একদিন মিছিলে ইনকিলাবের সাথে জসিমুদ্দিন, রাধারমণ, আবদুল করিমের লেখা গান স্লোগান হবে। তেমন দিনের অপেক্ষাতে আপাতত শহরে বন্দরে নগরে গ্রামে নদীর তীরে, মানুষের ভিড়ে কথাদের খুঁজবো, যা আমাদের অস্থির সময়েকে আরও অসুস্থ করে তুলবে না। লিখেছেন লাবনী জঙ্গী।
১
ঘন নীল, স্বচ্ছ পানি তিরতিরে স্রোত; আর তার দিগন্ত জুড়ে পাহাড়ের আকাশ; সে নদীর সাথে খুব আপন-গোপন কথপোকথন হতে পারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গম্ভীর সন্ন্যাসিনী বকটিও নদীর ওপারে আমার মতোই বসে থাকে একটানা, কিছু মাছরাঙা ব্যস্ত বোরলি মাছ খুঁজতে। বেশ কিছু দূরে এক জেলে একটি অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি আর একটি খ্যাপলা সমেত সন্তর্পণে পা টিপে টিপে চলছে নদীর পাড় বেয়ে, বোরেলি মাছের সন্ধানে। এই বোরেলি মাছটি কেবলমাত্র রায়ডাকে পাওয়া যায়; রায়ডাক ব্রহ্মপুত্রের উপনদী, রায়ডাক আলিপুরদুয়ার-কোচবিহারের আদুরে-নদী। সেই পাহাড়ি নদী মৃদু খরস্রোত আর চোখ জুড়নো নরম নীল নিয়ে, বেঁচে থাকা আর বাঁচিয়ে রাখার স্বপ্ন দেয়।
কিন্তু পৃথিবী তার তথাকথিত সভ্যতার সাথে, বাঁচার নিয়ম বদলায়। এই তথাকথিত সভ্যতার প্রতিদানে প্রতিদিন খুন হয় জীবন, দূষিত হয় মাটি, চুরি হয় পাহাড়, শুকিয়ে যায় নদী, আর সাফ হয় বন-জঙ্গল। ঠিক এমনভাবেই পাহাড়ি ঘন নীল পানির নদীটার তীরে বেঁচে থাকা আর বাঁচিয়ে রাখার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়, যখন দেখি রায়ডাকের দেহ খুবলে তোলা বালি পাথর বোঝাই অসংখ্য গাড়িগুলো সারিবদ্ধ হয়ে চলছে। বিকট যান্ত্রিক শব্দে নদীর সাথে কথোপকথন বন্ধ হয়ে গেলে দেখি, নদীর বুক ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে; সে বুকে কোদাল-ফাওড়া নিয়ে আবছা যে শ্রমিকদল দিনভোর মালিকের ট্রাক বোঝায়ের জন্য বালি পাথর খুবলে তুলছে, খোঁজ নিয়ে জানলাম সেই আবছা শ্রমিকের দল আসে ‘সুরমা নদীর তীর’ থেকে ভরপেট দুবেলা অন্নের সন্ধানে সারাদিন নদী খুঁড়ে শহর সভ্যতা নির্মাণ করে যায় তারা, দেশে দুঃখ হলে চা বাগানে কাজ খুঁজতে মিনিরা আর আসামে আসে না, বরং চা বাগানের সস্তা শ্রমমুল্যে ক্ষুধার্ত পেটগুলো আসাম ছেড়ে দেশের চারিদিকে সস্তা শ্রমের কাজ খুঁজে নিচ্ছে। এভাবেই সুরমা নদীর মানুষরা আসে রায়ডাকের পাথর খুঁড়ে ট্রাক বোঝাই করতে।
