“‘নেশন ফর ফার্মার’ এর ভাবনাটা এরকম যে, সংসদে কমপক্ষে তিন সপ্তাহের একটা বিশেষ অধিবেশন প্রয়োজন কারণ তাদের অনেকগুলো বিষয়ে নজর দিতে হবে। অন্তত তিন দিন লাগবে স্বামীনাথন কমিশনের রিপোর্টের অনুপুঙ্খ আলোচনার জন্য। কয়েক দিন লাগবে সহায়ক মূল্য আর কৃষিঋণ মুকুবের বিল দুটো পাস করতে, কারণ অনেকগুলি রাজনৈতিক দল এতে সই করেছে এই বলে যে এই বিষয়ে সমর্থন আছে ফলে তাঁরা এই দুটি বিল খুব সহজেই তাড়াতাড়ি পাস করাতে পারেন। তিন দিন ঋণ সংকট নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনার জন্যে, যেটা কেবল একটা কৃষিঋণ মুকুবের থেকে অনেক বড়ো বিষয়,” বললেন পি সাইনাথ। সাংবাদিক পবন দহত হাফিংটন পোস্টের জন্যে এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। প্রকাশ ২৮.১১.২০১৮। অনুবাদ: কণিষ্ক ভট্টাচার্য। ছবি: শিঞ্জনি।
[metaslider id=”5299″]
‘দিল্লি চলো’ মার্চ কীসের জন্যে?
‘দিল্লি চলো কিষাণ মুক্তি মার্চ’ হচ্ছে কৃষক ফেডারেশনের ডাকে। আমি এর সংগঠক নই, এটা আমার মার্চ নয়। আমি এটাকে সমর্থন করছি। অল ইন্ডিয়া কিষাণ সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটি (এ.আই.কে.এস.সি.সি) প্রায় ১৫০ থেকে ২০০টা কৃষক সংগঠনের একটি সংঘ, তাদের কেউ কেউ খুব ছোটো, কেউ কেউ খুব বড়ো। তারা একটা ডাক দিয়েছে নভেম্বরের ২৯ আর ৩০ তারিখ সংসদ ভবন যাওয়ার। এই ভাবনাটা এসেছে নাসিক মুম্বাই মার্চের পরে, যেখানে ৪০ হাজার আদিবাসী কৃষক মুম্বাই এসেছিলেন আর তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ১০ হাজার সাধারণ মানুষ এই বছরের শুরুতে। একেবারে পদ্ধতিগত ভাবে কৃষকদের কোনও গুরুত্বপূর্ণ দাবিকেই সংসদ এতদিন নজর দেয়নি। স্বামীনাথন কমিশনের প্রথম রিপোর্ট জমা পড়েছিল ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে। আর শেষ রিপোর্ট জমা পড়েছে ২০০৬ সালের অক্টোবরে। গত ১৪ বছর ধরে কৃষকদের জাতীয় কমিশন সংসদে স্রেফ পড়ে আছে, এত বছরে সংসদ এক ঘণ্টা সময়ও বার করতে পারেনি সে বিষয়ে আলোচনার জন্যে। কিন্তু যখন কর্পোরেট সেক্টর বা জিএসটি-র মতো বিষয় আসে, যেগুলো একেবারে দায়িত্ব নিয়ে হাজার হাজার ছোটো মাঝারি সংস্থাকে ধ্বংস করছে, তখন সংসদ এক সপ্তাহের মধ্যে বিশেষ অধিবেশন ডেকে মাঝরাতে ভারতের রাষ্ট্রপতি নিয়ে সেই বিল পাস করতে পারে। কিন্তু ১৪ বছর ধরে তাঁরা সময় পায়নি কৃষকদের জাতীয় কমিশন নিয়ে আলোচনার জন্যে। এ.আই.কে.এস.সি.সি প্রধানত দুটি দাবি নিয়ে জোর দিচ্ছে। একটি হল ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আর অনুদানমূলক মূল্য বিষয়ে সংসদে একটা প্রাইভেট মেম্বর বিল আনা। আর দ্বিতীয়টি হল কৃষিঋণ থেকে মুক্তির বিল। কিন্তু কৃষি সংকট একটা বড়ো বিষয়, সেটা ঠিক দুয়েকটা বিলের বিষয় নয়।
