সম্প্রতি দক্ষিণ কলকাতার একটি শপিং মলে এক মহিলা তার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্যে উপযুক্ত জায়গা খুজতে গিয়ে অপমানিত হন। এই ঘটনা মহিলাদের ‘পাবলিক স্পেস”-এ শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো নিয়ে বিতর্ক উস্কে দিয়েছে। সে বিতর্ক নিয়ে লিখেছেন সোহিনী রায়।
দক্ষিণ কোলকাতার যাদবপুর থানার গা ধরে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলে ঝাঁ চকচকে সাউথ সিটি মল। সাউথ সিটিতে এক মহিলা বাচ্চাকে বুকের দুধ দিতে গিয়ে চরম হেনস্থার শিকার হন। সাউথ সিটির এক নিরাপত্তাকর্মী তাকে টয়লেটে গিয়ে দুধ খাওয়াতে বলেন। ঘটনাটি নিয়ে মহিলা ফেসবুকে লিখলে, সাউথ সিটির ফেসবুক একাউন্ট থেকে মহিলাকে অত্যন্ত বাজে কিছু কথা বলে অপমান করা হয়। এরপর ফেসবুকে ঘটনাটি ও সাউথ সিটি-র উত্তর প্রায় ভাইরাল হয়ে যায়। চাপে পড়ে সাউথ সিটি কর্তৃপক্ষ ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়। বাচ্চাকে বুকের দুধ দেওয়া মা-র অধিকার, বাচ্চারও অধিকার। প্রকাশ্যে দুধ খাওয়ানোর জন্য এই ধরনের ব্যবহার চূড়ান্ত অন্যায়। সাউথ সিটি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন যে আপাতত তাদের একটি তলাতে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য ঘর আছে। পরবর্তীকালে সব তলাতেই হবে। যে নিরাপত্তাকর্মীটি মহিলাকে হেনস্থা করেন তিনি এই বিষয় ওয়াকিবহাল নন বলে কর্তৃপক্ষ জানায়।
কিন্তু ঘটনাটি সামাজিকভাবে অত্যন্ত অবহেলিত একটি বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে। বিষয়টি হল কোনো একজন মা-র ‘মানুষ’ হিসেবে বাঁচার অধিকার। এখানে ‘মা-র অধিকার’-এই নির্দিষ্ট শব্দবন্ধটি সচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়া হল। মা-র অধিকার নিয়ে অনেকদিন ধরে অনেক কথা হচ্ছে। আগে অভিভাবক হিসেবে মা-র কোনো অধিকার ছিল না। নারী-অধিকার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই অধিকার আদায় হয়েছে। যদিও সন্তানের ‘স্বাভাবিক অভিভাবক’ এখনও বাবা। তবে মূলত খাতায়-কলমে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে। কিন্তু মা-র ‘মানুষ’ হিসেবে বাঁচার অধিকার ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’ র মতো একটি বিষয়। সাউথ সিটির ঘটনাটা বিষয়টিকে কীভাবে সামনে নিয়ে এল? একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া যাক।
ইদানিং মাতৃত্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হল বাচ্চার জন্মের প্রথম ছ-মাস কেবলমাত্র এবং পরবর্তীতে নিয়মিতভাবে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো। আগে সদ্যজাতকে হয় মা-র বুকের দুধ দেওয়া হত অথবা গরু বা ছাগলের দুধ দেওয়া হত। সাথে জলও দেওয়া হত। ফর্মুলা দুধ বাজারে আসার পর থেকে বাচ্চাকে বুকের দুধ দেওয়া কমতে থাকে। ১৯৬০ থেকে ভাল রকম কমে । দেখা যায় শিশুমৃত্যুর হার বাড়ছে। ১৯৯০ এর দশক থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ একযোগে, বাচ্চাকে কেবলমাত্র-বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রচার শুরু করে। কেবলমাত্র-বুকের দুধ খাওয়ানো কথাটার মানে কী? বাচ্চা জন্মের পর থেকে ছ-মাস পর্যন্ত কেবলমাত্র বুকের দুধ খাবে। এমনকি জলও খাবে না। তরল পদার্থ বলতে একমাত্র ভিটামিন বা ওষুধ খেতে পারে। এই হল কেবলমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানোর ধারণা যা exclusive breast feeding নামে বেশি পরিচিত। মূলত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের উদ্যোগে ১৯৯২ সাল থেকে, অগাস্টের ১-৭ বিশ্ব স্তন্যপান সপ্তাহ পালন শুরু হয় বিভিন্ন দেশে এই প্রচার আরও জোরদার করার জন্য। এছাড়াও নানা ধরনের প্রচার চালানো হয়ে থাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের পক্ষ থেকে। ছ-মাস নাকি চার-মাস এই নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকলেও এটা মোটামুটি সবাই মেনেই নিয়েছে যে, মা-র বুকের দুধই বাচ্চার জন্য সেরা খাদ্য। মার স্বাস্থ্যের জন্যও বুকের দুধ খাওয়ানো ভাল। স্তন-ক্যান্সার, বিভিন্ন হরমোন ঘটিত রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। বুকের দুধ সম্পূর্ণ ‘নিখরচায়’ পাওয়া যায়-এটা বুকের দুধের একটি বাড়তি সুবিধা। এখানে নিখরচায় কথাটায় আলাদা করে জোর কেন দেওয়া হল ? কারণ এই ‘নিখরচায়’ দুধ কিন্তু মা-র শরীর নিংড়ে তৈরি হচ্ছে–কেবলমাত্র এটুকু মাথায় রাখার জন্য।