আমিও এই নদীর বুক শুকিয়ে খুবলে নেওয়া সভ্যতার অংশীদার, আমার অপরাধবোধ হয়। আমার, আমাদের নদীর সাথে দূরত্ব ক্রমাগত বাড়ছে। যতটা দূরে যাচ্ছি নদীর আর আমরা ততটাই নিকটে আসছি ধর্মীয় হিংসা, পুঁজিবাদী প্রলোভনের। মাঝে মাঝে বড় এলোমেলো সময় যায়, যখন দেখি নদীকে আশ্রয় জানতে শেখা মানুষের, সেই নদীর সাথেই অনেক দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। অস্বস্তি, নিজের উপর বিরক্তি জমতে জমতে পাহাড় সমান। তারপর মনে হয় প্রলয় আসুক, ভয়ংকর প্রলয় এই একপেশে তথাকথিত সভ্যতাকে শেষ করে দিক। আমরা যারা পেটভারাতে সারাদিনভোর আমাদের মতো মানুষদের কাজে লাগিয়ে নদী খুবলে, পাহাড় চুরি করে, জঙ্গল কেটে ইমারত বানাচ্ছি সুখে বাঁচবো বলে, প্রলয় এসে আমাদের এসব ইমারত গুঁড়িয়ে দিক।
আমার এক প্রিয় বন্ধু বলেছিল, তুই ও যদি ধ্বংস চাস ওদের থেকে ফারাক কি রইলো, সে মনে করে আগামী সময় যতটা দুঃসহ ততটাই আশার; তার মনে হয় খুব বড় কিছু একটা হবে, খুব বড়। এই অস্থির সময়ের মধ্যেও আগামীদিনে এক বড় ‘বাঁচার লড়াইয়ের স্বপ্ন’ তার দুচোখ দেখে চলে সমানে। তার স্বপ্ন সত্যি হলে ‘সুরমা নদীর তীর থেকে আসা আধপেটা খাবার জোটা কোদাল হাতে রায়ডাক খুঁড়ে চলা আবছা শ্রমিকেরা, একদিন প্রবল স্রোতে এই সর্বগ্রাসি সভ্যতার বুকে আছড়ে পরবে। অন্যদিকে আমার দুঃস্বপ্ন একদিন এই সর্বগ্রাসি সভ্যতা একটু একটু করে পুরোটা ধ্বংস করে দেবে প্রকৃতি, পাহাড়, জঙ্গল, রায়ডাক নদী, বোরেলি মাছ, এমন সবকিছু যেখানে ভালোবাসা আছে, বেঁচে থাকার নিজস্ব নিয়ম আছে। আমি আজকাল খুব করে চাই আমার বন্ধুর স্বপ্নটাতে বাঁচতে। তাই নদীর তীরে, মানুষের ভিড়ে কথাদের খুঁজি, সেসব কথাদের যা আমাদের অস্থির সময়ে আরও অসুস্থ করে তুলবে না।
রায়ডাক নদীর তীরে গ্রাম বারবিশা গঞ্জ; এই গঞ্জটি আমাকে এমন অনেক কথা শুনিয়ে চলে যা শুনে মনে হয় আমার বন্ধুটির অনুমান ঠিক, বড় কিছু একটা হবে, কাস্তে- হাতুড়ি-কোদাল-ফাওরা নিয়ে আজ যারা মালিকের জন্য ফসল বুনছে, পাহাড় ভাঙছে, নদী খুঁড়ছে; কাল তারা এক হয়ে পথে নামবে বাঁচার লড়াইয়ে, নিজেদের জন্য, নদীর জন্য, পাহাড়ের জন্য, গাছেদের জন্য।
২
আলিপুরদুয়ারের বারবিশা গ্রামে আসা মুলত আমার বান্ধবীর বিয়ে উপলক্ষ্যে। আমার জীবনের প্রথম দেখা হিন্দু-মতে বিয়ে, গায়ে হলুদ থেকে সাতপাকে বাঁধা, বাসি বিয়ে প্রতিটা আচার-অনুষ্ঠান একেবারে সামনে থেকে দেখার এক আলাদা অনুভুতি যেমন ছিল। একই সাথে ছিল কোথাও একটা দেয়াল ভাঙ্গার সোচ্চার নিঃশব্দ। বান্ধবী ও তার পরিবারের কারুর কাছে বিরক্তি অশান্তির কারন ছিলাম না আমার ধর্মের কারণে আমি। আমার উপস্থিতি তাঁদের বাড়ির ঠাকুর ঘরকে অপবিত্র করেনি, তাঁদের বাড়ির রান্নাঘরে আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়নি। তারা আমাকে মানুষ হিসেবে মনে করছিলো; মেয়ের মতো ভালোবাসা দিচ্ছিল। মুসলমান পরিচয়ের যে হেনস্থা আমার জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে, সেখানে এক ভালোবাসার প্রলেপ লাগছিলো আমার