ফোনে বোতাম টিপলেই যেখানে চাইবেন ঠিক সেইখানে চলে আসবে গাড়ি। রাস্তায় বেরিয়ে হাঁকাহাঁকির প্রশ্ন নেই, নেই প্রশ্ন প্রত্যাখানেরও। অন্যদিকে মাসে লক্ষাধিক টাকা কামাবেন ক্যাব অপারেটররা। এমনটিই দাবি ওলা-উবের কর্তৃপক্ষের। ড্রাইভার, গাড়ির মালিক, প্যাসেঞ্জার, বহুজাতিক কোম্পানি, স্মার্টফোন প্রযুক্তি – সব মিলে সুখের সংসার। অথচ, গত কয়েকদিনে কলকাতা শহরে আমরা দেখেছি এহেন ওলা-উবেরের ড্রাইভার-মালিকদের ধর্মঘট, গাড়ি ভাংচুর, যাত্রীদের গাড়ি থেকে নেমে যেতে বাধ্য করা। কেন? লিখছেন বাসুদেব নাগ চৌধুরী।
গত ২৪ শে ডিসেম্বর বিকেল বেলায় অকস্মাৎ তৃণমূল কংগ্রেসের অন-লাইন ক্যাব সংগঠনের পক্ষ থেকে ‘ওলা’-‘উবের’-এ তিন দিনের ধর্মঘট ডাকা হয়। বিষয়টি নিয়ে মেইন স্ট্রীম মিডিয়ায় ব্যাপক ভাবে খবর প্রচারিত হয়। পিপ্ল্’স্ ব্রিগেড-এর অন-লাইন ক্যাব ড্রাইভার অ্যান্ড অপারেটরস কমিটির পক্ষ থেকে তৎক্ষণাৎ ড্রাইভার/অপারেটর-দেরকে প্রকাশ্যে (ওপেন হোয়াটস আপ গ্রুপে) জানানো হয় যে এই ধর্মঘট তৃণমূলের সংগঠন তুলে নেবে এবং শ্রমিকদের সাথে বেইমানি করবে। সেই রাতের মধ্যেই এই কথা সত্য বলে প্রমাণিত হয়। পরদিন কিছু ক্যাব ড্রাইভার না জেনেই বিক্ষিপ্ত ভাবে ধর্মঘট করবার চেষ্টা করেন, এবং সামান্য কয়েকটি ঘটনার ফুটেজ ব্যবহার করে বাজারি মিডিয়াও তাদের চিরকালীন শ্রমিকবিরোধী কুৎসা প্রচারে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তাই গোটা ব্যাপারটার সম্বন্ধে আরও একটু বিষদে কিছু কথা তুলে ধরা দরকার।
প্রথমত: ‘ওলা’-‘উবের’ সহ সকল অন-লাইন ক্যাব কোম্পানি নিজেদেরকে আই.টি. সার্ভিস প্রদানকারী সংস্থা হিসাবে দাবী করে। ফলে না শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন ভিত্তিক অধিকার রক্ষার দায় তাদের আছে, না ক্যাব-মালিক হিসাবে গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের কোনও দায়িত্ব তাদের নিতে হয়। নিজেদের সফ্টওয়্যার ব্যবহার করে ড্রাইভার, ক্যাব-মালিক (তথা অপারেটর) এবং কাস্টমার-এর মাঝে কার্যত হাই-টেক দালালি করেই মুনাফা কামাচ্ছে তারা। আর এভাবেই শেষ অর্থবর্ষে ভাবিশ আগরওয়াল-এর কোম্পানি ‘ওলা’-র রেভিনিউ পৌঁছিয়েছে ১২৮৬ কোটি টাকায়; বর্তমানে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইউ.কে.-এর ১৬৯ টি শহরে ব্যবসা চালাচ্ছে সে। অন্যদিকে মার্কিন কোম্পানি ‘উবের’ আজ ব্যবসা করে পৃথিবীর ৭৮৫ টি মেট্রো শহরে, এবং তার রেভিনিউ পৌঁছে গেছে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ২.৫ লক্ষ কোটি টাকায়।
দ্বিতীয়ত: এই ‘অন-লাইন ক্যাব’ কোম্পানিগুলি ড্রাইভার/অপারেটরদের অভিহিত করছে ‘বিজনেস পার্টনার’ বলে। অথচ একতরফা ভাবে ক্যাব-ফেয়ার ও ইনসেন্টিভ ঠিক করে তারা, রুটও ঠিক করে তারা, ড্রাইভারদের নিয়মকানুনও বানায় তারা, কাস্টমারদের অভিযোগ নিয়ে বা না নিয়ে পেনাল্টি কাটে এমনকি আই.ডি. ব্লক পর্যন্ত করে শাস্তিও দেয় তারাই। একপক্ষের পূর্ণ-কর্তৃত্বের এমন ‘পার্টনারশিপ’ (শব্দটি কোম্পানিগুলির তরফ থেকে বারবার ব্যবহার করা হয়) কেউ দেখেছে কোথাও কখনও কি ? আসলে ‘এমপ্লয়ী’ বা “শ্রমিক/কর্মী” হিসাবে আইনত প্রাপ্য অধিকারসমূহ এবং ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধাগুলো থেকেও ড্রাইভারদেরকে বঞ্চিত করবার জন্যই তারা এই ‘পার্টনার’ শব্দের পেছনে লুকোতে চায়, যাতে ‘এমপ্লয়ী’-র স্বীকৃতিটুকুও তাদের দিতে না হয়।
তৃতীয়ত: ট্রিপ পাওয়ার জন্য ড্রাইভারদেরকে কার্যত সারা দিন সারা রাত ‘লগ্-ইন’ করে অপেক্ষা করতে হয়; এবং অবস্থাটা আজ এমন দাঁড়িয়েছে যে সপ্তাহভর দিনরাত ‘লগ্-ইন’ থেকেও সেই কটা ট্রিপ মেলে না যাতে সব খরচ পুষিয়ে ঘর চালাবার মতো সংস্থানটুকু জোটে। কিন্তু, আইন অনুযায়ী পরিবহন শ্রমিকদের শুধু যে দিনে ৮ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাতে দেওয়া যাবে না তাই-ই নয়, উপরন্তু দিনে কাজের সময়ের মোট ব্যাপ্তি ১২ ঘণ্টার বেশি হওয়া চলবে না। সেক্ষেত্রে দিনে ১২ ঘণ্টার বেশি ‘লগ্-ইন’ রাখিয়ে কোম্পানিগুলি স্পষ্টতই আইন ভাঙছে। বিপরীতে, তার পরেও ড্রাইভারদের ট্রিপ মিলছে না।
চতুর্থত: কাস্টমারকে কোম্পানি বলছে ‘লোকেশন দিলে আপনার দরজায় গাড়ি পৌঁছবে’। কিন্তু যেকোনো অলিগলিতে কি গাড়ি ঢুকতে পারে? আর কোম্পানির দেওয়া এমনই সব অবান্তর প্রতিশ্রুতি ড্রাইভার পালন করতে না পারলেই কাস্টমার দিয়ে দিচ্ছেন ‘লো-রেটিং’; আর তারই ভিত্তিতে কোম্পানি ট্রিপ কম দেওয়া থেকে শুরু করে আই.ডি. ব্লক পর্যন্ত যা খুশি করে চলেছে। ড্রাইভারের ব্যবহার পছন্দ না হলেই কাস্টমার ‘লো-রেটিং’ দিতে পারেন, এমনকি পুলিশে অভিযোগও করতে পারেন, কারণ ড্রাইভারের সমস্ত তথ্য কাস্টমারের কাছে থাকছে; কিন্তু অন্যদিকে, কাস্টমারের কোনো পরিচয়পত্র ড্রাইভারের কাছে থাকছে না। কাজেই, কাস্টমারের অভদ্র আচরণের কথা ছেড়েই দিন, এমনকি কাস্টমার ভাড়া না দিয়ে চলে গেলেও তাকে ধরার বা থানায় তার নামে অভিযোগ করার উপায় ড্রাইভারের নেই।
পঞ্চমত: প্রায় তুঘলকি কায়দায় যেমন খুশি দূরত্ব থেকে ‘পিক্ আপ’ দিয়ে দেয় কোম্পানি, প্রায়শই যা এমন কি ৯-১০ কিলোমিটার হয়ে দাঁড়ায়। শুনলে হতবাক হবেন যে, ৩০ কিমি দূরত্ব থেকে পর্যন্ত ‘পিক্ আপ’-এর রিপোর্টও আছে। খালি গাড়ি এত দূর নিয়ে যাওয়ার জন্য ড্রাইভারের মেহনত ছেড়ে দিন, তেলের খরচা আসবে কোথা থেকে? অথচ এহেন ট্রিপ ক্যান্সেল করলেও রেটিং কমে যাবে! আর সেই অনুপাতে কমে যাবে প্রাপ্য ট্রিপ!
