ফ্রান্সের ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলন: পৃথিবী জোড়া জনরোষের এক নতুন দিক


  • December 19, 2018
  • (0 Comments)
  • 2467 Views

“ইয়েলো ভেস্ট নিয়ে মূল অভিযোগ হ’ল এই আন্দোলন ডান-পন্থী এবং জাতীয়তাবাদী। সিরিয়ান ক্রাইসিস ও অভিবাসীদের সংখ্যাবৃদ্ধি এবং সামগ্রিকভাবে ইউরোপীয় জনতার স্বার্থ সুরক্ষার জন্য এই আন্দোলনের পিছনে অতি-ডানদের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ। সমস্যা হল এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যে নয় এবং একে সরলীকরণ করে যে একটা উদার-লিবেরাল দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রগতিশীল বলা হচ্ছে তার একটা ফাঁক রয়েছে।” লিখছেন শুভদীপ মৈত্র

 

 

জ্বালানীর দাম বেড়েই চলেছে। রোজগার কমছে। সরকারি অনুদানে কাটছাঁট। দেশের ভিতরের অংশ গ্রাম, মফঃস্বল থেকে মানুষ কাতারে কাতারে আসছে রাজধানীতে প্রতিবাদ জানাতে, আন্দোলনে যোগ দিতে। না এ ভারতের ছবি নয়, অন্তত শুধু ভারতের ছবি নয় – এ ঘটনা ঘটছে ফ্রান্সে। প্যারিস শহর গত একমাস ধরে দেখছে ব্যারিকেড (অবশ্যই তা নতুন কিছু নয়), আর জনরোষ।

 

উপরের যে তুলনা তা শুধুমাত্র দৃষ্টি আকর্ষণ করার সাংবাদিকতা-সুলভ ইন্ট্রো নয়। এই আন্দোলনকে স্থানিক বা লোকাল বলা যাচ্ছে না সেটা বোঝাতেই দেওয়া। স্থানিক বলা যাচ্ছে না এই জন্য নয় যে তা ফ্রান্স থেকে ইউরোপ ও আফ্রিকার কিছু অংশে ছড়িয়েছে, বরং এই জন্য যে এর পিছনের কারণ একটাই, ভারত হোক বা আমেরিকা বা ইউরোপ বা আফ্রিকা – একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা ক্রমশ জনবিরোধী হয়ে উঠেছে ও অসাম্যের দিকে হেলে পড়েছে। আর এই উদ্বেগ শুধুমাত্র বামপন্থীদের নয় এমনকি তাবড় লিবেরাল, গণতান্ত্রিক অর্থনীতিবিদ থেকে গবেষক সবাই স্বীকার করে নিচ্ছেন।

 

কী এই আন্দোলন

গত একমাস ধরে চলেছে ইয়েলো-ভেস্ট আন্দোলন যা প্রচার মাধ্যমের শুরুর অবজ্ঞা সত্ত্বেও কার্পেটের তলায় ঢুকিয়ে রাখা যায়নি এবং ফরাসি প্রেসিডেন্টকে আপাত কিছু ছাড় দিতে হয়েছে, বা ছাড়ের কথা অন্তত ঘোষণা করতে হয়েছে। যদিও তার ফলাফল কী হবে জানা নেই, সমস্যার সমাধান আসবে কী করে তাও জটিল এক ধাঁধা, কারণ এই সমস্যা সিস্টেমিক একটা সমস্যা, যা আমরা খতিয়ে দেখব পরে। প্রথমে দেখা যাক এই আন্দোলনের শুরুর কারণগুলো।

 