বান্ধবীর এই বিয়েতে এসে। আমার স্কুলের সর্বক্ষণের বান্ধবীর কলেজে উঠে বিয়ে হয়, সেবার আমাদের গ্রুপের সকলকে নিমন্তন্ন করা হয় আমাকে বাদে; সেদিন আমার ধর্ম পরিচয় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রিয় বান্ধবীর বিয়ের দাওয়াত পেতে। খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন, আর রাগও। তবে সময় সবকিছু ঠিক করে দেয়। শর্মিলা আর গায়ত্রী দুজনেই আমার জীবনে প্রিয় মানুষ, ফারাক কেবল শর্মিলা আমাকে ‘মুসলমান বন্ধু’ মনে করতো, গায়ত্রি আমাকে কেবলই ‘বন্ধু’ মনে করে। আর বন্ধুকে কোন জাত-ধর্মের খোপে পুরে দিয়ে দেখার অশিক্ষা আমাদের এই অস্বস্তিকর সময়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে, এমন সময়ে গায়ত্রীর বিয়ে আর তার বাড়ির সাথে এই সুন্দর সম্পর্ক কী যে স্বস্তির।
মজার বিষয় হল, এই সব ভালোলাগার অনুভূতিগুলোই হতো না যদি ৭ তারিখ কোচবিহারে বিজেপির রথযাত্রা হতো। আমাদের আসার কথা ছিল ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে, ওই সময় বিজেপির ধর্মীয় উস্কানি সমেত এই রথযাত্রার প্রস্তুতি খবরে আসতে শুরু করলে বাড়িতে খুব ভয়ের আবহাওয়া তৈরি হয়। যদি ৭ তারিখ রথযাত্রা হতো এটা অনুমান করাই যায় একটা বড় সাম্প্রদায়িক দুর্ঘটনার পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার বিষয়টি অমূলক নয়। এধরণের পরিস্থিতিতে বাড়ি থেকে নির্বিরোধ ছাড়া পাওয়া একটু কঠিন হয়। কিন্তু সৌভাগ্য এই রথ নামক বিজেপির ধান্দাবাজির এসি বাসের চাকা কিছুদিনের জন্য স্থগিত থাকে। এই হিংসা বিস্তারের এসিবাস কিছুদিন স্থগিত থাকার কারণে আমার সাথে পরিচয় হয় রায়ডাক নদীর, বারবিশা এক জেলে দাদার সাথে যিনি কেবল বোরলি মাছ ধরেন; আমার বোঝাপড়ার বৃত্তে সংযোজিত হয় বান্ধবীর পরিবার যারা ধার্মিক, কিন্তু ধর্মের জন্য মানুষকে আঘাত করেনা, ধর্ম দেখে মানুষকে ভালোবাসে না তারা। আমার পরিচয় হয় প্রভাস দাসের সাথে যিনি বারবিশার একজন পৌঢ় সংবাদপত্র বিক্রেতা। প্রভাস কাকুর সাথে হঠাৎ পরিচয় হয় ফেরার দিনে; শিলিগুড়ির বাস আসার দুঘণ্টা দেরি। কাকুর ছোট্ট দোকান, একটা টুল দিয়ে বললেন এখানে বসো। হাতে পেপার দিয়ে বললেন পড়ো, এই টুকু সময় পেপারের হেডলাইন পড়তে পড়তে গল্প করতে করতে কেটে যাবে। আমি ওনার কাছে খোঁজ করলাম স্থানীয় পেপার,পত্রিকার; সেগুলো কিছু দিলেন; আমি জানতে চাইলাম এখানে কোন পেপার বেশি বিক্রি হয়। উনি জানালেন, “আনন্দবাজার, বর্তমান ভালই বিক্রি হয়, উত্তরবঙ্গ সংবাদও ভালো চলে; আমি বেশি ভ্যারাইটি রাখি না, চারপাঁচ রকম খবরের কাগজ রাখি। বাকি ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষার প্রস্তুতি বিষয়ক বইপত্তর রাখি। কি আর খবর লোকজনে নতুন করে পড়বে বল ? চারিদিকে তো ওই একটাই খবর ওদিকে মোচ্ছব চলছে এদিকে প্রতিবছর দেখছি ছেলে মেয়েগুলো চাকরিবাকরি না পেয়ে হতাশাতে ডুবে যাচ্ছে। আজকাল ছেলেমেয়েগুলোকে দেখলে বড্ড মায়া লাগে।”
