কাশ্মীর: একটি রক্তাক্ত উপত্যকার কথকতা


  • February 5, 2019
  • (0 Comments)
  • 2816 Views

“দুধ মাঙ্গো তো ক্ষীর দেঙ্গে/ কাশ্মীর মাঙ্গো তো চির দেঙ্গে”- এই স্লোগানে বেড়ে ওঠা মনন যে উগ্র জাতীয়তাবাদী আরক গিলে কাশ্মীর ভারতের “অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ” বলে চিৎকার করে ও ভিন্নমতের মানুষেদের শাপান্ত ক’রে দেশপ্রেমের হাতে গরম নমুনা পেশ করে তাদের কাছে যদি প্রশ্ন করা যায় যে, অবিচ্ছেদ্য কাশ্মীরের মানুষরা আমাদের সহনাগরিক তো? তাদেরও ভারতীয় সংবিধান বর্ণিত অধিকার ভোগ করার কথা – একথা আমরা বিশ্বাস করি তো? উত্তরটা সহজ হবে না। লিখছেন সুমন কল্যাণ মৌলিক

 

 

কাশ্মীরে মানবাধিকারের প্রশ্নটা অনেকটা সোনার পাথরবাটির মতো। কারণ, শাসকদের সৌজন্যে, সিনেমার কুশলী বিষোদগারের কারণে আমরা সেখানকার মানুষদের সহনাগরিক ভাবি না বরং শত্রু শিবিরের লোক বলে দেগে দেওয়াতেই আমরা নিশ্চিন্ত বোধ করি। আমরা কখনও প্রশ্ন করি না যে কাশ্মীর যদি আমাদের দেশ হয়, তবে সেখানকার মানুষরাও আমাদের সহনাগরিক হবে না কেন। আমরা চিৎকার ক’রে বলতে পারি না যে, রাষ্ট্র তার নিজের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে না।

 

আমাদের ঔদাসীন্য, অবহেলা, অবিবেকী উচ্চারণ কাশ্মীর সমস্যাকে আরও জটিল করছে। তবুও এই কঠিন সময়ে গণতন্ত্রের প্রতি ভালোবাসায়, নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার সচেতন প্রয়াসে প্রতিবছর সেখানকার মানুষের অবস্থা, অধিকার ভঙ্গ হওয়ার বেদনা বিধুর কথকতা আমাদের সামনে তুলে ধরছে দায়বদ্ধ দুটি সামাজিক সংগঠন – ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ পেরেন্টস অফ ডিসঅ্যাপিয়ার্ড পার্সনস্’ এবং ‘জম্মু-কাশ্মীর কোয়ালিশন অফ্ সিভিল সোসাইটি’। ২০১৮-এর সালতামাম সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। তাদের এই অসাধারণ প্রয়াসকে কুর্ণিশ জানিয়েই এই নিবন্ধের অবতারণা।

 

ঘটনার ঘনঘটায় ২০১৮ সালকে কাশ্মীরের মানুষ সহজে ভুলবে না। এ বছরই সেখানে তারা ভারতীয় জনতা পার্টি ও মেহবুবা মুফাতির পিডিপি’র অনৈতিক সুবিধাবাদী জোট সরকারের পতন দেখলো। কথায় কথায় জাতীয়তাবাদের বুলি ওগড়ানো বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ কীভাবে তাদের নিজেদের ভাষায় ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ সাজ্জাদ লোনের সঙ্গে গোপনে রফা করে সে রাজ্যে ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত করেছিল – তা দেখল আমজনতা। কীভাবে আরেকবার সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসনের বকলমে সামরিক শাসন চাপিয়ে দেওয়া হল – সে দৃশ্য কেউ ভুলবে না।

 

বেয়নেটের ডগায় স্থানীয় নির্বাচনের প্রহসনও মঞ্চস্থ হল। ‘মৃত্যু’ শব্দটি যদিও উপত্যকাবাসীর কাছে আজ আর কোন আলাদা তাৎপর্য বহন করে না হয়তো, তবুও মৃত্যুর খতিয়ানে গত দশবছরে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটলো ২০১৮ তে। ২০০৯ সালে ৪৬০, ২০১৪ তে ২৩৫, ২০১৬ তে ৩৯৫, ২০১৭ তে ৪৪৯ এবং ২০১৮ তে ৫৮৬। এই অবিরত মৃত্যুর ধারাবিবরণীতে সাধারণ মানুষের সংখ্যা ১৬০। পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনীর সংখ্যা ১৫৯ এবং ২৬৭ জন জঙ্গি (প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য আলোচিত প্রতিবেদনে Militant শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে,যদিও মানবাধিকার আন্দোলনের ভাষায় জঙ্গি শব্দটি আমরা ব্যবহার করি না, বদলে সশস্ত্র বিরোধী গোষ্ঠী কথাটি ব্যবহার করা হয়)। তথ্যের খাতিরে মৃতদের এলাকাগত পরিচয়টা দেখে নেওয়া যেতে পারে।

