“ইথার তরঙ্গ, ইন্টারনেট বাহিত হয়ে, হ্যাশট্যাগ জড়িয়ে আছড়ে পড়ছে প্রতিশোধ-প্রতিশোধ ধ্বনি। যুদ্ধ-যুদ্ধ রব। এর মাঝে দাঁড়িয়ে দু’দণ্ড যে নীরব থাকব, অসহায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহগুলির কথা স্মরণ করে অস্ফুটে বলব, ‘বিদায় যেখানেই থাকো, শান্তিতে থেকো।’ দু’দণ্ড একথাও ভাবব যে, কোন উদগ্র আক্রোশে, ঘৃণার প্রচণ্ডতায় এক তরুণ গাড়ি বোঝাই বিস্ফোরক নিয়ে সেঁধিয়ে যেতে পারে তার চেয়ে শত শত গুণ বেশি শক্তিশালী আধা সামরিক বাহিনীর কনভয়ে! ঘটাতে পারে চরম বিস্ফোরণ!” লিখছেন দেবাশিস আইচ।
“মারের মুখে মার দাঁড়াবে? শোকের মুখে শোক? / এই তাহলে উপায়? পথ? পদ্ধতি? সহায়? / ফিরে যাবার রাস্তা শুধু এক দিকেই যাবে? / হত্যা থেকে পালটা হত্যায়? / তোমার মুখ কী করে আমি হাতে ধরব তবে?” – মা নিষাদ, জয় গোস্বামী।
ঘরে হিংসা, বাইরেও। ঘরে ঘৃণা, বাইরেও। ইথার তরঙ্গ, ইন্টারনেট বাহিত হয়ে, হ্যাশট্যাগ জড়িয়ে আছড়ে পড়ছে প্রতিশোধ-প্রতিশোধ ধ্বনি। যুদ্ধ-যুদ্ধ রব। এর মাঝে দাঁড়িয়ে দু’দণ্ড যে নীরব থাকব, অসহায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহগুলির কথা স্মরণ করে অস্ফুটে বলব, ‘বিদায় যেখানেই থাকো, শান্তিতে থেকো।’ দু’দণ্ড একথাও ভাবব যে, কোন উদগ্র আক্রোশে, ঘৃণার প্রচণ্ডতায় এক তরুণ গাড়ি বোঝাই বিস্ফোরক নিয়ে সেঁধিয়ে যেতে পারে তার চেয়ে শত শত গুণ বেশি শক্তিশালী আধা সামরিক বাহিনীর কনভয়ে! ঘটাতে পারে চরম বিস্ফোরণ! এই যে ভাবব, কথা বলব, তার আর উপায় থাকে না। কেন না, হঠাৎই জাগ্রত স্বদেশ, জাতীয়তাবাদী উগ্র উন্মাদনায় সক্রিয়তা দাবি করে বসে। উড়িয়ে দাও, গুঁড়িয়ে দাও ধ্বনিমুখর উন্মত্ততার মুখে-শরীরে তখন চূড়ান্ত প্রতিশোধস্পৃহা। এই উন্মাদনাও নাকি জাতীয় ভাবাবেগ। এই ভাবাবেগের স্রোতের বিরুদ্ধে অসহায় আমি টিভি থেকে মুখ ফেরাই, সংবাদপত্রে চোখ রাখি না। মোবাইল দূরে রাখি। এ কথা জেনেও যে নগর যখন পোড়ে, দেবালয়ও বাঁচে না। এই ‘দশ ফুট বাই দশ ফুট’ও রক্ষা পাবে না।
কিন্তু, এই আত্মঘাতী আক্রমণ, এই অসহায় মৃত্যু, এই চরম অসহিষ্ণুতার বিপরীতে কোনও ‘শান্তির ললিত বাণী’ও শুনতে চাইনি। এ কথাও বলছি না, ‘ক্ষমা মহতের ধর্ম’। না, ‘ন্যায়বিচার চাই’ আর সে কথা জোরের সঙ্গেই বলতে চাই। কিন্তু, গলার শির ফোলানো প্রতিহিংসাকামী নিউজ কাস্টার; আর যারা বিগত পাঁচ বছর ধরে ঘৃণাবোধ থেকে উৎসারিত গণপ্রহার ও হত্যাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে, দিয়েছে সামাজিক মান্যতা তাদের কাছে কোন ন্যায়বিচার দাবি করব? সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ও ঐতিহ্য রক্ষার অজুহাতে তো তারা পথ-ঘাট, যানবাহন, পাড়া-বেপাড়ার অসহায় ‘অপর’-এর মহল্লাতে স্থাপন করে ফেলেছে একের পর এক গণ-আদালত। স্রেফ সন্দেহ, স্রেফ কল্পনা, নেতিবাচক পূর্বধারণা কিংবা অজ্ঞতা-প্রসূত মিথ্যার উপর নির্মিত বিচারবোধ থেকেই মিটিয়ে ফেলা হচ্ছে বিচার প্রক্রিয়া। ঘোষিত হচ্ছে গণপিটুনির নিদান। দেশজোড়া এই পরিমণ্ডলের মধ্যে দাঁড়িয়ে ‘ন্যায়বিচার’-এর দাবি নিজের কানেই পরিহাসের মতো শোনায়।