“তোমাদের সময়টাই খুব খারাপ, রাজ্যসরকারের চাকরী নিয়োগের হাল দেখে কষ্ট হয়, মনে হয় এই যে তোমরা লেখাপড়া করছ কী হবে, কী করবে তোমরা, চারিদিকে মেলা আর উৎসবের হিড়িক পরেছে, এতো টাকা দিয়ে বোম্বের শিল্পী আনাচ্ছে রাজ্যসরকার আর ছেলেমেয়েদের চাকরী দিতে পারছে না। এত অরাজকতা তৈরি হয়েছে শাসন ব্যাবস্থাতে যে কী বলবো।”
আমি ভাবলাম বারবিশার চারিদিকে রাস্তাতে যে গেরুয়া পতাকা উড়ছে, আর দেশের গণতন্ত্র বিনাশকারী দল রাজ্যের ‘গণতন্ত্র রক্ষার ডাক’ –এ পোষ্টার দিয়েছে; তার প্রভাব হয়তো প্রভাস কাকুর কথা তে উঠে আসছে। আমি তাই ওনার কাছে জানতে চাইলাম বারবিশার রাজনৈতিক অবস্থান কী সে বিষয়ে। উনি জানালেন, “এই অঞ্চলে তাও ভোট হয়েছিলো; আমার বাড়ি কোচবিহারের তুফানগঞ্জে সেখানে তো শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে টু–শব্দটাও করা যায় না। বারবিশাতে অবস্থাটা একটু ভালো, এখানে শাসকের বিরুদ্ধে কথাটুকু এখনো বলা যায়। এখন বিজেপি ক্ষমতায় আছে, ভোট দিতে পেরেছিল লোকে তাই বিজেপি ক্ষমতায়। এমন একটা রাজত্ব যেখানে সবলেরা শাসন করবে, সেখানে ভোটের মর্যাদা শেষ”।
আমি কৌতূহলবশত প্রশ্নটা করেই বসি তাহলে রাজ্যের এই অবস্থার বিকল্প কী? বিজেপি?
উনি একচোট হাসেন, বলেন কীসে পড় তুমি? নিশ্চয় কলেজে পড়, তাহলে শোনো কথাটা খারাপভাবে নিয়ো না “দক্ষিণপন্থার বিকল্প কোনোদিনো দক্ষিণপন্থা হতে পারে কি” খুনে শাসকের বিরুদ্ধে আরেকটা বড় মাপের খুনে শাসককে কি তাহলে বিকল্প বলা যায়”?
আমি তখন প্রশ্ন করি তাহলে ভোট হলে বিজেপি জিতল কেন?
উনি বলেন মানুষ রেগে গেলে চিন্তাশক্তি হারায়, ধর তোমার পঞ্চায়ত প্রধানের উপর খুব রাগ হল তুমি ভাবলে এমএলের কাছে যাই, প্রধানের থেকে বেশি ক্ষমতা তাকে ধরি। বিষয়টা অনেকটা এরকম, কেউ বিজেপির রাজনীতিতে আকর্ষিত হয়ে ভোট দিচ্ছে না। রাজ্যের চরম অরাজকতার পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই ভোটের রেজাল্ট। তবে শুনে রাখ বিজেপির আগামী রেজাল্ট খুব একটা ভালো হবে বলে মনে হয় না। এরা রাজনীতির থেকে হিংসা ছড়ায় বেশি। এদের রূপ মানুষ খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে।
প্রভাস কাকুর সাথে চা খেতে খেতে আলাপ করি ৭ ডিসেম্বর কোচবিহারের বিজেপির রথযাত্রা নিয়ে, ওনার কোচবিহারের তুফানগঞ্জ এলাকাতে পার্শ্ববর্তী বারবিশাতে বিজেপির রথযাত্রার প্রভাব কী?
