খুব সামান্য একটা কাজ, একটি গণতান্ত্রিক দেশের বাসিন্দা হয়ে নিজের মত প্রকাশ করা, আর তারই খেসারত দিতে হলো অনুর্ধ ১৮ এক কিশোরকে। দেশ কী, দেশভক্তি কী, ঠিক কী ভাবে দেশের অচলাবস্থায় নিজের মতামত প্রকাশ করলে সেটা সহি দেশভক্তের পরিচয়? দেশের সেনাবাহিনীর প্রতি কতটা এবং কিরূপ আনুগত্য দেখালে এই পরীক্ষায় পাশ করা যায়? করা ঠিক করে দেয় এইসব ধ্রুবক? উত্তর জানা নেই, শুধু জানা আছে যে এক ভয়াবহ সময় অতিবাহিত হচ্ছে যেখানে মানবাধিকারের কথা বললে, যুক্তির কথা বললে, উগ্র হিন্দুত্ববাদের পক্ষে না থাকলে নিরাপত্তার কোনো গ্যারান্টি নেই, মৌলিক অধিকারেরই কোন গ্যারান্টি নেই। এই ভয়াবহ সত্য আর একবার সারফেসে উঠে আসল যখন উন্মত্ত জনতার হাত থেকে বাঁচানোর বদলে গ্রেফতার করা হল অর্পনকে। গণতান্ত্রিক দেশের পুলিশ গ্রেফতার করল।
অর্পণের অপরাধ ও একটি মিছিল এবং পথসভায় যোগদান করেছিল, এবং তারপর ওই পথসভা সংক্রান্ত একটি পোস্ট ফেসবুকে শেয়ার করে যাতে কিছু যুক্তিমূলক প্রশ্ন তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু মৌলবাদী গণ-হিস্টিরিয়া যখন রাজনৈতিক অস্ত্র, তখন যুক্তি ধোপে টিকবে কেন? পোস্টটি শেয়ার করার পর থেকেই কমেন্ট থ্রেডে অকথ্য গালিগালাজ করতে থাকে একদল স্বঘোষিত দেশপ্রেমিক। তাদের আক্রমণ ফেসবুকে সীমিত থাকে না, তারা চড়াও হয় অর্পণের হাবড়ার বাড়িতে। বাড়ি ঘিরে ফেলে উপদ্রব শুরু করে যে ফেসবুক লাইভে ক্ষমা না চাইলে তাকে ও তার পরিবারকে দেখে নেওয়া হবে। অর্পণের বৃদ্ধ বাবা-মা এই ঘটনায় অত্যন্ত বিব্রত বোধ করেন। ইতিমধ্যে পুলিশ আসে, কিন্ত ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনার বদলে তারা চড়াও হয় অর্পণের ওপর। ওকে গ্রেফতার হতে হয়। এখানেই প্রহসনের শেষ নয়।
নির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই অর্পণকে গ্রেপ্তার করার পরে তাকে দেশদ্রোহিতা চার্জ দেবার হুমকি দেন হাবড়া থানার আইসি এবং স্থানীয় বিজেপি-আরএসএসের গুন্ডারা। থানার ভিতরেই গুন্ডাবাহিনী অর্পণকে গালিগালাজ করতে থাকে এবং গায়ে হাত তোলার চেষ্টা করে। থানা থেকে বের করে পিটিয়ে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়। এ সমস্তটাই চলে থানার আইসির সামনে এবং প্রত্যক্ষ মদতে। অর্পণের বিরুদ্ধে 501, 502B, এবং আইটি অ্যাক্ট 66A ধারায় কেস দাখিল করা হয়।
অর্পণ যে পোস্ট শেয়ার করে তাতে কিছু প্রশ্ন এবং দাবি ওঠে এসেছিল: দাবি তোলা হয়েছিল কাশ্মীর সমস্যার দ্রুত সমাধান করে দেশের সাধারণ জনতা, সেনা, এবং বিশেষ করে কাশ্মীরি মানুষদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার। প্রশ্ন করা হয়েছিল, নির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য থাকা সত্ত্বেও কেন আগাম সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়নি? বছরের পর বছর সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করে চলা শাসক দলের অপদার্থতায় কেন হনুমান থাপার মত একজন সাচ্চা দেশপ্রেমীকে অবলীলায় মরে যেতে হয়? রাফাল ব্যাপমের মত কেলেঙ্কারীর নায়ক কেন্দ্রীয় শাসক দল চারহাজার কোটির মূর্তি বানাতে পারেন অথচ সেনাদের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও নিরাপত্তা দেওয়ার পয়সা থাকে না কেন? উত্তর খুব সহজ, কারণ মূর্তিতে ভোট আছে। সেনারা বেশিরভাগই সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা, তাদের প্রাণের বদলে ভোট ব্যাংক সুনিশ্চিত হলে রাষ্ট্রের বিশেষ ক্ষতি নেই। এই সব অত্যন্ত সাধারণ এবং প্রাসঙ্গিক প্রশ্নেই টনক নড়েছে “ভোট যুদ্ধের নায়ক” দের আর তাই তারা তাদের গুন্ডাবাহিনীকে এগিয়ে দিয়েছে প্রশ্নগুলোর মুখ বন্ধ করতে। যাদের গুরু সাভারকর, যে ব্রিটিশ শাসকের কাছে মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পেয়েছিল এবং লিখিত দিয়েছিল যে সে ব্রিটিশ রাজকে সর্বৈব ভাবে সাহায্য করতে প্রস্তুত, তারা আজ দেশভক্তির কান্ডারী। তাদের কাছে নাকি শিখতে হবে কীভাবে দেশমাতৃকার পুজো করতে হয়।
১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে গ্রেফতার হয় অর্পণ। ১৮ তারিখ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রেস বিবৃতি দিয়ে পুলিশকে বলেন দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে। তা সত্ত্বেও অর্পণের জামিন হয় না। পুলিশের পক্ষে জানানো হয় অর্পণ জুভেনাইল হোমে সুরক্ষিত। কিন্তু অর্পণের সুরক্ষাই যদি পুলিশের প্রায়োরিটি হয়, তাহলে দেশদ্রোহিতার কারণে কেস ফাইল করা কিসের জন্য? অর্পণকে বলা হয়, ভুল হয়ে গিয়েছে বলে পিছিয়ে আসতে। উত্তরে উদ্দীপ্ত কিশোর বলে ওঠে, “এটা আমার রাজনৈতিক অবস্থান। এটার জন্য ক্ষমা চাইব কেন?” একটুও মুষড়ে পড়েনি জামিন হয়নি বলে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের বিশ্বাস আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই তরুণ প্রজন্মই রাজনীতির আকর। এদের কাছে রাজনীতি কোনো কৌশল বা টুল নয়, পাবলিক ইমেজ নয়, তথ্য বোঝাই বাগাড়ম্বর নয়।এরাই ভরসা যোগায় আগামীর পৃথিবীতে।
পাঞ্চালী কর একজন রাজনৈতিক কর্মী, লেখক এবং ডকুমেন্টারি নির্মাতা।
Keep it up.