তবু তো কথা বলতেই হয়। প্রশ্ন তুলতে ভুলে যাওয়া চলে না। যখন কিছুটা ধাতস্থ হয়ে সংবাদপত্রের পাতা উল্টোই, দেখি একাদশ শ্রেণির স্কুলছুট আত্মঘাতী জৈশ জঙ্গি নাকি তার গাঁয়ের মসজিদে মুয়াজ্জেনের দায়িত্ব পালন করত এক সময়। তবে, এই ধর্মবিশ্বাসী তরুণের তো জানা উচিত, কোরান ও হাদিসে আত্মহত্যার মান্যতা নেই। উল্টে নিন্দা আছে। নরকভোগের দণ্ড রয়েছে। আল্লাহর কাছে তা অমার্জনীয় অপরাধ। তবে, এক ধর্মনিষ্ঠ তরুণ কোন যন্ত্রণায় ধর্মের পথ পরিহার করল? নাম লেখাল এক ভয়ংকর জঙ্গি দলে। নাকি একটু তলিয়ে দেখব এই ভেবে যে, “…তথাকথিত মুসলমান ধর্মান্ধ আত্মঘাতী বোমারুরা যেটা করে — ভালো করে ভেবে দেখলে সেটাকে আত্মহত্যা বলাই যায় না। কেন — তা একটু ধৈর্য ধরে বুঝে দেখলে বিদর্ভের কার্পাসকৃষকদের ঝাঁকে ঝাঁকে নিজের হাতে নিজের হত্যাকেও আত্মহত্যা বলবার আগে আমরা হয়তো একটু দ্বিধাগ্রস্ত হবো। আর এই দ্বিধাটুকুই আমাদেরকে পুঁজিলোলুপ উন্নয়নের ঘুণধরা নৈতিক চেহারাটিকে দেখতে সাহায্য করবে।” তবে কি এই আত্মঘাতগুলি সামাজিক- রাজনৈতিক-আর্থিক অপরাধ? অর্থাৎ “…বাইরে থেকে আসা ক্ষমতার চাপে পড়ে পরকৃত বাধ্যতামূলক আত্মহত্যা হিসেবে ধরতে হবে। এরা (কার্পাসচাষী কিংবা আত্মঘাতী জঙ্গি) যেচে মরেনি, এদেরকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে।”
দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তীর এই ভাবনায় ভাবিত হয়ে আমরা যদি কাশ্মীরের দিকে তাকাই তবে কি খুঁজে পাব “বাইরে থেকে আসা ক্ষমতার চাপ” আর বাধ্যতামূলক “সামাজিক অপরাধ”-এর আখ্যান। বিগত তিন দশকের কাশ্মীরের দিকে তাকালে মন বলে পাব বই-কি। অত পিছনে না-তাকালেও চলে। মোদী জমানার পাঁচটি বছর-ই যথেষ্ট। ২০১৪ পূর্ববর্তী এক যুগের তুলনায় যে জমানায় লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে জঙ্গিবাদের বাড়বাড়ন্ত আর পাশাপাশি সামরিক বাহিনী বিরোধী গণপ্রতিবাদ। বেড়েছে সরকার আর সাধারণের মধ্যে অবিশ্বাস, সরকার সাধারণের কাছ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। বেড়েছে সাধারণ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা। বহুনন্দিত ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’-এর পরেও সীমান্তে বেড়েছে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা। দক্ষিণ কিংবা উত্তর কাশ্মীরের জেলায় জেলায় নির্বাচন পরিহাসে পরিণত হয়েছে।