আমি মনে করি, নাসিক-মুম্বাই মার্চ একটা টার্নিং পয়েন্ট যা গোটা দেশের কৃষক ও সাধারণ মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে উৎসাহ দিয়েছে। তারপর থেকে দেশের নানা জায়গায় অন্তত কুড়িটা কৃষক মার্চ হয়েছে। এটা একটা বিস্ময়কর ঘটনা যে কৃষকেরা তাদের বিগত বিশ বছরের হতোদ্যম অবস্থা থেকে জেগে উঠছেন, এই হতোদ্যম অবস্থা তাদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, জেগে উঠে তাঁরা প্রত্যক্ষ প্রতিবাদের রাস্তায় হাঁটছেন যেটা তাঁদের অধিকার আদায়ের দিকে নিয়ে যাবে। আমি মনে করি, এটা একটা খুবই ভালো জিনিস ঘটছে। আমি প্রস্তাব দিয়েছি, তাদের একটা দাবি হওয়া উচিত যে, সংসদকে কেবলমাত্র কৃষি সংকট নিয়ে তিন সপ্তাহের একটা বিশেষ অধিবেশন ডাকতে হবে। যেখানে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, সেখানে এই বিষয়ে সারা দেশের নজর পড়া উচিত। গোটা দেশের এটা কৃষকদের বলার দরকার যে, তাঁরা দেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, দেশ তাদের ব্যাপারে ভাবে। যখন এ.আই.কে.এস.সি.সি আর বাকিরা মার্চের দাবিকে সমর্থন করল তখন বিভিন্ন মধ্যবিত্ত পেশাজীবী এই বছরের অগাস্ট মাসে দিল্লিতে একসঙ্গে বসে। গোপাল গান্ধী, মৃণাল পাণ্ডে প্রথম মিটিংয়ে এসেছিলেন আর তখনও এটা কোনও আকার পায়নি। এটা কোনও রেজিস্টার্ড অর্গানাইজেশন নয়, একটা ফোরাম। নাম ‘নেশন ফর ফার্মার’।
শেষ কবে বলুন তো মধ্যবিত্ত মানুষেরা কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছেন? নাসিক-মুম্বাই মার্চের সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হচ্ছে এর মধ্যে দিয়ে সেটা আবার শুরু হল। মধ্যবিত্ত আবার নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। আমার মনে হয় এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ আর এটা আগামী ২৯ ও ৩০ নভেম্বরের পরেও বজায় থাকবে যে কৃষক এবং মজুর গণপরিসরে সাধারণ মানুষের আলোচনার মধ্যে উঠে আসছে, মধ্যবিত্ত অঙ্গনওয়ারীর মানুষের সঙ্গে কথা বলছে, কৃষক আর খেতমজুরের সঙ্গে কথা বলছে। এটা গণতন্ত্রের পক্ষে ভালো, এটা সমতার, সাম্যের পক্ষে ভালো।
সংসদে ২১ দিনের বিশেষ অধিবেশনের ক্ষেত্রে ভাবনাটা কী?
