো বাইরে, সর্বসমক্ষে। রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈধতাও দেওয়া হলো। এবং, পৃথিবীর যে কোনও দেশ, যে কোনও অঞ্চল, যে কোনও সম্প্রদায়- তা সে কাশ্মীরীই হোক, বা পাকিস্তান- কখনোই একই রকম কার্বনকপি মানুষের জন্ম দিতে পারে না, একথা উচ্চারণ করাও হয়ে উঠলো দেশদ্রোহিতা। এই মরমে বক্তব্য রাখার ফলে সোনি টিভি থেকে দরজা দেখানো হলো নভজ্যোত সিং সিধুকে।

 

এই আখ্যানের একদিকে যদি থাকে “আতঙ্কবাদী” কাশ্মীরী, তাঁর ঠিক অন্যদিকে দাঁড় করানো হল, ভারতীয় সেনাবাহিনীর বীর নিহত “শহীদ” জওয়ান। এবং, এই মুখোমুখি দাঁড় করানোর মধ্য দিয়ে প্রচেষ্টা করা হলো জাতি, দেশ, জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত একটি আখ্যানকে প্রতিষ্ঠা করার। এবং, একমাত্র সেই আখ্যানটিকেই রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বৈধতা দেবার। তদুপরি, এই আখ্যানটিকে ব্যবহারও করা হলো পরিস্থিতির যে কোনও ব্যতিক্রমী, বিকল্প মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণের টুঁটি চেপে ধরতে। এবং, এই আখ্যানটি দাঁড়িয়ে আছে ‘কাশ্মীরী’ ও ‘জওয়ান’ এই দ্বৈততার উপরেই। অনেকাংশে দাঁড়িয়ে আছে ভারতীয় জাতীয় রাজনৈতিক অবচেতন। কিন্তু, এটাই বোধহয় ফ্যাসীবাদ। যে অসাম্য থাকে সমাজের গভীরে, যে পরিকাঠামোগত বৈষম্যবোধ গেঁথে থাকে সামাজিকতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, তাকেই ফ্যাসীবাদ নিয়ে আসে সর্বসমক্ষে। দেয় ক্ররতম, বিষাক্ততম রূপ।

 

কাজেই, খেয়াল করে দেখুন, তীব্র কাশ্মীরি বিরোধিতার সাথে সাথে, গত ১৪ই ফেব্রুয়ারির পর থেকে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘জওয়ান’ এককটি নিয়েও কতগুলো বিষয় দেখা গেল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ান কারা? সমাজের ঠিক কোন অংশ থেকে মানুষ সেনাবাহিনীতে জওয়ান হওয়ার জন্য নাম লেখান? কেন? সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ঠিক কীভাবে বেঁচে থাকেন জওয়ানরা? বিশেষতঃ, যদি তাঁদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রাকে তুলনা করা হয় সামরিক উচ্চপদস্থ অফিসারদের জীবন যাত্রার মানের সাথে? ঠিক কেমনভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে বেঁচে আছে জাতপাতের রাজনীতি? অর্থাৎ, ‘জওয়ান’ বিষয়টিকে, পরিচিতিটিকে রাজনৈতিকভাবে পর্যালোচনা করা, সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গীর দ্বারা বিশ্লেষণ করা। কিন্তু, সোশ্যাল মিডিয়াতে সেই পর্যালোচনা বা বিশ্লেষণের সামান্যতম প্রয়াসকেও সুপরিকল্পিতভাবে আক্রমণ করা হলো। কলকাতার দিল্লি পাবলিক স্কুলের শিক্ষক ফেসবুকে এই জাতীয় প্রশ্ন করে চাকরি খোয়ালেন। আসামের অধ্যাপিকা পাঁপড়ি ব্যানারজী গ্রেফতার হলেন ও চাকরি থেকে সাস্পেন্ড হলেন তাঁর এই বিষয়ক একটি ফেসবুক পোস্টের জন্য। সেই পোস্টটিতে পাঁপড়ি লিখেছিলেন, “Soldiers paying a price with their lives to reinforce the hyper-nationalism of this government.” কাজেই, যেটা দাঁড়ালো, তা হল জওয়ান বা সেনাবাহিনীকে কোন একটি সমাজতাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে ফেলে বিচার করার নামই হলো দেশদ্রোহিতা। আর, যারা তা করে, তাঁরা হলো দেশদ্রোহী।

 

এবং, এই দেশদ্রহীদের ছেঁকে ছেঁকে, ফেসবুক- সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট খুঁছেঁকেজে খুঁজে বার করার নামই জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেম। যে দেশপ্রেমের নমুনা আমরাদেখলাম সোশ্যাল মিডিয়াতে, বাস্তব সমাজে। সেইদেশপ্রেমের পারফরমেন্সের ভিত্তিভূমি তৈরি হল একধরনের গণদ্বেষ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে। সেই গনদ্বেষের তীরের ফলার মুখে রইলো দুটি গোষ্ঠী- কাশ্মীরী ও দেশদ্রোহী। বর্তমান ভারতের রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদের দুই অপর।

 

কিন্তু, তৎসত্ত্বেও বহু প্রশ্ন আটকানো গেল না। যেমন, জানা গেল ৪০ জন মৃত জওয়ানের মধ্যে আটজন ব্যতীত বাকি সবাই দলিত, ওবিসি, আদিবাসী কিংবা মুস্লিম। মানে, জওয়ানদেরও আছে শ্রেণি, পেটের দায়। তাঁরাও কেউ এমনি এমনি মরতে চায় না। যেমন বললেন মৃত জওয়ান বাবলু সাঁতরার স্ত্রী মিতা সাঁতরা। সুপরিকল্পিতভাবে ক্রোধ, সাম্প্রদায়িকতা জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, তেমনভাবে জাগিয়ে তোলা গেল না সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ। দুর্বলভাবে হলেও, মানুষ প্রতিরোধ করলেন। জ্বলন্ত জম্মু শহরে কাশ্মীরি মুসলমানদের জন্য গুরুদুয়ারা খুলে দিলেন শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ। খুললেন বিশেষ লঙ্গরখানা। চন্ডীগড় বা হরিয়ানার বিভিন্ন জায়গাতেও শিখ সম্প্রদায় আক্রান্ত কাশ্মীরি ছাত্রদের জন্য গুরুদুয়ারার দরজা খুলে দিলেন। দিল্লি-এনসিআর অঞ্চলে বহু ব্যক্তি মানুষ এগিয়ে এলেন কাশ্মীরি ছাত্র তথা অন্যান্য আক্রান্ত মানুষকে আশ্রয় দিতে। তাই আশা মরতে মরতেও মরে না। এই নিরাশার মধ্যেও জেগে থাকে প্রতিরোধ, প্রতিবাদের স্বপ্ন, কার্যক্রম। এই লেখা শেষ করার সময়ে ভারতের বিমানবাহিনী লাইন অফ কন্ট্রোলে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক শুরু করেছে। এই উপমহাদেশে আসন্ন যুদ্ধের মুখোমুখি আমরা। কিভাবে এই নতুন যুদ্ধ-বাস্তবতার মোকাবিলা করবো আমরা ? এই উপমহাদেশের সাধারণ মানুষ ? তার ওপরেই আজ দাঁড়াবে আমাদের বেঁচে থাকা, আমাদের সৃষ্টিশীলতা, আমাদের জীবনধারণ।

 

 

লেখক রাজনৈতিক কর্মী এবং র‍্যাপ গায়ক।

Share this
Leave a Comment