 

এই রণক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার সবচেয়ে বেশি হয়েছেন দক্ষিণ কাশ্মীরের মানুষ – কুলগাম, অনন্তনাগ, ফুলওয়ামা ও সোপিয়ানে ৮৫ জন সাধারণ মানুষ মারা গেছেন। উত্তর কাশ্মীরের বারামুলা, কুপওয়ারা ও শাদিপোরাতে ২৪ জন এবং মধ্য কাশ্মীরের শ্রীনগর, গাদেওয়াল ও বাদগামে ১৩ জন। কীভাবে মারা গেলেন এই সাধারণ মানুষরা? এ বছরে যে ১৬০ জন মানুষ মারা গেছেন তার মধ্যে ৭১ জন নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে, ২৯ জন নিয়ন্ত্রণরেখার দু-পারের মধ্যে গোলাগুলির কারণে, ২৫ জন অজ্ঞাত পরিচয় যুদ্ধবাজদের হাতে, ১৮ জন জঙ্গিদের দ্বারা, ১০ জন বিস্ফোরণে, ১ জন পাথর ছোঁড়ায়, ১ জন বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীর গুলিতে ও ১ জন শিশু গণধর্ষণের পর হত্যার কারণে (কাঠুয়া)।

 

শুধু মৃত মানুষের সংখ্যাই বিবেচ্য নয়, কাশ্মীরে সরকারের অচরিত গণতন্ত্রে আলাপ-আলোচনার কোন স্থান নেই, যে কোন প্রতিবাদ বা বিরুদ্ধতাকে বলপ্রয়োগের দাওয়াই দিয়ে স্তব্ধ করাই একমাত্র পন্থা। ২০১৬ সালে পেলেট গানের ব্যবহার নিয়ে সারা দেশের মানবাধিকার কর্মীরা সরব হয়েছিলেন কিন্তু তাতে যে শাসকদের ভাবনার কোন পরিবর্তন হয়নি, ২০১৮ আরেকবার তা প্রমাণ করলো। শুধুমাত্র ১লা থেকে ৯ই মে-র মধ্যে ১১৫ জন শ্রী মহারাজ হরি সিং হাসপাতালে পেলেট ও বুলেট ইনজুরি নিয়ে ভর্তি হন, এর মধ্যে ৬০ জন চোখে আঘাত পেয়েছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বয়ান মোতাবেক ২০১৬ সালের গ্রীষ্মের সময় থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পেলেট গানের কারণে ১২৫৩ জন মানুষ অন্ধ হয়ে গেছেন। ২৫শে নভেম্বর (২০১৮) সোপিয়ানে এক ১৯ মাসের বাচ্চার দৃষ্টিশক্তি পেলেট গানের আঘাতে চিরতরে চলে গেছে।

 

কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনী ও সশস্ত্র প্রতিবাদী গোষ্ঠীগুলির মধ্যেকার সংঘর্ষ সেখানকার জনজীবনে কীধরণের বিপন্নতা বয়ে আনছে – সেটাও এই প্রতিবেদন যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছে। এবছর এই ধরনের সংঘর্ষে ২৬৭ জন জঙ্গি মারা গেছেন। নিজেদের সন্ত্রাসকে লুকোতে প্রশাসন ও সামরিক কর্তৃপক্ষ সাফাই দিচ্ছেন যে এই নিহতদের জঙ্গিরা মানবঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে ৪০ জন মানুষকে সরকারি এনকাউন্টারে মেরে ফেলা হয়েছে। জম্মু-কাশ্মীরে ১৫ বছর পর আবার সরকার ফিরিয়ে এনেছে নির্যাতনের এক ভয়ংকর কৌশল যার নাম – ‘Cardon And Search Operation (CASO)’। একটি নির্দিষ্ট এলাকাকে সেনা দিয়ে ঘিরে দিয়ে তল্লাশি অভিযান। ২০১৮তে এরকম অভিযানের সংখ্যা ২৭৫টি। সাধারণ নাগরিকের ওপর নির্যাতন, মারধোর, মহিলাদের ওপর যৌন অত্যাচারের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি এই অভিযানগুলোকে কেন্দ্র করে। এই ধরনের অভিযানের সময় নিরাপত্তাবাহিনী যদি মনে করে কোন বাড়িতে সন্দেহভাজন কেউ লুকিয়ে আছে, তাহলে সেগুলিতে যথেচ্ছভাবে অগ্নিসংযোগ করে বা বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয় বলে প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের সম্পত্তিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