কাশ্মীরের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সোচ্চার দাবির উত্তরে ভারত মুখে যাই বলুক বার বার সামরিক সমাধানের নির্মম পথই নিয়েছে। একের পর এক গণহত্যা, গণধর্ষণ, শত শত যুবকের রহস্যজনক অন্তর্ধান, গণকবর, যুযুধান জঙ্গি আর ভারতীয় সামরিক বাহিনীর মাঝে পড়ে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া — সেই নয়ের দশকের স্মৃতি — আর যারাই বিস্মৃত হোক কাশ্মীরের মানুষ ভুলে যায়নি। দু’হাজার পরবর্তী সময়ে কাশ্মীরের প্রায় অধিকাংশ সাধারণ মানুষই হুরিয়ত কিংবা জঙ্গি নেতৃত্বের প্রতি যেমন আর অবিচল আস্থা দেখায়নি তেমনই ভারত এবং তার সেনাবাহিনীর প্রতি ছিল চরম অনাস্থা। আবার ২০০৮ সালের পর থেকে জঙ্গি হামলা কমে এলেও তরুণ কাশ্মীরিরা বেশি বেশি করে আন্দোলনমুখী হয়ে উঠছিল। তারই মাঝে ঢাকঢোল বাজিয়ে কাশ্মীরের ‘মন বোঝার’ পালা সংগঠিত হয়েছে। নিয়োজিত হয়েছে ‘মধ্যস্থতাকারী’। এই ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসেই তো জম্মু-কাশ্মীরের নানা অংশীদারদের একসঙ্গে মুখোমুখি বসানো, আলোচনা শুরু করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান দীনেশ্বর শর্মাকে। কেন্দ্রের বক্তব্য ছিল আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে কাশ্মীরি জনগণের ‘ন্যায়সংগত আশা-আকাঙ্ক্ষা’কে বোঝা। এর ঠিক দু’মাস আগে ১৫ অগস্ট প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, ‘বুলেট’ ও ‘রূঢ়তা’ দিয়ে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হবে না। কাশ্মীরিদের ‘বুকে জড়িয়ে ধরতে’ হবে। কিন্তু দেখা গেল আলোচনার প্রস্তুতির মাঝেই এনআইএ হুরিয়ত নেতাদের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসবাদীদের অর্থ সাহায্য’ করার অভিযোগ আনল। এর ফলে দীনেশ্বর শর্মা’র ভূমিকা ও ক্ষমতাই খর্ব হয়ে পড়ল। নানা সময়ে এমন নানা বহুপক্ষীয় আলোচনা হয়েছে। যা আলোচনাকারী, মধ্যস্থতাকারী কিংবা সরকারের একাংশই জানে। সাধারণের মাঝে যা কখনোই পৌঁছায়নি। স্রেফ ধামাচাপাই দেওয়া হয়েছে।
এই যে মোদীর ‘হৃদয় পরিবর্তন’ আবার একই সঙ্গে আলোচনার চাকায় বল্টু এঁটে দেওয়া — এ আসলে ২০১৭’র এপ্রিলে লোকসভা উপনির্বাচনে মানুষের প্রতিক্রিয়ার ফল বলেই মনে হয়। ওই নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৭.১৪ শতাংশ। অনন্তনাগে ভোটই করা যায়নি। মৃত্যু হয় আট জন সাধারণ নাগরিকের। সামরিক বাহিনীর জিপের বনেটে এক ভোটদাতাকে বেঁধে অকুস্থলে ঘুরে বেড়ায় সেনাবাহিনী।
অথচ পিডিপি-বিজেপি জোটের ‘অ্যাজেন্ডা অব অ্যালায়েন্স’ অনুযায়ী যে রোডম্যাপ তৈরি হয়েছিল বিভিন্ন ওয়ার্কিং গ্রুপ-এর রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে — তার প্রায় কিছুই মেনে চলা হয়নি। পাক-শাসিত কাশ্মীরের উদ্বাস্তু, পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তু এবং কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বিশেষ সুযোগসুবিধের বিষয় তার অন্যতম ছিল। অ্যাজেন্ডায় ছিল হুরিয়তের সঙ্গে আলোচনা। আফস্পার মতো কালাকানুন তুলে নেওয়া। এছাড়াও বহুমাত্রিক ডায়ালগ, উন্নয়ন পরিকল্পনার মতো নানা সম্পাদ্য কার্যাবলী।