আন্দোলনের উৎস

সাদা চোখে দেখলে সমস্যার উৎস ফ্রান্সে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়া। একবছরে প্রায় ১৫ থেকে ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এই দাম। যা গরিব মানুষ বিশেষ করে শহরের বাইরের কৃষক, শ্রমিক ও চাকুরীরতদের আয়কে কমিয়ে দিয়েছে একধাক্কায় অনেকটা। এই বৃদ্ধির কারণ পরিবেশ-কর ও ভ্যাট বা ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাকস। গত শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকেই ফ্রান্সের সরকার সাবসিডি দিয়ে আসছে জ্বালানীর উপর, সেই সুবিধে সরে যাওয়ায় মানুষের রোজগারের অনেকাংশ চলে যাচ্ছে। এছাড়া প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মাঁক্র-র সম্পত্তি কর বা আইএসএফ নামে যা পরিচিত তার অ্যামেন্ডমেন্ট আনা – অর্থনৈতিক অসাম্য বাড়িয়ে তুলেছে। এর উপর ওভার টাইমের উপর কর বসানো এবং পেনশনভোগীদের পেনশনের উপর কর বসানোর সিদ্ধান্তও নেয় মাঁক্র সরকার। এই সমস্ত সিদ্ধান্ত জনবিরোধী এবং ক্রমশ ওয়েলফেয়ার স্টেট-এর যে সব সুযোগ ফ্রান্সে ছিল তা তুলে  দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলে মনে করছেন ফ্রান্সের মানুষ। এতে গরিব ও বড়লোকের পার্থক্য বাড়িয়ে তুলেছে, বিশেষত শহুরে ধনী ও গ্রামীণ গরিবের মধ্যে ব্যবধান বিশাল।

 

আন্দোলনের আরম্ভ

গত নভেম্বরে একটি সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে এর প্রতিবাদ পিটিশন চালু করেন এক মহিলা ও তা ভাইরাল হয়ে দাঁড়ায়। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে একটি ভিডিও-ও ভাইরাল হয় যাতে রাস্তা আটকে, ব্যারিকেড করার ডাক দেওয়া হয়। ফ্রান্সের গ্রাম ও শহরগুলিতে ব্যাপক সারা পড়ে যায়। শুধু শ্রমিক-কৃষক নন, ছোট ব্যবসায়ী, ঠিকা কর্মী, আইটি কর্মী, ডেলিভারি কর্মী, পরিষেবা ক্ষেত্রের কর্মী এমনকি ছাত্ররাও এই আন্দোলনে যোগ দেন।
লাখো লোক সারা দেশ জুড়ে প্রতিবাদ করেন, রাস্তা আটকান, প্যারিস শহর কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। সপ্তাহান্তগুলোকে এই আন্দোলনের দিন হিসেবে ঠিক করা হয়। এই আন্দোলন তৃতীয় সপ্তাহে ও চতুর্থ সপ্তাহে ব্যাপক আকার নেয়। স্যাভোয়ায় একজন মারা যান, পুলিশের কয়েকজন আহত হয়। প্যারিসের সাঁজে লিজে অঞ্চল যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা নেয়, ব্যারিকেডে আগুন লাগে, গাড়ি পোড়ে, দোকানপাট লুঠ হয়। আহত ও গ্রেপ্তার হন বহু মানুষ। প্যারিস শহরের দ্রষ্টব্য স্থল, মিউজিয়াম, অপেরা বন্ধ রাখতে হয়, বন্ধ রাখতে হয় বিখ্যাত সাঁ জাঁমাঁ ক্লাবের ফুটবল খেলা। সত্তর শতাংশের উপর ফরাসীরা এই আন্দোলনের সমর্থন করছেন, দেখা যায় একটা সমীক্ষায়। শুধু প্যারিস নয় ফ্রান্সের বহু শহরে ও রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলন।

 