 

জোর করে আটকে রাখার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতের সুনির্দিষ্ট রায় থাকা সত্ত্বেও যে কোন প্রতিবাদ আন্দোলনের সময় ঢালাও গ্রেপ্তারি ও বেআইনীভাবে আটক রাখার ব্যবস্থা জম্মু-কাশ্মীরে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এক্ষেত্রে প্রশাসনের সবচেয়ে বড় সহায় “Jammu Kashmir Public Safety Act, 1978″। অধিকার আন্দোলনের কর্মী, সাংবাদিক, আজাদিপন্থী রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সন্দেহভাজন সশস্ত্র বিরোধী গোষ্ঠীর সদস্য বা প্রতিবাদী মানুষ – কেউই এই কুখ্যাত আইনের হাত থেকে রক্ষা পান না। প্রতিবেদকদের হিসাব অনুযায়ী এবারও কয়েকশো এরকম ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে আলাদা করে অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার হুরিয়ত নেতা মাসারত আলম ভাটের কথা – যিনি তার রাজনৈতিক জীবনে এই নিয়ে ৩৭ বার কুখ্যাত আইনটিতে আটক হলেন। জম্মু-কাশ্মীরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে আরেকটা বড়ো অভিযোগ হচ্ছে নাগরিকদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। অধিকার আন্দোলনের কর্মীদের মতে আজ পর্যন্ত উপত্যকা থেকে ৮০০০ মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেছেন। এ নিয়ে সরকারের ধরাবাঁধা উত্তর হল তারা সবাই নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করে জেহাদি শিবিরে নাম লিখিয়েছে। নিখোঁজ মানুষদের আত্মীয়রা অভিযোগ করেন যে এদের অনেককেই জোর করে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এবারেও এই ঘটনা ঘটেছে। তিনজন নিখোঁজ মানুষের মৃতদেহ পরে অন্য জায়গা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এরা হলেন মজদুর আহমেদ ভাট (শাদিপোরা), মুস্তাফ আহমেদ মীর (সাপোর), সিরাজ আহমেদ ভাট (কুলগাম)। সরকার এ ব্যপারে কোন স্বচ্ছ অবস্থান নিতে পারে না। নিখোঁজ সংক্রান্ত ঘটনাগুলির ব্যপারে অনুসন্ধানের জন্য আগত ‘The United Nations Working Group on Enforced or Involuntary Disappearances’-এর প্রতিনিধিদের ভারতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। যেমন হয় না উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা গণ কবরের তত্ত্ব তল্লাশ। ২০১৭ সালের ২৪শে অক্টোবর অধিকার সংগঠনগুলির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পুঞ্চ ও রাজৌরি জেলার গণকবর সম্পর্কে তদন্তের আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু সেই আদেশ আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১৮ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি এপিডিপি’র পক্ষ থেকে আইনজীবীদের একটি দলকে কবর খননকারী প্রয়াত আটা মহম্মদের কবরস্থলে যেতে দেওয়া হয়নি। আটা মহম্মদ দীর্ঘ সময় ধরে অজানা কবরগুলির পরিচিতি উন্মোচনের কাজ করছিলেন।

 

 

কাশ্মীরে শুধুমাত্র হত্যা বা দৈহিক আক্রমণই মানবাধিকার লঙ্ঘনের একমাত্র চিত্র নয়। প্রত্যেক দিন সেখানে মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, ধর্মাচরণের অধিকার, সংঘবদ্ধ হওয়ার অধিকারকে লুন্ঠন করা হয়। এই প্রতিবেদন সেই লুন্ঠনের কাহিনীর বিবরণ তুলে ধরে। এক্ষেত্রে গণতন্ত্রের “চতুর্থ স্তম্ভ” বলে বিজ্ঞাপিত সংবাদমাধ্যমের উপর অহরহ আক্রমণ সংঘটিত হচ্ছে। সুজাত বুখারির মৃত্যু তার তরতাজা উদাহরণ। ২০১৮ তে একাধিক সাংবাদিক রাষ্ট্রের রোষানলে পড়েছেন যেমন কামরান ইউসুফ (ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার), আকিব জাভেদ (কাশ্মীর অবজারভার), ফারুক শাহ (রাইজিং কাশ্মীর), অ্যানি গোয়েন (ওয়াশিংটন পোস্ট), ক্যাথাল ম্যাকনাটন (রয়টার্স)। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে সাধারণ মানুষের ধর্মাচরনের অধিকারের উপর প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। ২০১৮ সালে বছরের ৫২টি শুক্রবারের মধ্যে ১২টি শুক্রবারে জামিয়া মসজিদে নামাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। “গোষ্ঠী সংঘর্ষের আশঙ্কা আছে” এই বলে মহরমের শোভাযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়। মতপ্রকাশ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যবস্থা আজ সারা পৃথিবীতে এক বহুল প্রচারিত মাধ্যম। তাই ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে বন্ধ করার অর্থ মত প্রকাশের অধিকারকে লঙ্ঘন করা। ‘এ.পি.ডি.পি’ ও ‘জে.কে.সি.সি.এস’ ২০১৮ সালে ১০৮টি ইন্টারনেট ব্লক করার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। শুধু জেলাস্তরে নয়, এবছর সমগ্র কাশ্মীর জুড়ে ৭ বার ইন্টারনেট ব্লক করার ঘটনা ঘটেছে।

 

 

ধর্ষণ বা যৌন লাঞ্ছনা দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নিয়ন্ত্রণরেখার আশেপাশে ও দুর্গম গ্রামগুলি থেকে বারবার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। আধুনিক সমাজ-বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে ধর্ষণ’ও একপ্রকার যুদ্ধাস্ত্র, লক্ষ্য হল – “To punish, intimidate, coerce, humiliate and degrade the population”। হয়তো ২০১৮র সবচেয়ে ঘৃণ্য, পাশবিক ঘটনা হল, কাঠুয়ায় একটি ৮ বছরের মেয়েকে গণধর্ষণ ও হত্যা। সারা দেশের মানুষ এই নৃশংসতায় স্তব্ধ হয়ে গেছিল। ২০১৮ তে ১৪৩টি যৌন নির্যাতনের ঘটনা প্রশাসনের কাছে নথিবদ্ধ হয়েছে।

 

ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক সক্রিয়তার একটি ধারা ক্রমবর্ধমান। টুইটার, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক ভাবনা প্রকাশ করা বা কোন ঘটনার প্রতিবাদে সরব হওয়া আজকের দিনে একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য। কিন্তু কাশ্মীরে এই ধরনের সক্রিয়তার সঙ্গে যুক্ত মানুষজন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন।

 

যারা পুলিশ বা মিলিটারির বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছেন তাদের পুলিশ স্টেশন বা গোয়েন্দা দপ্তরে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদের নামে আটক করা হচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলি যাতে দেশের মানুষ জানতে না পারেন তাই সাম্প্রতিক সময়ে সুপরিকল্পিত ভাবে মানবাধিকার কর্মীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে পুলিশ-প্রশাসন। ২০১৮ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি পারভেজ ইমরোজ সহ তিনজন আইনজীবীকে বনিয়ার পুলিশ স্টেশনে আটক করে রাখা হয়। উপত্যকার বিশিষ্ট অধ্যাপক ও তথ্যের অধিকার আন্দোলনের কর্মী ড: আবদুল নায়েকের পুলিশি হয়রানির খবর সারা দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

 