না, সে পথে হাঁটাই শুরু হল না। ২০১৫ সালে হিজবুল মুজাহিদিন কমান্ডার বুরহান ওয়ানি উঠে এল জিহাদের নতুন মুখ হিসেবে। নতুন করে জঙ্গি দলে নাম লেখাতে শুরু করল উপত্যকার তরুণেরা। শুরু হল সামরিক অভিযান ‘অপারেশন অলআউট’। ২০১৭ মৃত্যু হল ২১৩ জন জঙ্গি এবং ৫১ জন সাধারণ নাগরিক। ২০১৮ সালে সংখ্যাটি যথাক্রমে ২২৫ ও ৫০ জন। ২০১৬ সালে ৮ জুলাই ওয়ানি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হল। ভারতের কাছে এক নেতৃস্থানীয় জঙ্গির মৃত্যু হল বটে, অসংখ্য কাশ্মীরি পেল আরও এক স্বাধীনতা সংগ্রামী শহিদ। বুরহানের জানাজায় মানুষের ঢল নামল। এর পর উত্তরোত্তর বেড়েছে ভারত বিরোধী আন্দোলন। ইট-পাটকেল হাতে তারা উপচে পড়েছে মহল্লায় মহল্লায়। সিআরপিএফ-এর পেলেট গানের ছড়রায় মৃত্যু হয়েছে শতাধিক সাধারণ মানুষের, সারাজীবনের জন্য অন্ধ হয়ে গিয়েছে আরও শতাধিক। এই তো গত ১৫ ডিসেম্বর পুলওয়ামার সিরনু গ্রামে জঙ্গি-বিরোধী অভিযানে তিন জন জঙ্গির পাশাপাশি মৃত্যু হল সাত সাধারণ নাগরিকের। আহত বেশ কিছু জন। সামরিক বাহিনীর অভিযানের বিরুদ্ধে কেউ কেউ ইট-পাটকেল, কেউ-বা খালি হাতেই পথে নেমেছিল। সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা মাথায়-বুকে গুলি করে হত্যা করে সাত জনকে। কাশ্মীরের সমস্ত দল এবং হুরিয়ত নেতৃত্বের নিন্দা ও প্রতিবাদের মুখে রাজ্যপালকেও ভর্ৎসনা করে বলতে হয়, বাহিনীকে এই জাতীয় অভিযানের ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রোসিডিওর’ মেনে চলতে হবে। রাজ্যপাল বললেন বটে কিন্তু এর কয়েক মাস আগেই সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত পরিষ্কার ঘোষনা করেছিলেন, বন্দুকের লড়াইয়ে যে নাগরিকরা বাধা দেবে তাদের ‘জঙ্গি’ হিসেবেই ধরে নেওয়া হবে। না, কেন্দ্রীয় সরকার সেনাপ্রধানের এই মন্তব্যের কোনও বিরোধিতা করেনি। এই অতীতচারণ যখন করছি তার ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগেই মঙ্গলবার ২০ ফেব্রুয়ারি শ্রীনগরে সেনা-সিআরপিএফ এবং জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের সম্মিলিত সাংবাদিক বৈঠকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল কানোয়াল সিং ধিঁলো কাশ্মীরের মায়েদের উদ্দেশে চেতাবনি দিয়ে বলেন, “ছেলেদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনুন। না হলে যে কোনও দিন মৃত্যু হতে পারে। কাশ্মীরে যে বন্দুক তুলে নেবে তাকে শেষ করে দেওয়া হবে।” তাহলে, স্রেফ পাকিস্তানের দিকে আঙুল তুলে, ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’-এর হুমকি দিয়েই চুপ করে থাকা যাচ্ছে না। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের সেনাকর্তাকে অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে একটি রাজ্যের মায়েদেরও চেতাবনি দিতে হচ্ছে। দুর্ভাগা সেই দেশ যার লেফটেন্যান্ট জেনারেল ধিঁলোর মতো বীরের প্রয়োজন হয়!