উনি জানান রথযাত্রার কর্মসূচী বাতিলের অন্য একটি কারণ, কোচবিহার আলিপুরদুয়ার এর ‘সাধারণ মানুষ’ রথযাত্রার এই রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ভালভাবে গ্রহণ করেনি। তাঁদের মধ্যে এ বিষয়টি বোঝাপড়ার মধ্যে আসে এই রথ ধর্মীয় রথ নয় রাজনৈতিক রথ, যেটা হিংসা ছড়াবে, হানাহানি ডেকে আনবে। তাই মানুষ সার্বিকভাবে এই রাজনৈতিক রথের পাশে ছিল না। বিজেপি তা বুঝতে পারে, রথ যাত্রাকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে ঢুকতে তাদের আরও সময় লাগবে, তাই উপরতলার এই নাটকে কিছুদিনের জন্য রথ স্থগিত করে, গণতন্ত্র বাঁচানোর অভিযান নাম দিয়ে লোক টানবার চেষ্টা করছে।
৩
আলিপুরদুয়ার আসার কদিন আগেই আমার চেনা প্রিয় বন্ধু বলেছিল, তার মনে হয় খুব বড় কিছু একটা হবে, মানুষ মানুষকে জাত-ধর্মের কারণে মারামারি হানাহানির এই পরিস্থিতিটা বদলে যাবে, অনেক মানুষ পথে নেমে বাঁচার লড়াই করবে; এই অসময় কেটে যাবে ঠিক। প্রভাস কাকু অচেনা এক কাগজ বিক্রেতা ঠিক একইভাবে বলেন এই খারাপ সময়টা বদলে যাবে, দেখো আমার মনে হয় মানুষরা বাঁচার লড়াইয়ে পথে নামবে, বিশ্বাস হারিয়ে ফেলো না। প্রভাস কাকু আগন্তুকের মতো দু-দণ্ড বসে বলে চললেন বারবিশার নামকরা পুরাতন হাটের কথা, “আগে সোম –শুক্র দুদিন করে সে হাট বসতো, সময়ের সাথে বাজার বড় হল, হাট ছোট হতে হতে মৃত প্রায়। বারবিশার রাসমেলা খুব বিখ্যাত, এককালে এই রাসমেলার থেকেও চারিদিকে নাম ছিল হাটের। প্রভাসকাকু বলেন আমরা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধ নিয়ে এতোসব কথা বলি তুমি জানো আমরা কোনোদিন ঈদে নতুন পোশাক কিনি না। কিন্তু আমি দেখি আমাদের এখানকার মুসলমানেরা দুর্গাপুজোতে নতুন জামা কেনেন, পরিবার সমেত এসে রাসমেলাতে অংশগ্রহণ করে উৎসবের আনন্দ খুঁজে নেয় তারা। তাহলে কীভাবে কোন সাম্প্রদায়িকতার কথা আমরা বলি। তুমি যদি আমাদের মতো খেটেখাওয়া মানুষের জীবনযাপন খোঁজো দেখবে সেখানে এইসব হিংসা নেই, আর যদি রাজনীতির চশমাটা পরো তাহলে অন্য কথা”
আরও কিছুক্ষণ আমরা কথা বলে গেলাম, মনে হল যেন কোন পূর্বপরিচিত কমরেডের সাথে দেখা হয়েছে। তার মতো করে আরও কতো জানা, বোঝা বাকি রয়ে গেল দুঘণ্টা বড় কম সময়, এই অসময়ে। তিনি বাসে উঠিয়ে দিলেন, ফোন নাম্বার দিয়ে বললেন ফোন ক’রো, আর আবার এসো। বাস এগোল ময়নাগুরি, পাহাড়ি নদী, ভাঙা সেতু পেরিয়ে চোখ বুজতেই আবার ফিরে গেলাম, বিয়েবাড়িতে, সেই যেখানে তারাদের নিচে বৌদিরা কাজকাম সেরে আগুণ পোহাতে পোহাতে সমস্বরে গেয়ে উঠেন ভাওয়াইয়া, ‘ও কী ও বন্ধু কাজল ভ্রমরারে কোন দিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও কয়া যাও রে।।যদি বন্ধু যাবার চাও ঘাড়ের গামছা থুইয়া যাও রে বন্ধু কাজল ভ্রমরারে কোন দিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও কয়া যাও রে’ যেটি লিখেছেন জসিমুদ্দিন।
এর পর পালা করে করে আসেন রাধারমণ, আবদুল করিম। রাত গভীর হলে এই গানের সাথে রায়ডাকের পানির শব্দ , আর কাঠের আগুনের শব্দগুলো যেসব মায়া তৈরি করতে থাকে সেগুলো অনুভব করলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় আগামী দিনে এই হিংসার পৃথিবীটা আবার প্রেম করতে শিখে যাবে। এই সভ্যতা যে নদীকে খুবলে খুঁড়ে নিচ্ছে, একদিন এই সব মাটি, পাহাড়, নদী, জঙ্গলের সন্তানেরা এই তথাকথিত সভ্যতাকে পাল্টা আঘাত করবে। সেদিন মিছিলে ইনকিলাবের সাথে জসিমুদ্দিন, রাধারমণ, আবদুল করিমের লেখা শ্লোগান গাওয়া হবে। তেমন দিনের অপেক্ষাতে তাই আপাতত শহরে বন্দরে নগরে গ্রামে নদীর তীরে, মানুষের ভিড়ে কথাদের খুঁজবো, সেসব কথাদের যা আমাদের অস্থির সময়ে আরও অসুস্থ করে তুলবে না।
লেখিকা সেন্টার ফর সোশ্যাল সাইন্স কলিকাতা-র শিক্ষার্থী ও গবেষক।
Thanks for the very good article/feature. The photographs are excellent. Captions would have been nice. Please, check whether the song cited was composed by Jasimuddin or not.