এই চিঠির লেখক গুফরান সিদ্দীকী উত্তর প্রদেশের অযোধ্যার ফৈজাবাদের বাসিন্দা, একজন সমাজকর্মী ও মানবাধিকারকর্মী। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে উত্তর প্রদেশে রিহাই মঞ্চ্ ও অন্যান্য জনসংগঠনের সাথে ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করছেন। আওয়াধ পিপলস্ ফোরাম, অযোধ্যা, ফৈজাবাদের তিনি একজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়াও তিনি একজন স্বাধীন লেখক।
প্রিয় স্বয়ং সেবক
ছোটবেলা থেকে ধর্ম আর রাষ্ট্রের প্রতি আপনাদের আত্মসমর্পণের কাহিনী শুনতে শুনতে এইটা বুঝতে পেরেছিলাম যে আপনাদের ভক্তি আসলে দেশবাসীর প্রতি হিংসাত্মক কাজকর্মের দিকেই আপনাদের নিয়ে যাবে। এক বিশেষ ধরনের ঘৃণা যা আপনাদের মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, তার ফলাফলস্বরূপ আমাদের সামনে একটি বিকৃত, ঘৃণায় ভরা প্রজন্মের উঠে আসাটাই স্বাভাবিক ছিল।
আপনাদের গুজরাট মডেলের সরকার, ‘স্বদেশী’ থেকে শুরু করে ‘ধর্মরক্ষা’র নামে আপনাদের আন্দোলনের আসল রূপ সকলের সামনে নিয়ে এসেছে। স্বদেশীর নামে চালানো আপনাদের আন্দোলন দেশকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর যে স্বপ্ন দেখাচ্ছিল, তাকে এফডিআই নাকচ করে দিল, এবং আপনাদের নিশ্চুপ থাকা প্রমাণ করে দিল যে এটা একটা ষড়যন্ত্র ছিল। যে ষড়যন্ত্রে বিদেশী পুঁজির বিরূদ্ধে দাঁড়ানো আন্দোলনকে দুর্বল করে দেওয়া হল, আর সরকারে এসেই আপনারা এফডিআই-এর উপর সরকারী সমর্থন জানিয়ে একে সবক্ষেত্রে জারি করে ফেললেন। একইভাবে ধর্মকে সাম্প্রদায়িক চেহারা দিয়ে আপনারা ধর্মের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করলেন।
যদি এ কথা সত্যি হয় যে ধর্ম সবাইকে ভালবাসা আর সমতার অধিকার দেয়, তাহলে আপনাদের তৈরি করা ধর্মের নামে সব দলগুলি কেন নৈরাজ্য, অরাজকতার পরিবেশ বানিয়ে রেখেছে? গোহত্যা, লাভ-জিহাদ, মন্দির নির্মাণের মতো বিষয়গুলিতে আপনাদের আন্দোলন স্রেফ ঘৃণা ছড়ানোর কাজ করে।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায় গোহত্যার নামে আপনারা হিংসা ছড়ান বটে, কিন্তু দেশে যেসমস্ত স্লটার হাউজ চলছে সেগুলির বিরূদ্ধে কখনও আন্দোলন করেন না, কারণ এই স্লটার হাউজগুলোর ধনকুবের মালিকদের মধ্যে কেবল ও কেবলমাত্র আপনাদের কৃপাধন্য পার্টির সঙ্গে যুক্ত লোকেদের সংখ্যাই বেশি।
প্রেমেও আপনারা লভ জিহাদ দেখতে পান, অবশ্য তখনই যখন ছেলেটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হয়, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের হলে অবশ্য ঘর ওয়াপসি-র নাম দেওয়া হবে। এতেও যদি আপনাদের পার্টির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি থাকে, বা পুঁজিপতি থাকে, তাহলে প্রেমের বিয়ে মেনে নেওয়া হবে কিন্তু গরীবদের প্রতি আপনারা সব সময়েই মারমুখী থাকেন।
যদি মন্দির তৈরির কথা ওঠে তবে আপনাদের রক্ত যেন ফুটতে শুরু করে, কিন্তু যে সম্প্রদায়ের বিরূদ্ধে আপনারা প্রচার প্রসার করেন তারা মন্দির তৈরি হতে না দেওয়ার কথা কখনওই বলেননি। তাঁরা তো শুধু বেআইনিভাবে মসজিদের উপর হামলা করে তা ভেঙে ফেলার ঘটনার বিচারের কথা বলেন, তাও দেশের আদালতের মাধ্যমে; তাঁরা রাস্তায় নেমে হিংসা ছড়ান না, বা অন্য ধর্মের বিরূদ্ধে আন্দোলনও করেন না। কিন্তু গুজরাট থেকে শুরু করে কাশি পর্যন্ত আপনাদের পছন্দের সরকার অসংখ্য প্রাচীন মন্দির বিকাশের নামে ধ্বংস করে দেয় আর আপনারা একটা শব্দও করেন না। এতে কি আপনাদের রক্ত গরম হয় না?
আপনারা এই দেশের সৌন্দর্য ও পারস্পরিক ভালবাসা নষ্ট করার চেষ্টা করেছেন, একে কি দেশদ্রোহ বলা হবে না? কথায় কথায় পাকিস্তান থেকে শুরু করে কে জানে কোথাকার সব উদাহরণ দিতে শুরু করেন, কিন্তু একটা ছোট্ট কথা আপনারা বুঝতে পারেন না যে আপনারা যাদের অনুসরণ করেন, তারা নিজেদের দেশকেই বরবাদ করে দিয়েছে।
আমি আমার কথায় এটাই বলতে চাই, যে সংবিধানের বিরূদ্ধে আপনারা জনমত তৈরি করার চেষ্টা করছেন, তা এই দেশের আত্মা, আর কোনও শরীর আত্মাকে ছাড়া বাঁচতে পারে না। আপনারা এই দেশের বেশ কতকগুলি প্রজন্মকে ঘৃণা আর হিংসার মাধ্যমে বরবাদ করেছেন, অন্তত এই দেশটাকে বাঁচতে দিন। যাঁকে নিজের মায়ের সম্মান দিয়েছেন তাঁর আত্মার বিরূদ্ধে ষড়যন্ত্র করা বন্ধ করুন।
ঘৃণা আর হিংসার ব্যবসা আপনাকে ব্যক্তিগত সুখ আর অর্থনৈতিক লাভ হয়তো দিতে পারবে, কিন্তু এই দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম — যার মধ্যে আপনার সন্তানেরাও থাকবে — এমন একটি অসংবেদনশীল, অরাজকতা আর ঘৃণায় ভরা সমাজ দেখবে যা আমরা এখন থেকেই কল্পনা করতে পারি। কথায় কথায় গণহত্যা, সাম্প্রদায়িক হিংসা, জাতিগত হিংসা আর মহিলাদের বিরূদ্ধে ঘটতে থাকা অপরাধের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা আমাদের বলছে যে আমরা ক্রমশ এক নিষ্ঠুর, ঘৃণ্য আর ঘৃণায় ভরা সমাজে বদলে যাচ্ছি, যেখানে মতের মিল না থাকা মানে শুধু আর শুধুমাত্র মানুষকে হত্যা করা।
শেষে আমি আপনাদের এটাই বলতে চাই যে আমি, আমরা, এই দেশকে এভাবে ধ্বংস হতে দেব না যেভাবে আপনারা করতে চাইছেন। এই দেশ সংবিধান মেনেই চলবে, এবং এর গণতন্ত্রকে বাঁচানোর জন্য আমাদের মতো লাখো তরুণ আমাদের পূর্বপুরুষদের মতোই এর ক্ষতি করতে চাওয়া মানুষদের বিরূদ্ধে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়াবে।
ইনকিলাব জিন্দাবাদ
গুফরান সিদ্দীকী
হিন্দি থেকে বাংলায় অনুবাদ: সুদর্শনা চক্রবর্তী।