উল্টোদিকে, জম্মুতে হিন্দুত্ববাদী যুদ্ধজিগির, ৩৭০ ধারার বিরোধিতা, কাঠুয়ায় বাকেরওয়ালে বালিকার ধর্ষণ ও খুনে অভিযুক্তদের পাশে বিজেপি নেতৃত্বের সর্বশক্তি নিয়ে পথে নামা — প্রমাণ করে জোট-সরকারের রীতিনীতি মেনে চলতে রাজি নয় তারা। সরকারের পতন অনিবার্য ছিল। কিন্তু উল্লেখযোগ্য যে, সরকারের পতনের পর বিজেপি ছাড়া আর কোনও রাজনৈতিক দলই সরকার গঠনে আগ্রহ দেখায়নি। কেননা সরকার নিয়ে সাধারণের মধ্যেও ছিল না ন্যূনতম আগ্রহ। নির্বাচিত সরকার মানে যদি সেই বকলমে সামরিক শাসন হয়, তবে সে সরকারের পতনে কী আসে যায় সাধারণ মানুষের!
এই সামরিক-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিবেশ কি এক মুয়াজ্জেনকে জঙ্গিতে পরিণত করে? শেষ পর্যন্ত আত্মহননে বাধ্য করে? একই ভাবে কি প্রশ্ন তোলা যায় যে এই ৪৪ জন জওয়ানের এই মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্যও কি এই সামরিক-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিবেশ দায়ী নয়?
ভয় হয় এ কথা বলার জন্য খুনের হুমকি দেওয়া হবে কি না? ভারতমাতা ও জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিয়ে উন্মত্ত আক্রমণ শানানো হবে কি না? জানি না। রাজ্যজুড়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ এই কথাগুলিই নিজের মতো করে বলতে গিয়েই তো উগ্র জাতীয়তাবাদী ‘দ্বেষপ্রেমিক’দের কাছে চূড়ান্ত অপমানিত, হেনস্থা ও নিগ্রহের শিকার হয়েছেন বহু তরুণ-তরুণী, বহু কাশ্মীরি ছাত্রছাত্রী, সাধারণ মানুষ। চাকরি খোয়াতে হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন-পুলিশ পাশে দাঁড়ায়নি। উলটে প্রশ্ন করার অপরাধে, প্রতিবাদ করার অপরাধে তাদের গ্রেফতার করেছে। কিন্তু, ভিন্নমত পোষণ, ভিন্নভাবনা, আলাপ-আলোচনার পরিবেশ ছাড়া গণতন্ত্র বাঁচে না। তাই, বুড়ো শরীরেও শক্তি জোগায় এক আঠারোর তরুণ। এই সময়ে দাঁড়িয়ে সে বলেছিল, “সৈন্যদের মৃত্যু শোকের পাশাপাশি কাশ্মীরি যুবকদের মৃত্যুরও নিন্দা করুন।” এই সত্য কথনের দায়ে সে গ্রেফতার হয়েছে। অস্বীকার করেছে ক্ষমা চাইতে। কেননা এ তার রাজনৈতিক ভাষ্য। রাজনৈতিক দর্শন। ফলত তার জামিন মেলেনি প্রথমদিন। এই দু:সময়ে এও কি কম পাওনা?
কৃতজ্ঞতা : অরিন্দম চক্রবর্তী, ভাতকাপড়ের ভাবনা এবং কয়েকটি আটপৌরে দার্শনিক প্রয়াস (অনুষ্টুপ ২০১৪)।
লেখক স্বতন্ত্র সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী।