“একটা ব্যাটাছেলে ধুতিপাঞ্জাবি বা প্যান্টশার্ট পরে আমার ভবিষ্যৎ ঠিক করে দিতে পারেনা! আমি সেই অধিকার আমার বাবা-মা কেই দিইনি! মোদী কে?!”
গতকাল দেশের বিভিন্ন জেলা, শহরের সাথে কলকাতাতেও আয়োজিত হয় লোক সভায় সদ্য পাশ হওয়া “ট্রান্সজেন্ডার বিল” নিয়ে প্রেস কনফারেন্স। আয়োজন করেন রাজ্যের বিভিন্ন হিজরা, কুইয়ার এবং ট্রান্সজেন্ডার সংগঠন। উপস্থিত ছিলেন পশ্চিম বঙ্গ বৃহন্নলা সমিতির পক্ষ থেকে অপর্ণা এবং সিমরান, ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রান্স ডেভলপমেন্ট বোর্ড-এর প্রাক্তন সদস্য নীল ঘোষ, “সমভাবনা”-র রায়না রায়, মেদিনীপুর জেলা থেকে আসা প্রৌঢ়া শোভা বড়মা, “স্যাফো”-র পক্ষ থেকে মালবিকা, এবং অন্যান্য বহু হিজরা এবং ট্রান্সজেন্ডার মানুষজন। নিচে বক্তাদের বক্তব্যের কিছু মূল অংশ তুলে দেওয়া হল। গ্রাউন্ডজিরো রিপোর্ট।
নীল:
আমি একজন ট্রান্স পুরুষ। লোকসভায় সদ্য পাশ হওয়া ট্রান্স বিলটি সম্পূর্ণ ভুলে ভরা এবং অত্যন্ত সমস্যাজনক একটি দলিল। ২০১৪-র নালসা জাজমেন্ট লিঙ্গের স্ব-শনাক্তিকরণকে মান্যতা দিয়েছিল। আমি ট্রান্স কিনা তা প্রমাণ করার জন্য কোনও সার্জিকাল বা মেডিক্যাল পদ্ধতির দরকার নেই, এই ছিল নালসা-র বক্তব্য। অথচ এই ট্রান্স বিল অনুযায়ী আমাকে এখন ডিসট্রিক্ট স্ক্রীনিং কমিটির কাছে পরীক্ষা দিতে হবে যে আমি সত্যি-ই ট্রান্সজেন্ডার কিনা। কোথাও কোনও নারী বা পুরুষকে কি কখনো পরীক্ষা দিতে হয় প্রমাণ করার জন্য যে তারা নারী বা পুরুষ? তাহলে আমাদের ক্ষেত্রে কেন এই পরীক্ষা? এই বিল যা দিচ্ছে, তার থেকে অনেক বেশি কেড়ে নিচ্ছে। ভারতীয় পিনাল কোড অনুযায়ী মহিলাদের উত্যক্ত করার সাজা ৩ বছরের কারাবাস। সেখানে ট্রান্স বিল অনুযায়ী ট্রান্সজেন্ডারদের উপর শারীরিক বা যৌন উৎপীড়নের সাজা সর্বাপেক্ষা ২ বছর! এর মানে কি?! পুলিশি জুলুমের বিরুদ্ধে আমরা কোথায় যাবো, বিল-এ বলা নেই। এই বিল-এর ২০১৬ ড্রাফট-এর প্রতিবাদে দেশ জুড়ে বহু প্রতিবাদ প্রতিরোধ আয়োজন করা হয়, হিজরা ও ট্রান্সজেন্ডার সমাজের তরফ থেকে পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে পাঠানো হয় বহু সুপারিশ। কিন্তু সেই সমস্ত সুপারিশ খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। পার্লামেন্ট-এর কিছু সদস্য-ও বিল-এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন, তা সত্ত্বেও গায়ের জোরে বিল পাশ করানো হল। আবার দেখুন, রাজ্যসভায় DMK সাংসদ তিরুচি সিভা-র আনা ট্রান্স রাইটস বিল, যা কিনা আমাদের হিজরা ট্রান্স কম্যুনিটির সাথে আলোচনা করে, আমাদের বেশ কিছু দাবী মেনে ড্রাফট করা হয়েছিল, সেই বিলটিকে ঠাণ্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হল!