এসবের সাথে আছে স্বচ্ছতার অভাব; কাস্টমারের কাছে এক ভাড়া দেখানো, ড্রাইভারের কাছে অন্য; এমন ভুরি ভুরি অভিযোগ আছে কোম্পানির বিরুদ্ধে। আর এই সবের ওপর আছে রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশের তোলাবাজি। আর ঘাসে যেভাবে খরগোশ মুখ লুকোয়, সেভাবেই সব কিছু থেকে নিজের হাত গুটিয়ে লুকিয়ে আছে সরকার।
এভাবেই একদিকে যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ‘লগ-ইন’ থেকেও কাজ নেই, কখনও ৯-১০ কিমি দূরত্ব থেকে পিক্-আপ, সমস্ত রক্ত জল করে খেটেও লো-রেটিং, বলা নেই কওয়া নেই আই.ডি. ব্লক, কাস্টমারের দুর্ব্যবহার, পুলিশের অত্যাচার — সব কিছুর পর ড্রাইভারের জোটে গড়পরতায় ট্রিপ পিছু মাত্র ৬০ টাকা, আর গাড়ির ই.এম.আই. দিয়ে, সার্ভিসিং করিয়ে, পেট্রোল-ডিজেলের দাম দিয়ে, কেসের টাকা চুকিয়ে ড্রাইভারের প্রাপ্য দেওয়ার পর অপারেটর তথা ক্যাব-মালিকের ঘরে নিয়ে যাওয়ার মতো প্রায় কিছুই আর থাকে না, তখন ঠিক এর বিপরীতে ‘ওলা’ ও ‘উবের’ কোম্পানি গত এক বছরে তাদের ‘রেভিনিউ’ বাড়িয়ে তুলেছে যথাক্রমে ৭০% ও ৮৫%।
এই পরিস্থিতিতে পিপ্ল্’স্ ব্রিগেড-এর পক্ষ থেকে অন-লাইন ক্যাব ড্রাইভার অ্যান্ড অপারেটরস কমিটি গঠন করে দশ দফা দাবীর ভিত্তিতে ড্রাইভার/অপারেটর-দেরকে বৃহত্তর আন্দোলনের স্বার্থে সংগঠিত করতে শুরু করা হয়। বিষয়টি জানাজানি হতেই তৃণমূলের অন-লাইন ক্যাব সংগঠনের নেতা পার্থ সেন সশরীরে উপস্থিত হয়ে পিপলস ব্রিগেডের কর্মীদের হুমকি দেন; এবং তার পর তাঁরা ড্রাইভারদেরকে সরাসরি শাসানি দেন আমাদের মিটিংগুলিতে না আসার জন্য, নাহলে নাকি আই.ডি. ব্লক হয়ে যাবে অথবা ট্রিপ মিলবে না। এই সবের পিছনে আছেন চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে জেল-হাজত বাস করা প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্র। কিন্তু সকল চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করেই ড্রাইভার ভাইয়েরা একত্রিত হতে থাকেন। অতঃপর আন্দোলনের প্রস্তুতির শুরুতেই তৃণমূলের সংগঠনের পক্ষ থেকে ২৪ শে ডিসেম্বর অকস্মাৎ ওলা-উবেরে ধর্মঘট ডেকে দেওয়া হয়। আসলে এক ঢিলে দু-পাখি মারার উদ্দেশ্য নিয়েই তারা একাজ করে। একদিকে ক্রিস্টমাস-এর প্রাক্কালে ধর্মঘট-এর নামে সরকারকে ব্ল্যাকমেল করে শাসক তৃণমূল দলের অভ্যন্তরে যা যা সম্ভব গুছিয়ে নেওয়া, আর অন্যদিকে সংগঠিত ভাবে লড়াই করবার বদলে বিক্ষিপ্ত ভাবে ধর্মঘটের দিকে ঠেলে দিয়ে শ্রমিকদের মাজা ভেঙ্গে দেওয়া, এই ছিল তাদের লক্ষ্য। কিন্তু তারা ধর্মঘট ডাকার পরক্ষণেই পিপলস ব্রিগেড অতি দ্রুত এবিষয়ে ড্রাইভার ভাইয়েদের সতর্ক করে দেয় যে, এই ধর্মঘট তুলে নিয়ে তাঁদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে তৃণমূল। ঠিক তাই-ই ঘটে যদিও অধিকাংশ অন-লাইন ক্যাব ড্রাইভার ভাই তাদের এই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেননি। এ ষড়যন্ত্র পরাজিত। খুব শীঘ্রই এ শহর দেখবে অন-লাইন ক্যাবের ড্রাইভার ও অপারেটরদের সংগঠিত সংগ্রাম।
পিপলস ব্রিগেডে র দাবীসমূহ :
১) ‘অন-লাইন ক্যাব’-এর ভাড়া এবং ড্রাইভার-অপারেটরদের সকল প্রাপ্য ঠিক করবার ক্ষেত্রে কোম্পানি ও সরকারের সাথে ড্রাইভার-অপারেটরদের ‘যৌথ দরকষাকষির অধিকার’ চাই।
২) রেটিং ব্যাতিরেকে সপ্তাহে ৬ দিন দিনে ১২ ঘণ্টার ‘লগ-ইন’ পিছু ৮ ঘণ্টার কাজ চাই। সকল গাড়িতে কাস্টমারের সুষম বণ্টন করতে হবে।
৩) সকল ড্রাইভারের ঘণ্টা পিছু ১০০ টাকা মিনিমাম ওয়েজ চাই।
৪) ‘রেটিং’-এর ওপর ভিত্তি করে সুনির্দিষ্ট ‘ইনসেন্টিভ’-এর ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে।
৫) ২ কিমি-র বেশি দূর ত্ব থেকে ‘পিক্-আপ্’-এর ক্ষেত্রে পেট্রোল/ডিজেলের দাম ও ‘ইনসেন্টিভ’ দিতে হবে।
৬) পেমেন্ট-এর লিখিত ডিটেল সহ সপ্তাহের টাকা সপ্তাহে দিতে হবে।
৭) আই.ডি. ব্লক করাকে বেআইনী ঘোষণা করতে হবে।
৮) ড্রাইভারদের সুরক্ষার স্বার্থে সকল কাস্টমারের KYC আপলোড করতে হবে।
৯) ‘সার্ভিস’-এর সময় দুর্ঘটনা ঘটলে কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব নিতে হবে।
১০) ভাড়ার বিষয়ে ড্রাইভার ও কাস্টমারের মধ্যে সফটওয়ারের মাধ্যমে তৈরি করা অস্বচ্ছতা দূর করতে হবে।