কিন্তু হায়! বুকের দুধের এত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে যে, এ পৃথিবীর অধিকাংশ বাচ্চা এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং থেকে বঞ্চিত। একটি বড় অংশের বাচ্চা এমনকি মা-র দুধ থেকেও বঞ্চিত। এ পৃথিবীর অধিকাংশ বাচ্চা জীবনের প্রথম ছ-মাস হয় ফর্মুলা দুধ মানে কৌটোর দুধ অথবা গরু বা ছাগলের দুধ খাচ্ছে ! কেন? সমীক্ষাগুলোতে মূলত যে কারণগুলো দেখা যাচ্ছে, তা অনেকটা হল এইরকম-
১। প্রকাশ্য জায়গায় বুকের দুধ খাওয়ানোর কোনো নির্দিষ্ট বন্দোবস্ত নেই
২। মাতৃত্বকালীন ছুটির অভাব
৩। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সহযোগিতা ও পরামর্শের অভাব
৪। বুকের দুধের পরিমাণ নিয়ে কিছু প্রাচীন কুসংস্কার, যেমন, বুকের দুধে বাচ্চার পেট ভরে না ইত্যাদি
৫। বাচ্চাকে গরুর দুধ ইত্যাদি অন্যান্য সাবেকি দুধ খাওয়ানোর পদ্ধতি
৬। হাসপাতাল ও নার্সিং হোমগুলোতে বাবা-মা-র অনুমতি না নিয়ে সদ্যজাতকে অবাধে কৌটোর দুধ খাওয়ানো শুরু করে দেওয়া
অর্থাৎ মোটমাট বাচ্চাকে কেবলমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানোর পক্ষে এক প্রতিকূল পরিবেশ বিরাজ করছে সর্বত্র। এখন প্রশ্ন হল যে, এই এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং বিষয়টা ঠিক কীরকম ? কম-বেশি দু-ঘন্টা পর পর কম-বেশি আধ ঘন্টা ধরে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো। মূল বিষয়টা হল বাচ্চা যখন চাইবে তখনই খাবে। এরও একটি খুব চালু শব্দ-বন্ধ হল ‘ডিমান্ড ফিড’। ঠিক এখানেই বিষয়টি বেশ জটিল হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চা যখনই চাইবে তখনই মা-র খাওয়ানোর মতো পরিস্থিতি নাই থাকতে পারে। মা-র শরীর ভালো না থাকতে পারে, মন ভালো না থাকতে পারে, মা অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত থাকতে পারেন ইত্যাদি নানা কিছু হতে পারে। কারণ বাচ্চার মাকে যতই তার খাবারের উৎস বলে মনে করা হোক না কেন মা আসলে একজন মানুষ। আবার বাচ্চার খাবারের উৎসও বটে। ফলে শত অসুবিধার মধ্যেও মা-কে যদি বাচ্চার ভালোর জন্য বাচ্চাকে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিড করিয়ে যেতে হয় মা-র কিছু দরদী হাতের প্রয়োজন, অনুকূল পরিকাঠামোর প্রয়োজন, আরামদায়ক পরিবেশের প্রয়োজন। কিন্তু উপরের সমীক্ষা দেখাচ্ছে যে, বদলে সে পাচ্ছে একটি প্রতিকূল পরিবেশ। সম্ভবত এই কারণেই সে পেরে উঠছে না। এবং তার অপারগতা থেকে দুটো ঘটনা ঘটছে। ১। সে হয় গরুর দুধ বা ছাগলের দুধ বা কৌটোর দুধ মানে ফর্মুলা দুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে আর ২। সে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং-এর প্রবক্তাদের তীব্রতম সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছে। প্রথম ক্ষেত্রটা নিয়ে এখানে কিছু খুব বলার নেই। কারণ লেখাটার প্রথমেই ধরে নেওয়া হয়েছে যে, মা-র বুকের দুধই বাচ্চার সেরা খাদ্য। ফলে সরাসরি দ্বিতীয় পয়েনটে চলে আসি। কী ধরনের সমালোচনা করেন তারা ? নীচে মূল সমালোচনাগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখা হলঃ
১। মা হয়ে বাচ্চাকে দুধ না খাওয়ানো স্বার্থপরতা।
আলোচনাঃ ঠিক। কিন্তু দিনের শেষে মা আর বাচ্চা আলাদা দুজন মানুষ। বাচ্চার ভালো যদি মা-র চূড়ান্ত অসুবিধার কারণ হয় আর বিকল্প যদি হাতের কাছে থাকে মা সেটাকেই বেছে নেবে। মা মানেই সে নিজের ন্যূনতম ভালো লাগা শিকেয় তুলে বসে আছে এরকমটা নাও হতে পারে।
২। গরু ছাগলরা তো শুধু মা-র দুধই খায়। ওরা তো কই কৌটোর দুধ কিনে খায় না !