রায়না:
সুরক্ষা-র নাম করে আমাদের ক্রিমিনালাইজ করা হয়েছে এই বিল-এর মাধ্যমে। ছোটবেলা থেকে নিজের পরিবারে, নিজের পাড়ায় বা স্কুলে মানসিক, শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক আঘাত অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমাদের একমাত্র অবলম্বন হিজরা পারিবারিক কাঠামো, হিজরা রীতি রেয়াজ, আমাদের অন্যান্য হিজরা ভাই- বোনেরা, আমাদের হিজরা গুরুরা। অথচ এই বিল-এর ফলে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও আমরা আর স্বেচ্ছায় বাড়ি ছাড়তে পারব না, বাড়ি ছাড়ার জন্যও আমাদের করত্রিপক্ষের কাছে পিটিশন লিখতে হবে! বিলটিতে ভিক্ষাবৃত্তি কে “ক্রাইম” করে দেওয়া হয়েছে। সরকার ও সমাজের কাছে আমার প্রশ্ন, শুধুমাত্র রুপান্তরকামীদের ক্ষেত্রেই কেন ভিক্ষাবৃত্তিকে অপরাধ হিসেবে দেখা হয় সবসময়?
এই বিলকে আটকাতেই হবে। এই বিল শুধু হিজরা, ট্রান্স বা কুইয়ার সমাজের নয়, গোটা মানবজাতি-র উল্লঙ্ঘন, মানবাধিকারের উল্লঙ্ঘন। পৃথিবীর ইতিহাসে এই ধরনের আক্রমণ নতুন কিছু নয়। হিটলার-এর সময় নাৎসি জার্মানিতে রুপান্তরকামীদের উপর নামান হয়েছিল অকথ্য অত্যাচার, আইন এবং হাতিয়ারের সাহায্যে। তখনো আমরা লড়েছি, এখনো লড়ছি, লড়ব। দেশ জুড়ে আমরা আন্দোলন গড়ে তুলব। যে সমাজ একদিকে মহিলাদের রেপ-এর জন্য “খোলামেলা জামাকাপড়” কে দায়ী করে, সেই সমাজ-ই আজ আমাদের বলছে উলঙ্গ হয়ে প্রমাণ করতে যে আমরা ট্রান্সজেন্ডার। “আসল” বৃহন্নলা, “নকল” বৃহন্নলা – কই “আসল” পুরুষ, “নকল” পুরুষ নিয়ে তো প্রশ্ন তোলে না কেউ?!
শোভা বড়মা:
অজয় মজুমদার এবং নিলয় বসু একটি বই লিখেছিলেন – “ভারতের হিজরা সমাজ”। আপনারা না পড়ে থাকলে পড়ে দেখতে পারেন। বইটিতে লেখকরা জানিয়েছেন, বৃহন্নলা বা রুপান্তারকামিতা একটা রোগ। এসব নাকি মানসিক প্রতিবন্ধকতা, যৌন প্রতিবন্ধকতা। এটা পরিষ্কার, “বুদ্ধিজীবী”দের ক্ষেত্রেও রাজনীতির ব্যতিক্রম নেই। আমরা যদি রোগগ্রস্ত হইও, তবু কোন ভিত্তিতে ভারতীয় সংবিধানের ৩২টি মৌলিক অধিকার-এর কোনটি-ই বৃহন্নলা সমাজকে আজ অবধি দেওয়া হয়নি? এর জবাব কে দেবেন? বুদ্ধিজীবীরা, নাকি সাংবাদিক ভাইয়েরা, নাকি আমাদের মোদী ভাই?