‘নেশন ফর ফার্মার’ এর ভাবনাটা এরকম যে, সংসদে কমপক্ষে তিন সপ্তাহের একটা বিশেষ অধিবেশন প্রয়োজন কারণ তাদের অনেকগুলো বিষয়ে নজর দিতে হবে। অন্তত তিন দিন লাগবে স্বামীনাথন কমিশনের রিপোর্টের অনুপুঙ্খ আলোচনার জন্য। কয়েক দিন লাগবে সহায়ক মূল্য আর কৃষিঋণ মুকুবের বিল দুটো পাস করতে, কারণ অনেকগুলি রাজনৈতিক দল এতে সই করেছে এই বলে যে এই বিষয়ে সমর্থন আছে ফলে তাঁরা এই দুটি বিল খুব সহজেই তাড়াতাড়ি পাস করাতে পারেন। তিন দিন ঋণ সংকট নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনার জন্যে, যেটা কেবল একটা কৃষিঋণ মুকুবের থেকে অনেক বড়ো বিষয়। আমি কৃষিঋণ মুকুবের পক্ষে, কিন্তু যতক্ষণ না আপনি ঋণ ব্যবস্থাকে নতুন করে পর্যালোচনা করছেন পরের বছরে আবার কৃষকেরা এসে একই সমস্যার মুখে পড়বেন কারণ কৃষি ঋণের সুযোগকে কৃষকের দিক থেকে কৃষি ব্যবসায়ীর দিকে ঘুরয়ে দেওয়া হয়েছে। ছোটো এবং প্রান্তিক কৃষকের কাছে ক্ষুদ্র ঋণের নামে দিনে দিনে আরও কম টাকা যাচ্ছে। তাই তিন দিন আলোচনা হোক ঋণ সংকট আটকাতে, যার আরেকটা অর্থ সরকারি ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণ করা যাবে না। নয়তো এই মানুষগুলো কোনও ঋণ পাবেন না। উলটে এদের প্রাপ্য ঋণের টাকা আবার পাঠিয়ে দেওয়া হবে বড়ো কর্পোরেট কোম্পানির কাছে। তিন দিন আলোচনা হোক কৃষিতে যে ভয়ংকর জলসংকট চলছে তাই নিয়ে, এটা কিন্তু খরার থেকেও অনেক বড়ো সমস্যা। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই দেশ এই বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে কিছু ভাবছেই না। দেশে জল সংকটের ক্ষেত্রে অনেকগুলো স্থানান্তর বা হাত বদল হয়ে গেছে, যেমন জল চলে গেছে গরিবের থেকে বড়োলোকের হাতে, কৃষির থেকে শিল্পের হাতে, খাদ্য শস্যের বদলে অর্থকরী ফসলের হাতে্ গ্রাম থেকে শহরের হাতে, জীবিকা থেকে লাইফস্টাইলের হাতে। জল নিয়ে একটা আইন থাকা দরকার যে এটা পণ্য বা ব্যক্তিগত সম্পদ না মৌলিক মানবাধিকার। সমানাধিকার আর ন্যায়বিচারের আরও কিছু বিষয় আছে এখানে। গ্রামাঞ্চলে জলের অধিকার নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত, বিশেষত যাদের জমি নেই, যাঁরা কৃষক নন তাদেরও জলের অধিকার নিয়ে।
তিন দিন এই আলোচনায় সময় দেওয়া হোক, যেটা আমার মনে হয় আলোচনা না করলে কখনওই কৃষি সংকটের সমাধান হবে না – মহিলা কৃষকদের কৃষির অধিকার এবং স্বীকৃতি, মহিলা কৃষকদের জমির অধিকার, যারা কৃষিক্ষেত্রের ৬০ শতাংশের বেশি উৎপাদনের ক্ষেত্রে যুক্ত। যেমন দলিত কৃষকদের জমির অধিকার, যারা জমি প্রদানের ২০ বছর পরেও পাট্টা পাচ্ছেন না, রাষ্ট্র সেই জমি দখল করছে আদানি বা অন্য কারোর নামে। সেখানে গরিব আদিবাসী কৃষক যারা জানেনই না পাট্টার ব্যবস্থা সম্পর্কে। তাই জমির অধিকারকে নিশ্চিত করতে হবে। তিন দিন ভূমি সংস্কারের যে কাজ পড়ে আছে সেই নিয়ে আলোচনা হোক। তিন দিন আলোচনা হোক যে, ২০ বছর পরে দেশে কী ধরণের কৃষির প্রয়োজন তাই নিয়ে। কর্পোরেট চালিত, কেমিক্যাল কোম্পানি নির্ভর কৃষি নাকি জনগোষ্ঠী চালিত প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র নির্ভর চাষ? খুব গুরুত্ব দিয়ে আইনসম্মত ভাবে ভাবা