একে অনেকে ৬৮-র বিখ্যাত ছাত্র-শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করছেন (এটা তার পঞ্চাশ বছরও বটে)। কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে এই  আন্দোলন আলাদা। এই আন্দোলন শহর কেন্দ্রিক নয়, প্যারিস কেন্দ্রিক নয় তো বটেই। বরং নাগরিক ফ্রান্সের বিরুদ্ধে এ এক তীব্র রোষ। ফ্রান্স তথা ইউরোপের চেহারাটাই এই যে, অসাম্য যা বেড়েছে তা শহর ও গ্রাম মফঃস্বলকে আলাদা করে দিয়েছে। ফ্রান্সের যে সংখ্যালঘু ধনী সম্প্রদায় বা “ক্রিমি-লেয়ার”, তারা নাগরিক। এবং সমস্ত সুবিধাগুলোও তাদের কোলেই এসে পড়ছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে অভিযোগ তিনি এই আরবান এলিটদের প্রতিভূ, এমনকি তাঁকে অনেকে ষোড়শ লুইয়ের সঙ্গেও তুলনা করছে। তাঁর ভোটে জিতে আসার পিছনে যে মিডিয়ার নতুন ঝকঝকে ফ্রান্সের স্বপ্ন বোনা হয়েছিল তার প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছে জনতা। গত বছর তিনি এমনকি এও বলে বসেন যে শ্রমিকদের কাজই হল কাজ না করে গোলমাল পাকানো।
এই আন্দোলনের ফলে তিনি খানিক পিছিয়ে এসেছেন বলে বলা হলেও আদপে তিনি তাঁর নীতি বদলাবেন কিনা এ নিয়ে গোটা ফ্রান্স সন্দিহান। এবং এই আন্দোলনকে মেনে নেওয়া শুধু তাঁর পক্ষে কেন, অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদেরও সমস্যা হচ্ছে, সে কী বাম, কী ডান। এই সমস্যার কারণগুলো লুকিয়ে আছে এই আন্দোলনের অভিনবত্বে, যার দিকে নজর দেওয়া জরুরি।

 

 

আন্দোলনের নানা দিক

প্রথমত, এই আন্দোলন শুরু হয়েছে কোনও নেতৃত্ব ছাড়াই। কেন্দ্রীভূত কোনও নেতৃত্ব এই আন্দোলনের নেই এবং তাঁরা কোনো ডানপন্থী বা বামপন্থী দলের কথা শুনতেও খুব আগ্রহী নন। এমন আন্দোলন ইউরোপে নতুন। ফ্রান্সে তথা ইউরোপের বামপন্থী দলগুলির এই আন্দোলন নিয়ে দোনামনা আরেক আশ্চর্য অবস্থান। (এই অবস্থানের কারণে আমরা খানিকটা বিষদে যাব)। ফ্রান্সের সবচেয়ে লড়াকু ট্রেড ইউনিয়নগুলির মধ্যে অন্যতম সিজিটি-র নেতা ফেলিপ্পে মার্তিনেজ প্রথমে এই আন্দোলনের বিরোধিতা করেন, তাঁর যুক্তি ছিল দাবী ন্যায্য হলেও এই আন্দোলনে ডানপন্থী ন্যাশানালিস্ট ফ্রন্ট রয়েছে। তাই একসঙ্গে লড়াইয়ে নামা সম্ভব নয়। পরে আন্দোলনের তীব্রতা দেখে তাঁরা ডিসেম্বরের শুরুতে জ্বালানী শিল্পের শ্রমিকদের বন্ধ ডাকেন। সোশ্যালিস্ট দলগুলো এই আন্দোলনকে ভাল চোখে দেখেনি। জার্মান সোশ্যালিস্ট দলও অতি ডানপন্থী ঝোঁক বলে ঘোষণা করে এই আন্দোলনকে। এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এরা ন্যাশানালিস্ট এবং অভিবাসন-বিরোধী, জাতিবিদ্বেষী।

 

দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলনের দাবী কোনো বিশেষ কয়েকটা চাহিদায় আটকে নেই আর। এই আন্দোলনের শুরু যদিও জ্বালানীর দাম বাড়ার বিরুদ্ধে শুরু হয়, সার্বিকভাবে তা ফরাসী সরকারের অর্থনীতির বিরুদ্ধে এখন এক রোষে পরিণত হয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শিক্ষা ক্ষেত্রে অনুদান হ্রাস ইত্যাদির বিরুদ্ধেও তারা সরব এখন। রাষ্ট্র ব্যবস্থার চেহারার মধ্যে যে ইনিকুয়ালিটি বা অসাম্য, তার বিরুদ্ধে এই আন্দোলন। লক্ষ্য করার মতো বিষয় এই আন্দোলন ব্যাপকভাবে সারা ফেলেছে এবং ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপের নানা দেশে তার কারণ গোটা ইউরোপের যে শাসন ব্যবস্থা তার সার্বিক ব্যর্থতা – ক্রমশ ইউরোপের রাষ্ট্রীয় সরকারগুলো জনগণের জন্য ওয়েলফেয়ার পলিসি থেকে সরতে সরতে পুঁজিবাদীদের স্বার্থরক্ষার দিকে এগিয়েছে এবং তার পরিণতিতে যে সাধারণ মানুষের ঘোরতর সমস্যা তৈরি হচ্ছে তা স্পষ্ট। এর বিরুদ্ধে বামপন্থী দলগুলির এক সময়ের আন্দোলনমুখী চেহারা যা “সেফটি ভালভ” হিসবে কাজ করত ইউরোপে, তাও আর বর্তমান সময়ে নেই বললে চলে। ইউরোপীয় বাম দলগুলো ও ট্রেড ইউনিয়ন সময়ের সাথে রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের ন্যারেটিভের অংশ হয়ে উঠেছে, আর তাই  ব্যর্থ হয়েছে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ, হতাশার শরিক হতে। বামপন্থী দলগুলো তাদের হায়ারারকিকাল গঠন অনুযায়ী যেভাবে জন-আন্দোলনকে দেখে, তার থেকে এই আন্দোলন আলাদা। যদিও ইতিহাস সাক্ষী যে বাম দলগুলো তাদের নেতৃত্বের বাইরের গণআন্দোলনকে সহজেই ডান-পন্থী ও শিশুসুলভ বলে দাগিয়ে থাকে, তবু ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলন নিয়ে সন্দেহ ও অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা প্রয়োজন, কারণ এর থেকে ইউরোপ তথা বিশ্বের আর্থসামাজিক অবস্থার একটা রূপরেখা পাওয়া যেতে পারে। ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলন ফ্রান্সের স্থানিক আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও এই মুহূর্তে তা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছে এবং প্রধানত ইউরোপীয় ফেনোমেনন বা ঘটনা হিসেবে একে দেখলেও বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে এর যোগ নিবিড়।

 