কাশ্মীরে এবার দুটি স্থানীয় স্তরের নির্বাচন হয়েছে। কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ – এই দাবির যথার্থতা প্রমাণের জন্য বলপূর্বক নির্বাচন করা, ভোটের ফলাফলে কারচুপি করা – কাশ্মীরের নির্বাচনে কোন নতুন ঘটনা নয়। ১৩ বছর পর এবার জম্মু-কাশ্মীরে নগরপালিকা নির্বাচন হল। চার দফা নির্বাচনে জম্মু ও মাগাম অঞ্চলে যথেষ্ট ভোট পড়লেও কাশ্মীরের মানুষ প্রকৃত অর্থে নির্বাচনকে বয়কট করে। উপত্যকায় ভোটের হার ৮.২% (৮ই অক্টোবর), ৩.৪% (১০ই অক্টোবর), ৩.৫% (১৩ই অক্টোবর), ১৫.৩% (১৬ই অক্টোবর)। ৯ দফায় পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়। কিন্তু এই স্থানীয় নির্বাচনগুলিতে রাজ্যের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল (ন্যাশনাল কনফারেন্স ও পিডিপি) অংশ নেয়নি। কিন্তু নির্বাচন সফল (!) করতে এখানে যে সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তা প্রহসনের নামান্তর। প্রার্থীদের নাম ঘোষণা হয়নি, বরং পরিচিতির জন্য সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে। সাধারণত মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় হয় বেলা ১০টা থেকে ৩টে কিন্তু এইবার ২৪ ঘন্টার জন্য মনোনয়ন জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ৩০০টি হোটেলে রীতিমত সেনাশিবির তৈরি করে প্রার্থীদের রাখার ব্যবস্থা করা হয়। সরকারি কর্মীরা নির্বাচনে অংশ নিতে অনীহা প্রকাশ করলে তাদের জন্য একমাসের বেতন, ভাতা হিসাবে দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। এমনকি নির্বাচনের আগেই সেখানকার রাজ্যপাল ঘোষণা করেন – এইবার একজন বিদেশে শিক্ষিত মানুষ (জুনেদ আজিম মাট্টু) শ্রীনগরের মেয়র হবেন, এবং বাস্তবে সত্যিই তাই হয়।

 

এই প্রতিবেদন রক্তস্নাত উপত্যকায় আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে এক সুস্পষ্ট চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরে। রাজনৈতিক কর্মী ও তাদের পরিবারবর্গ, বিচ্ছিন্নতাকামীরা আক্রমণের শিকার হয়েছেন, অন্যদিকে সশস্ত্র বিরোধী গোষ্ঠীগুলির হাতে খুন হয়েছেন রাজ্যের পুলিশ ও তাদের পরিবারবর্গ। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল শিশুদের উপর ধারাবাহিক আক্রমণ। কাঠুয়ার ঘটনা ইতিপূর্বে আলোচিত কিন্তু শুধুমাত্র ২০১৮ সালেই ৩১ জন শিশু সন্ত্রাসের কারণে মারা গেছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, সাধারণ মানুষ যারা ২০১৮ তে মারা গেছেন তার মধ্যে ১৯.৪৯% শিশু। পৃথিবীতে জম্মু-কাশ্মীর সম্ভবত একমাত্র সংঘর্ষের এলাকা যেখানে ঠান্ডা মাথায় প্রতিবন্ধী মানষদের এনকাউন্টারে হত্যা করে জঙ্গি নিধনের বাহবা নেওয়া হয়। গত বছরেও দুজন প্রতিবন্ধী (একজন মানসিকভাবে অসুস্থ) সামরিক বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন।

 

সন্ত্রাসের এই দমবন্ধ করা পরিবেশ শুধুমাত্র জম্মু-কাশ্মীরের ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠরত কাশ্মীরি পড়ুয়ারাও আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। প্রতিবেদন মোতাবেক গতবছর ২৪ জন কাশ্মীরি যুবককে মারধোর করা হয়েছে এবং ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

 

২০১৮ সালের ১৪ই জুন রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত হাইকমিশনারের দপ্তর (UNOHCHR) কাশ্মীর উপত্যকার মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ৪৯ পাতার একটি প্রতিবেদন জেনেভা থেকে প্রকাশ করে। বর্তমান প্রতিবেদনটি ৬৪ পাতার। দুটি প্রতিবেদনেই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে কাশ্মীর উপত্যকায় সবচেয়ে বড় সমস্যা অভিযুক্তদের আইনের বিচার থেকে সম্পূর্ণ অব্যাহতি (impunity) দেওয়া। সমস্যা হল যে গণতন্ত্র আইনের শাসনে দায়বদ্ধ থাকে না, বার্তালাপে বিশ্বাস করে না, কেবলমাত্র বন্দুকের ডগায় শাসন করতে চায় – সেখানে অবিরত রক্তক্ষরণই তার নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। এপিডিপি/জেকেসিসিএস-এর প্রতিবেদন “Annual Human Rights Review – 2018” – সেই কথাটি আরেকবার প্রমাণ করলো।

 

 

লেখক একজন মানবাধিকার কর্মী। ফিচার ছবি: ফাইল/আল জাজিরা

Share this
Leave a Comment