১৭ তারিখে পাশ হওয়া বিল-এর মূল কারণ বিগত ২-৩ বছর ধরে গড়ে উঠতে থাকা বৃহন্নলা সমাজের public presence. আজ আমাদের ভোটের ভিত্তিতে ক্ষমতায় আসা জনপ্রতিনিধিরাই আমাদেরকে ক্রিমিনাল ঘোষণা করছে আইন বানিয়ে। আমরা সকলে জানি কি ভাবে পাড়ার ছেলেদের পুলিশ এবং সমাজবিরোধীরা মিলে ধাপে ধাপে ক্রিমিনাল তৈরি করে। বর্তমান BJP সরকার আমাদেরকেও এক-ই দিকে ঠেলার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা BJP সরকারকে বুঝিয়ে দেব যে আমরা মোদী ভাইয়ের অনেক আগে থেকে এই সমাজের অংশ ছিলাম, এবং তার চলে যাওয়ার পরেও আমরা থাকব।
মোদী লোকসভায় ঢোকার আগে প্রণাম ক’রে সারা দেশের কাছে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে সে কত বড় হিন্দু। তুলসিদাস তাঁর রামায়ণে লিখছেন, বনবাস থেকে ফেরার পথে রামচন্দ্র দেখেন অযোধ্যা নগরীর বাইরে বেশ কিছু মানুষ বসে আছেন, চুলে বহুবছরের জট, গায়ে বহু বছরের ময়লা। তিনি জিগ্যেস করেন তাঁরা কে এবং কেন তাদের এই অবস্থা। উত্তরে তারা বলেন, তুমি বনবাসে যাওয়ার সময় সারা অযোধ্যার মানুষ যখন তোমার পিছনে হাঁটতে শুরু করে, তুমি বলেছিলে “অযোধ্যার নরনারীরা ফিরে যাও, ফিরে গিয়ে আমার অপেক্ষা কোরো। আমি ফিরব ১৪ বছর শেষে।” সকলে ফিরে গেলেও আমরা ফিরতে পারিনি, কারণ আমরা না নর, না নারী। আমরা বৃহন্নলা। আমরা সেই থেকে তোমার অপেক্ষায় পথে বসে আছি। রামচন্দ্র তখন আমাদের বর দিয়ে বলেন, আমাদের আশীর্বাদে বিয়ে এবং সদ্যজাত শিশুসন্তানদের মঙ্গলসাধন হবে। আমরা বৃহন্নলারা রামচন্দ্রের আশীর্বাদধন্য! মোদী কি তুলসিদাস-এর রামায়াণ পড়েনি? মোদী সরকারের বুকের পাটা থাকলে ছুঁড়ে ফেলে দিক এই রামায়ণ!
ট্রান্স বিলের বিরুদ্ধে আমরা দেশজুড়ে ধর্না করব, রেলের চাক্কা জাম করব, কৃষকদের মতো সংসদ অচল করে দেব। নরেন্দ্র মোদী, তোমার টাইম শেষ!
অপর্ণা:
আমি পেশায় হিজরা। এই পেশায় আমি দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত। এছাড়া জেন্ডার আন্দোলন, হিজরা আন্দোলন, কুইয়ার আন্দোলন-এর সাথে আমি ১৯৯৯ সাল থেকে যুক্ত। সিসজেন্ডার নারীর উপর যখন বাড়িতে অত্যাচার হয়, তখন আইনের বিধান আছে প্রয়োজনে গোটা পরিবারকে গ্রেপ্তার করে আক্রান্ত মহিলার বাড়িতে সুরক্ষিত জীবন নিশ্চিত করা। অথচ আমাদের ক্ষেত্রে আক্রান্তকে রিহ্যাব-এ নিয়ে যাওয়া হবে! এদেশে রিহ্যাব হোমগুলির কি অবস্থা তা আমাদের কারুর অজানা নয়! কি করে একটা সরকার বা সমাজ এই ধরনের দুমুখো নীতি নিয়ে চলতে পারে বছরের পর বছর? এই বিল-এ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি-তে আরক্ষণ – এ নিয়ে কোনও বক্তব্যই নেই। This bill stinks! আমরা নালসা জাজমেন্ট-এর প্রতিফলন চাই বিল-এ। আমরা অরগানাইসড ভিখারি নই, আমরা বন্ডেড লেবারের ব্যবসা করি না। বৃহন্নলাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব সম্পর্কে এদেশের কোন সরকারের কোন ধারনা নেই, কোনদিন ছিল না। আমরা বুদ্ধিজীবী, আমরা লড়তে জানি। আমার রাজনীতি সমাজের সাথে লড়াই করার রাজনীতি, কারণ আমার নিজের বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা তাই। কোনও বিল দিয়ে আমাদের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। কোনও সাইকিয়াট্রিস্ট বা কোনও সরকারের অধিকার নেই ঠিক করে দেওয়ার যে আমি ট্রান্স কি না। যা জানেন না, যা বোঝেন না, তাই নিয়ে কোন অধিকারে আইন পাশ করা হচ্ছে? একদিকে যেই মানুষ মঙ্গলগ্রহে জল খুঁজছে, অন্যদিকে সেই এক-ই মানুষ কিভাবে লিঙ্গ নিয়ে এই ধরনের সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ক্রিমিনাল আইন তৈরি করে?!
শুধু ট্রান্স বিল নয়, আরও ২টি বিল এই সরকার লাগু করতে চাইছে যা আমাদের উপর সরাসরি আক্রমণ। অ্যান্টি-ট্রাফিকিং বিল এবং সারোগেসি বিল। অ্যান্টি-ট্রাফিকিং বিল শুধুমাত্র রিহ্যাবিলিটেশন মাফিয়াদের মুনাফা নিশ্চিত করবে। সারোগেসি বিলের উদ্দেশ্য আমাদের নিঃসন্তান করে দেওয়া। আমরা কেউ বোকা নই। আমরা জানি যে ২০১৯-এর ভোট-এর আগে এই ধরনের এমন সব বিল পাশ করা হচ্ছে, যাতে বিভিন্ন শ্রেণীর অবদমিত মানুষকে সামাজিক আইনি রাজনৈতিক অধিকার থেকে মুছে দিয়ে রাষ্ট্রের হাতে আরও বেশি করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা যায়। ধর্ম নিয়ে, লিঙ্গ নিয়ে, জাত নিয়ে রাজনীতি করে এই সরকার ভাবছে ক্ষমতায় টিকে থাকবে। এরা ভুলে যাচ্ছে মানুষ একজোট হচ্ছে। শুধু আমরা বৃহন্নলারা নই, এই সমাজের সমস্ত অবদমিত মানুষ লড়বে এদের বিরুদ্ধে – একসাথে। ২০১৯-এ যেই জিতুক, আমাদের লড়াই করতেই হবে, আমরা জানি। কৃষকেরা প্রমাণ করেছেন যে সরকার অবদমিত মানুষকে ভয় পায়। আমরাও লড়াই করতে জানি, আমরা লড়ব।
মালবিকা:
অনেকে বলেন শারীর বিজ্ঞানের ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক ভাবে কোনও ব্যক্তি ট্রান্সজেন্ডার কিনা তা নির্ধারণ করা যায় এবং তা হলেই এই সমস্ত বিতর্কের সমাধান হবে। তাঁরা বলেন “ক্রোমোজোম”। অথচ ক্রোমোজোম যে সিসজেন্ডার বা ট্রান্সজেন্ডারের নির্ধারক নয়, সেটাও যে বিজ্ঞানীরা-ই প্রমাণ করেছেন – সে খবর তাঁরা রাখার প্রয়োজন মনে করেন না। এই ইস্যুকে মেডিকালাইজ করবেন না !
আর একটা কথা বলার আছে। আমি রাম-লক্ষণ কে দেখিনি, জানিনা, বুঝিনা। আমি ফাসিজম বুঝি, জেনোসাইড (গণহত্যা) বুঝি। “তোমার মতো নয় যে, তাকে মেরে ফেলো”। আমরা গোধরা ভুলিনি। এদেশের অবদমিত মানুষ জানে কি ভাবে লড়তে হয়। এই বিল পাশ হলেও লাগু করতে দেওয়া হবে না, এটা কথা দিচ্ছি!
সবশেষে এক পুরুষ সাংবাদিকের প্রশ্ন: “আপনারা নিজেরা তাহলে কিসের ভিত্তিতে কাউকে নিজেদের সমাজে জায়গা দেন? কেউ নিজেকে LGBT দাবী করলেই সংগঠনে নিয়ে নেন?”
উত্তরে অপর্ণা: যারা বলে “আমি LGBT নই”, তাদের কোন পরীক্ষা দিতে হয়? বিয়ের আগে বর বা বউকে ঠিক কোন পরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করতে হয় যে সে সত্যি পুরুষ বা মহিলা? জেন্ডার বা সেক্সুয়ালিটি একটা এক্সপ্লোরেশন। যারা বিয়ে-র পরে বুঝতে পারে যে তারা হেটেরোসেক্সুয়াল নয়, তাদের আপনি কি বলবেন?
এই সরকারের যদি মেরুদণ্ড থাকত, তাহলে আমাদের ক্যাবিনেটে ৩০% রিসারভেশন দিত, এবং বলত তোমরা তোমাদের আইন বানাও। একটা ব্যাটাছেলে ধুতিপাঞ্জাবি বা প্যান্টশার্ট পরে আমার ভবিষ্যৎ ঠিক করে দিতে পারেনা! আমি সেই অধিকার আমার বাবা-মা কেই দিইনি! মোদী কে?!