আলোচনাঃ যে জীবন গরুদের, যে জীবন ছাগলের সে জীবনের থেকে আজকের মানুষ তো অনেক দূরে! গরু বা ছাগলের জীবনে ফিরে যাওয়া মানুষের পক্ষে আর সম্ভব নয়। যা করতে হবে এখনকার বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়েই করতে হবে।
৩। মা-কে যদি কাজের জন্য বেরোতে হয় দুধ এক্সপ্রেস করে বাচ্চার জন্য রেখে দিয়ে বেরোনোই যায়।
আলোচনাঃ যায়। কিন্তু খুব কষ্টকর। পরিশ্রমসাধ্য। পরিবারের বাকি লোকজনের সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়। পরিবারের লোকজন এই পরিমান সমর্থক নাই হতে পারে। সমর্থক হলেও এই পরিমান সক্ষম না হতে পারে। সেক্ষেত্রে এ ব্যাপারে সাহায্যকারী কোনো এজেন্সি নেই। কোনো সাহায্যকারী গ্রুপ (সাপোর্ট গ্রুপ) নেই, অন্তত দেখতে পাওয়া যায় না দৃশ্যত। তাছাড়া যে মা যত বেশি দুধ এক্সপ্রেস করে আসবেন তার কাজের সময় তত বেশি দুধ তৈরি হবে। সেই দুধ ধরে রাখার কোনো উপযুক্ত পদ্ধতি প্রায় কোনো কাজের জায়গায় নেই। অন্তত আমাদের দেশে। তা সত্ত্বেও করা যায়। করা যায় না এমনটা নয়। কিন্তু একটা সাহায্যের হাত দরকার। বহু মার সেটা থাকে না।
৪। বাড়ির লোকজন যদি অন্য দুধ খাওয়ানোর কথা বলেও তাহলেও মা-র শক্ত হয়ে থেকে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো উচিৎ।
আলোচনাঃ কিছু মা নিশ্চয়ই পারেন। কিন্তু পারাটা কঠিন। এমনিতেই দু-ঘন্টা অন্তর বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো ক্লান্তিকর। তাছাড়া শেষ কয়েক মাসের গর্ভাবস্থার রেশ থাকে। রাত জাগার ধকল থাকে। এই অবস্থায় বাড়ির বড়রা যদি চাপ দিতে থাকেন তখন নিজের বিশ্বাসে অটল থাকা কষ্টকর। আর সবার আত্মবিশ্বাসও সমান হয় না। অনেকেই নানা কারণে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, বাবা-মার চাপের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়। এ ব্যাপারেও সাহায্য করবার কোনো এজেন্সি নেই। পরিবারের লোকজনকে আগে থেকে, আলাদা করে বোঝানোরও কোনো বন্দোবস্ত নেই।
৫। বাচ্চা রেখে কাজে যাওয়াটা একটা বড়লোকি ব্যাপার। কত গরীব লোক বাচ্চা পিঠে বেঁধে নিজেদের কাজে যায়।
আলোচনাঃ অনেক গরীব লোক বাচ্চা রেখেও কাজে যায়। আর বাচ্চাকে ওরকমভাবে নিয়ে যেতে তার সুবিধা হচ্ছে কি না সেটাই বা জিজ্ঞেস কে করেছে? তার হয়তো উপায়ান্তর নেই! আর সে ওরকম করছে বলেই যে অন্য কাউকে তাই করতে হবে এরকমও কোনো মানে নেই! আর তাছাড়া বাচ্চাকে নিয়ে কাজের জায়গা যাওয়া না হয় হল- সে ব্যবস্থা কদিন চলতে পারে যদি সেখানে বাচ্চা রাখার উপযুক্ত বন্দোবস্ত না থাকে?! অধিকাংশ কর্মক্ষেত্রে এরকম কিছু থাকে না।
৬। এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিড করছে মানে মা-কে গৃহবন্দী হয়ে যেতে হবে এরকম তো কোনো মানে নেই। মা চাইলে তো বাচ্চাকে নিয়েই বেরোতে পারেন। দুধ খেতে চাইলে রাস্তায় বাচ্চাকে দুধ খাইয়ে দেবেন! প্রকাশ্যে ব্রেস্টফিড করানো নিয়ে মা-দের ইনহিবিশনগুলো এবার কাটিয়ে ওঠা উচিৎ!
আলোচনাঃ মা চাইলে বাচ্চা নিয়ে রাস্তায় বেরোতেই পারেন! কিন্তু বাচ্চা যদি রাস্তায় দুধ খেতে চায় আর মা-র যদি কোনো অস্বস্তি হয় তাহলে সেটা নিয়েও কিন্তু অন্য কারুর কিছু বলার থাকতে পারে না! কোন নির্দিষ্ট চেতনার স্তরে পৌঁছলে মা-দের এই ইনহিবিশন কাটবে, অস্বস্তি কাটবে সেটাও তো প্রতিটি মা-র ক্ষেত্রে আলাদা। মা-রা যাতে বেরোতে পারেন তার জন্য পাব্লিক প্লেসে, প্রকাশ্য জায়গায় ব্রেস্ট ফিডিং-এর জন্য আলাদা ঘর করা যেতে পারে। সেটা থাকা সত্ত্বেও কোনো মা প্রকাশ্যে ব্রেস্টফিড করাতেই পারেন। কিন্তু সেটা পুরোটাই সেই নির্দিষ্ট মা-র ব্যাপার। এই পরিকাঠামোগুলো না তৈরি করে মা-কে ইনহিবিশন কাটানোর কথা বলার কোনো মানে হয় না! ইনহিবিসন বা অস্বস্তির তো একটা বস্তুগত উৎস আছে! অনুভূতিটা বিমূর্ত কিন্তু উৎসটা তো আর বায়বীয় নয়! অস্বস্তি তৈরি হওয়ার একটা ইতিহাস আছে! আচমকা ‘ইনিহিবিসন কাটাও’ বললে ইনহিবিশন কাটে না। অন্য কিছু ইতিহাস, অন্যকিছু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মা-কে যেতে হয়-অস্বস্তি কাটানোর জন্য। সেই অস্বস্তি কাটিয়ে ওঠার পদ্ধতি কী হতে পারে? নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। কিন্তু কিছু কিছু জিনিষ মোদ্দা ধারণা থেকে বলে দেওয়া যায়। যেমন-রাস্তাঘাটে বুকের দুধ খাওয়ানো নিয়ে বড় বড় হোর্ডিং, বুকের দুধ খাওয়ানো নিয়ে সচেতনতা-প্রচার, প্রকাশ্য জায়গায় বুকের দুধ খাওয়ানোর আলদা ঘর আর ঘরের সামনে কোনো মার বুকের দুধ খাওয়ানোর ছবি ইত্যাদি এরকম নানা কিছুই হতে পারে। এমনি এমনি অস্বস্তি তৈরি হয়নি। ফলে এমনি এমনি অস্বস্তি কাটবে না। আর যদ্দিন না তার ইনহিবিসন কাটছে তদ্দিন কি সে গৃহবন্দী থাকবে ? !
আরও একটা ব্যাপার হল অন্য কোনো কিছু নিয়ে তো ইনহিবিশন কাটানোর কথা বলা হচ্ছে না! হঠাৎ এক্ষেত্রে কেন বলা হচ্ছে? বুক কি মা-দের যৌন অঙ্গ নয়! নাকি একজন মহিলা, মা হয়ে যাওয়ার পর অযৌন কোনো মানুষে পরিণত হন!
আর তাছাড়া সব জায়গায় বাচ্চাকে নিয়ে যাওয়াও যায় না। সেটা বাচ্চার জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে। যেমন সিনেমা হল। ছোট বাচ্চার সিনেমা হলে ভয় লাগে। সেক্ষেত্রে তাকে বাড়িতে রেখেই মা-কে বেরোতে হচ্ছে। আর না হলে মা-কে বেরোনো বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ সেই গৃহবন্দীত্ব।
৭। ব্রেস্টফিডিং-এর জন্য আলাদা ঘর করে কী হবে, বাচ্চা তো যেকোনো জায়গায় খেতে চাইতে পারে।
আলোচনাঃ তাহলে তো রাস্তায় কোনো টয়লেটও করা উচিৎ নয়। যে কোনো জায়গায় পেতে পারে! প্রাইভেসি বা গোপনীয়তা রক্ষাও তো একটা অধিকার। এই অধিকারটুকু তো মা-র আছে।
৮। ট্রেনে বাসে রাস্তায় ফুটপাথে প্রচুর মহিলা ব্রেস্টফিড করায়। তাদের তো কোনো অসুবিধা হয় না!
আলোচনাঃ ট্রেনেই বেশি দেখা যায়। বাসে রাস্তায় খুব কম দেখা যায়। ফুটপাথে যাদের দেখা যায় ফুটপাথ তাদের বাড়ি। দাঁড়িয়ে থাকলে দিনের কোনো একটা সময় নর-নারীর মিলনের দৃশ্যও দেখা যাবে। কিন্তু সেইটা হঠাৎ দাওয়াই কেন হয়ে উঠল?! কেনই বা সেটা আদর্শ হয়ে উঠল?! আর যারা ট্রেনে খাওয়ায় তাদের কি কখনও জিজ্ঞেস করা হয়েছে যে, তাদের সত্যি কোনো অসুবিধা হয় কিনা? আর যদি নাও হয় অন্য কারুর যে হতে পারবে না এটা কি কেউ ঠিক করে দিয়েছে?!