দরকার যে বছরের পর বছর ধরে যে নাটকীয় ভাবে কৃষিক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যয় বরাদ্দ কমছে সেই বিষয়ে। কৃষিক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগকে রক্ষা করতে হবে এবং বাড়াতে হবে। তিন দিন আলোচনা হোক কৃষি সংকটের আক্রান্তদের বিষয়ে, বিদর্ভের বিধবা, অনন্তপুরের অনাথেরা প্রথমবার ঐতিহাসিক পদক্ষেপে এগিয়ে আসুন পার্লামেন্টের সেন্ট্রাল হলে, তাঁরা সংসদ আর দেশবাসীদের জানান যে কৃষি সংকট আসলে কী আর সেটা তাদের জীবনে কী নিয়ে এসেছে। তবেই একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের মনোভঙ্গী পাওয়া যাবে এদের সম্পর্কে। ‘নেশন ফর ফার্মার’ সংসদে একটা বিশেষ অধিবেশন চাইছে। এটা একটা মধ্যবিত্ত বিষয়, আমরা কেউ কৃষক নই। কিন্তু আমাদের যা বলার তা হল, প্রত্যেকটি নাগরিক, সকলেই কৃষির সঙ্গে যুক্ত, কেবল খাবারের জন্যে নয় আমরা প্রত্যেকেই মাত্র দুতিনটি প্রজন্ম আগেই গ্রামে থাকতাম। এই পরিস্থিতিতে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে এই কৃষকদের প্রাথমিক শ্রেণির যোগাযোগটা নতুন করে স্থাপন করতে হবে। দিল্লি চলো এর সমর্থনে দৃষ্টি আকর্ষণে একটা ওয়েবসাইট। একটা আগ্রহজনক ব্যপার যেটা দেখা যাচ্ছে যে গত সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে ‘নেশন ফর ফার্মার’ সর্বত্র বেশ চেগে উঠেছে।
বেশ কিছু জটিল প্রশ্ন আছে। আমাদের সংসদে কৃষি সম্পর্কে গভীর বোঝাপড়া আছে এমন সাংসদ খুব কম। এমনকি এই বিষয়গুলো যদি তোলাও হয়, আপনার মনে হয় সেখানে কোনও সত্যিকারের আলোচনা হবে?
এখানে কোনও প্রশ্নই নেই যে তাঁরা সত্যিকারের আলোচনা করবেন কি করবেন না। এটা আমাদের ওপর যে তাদের সত্যিকারের আলোচনা করতে বাধ্য করা হবে। দেখুন আমাদের একটা বিকল্প আছে, ধরা যাক বললাম, তাঁরা সংসদে এই নিয়ে সত্যিকারের আলোচনা করলেন না। তাহলে সংসদে যাবেন না, সংসদকে মানুষের কাজের জন্য ব্যবহার করবেন না। সংসদকে রেখে দিন কেবল কর্পোরেট কোম্পানি আর অতি বড়োলোকদের জন্যে। এখন বিষয়টা হল, একজন নাগরিক হিসেবে আপনি কি চান যে আপনার অধিকারটা প্রতিষ্ঠা করতে আর সংসদকে বাধ্য করতে মানুষের কাজ করানোর জন্যে নাকি আপনি চান সংসদ থাকুক কেবল কর্পোরেট দুনিয়ার জন্যে? যেখানে বসে কেবল জিও আর জিএসটি-র জন্যে কাজ হবে, কেবল ডিজিটাল কোম্পানি আর নোটবন্দীর কাজ হবে?
সংসদ ভালো হবে না খারাপ হবে সেটা আমাদের ওপর নির্ভর করবে, আমাদের সমাজের ওপর, আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের ওপর। আমার যেটা বলার তা হল, আমার কি এটা বলা কাজ যে ওরা আমার অধিকার রক্ষা করছে না, আমার অধিকার প্রয়োগ করতে দিচ্ছে না, তাই আমি আমার সব অধিকার ত্যাগ করলাম? এটা আমার কাছে একটা মূর্খের রাজনীতি বলে মনে হয়। আমি বলব যে সংসদ তৈরিই হয়েছে আপনার কাজ করার জন্যে… ২৯ আর ৩০ তারিখে দিল্লি চলোর একটা ভালো বিষয় হল, আমাদের সংবিধান যে মানুষের জন্য সেটা নতুন করে দাবি করা, আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্র যে সাধারণ মানুষের সেটা নতুন করে দাবি করা। সংসদ মানুষের জন্যে কাজ করবে এর থেকে গণতান্ত্রিক দাবি আর কী হতে পারে?