ইয়েলো ভেস্ট নিয়ে মূল অভিযোগ হ’ল এই আন্দোলন ডান-পন্থী এবং জাতীয়তাবাদী। সিরিয়ান ক্রাইসিস ও অভিবাসীদের সংখ্যাবৃদ্ধি এবং সামগ্রিকভাবে ইউরোপীয় জনতার স্বার্থ সুরক্ষার জন্য এই আন্দোলনের পিছনে অতি-ডানদের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ। সমস্যা হল এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যে নয় এবং একে সরলীকরণ করে যে একটা উদার-লিবেরাল দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রগতিশীল বলা হচ্ছে তার একটা ফাঁক রয়েছে। গরিব খেটে খাওয়া মানুষের কাছে, বিশেষত শক্তিশালী বামপন্থী রাজনৈতিক আবহাওয়ার অবর্তমানে, বিশ্ব রাজনীতি মুখ্য নয়। তাদের দৈনন্দিন সমস্যাগুলোর কারণ হিসেবে বরং বিদেশীদের আসা, তাদের শ্রমের মূল্য হ্রাস করে “বার্গেনিং পাওয়ার” কমিয়ে দেওয়া – এসব অনেক বেশী প্রধান। এইসমস্ত ভয় তাঁদের আছেই। শ্রমিকের যোগান বেড়েই চলেছে, বেড়ে চলেছে সস্তায় শ্রমের যোগান, এবং তার ফলে পুঁজিবাদীদের মুনাফা। তার সঙ্গে টেকনোলজির উন্নতি বহু ক্ষেত্রে ব্যক্তি শ্রমিকের জায়গা নষ্ট করছে, অটোমেশন উৎপাদনে মানবিক শ্রমের প্রয়োজন নগণ্য করে দিচ্ছে। এর ফলে শ্রমের ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের ক্ষেত্রে পাল্লা উত্তরোত্তর ঝুঁকেই চলেছে পুঁজির মালিকদের দিকে। এর সুযোগে শ্রমিকের সুরক্ষা ও অধিকার খর্ব করা প্রতিদিন আরও সহজ হয়ে উঠছে। ইউরোপের অবস্থা তাই ভয়াবহ – একদিকে যখন কিছু ইউরোপীয় সরকার দরজা খুলে দিচ্ছে অভিবাসনের, একই সঙ্গে তারা কেড়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের সামাজিক সুরক্ষাগুলো, কমিয়ে চলেছে অনুদান। এর সুযোগে রক্ষণশীল ডানপন্থী দলগুলোর জাতিবিদ্বেষ ছড়ানো সহজ হচ্ছে। এখানে তথ্যের খাতিরে বলা প্রয়োজন যে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী ফ্রান্সে ২০১৭ সালে রিফিউজি জনসংখ্যা ছিল ৩,৩৭,১৪৩। অর্থাৎ প্রতি ১০০০ জন ফরাসি নাগরিক প্রতি ৫ জন রিফিউজি। এও বলা প্রয়োজন যে এর মধ্যে সিংহভাগকে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে আস্তে হয়েছে সিরিয়া, ইরাক, আফঘানিস্তান-এর মতন যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ থেকে – এবং এই সমস্ত যুদ্ধে, কোটি কোটি সাধারণ মানুষ ও শিশুর উপর বিরামহীন বোমাবাজিতে ফ্রান্সের ভূমিকা একেবারে প্রথম সারির, আমেরিকা, জার্মানি এবং ইংল্যান্ডের সাথে সাথে। এর মধ্যে সিরিয়া ছিল ফরাসি উপনিবেশ, এবং বর্তমান সিরিয়ার রাজনৈতিক সামাজিক বিপর্যয়ের জন্য ফরাসি শাসকশ্রেণী বহু অংশে সরাসরি দায়ী।

 

যাই হোক, বামপন্থী দলগুলোর হয়েছে শাঁখের কড়াত। একদিকে মতাদর্শগতভাবে তাদের থাকতে হচ্ছে অভিবাসনের সপক্ষে, অন্যদিকে সাধারণ মূলবাসীদের সমস্যাগুলো বেড়ে চলছে – এর  মাঝে তারা স্পষ্ট অবস্থান নিতে পারছে না। সাধারণ ইউরোপীয়র কাছে তাই বামপন্থীরা “আরবান এলিটিস্ট” এবং তাদের প্রতি ক্ষোভ বাড়ছে, জায়গা বাড়ছে দক্ষিনপন্থী রাজনীতির।

 

বামপন্থীদের এই সংকটজনক অবস্থানের পিছনে আরেক কারণ মাঁক্র তথা ইউরোপের প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে রাজনীতি। ইয়েলো-ভেস্ট আন্দোলনের প্রাথমিক যে কারণ তা ছিল জ্বালানীর মূল্যবৃদ্ধি, যা মাঁক্র দেখিয়েছিলেন এক পরিবেশ-বান্ধব পদক্ষেপ হিসেবে। কার্বন দূষণ নিয়ন্ত্রণের যে বিশ্বব্যাপী অঙ্গিকার তা মোটের উপর বাম থেকে উদার-গণতন্ত্রী সবাই নিজের নিজের মতো করে সমর্থন করেন। প্রশ্ন হল দূষণ নিয়ন্ত্রণের দায় কার? খুব সুচতুরভাবে কার্বন-উৎপাদক জ্বালানীর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের নামে  এই দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের উপর – আরবান সচ্ছল এলিট-এর সমর্থনকে হাতিয়ার করে দূষণ নিয়ন্ত্রণের অছিলায় কার্বন জ্বালানীর মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির স্বনির্ভরতার উপর নামানো হয়েছে আক্রমণ। এই জন্যই ইয়েলো-ভেস্ট আন্দোলনকে ক্ষমতাশালী মিডিয়া দেখানোর চেষ্টা করেছিল পরিবেশ-আন্দোলন-বিরোধী হিসেবে। যদিও সে অভিযোগ টেঁকেনি, আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন তাঁরা পরিবেশ রক্ষার বিরুদ্ধে নন বরং পক্ষেই। কিন্তু যেহেতু দূষণের সিংহভাগ হয় কর্পোরেট ও বৃহৎ-পুঁজি নিয়ন্ত্রিত উৎপাদনের কারণে তাই তার দায় তাদেরই, অর্থাৎ পরিবেশ রক্ষার্থে কর তারাই বেশি দিক, গরিব মানুষ নয়।