৯। হাসপাতালে যদি কৌটোর দুধ খাইয়ে দেয় তাহলে সেটা বারণ করলে আর খাওয়ায় না। আর তাছাড়া বাড়িতে আসার পর তো আবার বুকের দুধ চালু করাই যেত…বাচ্চাকে দুধ টানানো অভ্যেস করানো যায় ইত্যাদি…
আলোচনাঃ যদি সেটা সম্ভব না হয়? এ ব্যাপারেও তো কোনো এজেন্সি নেই। আর যে ডাক্তাররা ওই হাসপাতালগুলোতে কাজ করেন? কোলকাতার বহু বড় হাসপাতাল, নার্সিংহোমে মা একজায়গায় থাকেন বাচ্চা আর একজায়গায় থাকে। এমনকি তলা দুটোও আলাদা হয়। ফলে সদ্যজাত শিশুদের বুকের দুধ দিতে মা-দের খুব অসুবিধা হয়। যারা এক্সক্লুসিভ-ব্রেস্ট-ফিডিং-এর পক্ষে প্রচার চালান ( ডাক্তার, অ-ডাক্তারসহ সবাই ) তারা কি এই হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন? এক্সক্লুসিভ-ব্রেস্ট-ফিডিং-এর পক্ষের ডাক্তাররা কি এইসব হাসপাতালগুলো বয়কট করেছেন? হয়তো কেউ করেছেন। কেউ করেননি। না করে থাকলে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে তার। আসলে সবারই নানাধরনের অপারগতার কারণ থাকে, অপারগতার পিছনে কোনোধরনের বিপন্নতা থাকে। উচিৎ কাজ করা উচিৎ সেটা সবাই জানে। উচিৎ কাজ করতে না পারার কিছু বাস্তব কারণও থাকে।
১০। কৌটোর দুধ একটি ব্যাবসায়ী ফাঁদ। ওতে না পড়াই ভাল।
আলোচনাঃ কোনটা যে নয়…। যা যা ব্যবহার করছি সবই ব্যবসায়ী ফাঁদ।
১১। বুকের দুধ খাওয়ানো আমাদের দেশের সংষ্কৃতিতে আছে। এটা নিয়ে ইনহিবিশন বেবি-ফুড কোম্পানিগুলোর তৈরি করা। মা-দের এই ইনহিবিশন কাটিয়ে ওঠা উচিৎ।
আলোচনাঃ বুকের দুধ খাওয়ানো আমাদের দেশে আগে থেকেই ছিলো। কিন্তু এক্সক্লুসিভ-ব্রেস্ট-ফিডিং একটি অপেক্ষাকৃত নতুন ধারণা। সুতরাং একে ঘিরে তৈরি হওয়া সংষ্কৃতিটাও নতুন। সেটারও বিশেষ কোনো ইতিহাস নেই। একটি নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক অংশের মহিলারা প্রকাশ্যে বাচ্চাকে বুকের দুধ দিতেন। বাকি অন্য অংশের মহিলারা ঘর থেকেই বেরোতেন কম। ফলে তাদের কী ধরনের ইনহিবিশন ছিল সেসব এখন আন্দাজ করা মুশকিল! আর সেসব ভেবেই বা কী হবে ?! যে বাস্তবতার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে এখনকার মা-রা সেই বাস্তবতাতেই কোনো একধরনের সমাধান আসতে হবে! এখনকার মেয়েদের আগের সংষ্কৃতিকে আঁকড়ে ধরতে হবে-এই পরামর্শটা অর্থহীন একটা পরামর্শ।
১২। যে মা-রা বাচ্চাকে দুধ খাওয়ান না তারা নিজেদের ‘ফিগার’ ধরে রাখার জন্য এটা করেন।
আলোচনাঃ কথাটা নেতিবাচক অর্থে বলা হয়। মানে এই কথাটার মধ্যে একই সাথে দুটো সারকথা লুকিয়ে রয়েছে। একটা হল কথাটায় যা সরাসরি বলা হচ্ছে সেটা। আর একটা হল যে, মা-দের নিজেদের ‘ফিগার’ ধরে রাখার চেষ্টা করা একটা খারাপ কাজ। প্রথমত, এখানে সরাসরি যেটা বলা হয়েছে সেটা কিন্তু দুধ না খাওয়ানোর কারণগুলো মধ্যে কোথাও নেই। উপরোক্ত কারনগুলো জড়ো করার জন্য একাধিক সমীক্ষা ঘেঁটে দেখা হয়েছে- কোথাও এই কারণটা লেখা নেই। ফলে এই তথ্যটির সত্যাসত্য নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
এরপর আসা যাক দ্বিতীয় সারকথাটায় অর্থাৎ মা-দের ‘ফিগার’ ধরে রাখা খারাপ কাজ। কেন? এইখানে আবার দুটো মানে বেরোয়। খারাপ কাজ কারণ প্রথমত, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মা-র নিজেকে ভালো লাগতে পারে না। এর থেকে স্বাভাবিক অনুসিদ্ধান্ত হল মা-র এরকম কোনো কাজই ভাল লাগতে পারে না যেটা মা-র নিজের। যে জিনিষটার জন্য মা-র নিজেকে ঘিরে কোনো ভালোলাগা তৈরি হতে পারে। তার গোটা জীবনটাই সংসার এবং সন্তানের জন্য নিবেদিত। দ্বিতীয় মানেটা বুঝতে গেলে ‘ফিগার’ এই কথাটাকে একটু কাঁটাছেঁড়া করে দেখতে হবে। ‘ফিগার’-এর বাংলা বলা যেতে পারে দেহ-সৌষ্ঠব। এখন মা-র দেহের কোন অংশ বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয় ? মা-র বুক। মা-র বুক মা-র একটি যৌন অঙ্গ। মেয়েদের যৌন আবেদন মাপার ক্ষেত্রে তাদের বুকের আকার ও আয়তন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। অন্তত এখনও পর্যন্ত যৌনতা সম্পর্কে জনমানসে রাজত্বকারী যে ধারণা-সেই অনুযায়ী। বাচ্চাকে নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ালে