সারা দেশ জুড়ে কৃষকদের মধ্যে নানারকম আদর্শগত ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। আপনি কি মনে করেন যেভাবে আমাদের রাজনীতিক পরিবেশ প্রতিদিন আরও বেশি বেশি করে আঞ্চলিক হয়ে যাচ্ছে সেখানে তাঁরা এমন একটা বোঝাপড়ায় যেতে পারবে?
অবশ্যই একটা আদর্শগত ভিন্নতা আছে, নয়তো ২০০টা সংগঠন থাকত না, একটাই থাকত। সেটা আপনার সমাজের প্রতিচ্ছবিও দেখায় – কেন ৩০ খানা রাজনৈতিক দল রয়েছে? এটা আপনার সমাজের বিভেদ আর বর্ণ-সংকরতার প্রতিনিধিত্ব করে। তাই সেখানে আদিবাসী কৃষক আছে যাদের জন্যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য প্রধান ইস্যু নয়। তাদের ক্ষেত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন হবে। আপনি যেটাতে অবাক হবেন সেটা হল সেই পার্থক্যগুলো একসঙ্গে চলে আসছে। আমি মনে করি না যে এই মার্চ সবকিছুর জন্যে একটা চরম উত্তর। আমি মনে করি এটা একটা শুরু, যেমন মুম্বাইতে হয়েছিল, তেমনই দিল্লিতে মধ্যবিত্ত কৃষকদের সঙ্গে কথা বলবে। আমি কেবল এই বিষয়ে আগ্রহী যে, আমরা এই মধ্যবিত্ত পেশাজীবী শ্রেণি, আমাদের নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে রাখতে পারি এই লড়াইয়ের মধ্যে এই দাবিগুলির মধ্যে যেগুলো সাধারণ মানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবি। আপনি একজন সাংবাদিক কিন্তু আপনি একজন মানুষ তো, একজন নাগরিকও তো। তাই হ্যাঁ, পার্থক্য থাকবেই কিন্তু আপনি যত এগোবেন, বছরের পর বছর ধরে, সেই পার্থক্যগুলো তখন ছোটো হয়ে আসবে, যত আপনি শিখবেন সক্ষম সাধারণ মানুষের পদক্ষেপের আর জনগণের আন্দলেনের থেকে। আমি এমন আশা করি না যে, আমার রাজনৈতিক দাবির ১০০ শতাংশই মেনে নেওয়া হবে। সেটা মুর্খামি। বিষয়টা হল, তাঁরা কতগুলো ন্যূনতম সূত্রের ভিত্তিতে একমত কিনা, যেমন ভারতের সংবিধান। আপনি কি এমন মৌলিক কিছু বিষয়ে একমত, সেটা হল প্রশ্ন।
আমি তেমন ভয়ংকর কিছু পার্থক্য দেখছি না। আপনি এমন একটা দেশে থাকেন যেখানে ৭৮০ খানা ভাষায় কথা বলা হয় আর আপনি দেখছেন যে একটা প্রবণতা যেখানে সেই সব কিছু শেষ করে হিন্দি সব জায়গায় চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এটা এর একটা প্রবণতা। আমার কাছে ৭৮০ খানা ভাষা নিয়ে আমরা আশ্চর্যজনক সম্পদশালী। যদি আপনারা একটা একমাত্রিক, একরঙা সমাজ চান, যেখানে ১৩০ কোটি মানুষ বাস করে, যাদের মধ্যে কোনও রকম কোনও পার্থক্য নেই, আমি সেই পৃথিবীতে থাকতে ঘৃণা বোধ করব। আমি চাইব বৈচিত্র্য থাকুক। যাতে অনেক পার্থক্য জেগে ওঠে যেখান থেকে আপনি এসেছেন আর যেখানে আপনি আছেন তার মধ্যে। যদি আপনি জম্মু কাশ্মীরের একজন কৃষক হন, তাহলে আপনার এমন অনেক দাবির বিষয় থাকবে যা বাংলার কৃষকের থেকে আলাদা। কিন্তু এমন অনেক বিষয় আছে যাতে যেখানে তাঁরা এক হতে পারেন। আপনি এমন কতজন কৃষককে চেনেন যারা স্বামীনাথন কমিশনের রিপোর্টের বিরোধিতা করছেন? আপনি যেখানেই যান, তাঁরা অন্তত এই বিষয়ে শুনেছে। কতজন কৃষক আছেন যাঁরা আরেকটু ভালো ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বিরোধিতা করছেন? তাহলে, এমন কতগুলো মৌলিক বিষয় আছে যেখানে তাঁরা একসঙ্গে আসবেন, আর এর প্রক্রিয়াটা একটা ছোটো বিষয় নয়। এটা ঠিক নিছক একটা ঘটনা নয়, ২৯-৩০ তারিখটা একটা ঐতিহাসিক সূত্রপাত। যত আপনি এগিয়ে যাবেন, আরও আরও বেশি করে মানুষ ভাববে এই বিষয়গুলো নিয়ে। একটা স্বামীনাথন কমিশনের ধারণার জন্যেও প্রত্যেককে অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।
আপনি একজন সাংবাদিক কিন্তু আপনি এই মার্চের সমর্থনে লোক জড়ো করছেন। এই ধরণের ঝাঁপিয়ে পড়া কি একটা রাজনৈতিক সক্রিয়তা?