 

এইখানেই প্যাঁচটা। এই সমস্যা বিশ্বজোড়া। পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনের পাশাপাশি যে কার্বন এমিশন বিরুদ্ধ নীতি তার নির্ধারক রাষ্ট্র তথা পুঁজি – এরা বড় কর্পোরেটে তথা বড়লোকের স্বার্থ বাঁচিয়ে কার্বন এমিশন নিয়ন্ত্রণ করতে চলেছে যা সাধারণ মানুষের আর্থিক স্বাধীনতা ধ্বংস করে দেওয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কার্বন এমিশন নিয়ন্ত্রণ, গ্রিন-ট্যাক্স, কার্বন ক্রেডিট, ইত্যাদি, বা সাধারণ ভাবে বলতে গেলে দূষণ নিয়ন্ত্রণ নিজেই এক কোটি-অর্বুদ ডলারের ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপ তথা বিশ্বের বামপন্থী দলগুলোর অবস্থান এ বিষয়ে দ্বিধান্বিত। শহর-ভিত্তিক দলীয় নেতৃত্ব এই সমস্যার মুখোমুখি হতে ব্যর্থ হচ্ছে, এবং এই ইয়েলো-ভেস্ট আন্দোলন সেই ব্যর্থতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

 

এই আন্দোলন হয়তো দিশাহীন, কারণ এই বদলে যাওয়া পরিস্থিতির মুখোমুখি কী ভাবে হতে হবে তা জনগণের জানা নেই। এই মুহূর্তে যে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন দেখা যাচ্ছে একে আলাদা করে না দেখে দেখতে হবে গোটা পৃথিবী জুড়ে চলা আন্দোলনগুলোর সঙ্গে এক করে। সে ভারতের কৃষকদের আন্দোলন হোক, বা জল জমি জঙ্গল বাঁচানোর আদিবাসীদের আন্দোলন, যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন হোক, বা হোক প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষার লড়াই – প্রত্যেকটাই পুঁজি অর্থনীতির শোষণের নতুন নতুন পন্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ। পুঁজির চাপে ওয়েল-ফেয়ার স্টেটের ধারণার থেকে মাইলের পর মাইল সরে আসার পর যতগুলো আন্দোলন হয়েছে পৃথিবীজুড়ে, বিশেষত পুঁজির বিশ্বায়নের পরে, তার প্রত্যেকটিই জড়িয়ে একে অপরের সঙ্গে। এও স্পষ্ট যে বামপন্থী রাজনীতির কাছেও এটা নতুন এক চ্যালেঞ্জ। বিশেষত প্রকৃতির উপর যে ধরনের আঘাত হানা হয়ে চলেছে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে, পৃথিবীর পরিবেশ যে ধরনের নজিরবিহীন প্রলয়ের দিকে ধেয়ে চলেছে বিদ্যুৎগতিতে, তাতে হয়ত কার্যত এটাই বামপন্থী রাজনীতির ফাইনাল চ্যালেঞ্জ। কারণ এই লড়াইয়ে হেরে গেলে হয়ত কিছু দশক পরে আর সেই শস্যশ্যামলা পৃথিবীই থাকবে না, শ্বাসরুদ্ধ জলমগ্ন বিষাক্ত হয়ে মরতে বসবে প্রাণেরই অস্তিত্ব। অন্তত বিজ্ঞান তাই বলছে।

 

 

শুভদীপ মৈত্র লেখক ও সাংবাদিক। ছবি: লয়েস সফিয়া।

 

Share this
Leave a Comment