মেয়েদের বুকের সৌষ্ঠব নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। মানে তেমন সত্যিই হয় নাকি হয় না সেটার থেকেও বড় কথা হল যে কোনো মা-র এটা নিয়ে ভয় থাকতে পারে যে, বাচ্চাকে নিয়মিত দুধ খাওয়ালে তার যৌন আবেদন নষ্ট হবে! সত্যিই এরকম কোনো মা আছেন কি নেই সেটা বড় কথা নয়। কোনো মা এরকম থাকতেই পারেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, সমাজের চোখে এই ভয়টা একটা ‘খারাপ’ ভয়। কেন? কারণ কোনো মা নিজের যৌন আবেদন নিয়ে ভাববেন না, যদি সমাজের কাছে তিনি একজন ‘ভালো’ মা হয়ে উঠতে চান। তার মানে হরেদরে সেই একই জিনিষ দাঁড়ালো যে, মা-রা অযৌন হবেন এবং তার নিজের বলে কিছুই থাকবে না। একজন তথাকথিত ‘ভালো’ মা হয়ে ওঠার এইটা একটি পুর্ব শর্ত।
তথ্য বলে গর্ভাবস্থায় মেয়েদের যে ওজনটি বাড়ে সেটি কমাবার সেরা প্রাকৃতিক উপায় হল বাচ্চাকে নিয়মিত দুধ খাওয়ানো। যদি কোনো তরফের মনে হয়ে থাকে যে মা-দের এই ‘খারাপ’ ভয়টা আছে তাহলে সেই তরফ থেকে মা-দের এই ভয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে এই ‘খারাপ’ ভয়টাকে সন্তোষজনকভাবে সামলানো যেতে পারত! কিন্তু তা না করে একে ‘খারাপ’ ভয় বলে দেগে দিয়ে মা-দের মধ্যে এক প্রবল বিবেকের দংশন তৈরি করা কেন হচ্ছে? এখানে জন-মানসে মেয়েদের দেহ সৌষ্ঠবের সৌন্দর্য নিয়ে যে ধারণা সেটার সমালোচনায় যাব না। তার কারণ, তার মানে যেটা দাঁড়ায় সেটা হল যে, যতক্ষণ পর্যন্ত একটি মেয়ের সৌন্দর্য সম্পর্কে রাজত্বকারী ধারণার পালটা কোনো ধারণা মাথায় তৈরি না হচ্ছে সে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে পারবে না! যদি সত্যিই তাই হয় তাহলে বলতে হবে যে, তাহলে তা আজকে হওয়ার নয়। বহুদিন ধরে ধীরে ধীরে এই সৌন্দর্যবোধ মানুষের মনে শিকড় গেড়েছে। এখুনি যাবার নয়।
* * *
যতটা সম্ভব মূল সমালোচনাগুলো ধরার চেষ্টা করা হল। কিছু বাকি থেকেও যেতে পারে।
উপরে যে প্রতিবন্ধকতাগুলোর কথা বলা হল সেসব কাটিয়েও বহু মা বাচ্চাকে প্রথম ছ-মাস কেবলমাত্র বুকের দুধ দেন। কিন্তু সেটা একটা পারফরম্যান্স। কৃতিত্ব। যে কাজ কৃতিত্বের মতো কঠিন হয় তাকে প্রকৃত অর্থেই কৃতিত্বের গুরুত্ব দেওয়া হোক। মানে এইসব মা-দের কোনোধরনের ‘পিঠ-চাপড়ানি’ উপহার দেওয়া হোক। সেটা কীভাবে সম্ভব আমার জানা নেই। আর যে কাজ কৃতিত্বের মতো কঠিন তা কৃতিত্বের মতোই বিরল। সার্বজনীন নয়। সার্বজনীন হতে গেলে, অন্তত অধিকাংশ মানুষের জীবনচর্যায় ঢুকতে গেলে কাজটির যথেষ্ট পরিমান সহজ হওয়া প্রয়োজন।
যারা ব্রেস্ট-ফিডিং-এর পক্ষের লোক তাদের কাছ থেকে দুনিয়া এক্সক্লুসিভ-ব্রেস্ট-ফিডিং-এর গুরুত্ত্ব শিখেছে। তারা ভবিষ্যত প্রজন্মের শুভানুধ্যায়ী। এই দুনিয়াটা যাতে আজকের মা-দের এক্সক্লুসিভ-ব্রেস্ট-ফিড করানোর উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে সেই চেষ্টা করাটা তাদেরও কাজ। শুধুমাত্র মা-কে ‘বকাবকি’ করে, তাকে ‘দোষারোপ’ করে, তার মধ্যে ‘গভীর বিবেকের দংশন’ তৈরি করে কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। বছর কেটে যাচ্ছে।
সাউথ সিটির ঘটনা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে হলে কিছু বিশেষ দিকে নজর না দিলেই নয়। বিভিন্ন অর্থনৈতিক স্তরের মা-দের সংষ্কৃতি ও ঐতিহ্য কিন্তু বিভিন্ন। নিম্নবিত্ত মা-দের অনেক সময়েই প্রকাশ্যে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে দেখা যায়। যদিও যথেষ্ট কম আর নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় । যেমন ট্রেনে, স্টেশনে, হাসপাতালে ইত্যাদি জায়গায়। এর থেকে এরকম একটা আন্দাজ করা যেতে পারে যে, তাদের এ ব্যাপারে অস্বস্তি কম আছে। আর উচ্চবিত্ত মা যারা তাদের প্রকাশ্যে দুধ খাওয়াতে দেখা মুশকিল কারণ তাদের সেসব মনে হয় দরকার পড়ে না। গাড়ি ইত্যাদি নানা বন্দোবস্ত থাকে হয়তো সাথে। সবচাইতে কঠিন অবস্থানে আছে মধ্যবিত্ত আর উচ্চমধ্যবিত্ত মা-রা। কীরকম জানি একটা সন্দেহ তৈরি হয় রাষ্ট্রেরও আসলে যাবতীয় চিন্তা এই মধ্যবিত্ত বাচ্চাদের নিয়েই। কারণ গরীবের