না, তা নয়। আমি মনে করি এটা সবচেরে গোদা আর সবচেয়ে নির্বোধ ধারণা। আমি জানি এমন কিছু সাংবাদিক আছেন যারা বলছেন, ‘সাইনাথ এখন অ্যাক্টিভিস্ট হয়ে গেছে’। যিনি এটা বলছেন তিনি আগে সাংবাদিক হয়ে উঠতে চাইছেন, আমি সেই সাংবাদিকের জন্যে অপেক্ষা করছি যিনি এটা বলছেন কবে তিনি আগে একজন মানুষ হয়ে উঠবেন? আমার নিজের সাংবাদিক হিসেবে আমার কাজকর্মকে বাঁচানোর বা ফলিয়ে দেখানোর কিছু নেই। আমি একজন মানুষ। যদি আপনি একজন সাংবাদিক হন এবং অন্যায় দেখেও চুপ করে থাকেন তাহলে আপনি একজন তৃতীয় শ্রেণির সাংবাদিক। যখন সেই সাংবাদিকেরা ৩৬৫ দিন তাদের মালিক কর্পোরেটের সেবার জন্যে কাজ করছেন তখন কিন্তু তাদের আপনি অ্যাক্টিভিস্ট বলেন না। মানুষের পক্ষে সাংবাদিকতা করলে সেটাকে কিন্তু অ্যাক্টিভিজম বলা হয়। এই মানসিকতাটাকে আমি অবজ্ঞা করি।
আমার কাছে আমার সহযোগী দল আর সম্মানীয় সাংবাদিকদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর আপনি দেশের ৫০০০ সাংবাদিকের মধ্যে যে কোনও কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারেন তাঁরা আমার বা আমারর সাংবাদিকতা নিয়ে কী মনে করেন? আমার কি সত্যিই সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে বাঁচানোর কিছু আছে? আমি বলছি যে, যখন আপনি প্রতিদিন কিছু না কিছু লিখছেন আপনার কর্পোরেট মালিকের স্বার্থ দেখে, তখন সেই সাংবাদিক পুরো ভূতগ্রস্তের মতো আচরণ করছেন। এগুলোই ন্যায় বিচারের মৌলিক বিষয়। যখন সাংবাদিক আক্রান্ত হন, প্রতিবাদ মিছিল হয়, তখন কি সমাজের অন্য অংশের মানুষেরা তাতে যোগ দেন না? তখন কী বলা হয়, ‘এমনটা যদি সাংবাদিকের সঙ্গে ঘটে তখন সকলের কথা বলা উচিত।’ যখন আক্রমণটা কৃষকদের করা হচ্ছে তখন কেউ তাকিয়েও দেখে না। আমি যা আমি তাতেই খুশি।
পি সাইনাথ প্রবীণ সাংবাদিক। অনুবাদক কণিষ্ক ভট্টাচার্য স্কুলশিক্ষক ও লেখক। ছবি: শিঞ্জনি।
ভালো অনুবাদ । প্রযোজনীয় কাজ ।