বাচ্চা এমনিই মরে। বুকের দুধ-কৌটোর দুধ নির্বিশেষে টুপ করে মরে যায় গরীবের বাচ্চা। শুধুমাত্র ২০১৭ র অগাস্ট মাসেই উত্তরপ্রদেশের গোরখপুরের একটি সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে মারা যায় ৭৭ জন বাচ্চা ! উত্তরপ্রদেশে এখন বিজেপি সরকার। এই বিজেপিরই এক সদস্য, এখন মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের রাজ্যপাল আনন্দিবেন প্যাটেল এই বছরের শুরুতে বলে বসেন যে, শহরের মা-রা বাচ্চাদের বুকের দুধ খাওয়ান না কারণ তারা ‘ফিগার’ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় পান। তা এত যার বাচ্চার স্বাস্থ্য নিয়ে দরদ, গোরখপুরে যখন লটকে লট বাচ্চা অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে তখন এনার বা এনাদের মতো লোকজনের মুখ কেন বন্ধ থাকে! কারণ এরা জানে গরীবের বাচ্চার মৃত্যু আটকানো খুব কঠিন কাজ ! আর উচ্চবিত্তের বাচ্চারা সহজে মরে না। টাকাপয়সা ইত্যাদি আছে । ফলে সামলে ফেলা যায়। কিন্তু যে বাচ্চাদের মৃত্যু চেষ্টা করলে আটকানো যায় তারা হল মধ্যবিত্ত। ফলে যত আক্রমণ শানানো মধ্যবিত্ত মা-দের বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে নানাধরনের ঔচিত্য, বিবকের দংশন, ত্যাগের মহিমা ইত্যাদি ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ! তাই যাবতীয় ‘বকাবকি’-র লক্ষ্য হল আনন্দিবেনের ভাষায় ‘শহরের মা’। এখানে ‘শহরের মা’ মানে আসলে শহরের মধ্য ও উচ্চমধ্যবিত্ত মা। আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল যে মাতৃমূর্তি সেও কিন্তু এক্কেবারে মধ্যবিত্ত মা। সে ‘গুরুজন’ অথবা ‘রাষ্ট্র’-সবার বাধ্য। নেহাতই পেটের টান তৈরি না হওয়া পর্যন্ত সে বাড়ির বাইরে পা রাখেনি। সে স্বামী-সন্তান-গর্বে গরবিনী, নিজস্ব পরিচয়হীন মূলত গৃহবাসী এক জীব।
বর্তমান সময় স্ত্রী শিক্ষার প্রসার হতে হতে বিষয়টা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, এই মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত মা-রাও বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন। রোজগার করার জন্যই হোক বা যে কোনো কারণেই হোক। ঘর আর তাদের স্বাভাবিক আবাস-স্থল নয়। ঘর আর বার সব জায়গাতেই তারা অবাধ বিচরণ করতে চাইছেন। ফলে সাবেকি নিটোল মধ্যবিত্ত পরিবারের যে ছাঁচ, যে ছাঁচে ছেলেটি রোজগেরে (ব্রেড-আর্নার) আর মেয়েটি ঘরকন্না (হোম-মেকার) করে ( মেয়েটি রোজগার করলেও), তা ভেঙ্গে পড়ছে। ফলে বাচ্চারা পড়ছে গভীর বিপাকে। কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পরিবার ছাড়া বাচ্চাদের নিরাপত্তা দেওয়ার আর কোনো বন্দোবস্ত নেই। কোনো দেশেই নেই। পশ্চিম দুনিয়ায় কিছু দেশে, বিশেষ করে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রগুলোতে রাষ্ট্রের তরফে ভালোরকমের সহযোগিতা আছে বটে কিন্তু মূল সামাজিক একক সেই পরিবার। ফলে মধ্যবিত্ত মা-দের খুব ‘ধমকাতে’ হচ্ছে। নানাধরনের বিবেকের বোধ, অপরাধ বোধ মাথার ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। মানে বিষয়টা ঠিক ষড়যন্ত্রমূলক তা নয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসছে ব্যাপারটা।
মধ্যবিত্ত মা তার বাচ্চার সাথে এমনভাবে জড়িত যে, বাচ্চার কোনোধরনের খারাপ কিছু হলেই যাবতীয় তরফ থেকে মা-র দিকে আঙুল উঠছে। অথচ অন্যান্য তরফগুলো নিজেদের ভূমিকা নিজেরা পালন করছে কি না সেটা আর দেখার প্রয়োজন বোধ করছে না কেউ। সাউথ সিটি মলে মহিলাকে যখন বলা হয় যে, প্রকাশ্য জায়গায় বাচ্চাকে দুধ দিলে অন্য কারুর অস্বস্তি হতে পারে, তখন সে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর ঘরের খোঁজ করে। কিন্তু ওই নিরাপত্তাকর্মী ওরকম কোনো ঘর দেখাতে পারেননি। মা-দের একটি ছোট উদ্যোগ- ‘হাত বাড়ালেই’-এর পক্ষ থেকে কোলকাতার তিন-চারটি সরকারি হাসপাতালে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে যে, সেখানেও আউটডোরে এরকম কোনো ঘর নেই। থাকলেও ওখানকার লোকজন জানেন না। উদাহরণটা দেওয়া হল এটা বোঝানোর জন্য যে, শুধু মা-দের বলে কী লাভ!
এবার আসা যাক সাউথ সিটি মল- এই নির্দিষ্ট জায়গাটা প্রসঙ্গে। সাউথ সিটি মল একটি ঝাঁ চকচকে জায়গা। মেঝের পালিশে পিছলে যাওয়ার উপক্রম হয়। প্রতিটি দোকান সুসজ্জিত। প্রতিটি জিনিষ ঝকঝকে। ঝলমলে। যারা কিনতে আসেন তারাও মূলত সেরকমই। মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত। এখানে একটা নির্দিষ্ট উদার বাতাবরণ আছে। এখানে চুল-রঙ-করা-সমকামী জুটি হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হাঁটে, এখানে প্রবল নারীসুলভ পুরুষ দিব্যি এ দোকান ও দোকান ঘুরে বেড়ায়, এখানে সেলিব্রিটি ব্যক্তিত্ব চলমান সিঁড়ি দিয়ে শোঁ করে বেড়িয়ে যায়-কেউ ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে না, কারুর চোখ ট্যারা হয় না। কিন্তু এখানে বাচ্চাকে বুকের দুধ দেওয়া খুব একটা রোজকার ঘটনা নয়। পুরোপুরি বেমানান। এ দৃশ্যতে ওখানকার নিরাপত্তা রক্ষী অভ্যস্ত নয়। এটা তার ‘ইনহিবিশন’ এ ধাক্কা দিয়েছে।
সুতরাং উপরের আলোচনা থেকে যেটা দেখা গেল সেটা হল যে, নানাধরনের ধমকধামক সত্ত্বেও মধ্যবিত্ত মা-রা ক্রমশ তাদের খোলস ছেড়ে বেরোচ্ছেন। তারা এক ভিন্নতর সংষ্কৃতির দিকে যাচ্ছেন। এখন তাদের একটু সাহায্যকারী হাতের দরকার। কী ধরনের হতে পারে সেই হাত ? আর যেরকমই হোক না কেন তা প্রচণ্ড ধিক্কারমূলক বা প্রবল সমালোচনামূলক নয়।
লোকাল ট্রেনের দরজার সামনে এক এলোঝেলো মা ব্লাউজ তুলে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছেন –এ দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু সাউথ সিটি মল, বা গড়িয়াহাটের বাজার বা শ্যামবাজারের মোড়ে বা নন্দন চত্ত্বরে কোনো ঝকঝকে মা বাচ্চাকে বুকের দুধ দিচ্ছেন-এ দৃশ্য শুধু বিরল বললে কম বলা হয়। প্রায় ঘটে না এরকম একটি ঘটনা। ফলে এ এক নতুন ঘটনা। নতুন কান্ড। পুরোনো উদাহরণকে নতুন চোখে দেখা হোক আর নতুন কাণ্ডকে নতুনের বাস্তবতায় বরণ করে নেওয়া হোক।
( বিধিসম্মত সতর্কতাঃ এইধরনের লেখার ক্ষেত্রে একটা সতর্কতা না দিলে ভুল বোঝার সুযোগ থেকে যায়। লেখাটি আদৌ ‘কেবলমাত্র-বুকের-দুধ’-এই নীতির বিরোধী নয়। আমার একটি ছ-বছরের সন্তান আছে। সে তার জীবনের প্রথম সাড়ে পাঁচ মাস ‘কেবলমাত্র-বুকের-দুধ’-এর ওপর ছিল। তার চার মাস বয়স থেকে আমি কাজে যোগ দিই। বুকের দুধ এক্সপ্রেস করে বাড়িতে রেখে বেরোতাম। ফলে এ বিষয় বিবিধ ল্যাজ ও গোবরের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। )
লেখিকা একজন স্কুল শিক্ষিকা এবং রাজনৈতিক কর্মী।